চলচ্চিত্রে সাপ/ আফরোজা পারভীন

সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে সাপ নির্ভর চলচ্চিত্র কম নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু একসময় সাপ নিয়ে বিস্তর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে অর্ধশতাধিক ছবির বিষয়বস্তু  সাপ। সাপ, সাপুড়ে ও  বেদেনীকে  কেন্দ্র করে এসব কাহিনিচিত্র  তৈরি হয়েছে। তার কারণও আছে । পল্লী অঞ্চলে সাপ এখনো প্রতিদিনের জীবনের অংশ । অনেক মানুষ সাপের আঘাতে মারা যান। সাপ আমাদের অতি চেনা। তাছাড়া আমাদের চারপাশে রয়েছে  বেদে সম্প্রদায়। এই  চেনাপরিচিত সমাজের অংশ নিয়ে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় তখন  সেটা বাস্তব হয়। এইসব চলচ্চিত্রে থাকে জীবনের নির্যাস । তাই সিনেমাতে সাপের ব্যবহার অস্বাভাবিক কিছু না। বাংলা চলচ্চিত্রে এক সময় এ্যাকশন, শহুরে, গ্রামীণ,   প্রেম, পারিবারিক, সামাজিক, রূপকথা, বাদশাহী আমল এরকম অনেক ক্যাটাগরির সাথে সাপের ছবির একটা ক্যাটাগরি ছিল।  লোক বা  পৌরাণিক গল্পের ছবিতেও সাপের উপস্থিতি ছিল। তাই সাপকে উপজীব্য করে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং  সেগুলো দর্শক গ্রহণও করেছে। শুধু তাই নয়, সাপের ছবির দর্শকদের ক্যাটাগরিটাও আলাদা ছিল।  এক শ্রেণির দর্শক সাপের সিনেমা দেখতে পছন্দ করত। তারা সাগ্রহে সাপের ছবি মুক্তির জন্য অপেক্ষ করত। এখন আর আলাদাভাবে সাপের ছবি নির্মিত হতে দেখি না। তবে এক ছবিতেই সব পাওয়া যায়।

চলচ্চিত্রের কাহিনির স্বার্থে সাপ এসেছে নানাভাবে। তবে কাহিনিসজ্জার নেপথ্য কারণ অবশ্যই রোমাঞ্চ সৃষ্টি করা। মানুষ ভূতের ভয় পায় কিন্তু ভূতের গল্প শুনতে ভালবাসে। তেমনই সাপকে ভয় পেলেও সাপের কাহিনি দেখতে ভালবাসে। এর প্রধান কারণ দর্শকরা জানে তারা আছে সাপের ধরাছোঁয়ার বাইরে, নাগালের বাইরে। সাপনির্ভর চলচ্চিত্রের প্রধান দর্শক নারী ও শিশু । তাদের কাছেই সাপের ছবি সবচেয়ে  গ্রহণযোগ্য । এ কারণে একটা সময় পর্যন্ত  দেশে একের পর এক সাপকে উপজীব্য করে ছবি  তৈরি হয়েছে । অধিকাংশ ছবিই  পেয়েছে ব্যবসায়িক সাফল্য। সাম্প্রতিক সময়ে সাপ নিয়ে ছবির সংখ্যা  শূন্যের  কোঠায় নেমে এসেছে যা আগেই বলেছি। এর কারণ ছবির বিষয়বস্তু বদলে যাওয়া এবং দর্শকদের রুচির বদল।

বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাপ এসেছে বিভিন্নভাবে। সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার আঙ্গিকে সাপকে উপস্থাপন করা হয়েছে চলচ্চিত্রে। সাপ  কোথাও  যৌনতার প্রতীক,  কোথাও সংহারদেবী,  কোথাও উদ্ধারকর্তা,  কোথাওবা ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার ।  সাপ দুষ্টের দমনকর্তা এই ধারণাটি ব্যাপকতা নিয়ে এসেছে চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রে সাপ এসেছে দু’ভাবে- চরিত্র হিসেবে ও মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে।

অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে সামাজিক, ধর্মীয় ও কল্পনাশ্রয়ী বিষয়  যেমন প্রাধান্য  পেতো;  তেমনি  পৌরাণিক,   লোকজ ও অলৌকিক বিশ্বাসনির্ভর বিষয়ও স্থান  পেয়েছিলো। তাই গায়েবী আওয়াজ, উড়ন্ত জায়নামাজ, দরবেশের হাতে লাঠি, বিবেকের বিচরণ ছিল চলচ্চিত্রে। বাংলা চলচ্চিত্রের শুরুর সময়  থেকেই সাপ ছিল অন্যতম উপাদান। পূর্ব পাকিস্তানের ছবিতেও সাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে এসেছে। বাংলাদেশেও  সেই ধারাবাহিকতা অটুট  থেকেছে।

চলচ্চিত্রে সাপের ভূমিকা ব্যাপক ও বিচিত্র। সাপ প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুসৃত বিশ্বাসের কাঠামো  থেকে চলচ্চিত্রে এলেও প্রকৃতির অংশ হিসেবেও এসেছে। তাই শুধু সাপ নয়; সাপুড়ে আর যারা সাপ ধরে ও বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে, তারাও চলচ্চিত্রের বিষয় হয়েছে। সাপ এখানে  লৌকিক মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে।

চলচ্চিত্রে  আসার আগে পুরাণ,  লোকগাঁথা, মঙ্গলকাব্য,  মৌখিক সাহিত্যে সাপ উপাদান হিসেবে এসেছে । মঙ্গলকাব্যের তিনটি ধারা চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও মনসামঙ্গল। মনসামঙ্গল সবচেয়ে প্রাচীন।   মনসামঙ্গল প্রভাবিত মঙ্গলগান, আখ্যানগীত, পদ্মাপুরাণভিত্তিক খন্ডগান, পালাগান, ঢপযাত্রা,  লোকায়ত নৃত্য ভাটি বাংলায় বহুদিন ধরে চর্চিত হয়ে আসছে। বাংলা ছবি নির্মাণের শুরু  থেকেই মনসামঙ্গল থেকে উপকরণ আহরিত হতে থাকে। মনসা সাপের  দেবী। পদ্মা এবং পদ্মাবতী নামেও মনসা পরিচিত। এদেশে জঙ্গল বেশি থাকায় সাপের উপদ্রব  বেশি। আর সাপ বেশি  থাকায় সর্পদেবীর ধারণাটি  পোক্ত হয়েছে। অন্যদিকে সাপ কোনো কোনো ধর্মের কাছে পূজনীয়ও বটে। এইসব কারণে সাপ এসেছে  লোকসাহিত্য, নৃত্য ও গীতের আধেয় হয়ে। সবশেষে সাপ চলচ্চিত্রে এসেছে চরিত্র হিসেবে।

সাপের কাহিনির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকাররা একদিকে যেমন দর্শকদের রোমাঞ্চকর বিনোদন দেন অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে  বাংলার দর্শক ও সমাজের সামনে কতোগুলো নীতিকথা, আপ্তবাক্য তুলে ধরেন। ক্ষমতাধররা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কী হয়, অবৈধ কর্তৃত্ব করলে তার কী পরিণতি হয়, তা-ও  দেখানো হয়েছে। সাপের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে দুষ্টের দমন প্রক্রিয়া।  এ অঞ্চলের কিছু মানুষ বিশ্বাস করে  যৌন মিলনের প্রতীক সাপ। এ বিশ্বাসের প্রতিফলনও ঘটেছে  চলচ্চিত্রে ।

ক্ষমতা আর ভয়ের প্রতীকও, তা-ও চলচ্চিত্রগুলোতে স্পষ্ট।  ভৌগোলিক পরিবেশের কারণেই এদেশে ক্ষমতা ও ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে সাপ। তবে সাপ কখনও কখনও আদরেরও। যেমন বাস্তুসাপ। তারা বাস্তুভিটা রক্ষা করে বলেও অনেকে বিশ্বাস করে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র  শেষ দৃশ্যে  দেখা যায়, হরিহর তার পরিবারসহ নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম  ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে। তখন হরিহরের পরিত্যক্ত জীর্ণকুটিরে একটি সাপ প্রবেশ করে। এই সাপ বাস্তুসাপ।

