তূর্যবাদক কবি নজরুল/ আফরোজা পারভীন
(কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯- ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে)।
ছেলেবেলা থেকেই আমার সঙ্গে ছিলেন তিনজন কবি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর জীবনানন্দ। তাঁদের কবিতা পড়েই আমি বড় হয়েছি। দুর্যোগ মুহূর্তে তাঁদের কবিতা আমাকে পথ দেখিয়েছে । দুঃখের মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছে । অনুপ্রাণিত হয়েছি, আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছি, দৃঢ়সংকল্প হয়েছি । ভালবাসতে শিখেছি দেশকে, দেশের খেটে খাওয়া মানুষকে । এই নিয়ে বেড়ে উঠেছি। বড় হবার সাথে সাথে দেশ বিদেশের অনেক কবির লেখার সান্নিধ্যে এসেছি কিন্তু এ তিনজনকে ছাড়িনি কখনই। এই তিনজনের একজন আমাদের জাতীয় কবি নজরুল, যাঁর জন্মদিন ১১ জৈষ্ঠ্য। আজ তাঁকে নিয়েই এ লেখা।
বর্ধমানে জন্ম হলেও বাংলাদেশে নজরুলের শৈশব কৈশোর যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে। দরিরামপুর, দৌলতপুর আর কুমিল্লায় জন্ম নিয়েছে তাঁর অনেক কবিতা, গান। বৈবাহিক সূত্রেও তিনি আবদ্ধ হয়েছেন এ দেশে । সমাহিত হয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে । তাঁর লেখা সেই কালজয়ী গান ‘মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই / যেন সকাল সন্ধ্যা মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’ এর ইচ্ছে অনুযায়ী তিনি যেন সকাল সন্ধ্যে আজান শুনছেন এই বাংলাদেশের ঢাকায় অন্তিম শয়ানে শুয়ে। আমাদের রণসংগীতও তার অবদান। তাই নজরুল রয়েছেন আমাদের নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে আস্থায় অস্তিত্বে।
১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ এই অতি অল্প সময় নজরুলের সৃজনকাল। তিনি যখন কাব্যজগতে প্রবেশ করলেন রবীন্দ্র প্রতিভায় তখন চারদিক দেদীপ্যমান। তাঁর খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। কিন্তু এই অবস্থার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের পাশে তাকে ¤øান দেখায়নি। তিনি ছিলেন স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল। নজরুল যেমন অগ্রজের স্নেহধন্য ছিলেন তেমনি নিজের ষোলটি কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কবিতা নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেন অগ্রজ রবীন্দ্রনাথকে । উৎসর্গ পত্রে লেখা আছে এভাবে-
‘বিশ্বকবিসম্রাট
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু’
নজরুল দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মিশেলে বাজিয়েছেন বিদ্রোহের দামামা। সেই কারণে কেউ তাকে বলে ‘যুগস্রষ্টা’ কেউ বা বলে ‘তূর্যবাদক।’ সমকালীন কবি ছিলেন তিনি। তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ চিন্তা চেতনা বিষয় আঙ্গিকে সমকালীনতা। যে দ’ুদশক ধরে কবি লিখেছেন সে সময়টা ছিল বিশ্ব ইতিহাসের পট পরিবর্তনের সময়। রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতিতে এ সময় এসেছে বিশ^ব্যাপী পরবর্তন। উত্তুঙ্গু হয়েছে স্বাধীনতাকামী দেশগুলোর পরাধীন মানুষের স্বাধীন হবার কামনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র পৃথিবীব্যাপী তখন চলছে আর্থিক সঙ্কট। এশিয়া আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশের ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর মানুষের স্বাধীন হবার আশা তখন আকাশ স্পর্শ করেছে । বলশেভিকবাদের সাফল্যে মানুষের এই আশা আরও উদ্বেল হয়েছে। মনের জমিতে প্রতিনিয়ত গজাচ্ছে নতুন নতুন পাতা। শোষিত মানুষের আশা আকাঙক্ষা বিশ্বাস কামনা অত্যাচার লাঞ্ছনা মূর্ত হয়ে উঠল নজরুলের কবিতায়। তাঁর কবিতা মানুষের কথা বলতে লাগল । শুধু এ দেশের নয়, সমস্ত পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে উঠল তার কবিতা । তিনি হয়ে উঠলেন যুগের কবি, সমকালের কবি, জণগণের কবি, মানুষের সুখ দুঃখের সহযাত্রী কবি । তাঁর গণসাহিত্যমুখী কবিতাগুলো দেশের মানুষের মন ছুঁয়ে গেল । জনগণের বাস্তব জীবনের সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে লেখা কবিতাগুলো মানুষের চেতনার মূলে আলোড়ন তুলল, বিপ্লব ঘটালো। এ প্রসঙ্গে বিপিনচন্দ্র পালের মন্তব্য ,
‘নজরুল ইসলাম কোথায় জন্মিয়াছেন জানি না ; কিন্তু তাঁহার কবিতায় গ্রামের ছন্দ, মাটির গন্ধ পাই । দেশে যে নূতন ভাব জন্মিয়াছে তাহার সুর পাই। তাহাতে পালিশ নাই; আছে লাঙলেন গান, কৃষকের গান। মানুষে-মানুষে একাত্ম সাধন এ অতি অল্প লোকই করিয়াছে ।’
নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম মুক্তি, প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ১৯১৯ সালে । প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এরপর একে একে ‘বিষের বাঁশী, ভাঙার গান, চিত্তনামা, ছায়ানট, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণিমনসা, সিন্দু হিন্দোল প্রর্ভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবিতার মাধ্যমে কবি ততদিনে পৌঁছে গেছেন মাটির মানুষের মনে । তারা মেতে উঠেছে শ্রেণি বিভক্ত সমাজের বৈষম্য নিরসনের অস্ত্র হাতে নিয়ে। সে অস্ত্র নজরুলের কবিতা। কবি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি কবি হতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি।’ কিন্তু নেতা হতে না এলেও তিনি নেতা হয়েছেন। তার কবিতা নেতৃত্ব দিয়েছে দ্রোহে, সংগ্রামে, বিপ্লবে।
নজরুল সাম্যবাদ আর স¤প্রতীর জয়গান গেয়েছেন। তিনি সা¤প্রদায়িক চেতনা বিলুপ্তির কবি।
‘গাহি সামের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম- খৃষ্টান ।’
( সাম্যবাদী/ সাম্যবাদী )
নজরুল জন্মেছিলেন মুসলিমের ঘরে কিন্তু ধর্ম তাঁর কাছ মানুষের পরিচয় নয়। মানুষের পরিচয় সে জন্মেছে মানুষ হিসেবে । তাই তার লেখনীতে মূর্ত হয়ে ওঠে,
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী ! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র !’
( কান্ডারী হুঁশিয়ার/ সর্বহারা)
কবি বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমদ লিখেছিলেন ‘ জনগণের ভিতরে সে মানুষ হয়েছে । জনগণের নিকট হতেই সে প্রেরণা লাভ করেছে।’
নজরুল দুহাতে লিখেছেন ইসলামী গান । একই সাথে লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত । আরবী ফারসী উর্দু ব্যবহার করেছেন বেশুমার। তাঁর লেখায় এসেছে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধারা, গ্রীক পুরান, ইসলামী দর্শন। কবিতায় নিয়ে এসেছেন আন্তর্জাতিকতা। আবদুল মান্নান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বাাঙালির ‘জাতীয় সত্তার প্রথম রূপকার বলেছেন।’ কথাটা অনেকাংশে সত্যি । কারণ নজরুলের আগে লেখার মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানকে মেলানোর চেষ্টা এভাবে আর কোন কবি করেননি। এখানেই নজরুলের সাফল্য আর অসাধারণত্ব। নজরুল শুধু নিজে অসাধারণ হননি। সাধারণ মানুষকেও অসাধারণ করে তুলেছেন। কবি অরুণ মিত্রের ভাষায় ‘ জনসাধারণ অসাধারণ ’ নজরুলের কবিতায় । ১৯২৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে এক ভাষণে নজরুল বলেন, ‘আমি হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি । ’ নজরুলের কবিতায় প্রাণের প্রকাশ অবারিত । কবিতা যেন ইস্পাতের কঠিন ফলা, ধাঁরালো সূঁচালো, যৌবন রসে রঞ্জিত। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী ।’ এ কবিতায় যেন শির উঁচু করে দাঁড়ালো এ দেশের বীর ছেলেরা । এ কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ভাষা আর ধ্বনিতরঙ্গ যোগ করল। যুগের প্রতি নজরুলের অঙ্গীকার ও সমর্থন প্রকাশিত হল কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে। কি নেই বিদ্রেহী কবিতায় ! আছে আশ্বাস, আশা, বিদ্রোহ, জিজ্ঞাসা, ঘৃণা, স্মৃতি, প্রেম আরও অনেক কিছু । এই সব কিছুর যুগলবন্দী কবিতা বিদ্রোহী নাড়িয়ে দিল বিশ্ববিবেককে। অঘাত হানল মানবের মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। এ কবিতা মাথা না নোয়াবার । অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার, প্রতিজ্ঞায় কঠোর, সংকল্পে স্থির।
‘ আমি বেদুইন, আমি চেংগিস / আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ
(বিদ্রোহী/ অগ্নিবীণা)
এক্সট্রোভার্ট, রোমান্টিক কবি নজরুল। তাঁর প্রেমের কবিতা হৃদয় নিংড়ানো, আনন্দ বেদনা, স্বপ্ন -কল্পনা, আবেগ উচ্ছ¡াসে ভরা। তাঁর কবিতায় যেমন আছে বিরহ বিচ্ছেদ প্রত্যাখ্যান অবহেলার প্রকাশ তেমনই আছে পেয়ে হারানোর কষ্ট অতৃপ্তি আর্তনাদ। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি ভিখিরি কাঙাল।
‘আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি
আমি ষোড়শীর হৃদি- সরসিজ প্রেম, উদ্দাম আমি ধন্যি।’
(বিদ্রোহী/ অগ্নিবীণা)
উদ্দামতা কবির সর্বক্ষণ, সর্বত্র। তাইি প্রেম তাকে বাধতে পারেনি। তিনি চলিষ্ণ্ু, চিরপথিক, চির পরিক্রমপ্রত্যাশী, ভ্যান গগ আর হুইটম্যানের মত।
‘চল্ চল্ চল্ / ঊর্দ্ধগগনে বাজে মাদল / নিম্মে উতলা ধরণীতল
( চল্ চল্ চল্/ সন্ধ্যা)
স্বল্পকালীন লেখক জীবনে কবি বোধহয় আন্দাজ করেছিলেন তার শেষ পরিণতি। তাই ১৯৪১ সালের, ৫ এপ্রিল, কলকাতা মুসলিম ইন্সটিউিট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সমিতির রজত জুবিলী উৎসবে শেষ অভিভাষণে বলেছিলেন,
‘ যদি আর বাঁশী না বাজে আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন ; মনে করবেন পূর্ণতার তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল ।’
অগ্নিবীণার কবি , বিষের বাঁশীর কবি, ভাঙার গানের কবি যতই মানুষের প্রাণের কবি হন না কেন প্রকৃতির হাতে সত্যিই বন্দি। তাই তো এই অসহায় উচ্চারণ । যে কবিকে সমসাময়িক কবি জীবনানন্দ মূল্যায়ন করেন এভাবে,
‘ আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল।’
অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন,
‘ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল।’
সত্যিই ভাগ হয়নি নজরুল । ভাগ করা যায়নি তাঁকে দেশ কালে, যুগে শতকে, জাতি ধর্মে। তাই আজও সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের আশ্রয় তাঁর কবিতা। সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতির হাতিয়ার তাঁর কবিতা। আজও অনন্ত উদ্দীপনা আর অনুপ্রেরণার উৎস তাঁর কবিতা। রণতূর্য বাজিয়ে শিকল ভাঙার গান শোনায় তাঁর কবিতা।
Facebook Comments Sync