তেঁতুলবনে কী কাণ্ড! / শফিক হাসান
রম্য
তেঁতুলবনে কী কাণ্ড! / শফিক হাসান
তেঁতুলের মতো নিরীহ একটি ফল অস্বাভাবিক ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠেছে প্রায় এক দশক আগ থেকে! ফল হিসেবে তেঁতুল তুলনারহিত। নিজের গুণ ও রূপ দিয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে, খাদকের জিহ্বা, পাতে ও লিঙ্গ-বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে। তেঁতুলকে কেন জাতীয় ফল ঘোষণা করা হচ্ছে না, এমন মিহি আওয়াজও তোলেন কেউ কেউ! থিওরির পরোয়া না করে চিনে নেওয়া যাক তেঁতুলের বিভিন্ন রূপ!
তেঁতুলের শরবত
মাথা কিংবা পুরো দেহের গরম কমাতে তেঁতুলের শরবতের জুড়ি নেই। এই শরবতই শীতে দেয় উষ্ণতা! রেসিপি অনেকেরই জানা নেই। জেনে রাখুন তেঁতুল রেসিপি:
প্রস্তুতপ্রণালি : বাজার থেকে আড়াই কেজি পাকা তেঁতুল কিনে আনুন। নিজেদের গাছ থাকলে সরাসরি গাছ থেকেই শ’পাঁচেক তেঁতুল পাড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, অন্য কারও গাছ থেকে চুরি করে আনতে পারলে।
তেঁতুল ছিলে বাটিতে রাখুন। দশ জগ বিশুদ্ধ পানি নিন। ছিলে রাখা তেঁতুলগুলো পানিতে কচলে নিন। কচলানো শেষে তেঁতুল বীচিগুলো আলাদা বাটিতে রাখুন। (পরে সময় করে এই বীচি ভেজে খাবেন)। তাকিয়ে দেখুন তেঁতুলগোলা পানি কালো বর্ণ ধারণ করেছে কি না। করলে পানিতে তিন শ’ চিমটি লবণ দিন। একশ’ মুঠো গুড় বা দশ কেজি চিনিও দিতে পারেন। পানি কালো না হয়ে অন্য কোনো বর্ণ ধারণ করলে কালো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
ব্যবহারবিধি : একটি অপরিষ্কার মগ নিন। মগে পানি ঢালুন। হ্যাঁ, তৈরি হয়ে গেছে প্রত্যাশিত তেঁতুলের শরবত। মগের পানিটুকু মাথায় ঢালুন। দেখুন, এই পানিতে মাথা ঠান্ডা হয় কি না। মাথা ঠান্ড হলে বুঝবেন তেঁতুল শরবত খাওয়ার উপযোগী হয়েছে।
সতর্কতা : রেসিপি তৈরির প্রণালি অন্য কাউকে শেখানোর আগে সতর্ক থাকুন। বয়স্ক, যুবাদের কিল-ঘুষি এবং গৃহিণীদের খুন্তি-বেলুন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
তেঁতুল কেন টক : বিশেষজ্ঞ মন্তব্য
সবকিছুরই কার্যকারণ আছে। তেঁতুল কেন টক এটাও নিশ্চয়ই কারণের বাইরে নয়। কারণগুলো হয়ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমান হবে না। শোনা যাক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য:
বুদ্ধিজীবী : বস্তুকে আলাদাভাবে চেনার জন্য আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি। নইলে জগতের লক্ষ লক্ষ জিনিস থেকে তাকে পৃথক করা যাবে কীভাবে! তেঁতুল টক, টক না হলে মিষ্টি হত, মিষ্টি না হলে তেতো হত, তাতে নামের হেরফের হত না মোটেও!
ডাক্তার : তেঁতুলের অনেক ওষুধি গুণ আছে। (তেঁতুলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নামে বই লিখেছি, দাম ৫০০ টাকা। চেম্বার থেকে কিনে নিয়ে যাবেন)! তেঁতুলের গুণের মধ্যে একটি: মেদভুড়ি কমাতে ভূমিকা রাখে। এটা না থাকলে চারদিকে মেদভূড়ির রোগী ছাড়া অন্যকিছু দেখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত!