সাপ কখনও দেবী কখনও দেবতার বাহন। তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় আমরা সাপকে পাই দেবতার বাহন হিসেবে। মনিবের কাছে ঠকে, জমিদারের কাছে ধাক্কা খেয়ে, বিয়ে বাধা, বিয়ে ভাঙা, শিকার, প্রলয়, প্লাবন সবকিছু নিয়ে চলে যাচ্ছিল বাঁশবাদি গ্রামের কাহারদের জীবন। তাদের বিশ্বাস ‘কত্তাবাবা আছেন। তিনিই সব সামলাবেন।’ কত্তা বাবা একটা শিমুল গাছ। কিন্তু সেই বিশ্বাসের জায়গাটাতে পড়ল জোর ধাক্কা।  ধাক্কা দিলো করালী। ধাক্কার কাজটা শুরু হলো একটা শিসের শব্দে। উপন্যাসের শুরুতে আমরা এই শিসের ব্যাপারটা পাই। হঠাৎ শিসের শব্দে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। দিন কয়েক ধরে  কেউ  যেন শিস দিচ্ছে পল্লীর বাদাড়ের আনাচে-কানাচে। কখনও দু-গাঁয়ের মাঝে। কখনও  বেলগাছ-শ্যাওড়া  ঝোপে ভর্তি ব্রহ্মদৈত্যতলায়। কখনও কুলকাঁটার জঙ্গলে, কখনও বাঁশবনে। এই শিস নিয়ে ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম জুড়ে । গ্রামবাসীরা ভাবছে গাঁয়ের  দেবতা কত্তাবাবা বুঝি রুষ্ট হলেন? শিস দিয়ে তাই তিনি তার রাগের প্রকাশ করছেন। করালী কত্তাবাবার বাহন চন্দ্রবোড়া  সাপটিকে পুড়িয়ে মারল বেলতলা ও শ্যাওড়া গাছের বন পরিষ্কার করে। ধীরে ধীরে কাহারদের পুরোনো বিশ্বাস ও সংস্কারে পরিবর্তন আনে করালী। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে পশ্চিম বাংলায়।

সাপ নিয়ে বাংলাদেশে নির্মিত একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’। বেহুলার কাহিনি মনসামঙ্গল থেকে নেয়া। মনসামঙ্গলের কাহিনি মূলত দুই নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। সেই দুই নারী মনসা আর  বেহুলা।  মনসার জন্ম  কোন নারীর গর্ভে হয়নি। শিবের বীর্য পদ্ম পাতায় রাখলে,  সেখান  থেকে তা পদ্ম নাল  বেয়ে পাতালে  নেমে যায়;  সেখান  থেকেই মনসার জন্ম হয়। মনসার জন্মপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক না।  সেকারণে তার চাই সন্তানের স্বীকৃতি, সন্তানের দাবি প্রতিষ্ঠা। এই দাবিতে  সে অনড়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একই সাথে চাই মানব সমাজে  দেবীরূপে নিজের অধিষ্ঠান। সে চায় সবাই তার পুজো দিক। তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করুক।  কিন্তু সেখানে বাঁধা চাঁদ সওদাগর। তাই তো একের পর এক সাপ পাঠালো তার ছেলেদের দংশন করানোর জন্য। তবুও নত হয় না চাঁদ সওদাগর। অবশেষে পালা এলো   লক্ষীন্দরকে দশংনের । সাপ পাঠালো মনসা। মনসার চাওয়ার  ভেতর দিয়েই নারীর চাওয়া স্পষ্ট প্রতীয়মান। নারী অধিকার চায়। সে কর্তৃত্ব চায়।

অপরদিকে,  বেহুলা বাসর রাতে জেগে বসে থাকে। স্বামী আরামে ঘুমিয়ে পড়ে।  বেহুলা পাহারা  দেয়। সাপ এলে ছলাকলায় তাকে ভুলায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। মৃত স্বামীকে নিয়ে কলার ভেলায় ভাসে।  দেবপুরীতে যায়। স্বর্গের  দেবতাদের নাচ  দেখিয়ে মুগ্ধ করে।  বেহুলার সংগ্রাম, ত্যাগ আর পরিশ্রমে তার স্বামী বেঁচে ওঠে। বেহুলার কর্ম তাকে বাঁচিয়ে তোলে।  বেহুলা সেই  নারী যে তার স্বামীর জীবন নতুন করে সাজায়। এখানে বেহুলাও ক্ষমতাধর। সে পেরেছে তার চাওয়ার পরিপূর্ণ রূপ দিতে।

