ভূ-স্বর্গ বনাম- ভূনরক-কাশ্মীর – তাজনাহার মিলি

কাশ্মীর

মানুষের জীবনের অনেক দাম। প্রত্যেকের কাছেই পিতৃপ্রদত্ত জীবনের দাম অনেক বেশি। এ জীবন  যেমন স্বাভাবিক পথে এসেছে তেমনিভাবে বিদায়ের প্রার্থনা সবারই থাকে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবী আধুনিক সভ্যতায় যতই এগোচ্ছে ততই একদল অস্বাভাবিক চাহিদাসম্পন্ন লোভীর করাল থাবা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৯৪৭সালে  ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গেলো। তখন থেকেই ব্রিটিশের রোপিত ঘৃণার বীজে ভারত পাকিস্তান মুখোমুখি। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, আক্রমণ যুদ্ধ এ পথেই ২৬ শে ফেব্রুেয়ারি ভারত ভোর তিনটায় পাকিস্তানে হামলা চালায়। সস্ত্রাসবাদ আজ বড্ড ভাবাচ্ছে। কিন্তু সাত যুগ ধরে কাশ্মীরিদের স্বাধীকার আন্দোলন চলছে। বিশ্ব মোড়ল জাতিসংঘ কাশ্মীরি নিরীহ জনগণের মতোই হাত পা গুটিয়ে দর্শক কাতারে।

পৃথিবীর সবদেশের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেনারা নিষ্ঠুর। নিজেদের স্বার্থে একাট্ট। তাদের নিজস্ব চাহিদা পূরণে নিলর্জ্জ।

‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট ’ ব্রিট্রিশ কর্তৃক  প্রণীত আইন। এই আইন অনুযায়ী কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তান যে কোন রাষ্ট্রে যোগ দেবে। সে সময়ের হিন্দু মহারাজা হরিসিং স্বাধীনতা বা ভারতে যোগ দিতে চান। অন্য দিকে মুসলিমরা গিলগিট বালতচস্তানে  ও পশ্চিম জুম্ম কাশ্মীর যোগ দিয়ে পাকিস্তানের সাথে একীভূত হতে চাইছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পশতুন উপজাতীয় আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দিতে স্বাক্ষর করেন। ফলত ১৯৪৭ সালেই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে চলে ১৯৪৯ পর্যন্ত দু’বছর।

১৯৪৮ সালে জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে প্রসঙ্গ তোলা হয়। ৪৭ নং প্রস্তাবে কাশ্মীরে অচিরেই  গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি উঠানোর আহ্বান ছিল। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধ বিরতি হয়। তখন থেকেই কার্যত স্বাধীন এই এলাকাটা দু’ভাগ হয়ে যায়। দু’দেশের  আওতায় পড়ে। কাশ্মীরি সাধারণ জনগণের ইচ্ছা স্বপ্ন ব্যাহত হয়। জওহরলাল নেহেরু সব সময়ই মুখে বলেছেন কাশ্মীরের মালিক কাশ্মীরের জনগণ। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এটাকে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে নেহেরুর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল কথার সম্পূর্ণ বিপরীতে। বিগত ৭১ বছরে কেন গণভোট হল না? আজকের স্বাধীন বিবেকবান  কেন অন্যের দেশ-সম্পদ-ক্ষমতায় রাষ্ট্রীয় সস্ত্রাস করবেন? তাহলে রাষ্ট্রীয় সস্ত্রাস গ্রহণযোগ্য!

১৯৬২ সালে চীন-ভারত-যুদ্ধের মাধ্যমে চীন কাশ্মীরের কিছু অংশ দখল করে। ১৯৭২ এ সিমলা চুক্তির মাধ্যমে লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত করে। ভারত পাকিস্তান দুটি দেশ। অথচ কাশ্মীরের নিরীহ জনগণ ৭ যুগে উলুখাগড়ার মতো  নিষ্পেষিত। ভারত ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে। ১৯৯৯ সালে কারগিলে ভারত পাকিস্তান সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করে।