রাজনীতিক : আমি যে দলের রাজনীতি করি, ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। দলটির প্রতিষ্ঠাতার জীবদ্দশায় তেঁতুল মিষ্টি ছিল। সাধারণ মানুষ খুশির খবরে রসগোল্লার পরিবর্তে তেঁতুল খেত। তারপর আমাদের বিপক্ষ রাজনৈতিক দলপ্রধান একদিন তেঁতুলে হাত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তেঁতুলের স্বাদ পাল্টে গেল! ভোটারদের দল চেনার সময় এসেছে যাদের হাতে পড়লে নিরীহ তেঁতুলের স্বাদ পাল্টে যায়, তারা কী দিতে পারবে দেশকে!
আমলা : তেঁতুল কেন টক: আসলেই টক কিনা মন্তব্য করতে বছর দশেক লাগবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে বলতে পারব, তেঁতুল আদতে টক কি না। যদি টক হয়, কেন টক জানতে সময় লাগবে আরও দশ বছর…! সেই টককে মিষ্টিতে পরিণত করতে হবে কি না, সেটাও যাচাই-বাছাই করতে আরও দশ বছর অপেক্ষা না করে উপায় নেই!
কবি : ‘তেঁতুল’ ও ‘টক’ দুটোই বাংলা ভাষার শব্দ। তুলনামূলক বিচারে তেঁতুল শব্দটি শক্তিশালী, কারণ শব্দটি ব্যবহার করে আমি কালজয়ী কবিতা লিখেছি, “তেঁতুল আমার জোছনানিশির অমূল্য রতন, করেছি তারে প্রেমিকাসম তুমুল যতন.”..। একটা কথা, তেঁতুল যে টক আমার কোনো কবিতায় তো এখনো ঘোষণা দিইনি! তাহলে কীভাবে টক হল, কে করল!
ফল নিয়ে যত প্রবাদ
বিভিন্ন ফল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রবাদ, তেঁতুল নিয়েও। অন্য ফলের প্রবাদের সঙ্গে তেঁতুলেরও যোগসূত্র আবিষ্কার করেছি আমরা!
ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায় : একবারই তো যাবে! সে জেনে গেছে বেল ফল হিসেবে বড় হতে পারে কিন্তু তেঁতুলই সবচেয়ে সুস্বাদু!
গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল : কাঁঠাল খাওয়ার বড় সমস্যা, তেল নিয়ে বসে থাকতে হয়। অন্যদিকে বর্তমানে তেলের দাম চড়া। এ অবস্থায় তেঁতুলই হতে পারে বড় সমাধান। তেঁতুলের তেল বাজারজাত করে কাঁঠালকে দেখিয়ে দেওয়া যায়, কাঁঠাল নয়, তেঁতুলই জাতীয় ফল হওয়ার যোগ্য!
বেল পাকলে কাকের কী : এটা কাক শ্রেণির জন্য চরম বৈষম্যমূলক উক্তি। কাকের কি বেল খেতে ইচ্ছা হয় না? কাক তো তেঁতুলও খায়! কই, তেঁতুল নিয়ে তো আজতক কেউ খোঁটা দেয়নি!
নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা… : গানটিতে পক্ষান্তরে তেঁতুলের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তেঁতুলের ফুল ছিঁড়ে নিয়ে কেউ গন্ধ শোঁকে না সত্য, কিন্তু তেঁতুল ফল সবাই পছন্দ করে। তেঁতুলগাছ মালিকের চোখ বাঁচিয়ে তেঁতুল চুরির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে গানের কথায়! জ্বালানি হিসেবেও তেঁতুলগাছ চমৎকার।
তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা তেঁতুল বড় টক রে… : বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের ক্ষেত্রে তেঁতুল পাতা সহায়ক, তেঁতুলের টকও। তেঁতুলের আচারও প্রেম গাঢ় করতে ভালো ভূমিকা রাখে। প্রেমিককুল তেঁতুলবনে জোছনা দেখতে যায়। যে ফলের এত গুণ, সে ফলকে প্রেমের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না কেন!