পৌরাণিক কাহিনি থেকে নেয়া এই জাতীয় সাপ নির্ভর চলচ্চিত্রে  দেখানো হয়েছে মর্ত্যের মানুষের প্রতি  দেবকুলের অনৈতিক আচরণ। দেখানো হয়েছে মানুষ কর্তৃক মানুষের ওপর অত্যাচার দমন করার জন্য সাপের সহযোগিতা প্রয়োজন। সাপ ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য । দুর্বলকে উদ্ধার করা বা বাঁচানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে সাপ।

এদেশের আর একটি সুপারডুপার হিট চলচ্চিত্র ‘বেদের  মেয়ে  জোসনা’। নাম থেকেই বোঝা যায় কি আছে চলচ্চিত্রটিতে।  সাপ ও  বেদে সম্প্রদায়ের জীবন নিয়ে এটি একটি ব্যবসাসফল ছবি। ছবিটি দুই বাংলাতেই ব্যবসা করেছে।  ১৯৮৯ সালে ছবিটি নির্মিত হয়। এটি   তৈরি হয়েছিলো একটি যাত্রাপালা অবলম্বনে। যাত্রাপালাটি শতবর্ষের প্রাচীন এবং গ্রামে গঞ্জে  অভিনীত হয়েছে বহুবার। সে অভিনয়ের ধারাবাহিকতা আজও চলমান। সাপ ছাড়া বেদে জীবন অচল।  এ চলচ্চিত্রে সাপ ব্যবহৃত হয়েছে  বেদে জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।

সাপের ছবি মানেই সাপের সাথে সাপুড়ে আর তার বীণ। বীণের আলাদা একটা সুর আছে। যে সুর অন্য সব সুর থেকে আলাদা। এ সুরে কেমন যেন একটা মাদকতা আছে, ঘোর আছে। তাই চলচ্চিত্রেও দেখা যায় সাপে দংশন করার পর সাপুড়ে বা নায়িকা (যে কীনা সাপুড়ে বা বেদে কন্যা) বীণ বাজালে বহুদূর থেকে সাপ ছুটে আসে বিষ তুলে নেয়ার জন্য।  একটা সময় সিনেমা হলে সাপের  কোনো ছবি প্রদর্শন হলে গুজব রটতো  যে,  প্রেক্ষাগৃহে সাপ ঢুকেছে! চলচ্চিত্র ছাড়াও বিষহরীর গান, যাত্রা, পালা,  লোকনাট্য, আল্পনা, চিত্রকলা, নকশাকর্ম প্রভৃতি শিল্পমাধ্যমে সাপ বহুমাত্রিক চরিত্র ও প্রতীক হিসেবে হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এদেশের  দর্শকসমাজ সাপ, সাপুড়ে ও বীণকে গ্রহণ করেছে সাদরে। তাদের পছন্দের আর একটি বিষয় হচ্ছে ‘নাগীন কন্যা’। যে কীনা বীণ বাজানোর শব্দে সাপ থেকে নিমেষে নারীতে রূপান্তরিত হয়। এই ফ্যান্টাসি আমাদের মনকে আমোদিত করে। এই জাতীয় চলচ্চিত্রে মানুষের চাইতে সাপই  যেন সংখ্যায়  বেশি থাকে। নাগীন কন্যার কপালের টিপটাও হয়ে উঠে ক্ষুদ্র একটি সাপের  রেখা। নাগিনী কন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের  প্রেমের ঘটনা ঘটে স্বাভাবিকভাবে। এই  ফ্যান্টাসি এদেশের মানুষ লুফে নিয়েছে।

তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অনেকের মধ্যেই জানা শোনার ঘাটতি রয়েছে। রয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহারে অদক্ষতা।  আধুনিকমনস্কতা,  শৈল্পিক পরিশীলনের ঘাটতিও রয়েছে অনেকের মধ্যে। সাপ নির্ভর অনেক চলচ্চিত্রে ফ্যান্টাসি নির্মাণ তাই কোথাও কোথাও হাস্যকর লেগেছে। নির্মাণ কুশলতার দৈন্যে আশ্চর্যের  বিষয় না হয়ে এটা যেন হয়েছে হাসি ঠাট্টার বিষয়। এইসব ফ্যান্টাসির  স্পেশাল ইফেক্ট হয়েছে নিম্নমানের। মানুষ  থেকে সাপ বা সাপ  থেকে মানুষে রূপান্তরের ফ্যান্টাসি তারা করছেন  কেবল একটি কাট এর মাধ্যমে। ইফেক্ট  দেবার  চেষ্টাও করেননি। তবে সাপের ছবিতে দু’একটি ক্ষেত্রে তারা দক্ষতা অর্জন করেছেন। সাপুড়েদের বীণ বাজানোর নৃত্যভঙ্গি, অভিনেত্রীদের সাপুড়ে নৃত্য পরিবেশনা যথাযথ হয় প্রায়শই। এটাও একটা অর্জন। এদেশে সাপ থেকে নাগিনী হবার চরিত্রে অনেকেই অভিনয় করেছেন। তবে এই চরিত্রে নূতনকে খুব মানাতো। তার বীণ বাজানোর ভঙ্গিটিও চমৎকার।

সাপের ছবি জনপ্রিয়তা পাবার একটা বড় কারণ সাপকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের গানের কথা ও সুর । এই কথা ও সুর মানুষ এতই পছন্দ করত  যে,  সেসব গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। ছবিতে কাহিনি ছাড়াও  নাচ-গানও দর্শক উপভোগ করতে চান। তিন বা আড়াই ঘন্টার ছবিতে নাচ, গানও  জরুরি উপাদান। সাপের ছবিতে এ বিষয়গুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরা সম্ভব।

সাপ ও সাপুড়ে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলির অন্যতম মহুয়া (১৯৬৬), বেহুলা (১৯৬৬), অরুণ বরুণ কিরণমালা (১৯৬৮), পাতালপুরীর রাজকন্যা (১৯৬৯), বেদের  মেয়ে (১৯৬৯), নাগিনীর  প্রেম (১৯৬৯), মলুয়া (১৯৬৯), আমীর সওদাগর, ভেলুয়া সুন্দরী (১৯৭০), নাগ-নাগিনী (১৯৭৯), শীষনাগ (১৯৭৯), নাগিনী কন্যা (১৯৮২), নাগ পূর্ণিমা (১৯৮৩), নাগরানী (১৯৮৩), পদ্মাবতী (১৯৮৪), রসের বাইদানী (১৯৮৪), চন্দনদ্বীপের রাজকন্যা (১৯৮৪), জিপসি সর্দার (১৯৮৪), সতী নাগকন্যা (১৯৮৫), নাগমহল (১৯৮৬), চাঁদ সওদাগর (১৯৮৬), পদ্ম  গোখরা (১৯৮৭), নাগিনা (১৯৮৭), মহুয়া সুন্দরী (১৯৮৭), নাগজ্যোতি (১৯৮৮), সর্পরানী (১৯৮৮), বেহুলা লখিন্দর (১৯৮৮), জলপরী (১৯৮৯), বেদের  মেয়ে  জোসনা (১৯৮৯), সাপুড়ে  মেয়ে (১৯৮৯), সাগরকন্যা (১৯৮৯), নাচে নাগিন (১৯৯১), রাজার  মেয়ে  বেদেনী (১৯৯১), শীশমহল (১৯৯১), বনবাসে  বেদের  মেয়ে  জোসনা (১৯৯১), রূপসী নাগিন(১৯৯২), নাগিনী সাপিনী (১৯৯২), নাগ নাগিনীর স্বপ্ন (২০০৯) প্রভৃতি।