আশি দশকের পর থেকেই সাধারণ কাশ্মীরি জনগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যাচারে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৮৭ সালে বড় আকারে জেকে এল এফ সংগঠন জন্ম দেয়। ভারত চাইলে কাশ্মীরা  স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে। ১৯৮৯ সালে সহিংস আন্দোলন হয়। ১৯৯০ থেকে ভারতীয় সেনাদের অত্যাচার বেড়েছে। ভারত-পাকিস্তান উভয় অংশেই কাশ্মীরি জনগণ অত্যাচার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে চরম বৈরীমূলক পরিস্থিতির শিকার। কাশ্মীরিদের অত্যাচার মানবিক অধিকার হরণ করছে। অথচ বিশ্বমোড়ল উপেক্ষা করছে। জম্মু, শ্রীনগর, লাদাখ, আজাদ কাশ্মীরের জনগণ কি মানুষ না!!! ২০০ বছরের ব্রিটিশের পরাধীনতার নির্যাতন ভারত/পাকিস্তান রাষ্ট্র কিভাবে ভুলে যায়। এ দুটি রাষ্ট্র কি পারে না মানবতা দেখিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পৌঁছে দিতে।

কাশ্মীরে অর্থনীতি, রাজনীতি সমাজনীতি আজ পুলওয়ামা হামলায় ভয়াবহ অবস্থায় দাড়িয়ে। পর্যটকরা আজ মুখ ফিরিয়েছেন ভূস্বর্গ থেকে। ফলত: ব্যবসায়ীর বিপর্যস্ত। পর্যটন খাতকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলের মানুষ বেঁচে আছেন। খাওয়া-পরার যোগান আজ বড্ড ভয়াবহ সংকটে। এসময়টাতে ভ্রমণপ্রেমীদের ভূ-স্বর্গ । ২০০৮/২০০৯/২০১০ পর্যন্ত কিছুটা শান্তিপূর্ণ ছিল। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ -এ আবার নুতন করে শুরু হয় বেদনার কাব্য।

প্রিয়াংকা গান্ধীর পাঠানো টুইটের ভাষায় “কাশ্মীরে এখন যেভাবে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে খর্ব করা হচ্ছে তার চেয়ে বড় রাজনীতি আর বড় জাতীয় বিরোধী কার্যকলাপ আর হতে পারে না”।

প্রায় একমাস ধরে খাঁচাবন্দি জম্মু-কাশ্মীরের অধিবাসীরা। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাজার হাজার সেনা পুলিশ টহল দিচ্ছে। কারফিউ জারী করে জরুরি অবস্থা  ঘোষণা করা হয়েছে। পাড়া-মহল্লায় চলছে সাঁড়াশি অভিযান। কোন কারণ ছাড়াও যখন তখন ইচ্ছেমত কিশোর-যুবকদের তুলে নেয়া হচ্ছে। নির্যাতনের স্টিমরোলার চলছে। যৌন হয়রানি ও নারী ধর্ষণ করা হচ্ছে। অথচ বিশ্ব নীরব। এখন জাতিসংঘ কানা, কালা ও বোবা।  তবে এটা ঠিক, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পাকিস্তান নয়। ভারত নয় আজাদি।

জাতীয় আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো জানাতে পারছে না কাশ্মীরবাসীর দুঃখ যন্ত্রণার কাহিনী। গণতান্ত্রিক ভারতীয় সরকারের এ আচরণ কঠোর, নির্মম। আর এ পথে উগ্র জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের জন্ম হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গোটা উপমহাদেশের সকল শান্তিকামী মানুষ অপেক্ষায় আছে সাধারণ কাশ্মীরিদের মঙ্গল আকাঙক্ষায়।

আমরা চাই, ১৯৪৮ সালে পাস হওয়া সনদ অনুযায়ী  কাশ্মীরে নিরপেক্ষ স্বচ্ছ গণভোট হোক। ভারতীয় আর পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার হোক। এটিই সময়ের দাবী। পরমাণু অস্ত্রধারী দুটি দেশ কাশ্মীর দখলের  জন্য বার বার যুদ্ধে জড়িত হয়েছে। এবার তা বন্ধ হোক। সাধারণ কাশ্মীরি জনগণ মানবিকভাবে, সুস্থ পরিবেশে, নিজ নিজ ধর্ম, গোত্র ও বর্ণ অনুযায়ী বাঁচুক। কাশ্মীর অভয়ারণ্য হোক।