তেঁতুল নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক জনশ্রুতি
তেঁতুল উপকারী ফল, তারপরও একে বিভ্রান্তি থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। কিছু বিভ্রান্তি ও ব্যাখ্যা দেখা যাক:
তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায় : তেঁতুল যদি রক্তকে পানি করার ক্ষমতা রাখত, তাহলে পানিতে তেঁতুল গোলালে রক্ত হয়ে যায় না কেন!
তেঁতুলতলায় ভূত থাকে : শুধু তেঁতুলতলায়ই ভূত থাকে? বটে! সরকারি অফিসে, এখানে ওখানে তবে এরা কারা বসা? দেশের সব তেঁতুলগাছ কেটে ফেলা হোক, তারপর দেখা যাবে ভূতরা কোথায় না থাকে!
তেঁতুল বসন্তকালীন ফল : অবশ্যই তেঁতুল বসন্তকালীন ফল। তাই বলে কেউ আজতক বসন্তের কোকিলের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য পেয়েছে! বসন্তকালীন ফল হয়েও তেঁতুল বারোমাসি!
গর্ভবতীরা তেঁতুল পছন্দ করে : তাহলে পুরুষরা তেঁতুল খায় কেন? অপছন্দ করেই খায়, নাকি গর্ভধারণের আশায়…!
তেঁতুল দেখলে লালা ঝরে : শুধু তেঁতুল দেখলেই লালা ঝরে, না দেখলে ঝরে না? তেঁতুলের অবর্তমানে লালাগুলো কোথায় থাকে!
তেঁতুলের সাক্ষাৎকার
: মহাশয়, আপনার নাম?
: আজ্ঞে, তেঁতুল। তবে বৈজ্ঞানিক নাম ঞধসধৎরহফঁং রহফরপধ. ঋধসরষু : ঋধনধপবধব (ঢ়বধ, ড়ৎ ষবমঁসব ভধসরষু). ইংরেজি নাম পধসধষরহফড়, রহফরধহ ফধঃব, সধফবরৎধ সধযড়মধহু, ংবিবঃ ঃধসধৎরহফ, ঃধসধৎরহফ ইত্যাদি।
: বাংলাদেশের কেউ কেউ আপনাকে নতুনভাবে পরিচিত করালেন। কেমন লাগছে?
: আমি মুগ্ধ, আমি অভিভূত, আমি কৃতজ্ঞ। তাদের সামনে পেলে অবশ্যই কদমবুসি করব।
: আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কী?
: কয়েক শতাব্দী পরে অনেক বড় একটা উপাধি পাওয়া। অবশ্য এতে আমি একাই সম্মানিত হইনি, উপাধিদাতারাও নিজেদের সম্মানিত করেছেন। এখন তারা তেঁতুল হোসেন, তেঁতুল উদ্দিন, তেঁতুল চৌধুরী, তেঁতুল পাটোয়ারী ইত্যাদি নামে পরিচিত!
: আপনার প্রিয় গান কোনটি?
: তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা তেঁতুল বড় টক রে, বন্ধুর সাথে প্রেম করিতে আমার বড় সখ রে…!
: প্রিয় বই কোনটি?
: তেঁতুল বনে জোছনা। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
: প্রিয় অনুষ্ঠান কী?
: টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোগুলো।
: প্রিয় মুহূর্ত?
: যখন আমাকে দেখে কারও জিহ্বা থেকে লালা ঝরে…!
: কী ভাবতে ভালো লাগে?
: এতদিন শুধু মানুষের জিহ্বার লালা খসাতাম। এখন দিল-মনের লালা ঝরানোরও সক্ষমতা অর্জন করেছি।
: ফল-সম্রাট তেঁতুল এমন উপাধিতে কেমন লাগছে?
: ভালো তো অবশ্যই। তবে শঙ্কায় আছি, কবে না আবার আমার উপাধি ছিনতাই হয়ে যায়!
: পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
: তেঁতুল খান, তেঁতুল ভালোবাসুন। তেঁতুলের গান শুনুন। তেঁতুল বিষয়ক বই পড়ুন। তেঁতুলের মোরব্বা বানান!
Facebook Comments Sync