একুশ শতকের প্রশিক্ষণ ভাবনা – ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

একুশ শতকের প্রশিক্ষণ

আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব সমধিক। কেননা দক্ষ জনশক্তি ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক আমাদের জাতীয় উন্নয়নের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর চেহারা, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের শিক্ষার চাহিদা। ক্রমপ্রসারমান এই বিপুল জনশক্তিকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এদেরকে জ্ঞান-দক্ষতায় এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা আগামী একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করে। বিশেষত শিক্ষাদান পেশার সাথে যারা সরাসরি সংযুক্ত সেই শিক্ষক-সমাজকে সর্বাগ্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তুলতে হবে। সরকার শিক্ষকদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কার্যত এখনো কাঙিক্ষত ফলাফল অর্জিত হয়নি। কেননা আমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভাবনাগুলো এখনো অনেকটা গতানুগতিক। ক্ষেত্রবিশেষে নামসর্বস্ব। আমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হওয়া উচিত ছিলো গুণগত শিক্ষার ভিত্তি রচনার জন্য কিন্তু আজ আমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণব্যবস্থা হয়েছে শুধু সনদ অর্জন ও বাড়তি অর্থোপার্জনের জন্য। এ অবস্থার আশু উত্তরণ না হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষত প্রশিক্ষণব্যবস্থা নাজুক থেকে নাজুকতর হবে, ভেঙে পড়বে প্রশিক্ষণব্যবস্থা । শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নেমে আসবে অজানা অরাজকতা। এসব অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং আগামী শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে সবার আগে যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে, সেগুলো হচ্ছে :

বাংলাদেশে ভালো শিক্ষক তৈরির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ৬৬টি পিটিআই, ১টি নায়েম, ১৪টি সরকারি টিটিসি, ৭১টি বেসরকারি টিটিসি (২০১৯), ৫টি এইচএসটিটিআই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইইআর ও মাদ্রাসা- শিক্ষকদের জন্য বিএমটিটিআই। এসব প্রতিষ্ঠানে একসময় শুধু পেডাগগ (শিক্ষাবিজ্ঞানে পারদর্শী শিক্ষকসুলভ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী শিক্ষক) নিয়োগ দেয়া হতো। কিন্তু এখন এসব প্রতিষ্ঠানের চিত্র ভিন্ন। যেহেতু আমাদের দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য পেডাগজি জানা শিক্ষক নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক নয়, সেহেতু কেবল অনার্স বা মাস্টার্স পাশ করা শিক্ষকরা শিক্ষাদান পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তারা টিচিং লার্নিং-এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে মোটেই অবগত নয়, শিক্ষাদান-পদ্ধতির সাথেও তারা অপরিচিত। শিক্ষাবিজ্ঞানে অজ্ঞতার কারণে জ্ঞানের সকল কিছু উজাড় করে পাঠদান করেও কোনো কাঙিক্ষত ফলাফল আসছে না। শিক্ষকের এরূপ পাঠদানকে শিক্ষা-বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘জগ-মগ তত্ত¡’ বলে। যেখানে অসীম জ্ঞানের অধিকারী শিক্ষক কেবল নিজে সক্রিয় থাকেন, আর জ্ঞানশূন্য শিক্ষার্থী থাকে নীরব ও নিষ্ক্রিয়র ভূমিকায়। এ কারণে এরূপ শিক্ষা হয় নিরানন্দমূলক, একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকর। শিক্ষাদানের প্রকৃত উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হয় এ পদ্ধতির পাঠদানে। শিক্ষাবিজ্ঞানে পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগদানের বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এতে ভালো শিক্ষক তৈরির প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ছে । শিক্ষক-প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অবনতি ত্বরান্বিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি দ্রুত সামলাতে না পারলে শিক্ষক-প্রশিক্ষণে অজানা অরাজকতা নেমে আসবে।

 

প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবিজ্ঞানে পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষকদের গবেষণাপত্র তৈরি ও প্রতিবেদন পেশের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা-পেশায় নিযুক্ত শিক্ষকদের মাঝে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে জ্ঞান-গবেষণায় যাতে আরো বেশি যুক্ত হতে পারে সে ধরণের সুযোগ রাষ্ট্রকে তৈরি করে দিতে হবে। শিক্ষকগণ যদি গবেষণার সাথে যুক্ত হন তবে শিক্ষকের যেমন পেশাগত দক্ষতা অর্জিত হবে, সাথে সাথে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক নিজেই নিজের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারবেন।

 