ছবিগুলোর নাম থেকেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে  ধারণা পাওয়া যায়।  মঙ্গলকাব্য  থেকে উৎসারিত বেহুলা ও পদ্মাবতী ছবি দুটিতে সাপ এসেছে পুরাণের হাত ধরে। উভয় চলচ্চিত্রেই সাপ মর্ত্যের মানুষের ক্ষতি করতে তৎপর।  লোকগাঁথাভিত্তিক মহুয়া, মলুয়া,আমীর সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী প্রভৃতি ছবি  লোকজীবনের ক্যানভাসে নির্মিত। এগুলোতে মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হিসেবে এসেছে সাপ। পদ্মা  গোখরায় সাপকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান হিসেবে  দেখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।

সাপের রাগ মারাত্মক। একবার যদি  কেউ  সাপের অনিষ্ট করে, তবে ওই ব্যক্তির বিনাশ না করা পর্যন্ত থামে না সাপ। তবে চিকিৎসক বা ওঝা নয়, সাপ নিজেই ভালো করতে পারে সাপে কাঁটা মানুষকে। বীণের সুরে, গান অথবা নাচের তালে মুগ্ধ কিংবা বাধ্য হয়ে ছুটে এসে এই অসাধ্য কাজটি সাধন করে সাপ। গরুর দুধ পান করতে সবচেয়ে  বেশি পছন্দ করে সাপ। কিন্তু এসবই প্রচলিত ধারণা। কারো কারো বিশ্বাস। কিন্তু বিজ্ঞানে এর  কোনো ব্যাখ্যা নেই।

সাপের মাথায় মণি আছে এটাও প্রচলিত ধারণা। বাস্তবে সাপের মণি  বলে কিছু  নেই। তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে সাপ ধরা হয়- এটারও কোনো ভিত্তি নেই।  সাপ দুধ খায় না।  দুধ খাওয়ার মতো বা শুষে নেওয়ার  কোনো উপযুক্ত মাধ্যম  নেই সাপের মুখে।  সাপ কানে  শোনে না।  কম্পন দ্বারা অনুভব করে। কিন্তু চলচ্চিত্রে এই  এই সত্যিগুলোর প্রতিফলন ঘটে না দর্শক আকর্ষণ করার অভিপ্রায়ে। অর্থাৎ চলচ্চিত্রে সাপ বিষয়ে ভুল ধারণা  দেওয়া হচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

সাপ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাপ সংক্রান্ত কয়েকটি বিখ্যাত গান নি¤œরূপ:

বেহুলা – ও  বেহুলা সুন্দরী/ কি সাপ দংশিল

নাগিন –  গোখরা  রে  গোখরা ছাড়  তোর নখরা

নাগ পূর্ণিমা – আয়রে ও নাগিনী/  তুমি  যেখানে আমি  সেখানে

 

অরুণ বরুণ কিরণমালা – খা খা বক্ষীলারে কাঁচা ধইরা খা

চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা – মনটা যদি  খোলা  যেতো সিন্দুকেরই মতো

পদ্মাবতী – নয়ন জুড়ে/   ঘোমটা খুলে দিলাম/  দোহাই লাগে সুজন/কাল নাগিনী

নাগ  জ্যোতি – জনম ধরি যতন করি রাখিও  মোরে পরানে/ একটি গন্ধমের লাগিয়া/  আমার  কোন দুঃখ নাই/ আমার  ষোল বছর হইলো

বেদের  মেয়ে  জোছনা –  বেদের  মেয়ে  জোছনা

নাগিনী সাপিনী – আমি নাগিনী আমি সাপিনী

নাচ নাগিনী নাচ – নাগ নাগিনী  দোহাই লাগে

রাঙা বাইদানী – তুমি  যে আমার বন্ধু

রসের বাইদানী – আমি রসের বাইদানী ভাই/ তুমি আমার বারো মাসের গান

বেদেনীর  প্রেম – নাগ নাগিনী লইয়া সাপ  খেলা  দেখাই

দুই নাগিন – আমি দিওয়ানা হইলাম/  চুপি চুপি মন  কেড়ে নিয়েছে/ তুমি ফুল মনেরও  সেরা ফুল