তথ্য-প্রযুক্তিশিক্ষায় সকল স্তরের শিক্ষককে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। যেসব শিক্ষক তথ্য-প্রযুক্তিবিদ্যায় এগিয়ে থাকবেন তাদেরকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দেশের বাইরে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব শিক্ষক যাতে আর্থিকভাবে লাভবান হন সেদিকেও সরকারকে ইতিবাচক দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষত যাঁরা ইতোমধ্যে এসব প্রযুক্তি-বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেছেন তাদেরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের জাতীয় উন্নয়নে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষকের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ইন্টারনেট-সংযোগসহ ফ্রি ওয়াইফাই জোনের আওতায় আনতে হবে।

 

বর্তমানে যে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু আছে তা আধুনিকীকরণ করতে হবে। চলমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করতে হবে। বিশেষত যেসব বিষয় শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও দক্ষতা-বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং যা আয়ত্ব করলে শিক্ষার্থীরা সহজেই চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারবে সেসব বিষয় শিক্ষাক্রমের মধ্যে সংযুক্ত করা জরুরি। টিকিউআই-২ এরূপ প্রশংসনীয় বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে নতুন সংযোজিত কোর্স কারিকুলাম বিএড প্রশিক্ষণার্থীরা ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছে।

শিক্ষক-কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে হলে শিক্ষক-সংগঠনগুলোকে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। বর্তমানে শিক্ষক-সংগঠনগুলো শুধু পেশাগত দাবি-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। সংগঠনগুলো যদি শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা-উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন কিংবা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন, তাহলে শিক্ষকদের মাঝে যেসব দুর্বলতা আছে তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবেন। কারণ সংগঠনগুলোর মধ্যে এমন অনেক দক্ষ শিক্ষক আছেন যারা প্রশিক্ষিত এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞায় অভিজ্ঞ। এসব শিক্ষকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারলে প্রত্যেকটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকগণ পেশাগতভাবে দক্ষ হয়ে উঠবেন। সরকারি প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষা করে পাঠদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। শিক্ষক সংগঠনগুলো যদি এরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে শিক্ষকদের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হবে, তেমনি সরকারের কাছ থেকে তাদের পেশাগত দাবি আদায় করাও সহজ হবে। সংগঠনগুলো যেন কোনো দলের বা মতের লেজুড়বৃত্তি না করে সে-দিকেও নজর দিতে হবে।

চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তির পরে যে-প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় তার সময়কাল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণে যারা প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন তারা যেন পেডাগগ হন সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। কেবল সেসব শিক্ষকই এসব প্রশিক্ষণ-প্রদানে সংযুক্ত হতে পারবেন যাদের শিক্ষাবিজ্ঞানে ডিগ্রি আছে। নায়েমের বর্তমান যে-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তাতে পেডাগগ শিক্ষক নিয়োগ করা হয় না, অধিকাংশ অতিথি বক্তা পেশাগতভাবে শিক্ষকতার সাথে সংযুক্ত নন তাঁরাই প্রশিক্ষণ প্রদান করতে আসেন। এখানে যারা ট্রেনিং স্পেশালিস্ট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত তাদের মধ্যেও অনেকে শিক্ষাবিজ্ঞানের সাথে পরিচিত নন। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামে নায়েম কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের কাউকে লেকচার দিতে হায়ার করেন। তাঁদের কারো কারো লেকচার শুনে মনে হয়েছে নায়েম কর্তৃপক্ষের সময় ও শ্রম দুটোই ব্যর্থ হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

 

শিক্ষানীতি ২০১০-এ বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত নিম্নমানের শিক্ষক-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়েছে, সাথে সাথে সরকারি শিক্ষক-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করছে, ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। যেখানে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি মালিকানায় স্থানান্তর করার দাবি উঠছে প্রতিনিয়ত সেখানে বেসরকারি টিটিসিকে নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক। যেসব বেসরকারি টিটিসির প্রশিক্ষণের মান নিম্নমানের সেসব টিটিসিকে একটি পর্যবেক্ষণের আওতায় এনে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংশোধনী দিয়ে পরিবর্তন করা যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারির মাঝে বিভাজনের রেখা না টেনে বেসরকারি টিটিসিগুলোকে সমান সুযোগ-সুবিধার আওতায় এনে আরো শক্তিশালী করা যেতে পারে। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি টিটিসিগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই কোর্স কারিকুলাম ও পরীক্ষাপদ্ধতির আলোকে পরিচালিত হচ্ছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের সনদ দেয়ার কর্তৃপক্ষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তাই কর্তৃপক্ষ চাইলেই  পিছিয়ে পড়া বেসরকারি টিটিসির মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। যেখানে সরকার পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাতিল করে নতুন সরকারি টিটিসি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা অপ্রত্যাশিত। বেসরকারি টিটিসিগুলোকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করলে সরকারের উপর আর্থিক চাপ আরো কমবে। আর এটাই প্রত্যাশা।