পরিশেষে বলতে চাই, সাপ নির্ভর চলচ্চিত্রের যেমন দর্শক আছে তেমন এসব চলচ্চিত্র নিয়ে হাসাহাসিও কম হয় না। এই জাতীয় চলচ্চিত্রকে তুচ্ছ করার একটা প্রবণতাও আছে।  বেদে সম্প্রদায়ের প্রতি সমাজের নেই কোনো শ্রদ্ধাবোধ। তারা যেন বিনোদন দেবার হাতিয়ার অনেকের ধারণা এমনই। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও এ ভাবনার ছাপ পড়ে।

নির্মাণ ভালো হলে তুচ্ছ করার কিছুই নেই। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় এই জাতীয় চলচ্চিত্রেও গভীর বক্তব্য আছে। এসব চলচ্চিত্রে নারীকে ক্ষমতাধর  দেখানো হয়েছে  মঙ্গল কাব্যের মতোই। ফিমেল এনপাওয়ারমেন্টের কথা বলা হয়েছে। তাইতো আমরা দেখি নায়ককে সাপ কামড়ায় আর  ক্ষমতাধর নায়িকা নাগিন হয়ে বিষ চুষে নায়ককে বাঁচায়। অর্থাৎ নায়কের চেয়ে নায়িকা ক্ষমতাধর, শক্তিমত্ত।  কোথাও  কোথাও নায়িকা মারা গিয়ে আত্মত্যাগের উদাহরণও সৃষ্টি করে। এগুলো এক একটি মেসেজ। দুষ্টের দমন করা, সাপের কামড়ে দুষ্ট বা কর্তৃত্বপরায়ণ লোকের মৃত্যুও সমাজের জন্য মেসেজ। তাই সাপের ছবি মানেই বক্তব্যবিহীন নাচ গান এটা ঠিক নয়। মনসামঙ্গলের মতো গ্রীক কিংবা মিশরের পুরাণেও নারীকে শক্তিশালী অবস্থানে  দেখানো হয়েছে। যার অধিকাংশই পুরুষের জীবন বাঁচানো নির্ভর। নারীই পুরুষের জীবনকে সাজিয়ে  দেয়  এতে  কোন সন্দেহ  নেই।

সব ধর্ম আর পুরাণেই নারীকে  দেখানো হয়েছে পুরুষের জীবনে প্রাণদায়িনী হিসেবে। নারী ছাড়া কার এমন সাধ্য আছে স্বামীর জন্য মৃতদের  দেশ  থেকে ঘুরে আসে। সাধ্য হয়েছে নারীর, বেহুলার!  মিশরের মিথে দেখা যায় আইসিস তার স্বামীকে প্রাণ ফিরিয়ে  দেয়ার জন্য লড়েছেন। ইনকা  থেকে শুরু করে আজকের গারো উপজাতি সবখানেই নারীর স্থান অনেক উপরে।

তাছাড়া হলিউডের এনাকন্ডা মুভি নিয়ে যদি হাসি তামাশা না হয় তাহলে বাংলাদেশের সাপ বিষয়ক সিনেমা নিয়ে  কেন হাসাহাসি হবে! আর সাপের ছবি মানেই গাঁজাখুরি নয়। অনেক ক্ষেত্রে  সাপের চলচ্চিত্র সমাজ সভ্যতা  থেকে তুলে আনা মানুষের জীবন কাহিনি নির্ভর হয়ে থাকে।

ছেলেবেলায় দাদা-দাদী, নানা-নানীর কাছে সাপের গল্প শুনতাম। বিশ্বাসও করতাম। মনে হতো সত্যিই নাগিনকন্যা আছে। তার মাথায় মণিও আছে। নাগনাগিনীর ছবি  দেখার পর বাড়ির আশে পাশে  ছোট খাটো জঙ্গলে গিয়ে নাগরাজ- নাগরাণী খুঁজতাম।

সাপের ছবিগুলো রোমাঞ্চকর । ঠিক মতো নির্মাণ করতে পারলে  রোমাঞ্চের সাথে যথেষ্ট বিনোদন দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। এ বিষয়ে দর্শকদের আগ্রহও আছে। হলিউডে এখনো কল্পকাহিনি নির্ভর  সিনেমা নির্মাণ হয়। আমাদের  দেশেও হতে পারে। শুধু দরকার কমিটমেন্ট আর ভালোভাবে  তৈরির দক্ষতা। দর্শক যে কোনো ভালো জিনিস গ্রহণ করে। করবেও ।