দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা পর্ব ৫
কিছুক্ষণ বসে থাকে মেয়ের পাশে। মাথায় হাত রাখে। তারপর বলে,‘ ‘রাহাকে আনলেই তো পারতিস।’ কথা বলেনা ইথিকা। বলতে ইচ্ছা করেনা। কথা বলতে ইচ্ছা না করলেও ওর নাছোরবান্দা মা ওকে ছাড়বে না তা জানে ইথিকা। মায়ের উপর রাগ হতে থাকে ওর। কেন ওকে একলা থাকতে দিচ্ছে না। ও মেয়ে হয়েছে বলে কি সব কথার জবাব দিতে হবে ওকেই; এ কেমন কথা। এতদিন যখন শোনেনি এখন শোনার কি প্রয়োজন। কোন প্রয়োজন নেই। একটা গাঢ় অভিমান ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
‘কিরে কথা বলছিস না কেন। তমিজের সঙ্গে কি ঝগড়া করেছিস?’ মা আবারও বলে। শুধু তমিজের কথা! যেন তমিজ ছাড়া অচল তার মেয়ে। ইথিকার মায়ের ওপর অভিমানের বাষ্প ঘনীভূত হতে থাকে! মাকে বলে, ‘মা আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লিজ।’
‘কেন একা থাকবি? এলি এতোদিন পর। কথা বল। আমার সঙ্গে কি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না!’ মায়ের কথায় লজ্জা পেয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় ইথিকা। ‘পিয়াস, শিমুল কোথায় মা?’
‘খেলতে গেছে পিয়াস আর শিমুল গেছে অ্যামবেসিতে। অস্ট্রেলিয়া যেতে চায় পড়তে।’
‘তাই নাকি। বেশ ভাল। এখান থেকে কি-ই করতে পারবে।’
‘না পারে না করবে। তবুও তো নিজের দেশ। নিজের দেশের জলমাটি বাতাস সব নিজের। পরদেশ, পর-দেশ-ই থাকে। তা কখনও নিজের হয় না।’ মায়ের সঙ্গে তর্কে যেতে ইচ্ছা করছে না, কথাও বলতে ইচ্ছা করছে না।
মা আরও কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু রা কাড়ে না মেয়ে; পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে ইথিকা। ওকে শুতে দেখে অবাক হয় মা। কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব মেয়ের; মনে খটকা লাগে মায়ের। নিশ্চয় কিছু হয়েছে! না হলে আসবার মেয়ে নয় ও। ইথিকার মা, মরিয়ম বেগমের মনে চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করে। এলোমেলো চিন্তা! মেয়েকে একা রেখে চলে যায় মা। ইথিকা শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়!
‘এ্যাই আপু কখন এসেছো?’ পিয়াসের ডাকে ঘুম ভাঙে ইথিকার। ঘুমিয়ে পড়েছিল এটুকু সময়ের মধ্যেই; টেনশনে থাকলেই ওর ঘুম, খিদে দুইই বাড়ে।
‘ওমা তুই কতক্ষণ। খেলায় জিতলো কে?’
‘আমরাই। জান আপু ট্রফি পেয়েছি।’ হাত উঁচু করে ট্রফি দেখায় পিয়াস। পিয়াস এবার নাইনে। স্কুল টুর্নামেন্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সবসময়ই দেখা যায় ওকে। এই বয়সে ভাল আবৃত্তি করে, গানও গায়। আজ খেলতে গিয়েছিল আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়; জিতেছে।
জেতার আনন্দে পিয়াসের আনন্দ উচ্ছ্বল মুখ। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দ রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে ইথিকার মনেও। পিয়াসের সাফল্যে যে আনন্দটুকু এখন মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সেটুকু পিয়াসের সঙ্গে ভাগ করে নেয় ইথিকা।
‘তোর ট্রফিটা তো সুন্দর। তোকে রাখতে দিয়েছে নাকি ফেরত দিতে হবে?’
‘নাহ্, এটা দলের সকলের বাসায় একদিন করে থাকবে তারপর জমা দিতে হবে স্কুলে।’ আনন্দে টগবগ করে পিয়াস। ‘জান আপু, সামনের বারে আমাকে দলের ক্যাপ্টেন বানাবে বলেছে হেড স্যার।’
‘তাই নাকি, খুব ভাল কথা। যা এখন হাত-মুখ ধুয়ে নে তারপর কথা বলব।’
পিয়াস চলে যায়। ওর কথা চিন্তা করে ইথিকা। ওর যখন খেলাধুলায় এতো আগ্রহ তখন বাবাকে বলে কোন একটা ক্লাবে ভর্তি করে দেবে ওকে। সেই ক্লাবের পক্ষ নিয়ে খেলবে। ভাল কোচ পাবে। উন্নতি করবে খেলায়।
ঘরে ঢোকে শিমুল।
‘কিরে আপু তুই কখন। দুষ্টুমনি রাহাটা কোথায়, দেখছিনা যে।’
‘ওকে আনিনি।’
‘কেন? ও থাকলে দিনটাই অন্যরকম হয়ে যায়! কোথা দিয়ে সময় চলে যায় বোঝাই যায় না! আনন্দময়ী ছেলে একটা। কেন আনিস নি বলত?!’ একটু অভিমান ঝরে পড়ে কণ্ঠে।
‘এমনি। যাক ওর কথা। তোর কথা বল। তুই নাকি বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিস?’
‘হ্যাঁ, পরশু যেতে বলেছে। চেষ্টা করছি, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।’
‘হবে তো।’
‘দেখি চেষ্টা করে। তাছাড়া হলেও তো টাকা লাগবে!’
‘টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে; টাকার জন্য টেনশন করিস না।’
ওরা বন্ধুর মতো। একজনের মনের কথা, দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনার কথা না বলে থাকে না। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ইথিকা যেন দূরে সরে গেছে ওর কাছ থেকে। ওর কাছে লুকিয়ে রাখে সব কথা। এটা কি ঠিক, ঠিক নয়। অনেক দিন ভেবেছে শিমুল, ইথিকাকে বলবে কেন এভাবে পর করে দিচ্ছিস আমাদের। আমরা কী তোর পর? বিয়ে হয়ে গেলে কি মেয়েরা এমন পর হয়ে যায়! দূরত্ব বেড়ে যায় ভাই-বোনের। আলগা হয়ে যায় বাঁধন। শিমুল ওর দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। কি যেন ভাবে একমনে। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলে, ‘রাহাকে আনলে ভাল করতিস আপু। অনেক দিন দেখি না ওকে। তাছাড়া তুই থাকবি এখানে, আর রাহা একা একা ওখানে। তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না ও। তার চেয়ে নিয়ে আসি ওকে।’
‘না না-’ ব্যস্ত হয়ে ওঠে ইথিকা।
‘না কেন? আমি যাবো। দেখি গিয়ে রাহা এখানে আসলে কী এমন অসুবিধা।’
‘অসুবিধা নয়, তবুও।’ শিমুল শোনে না ওর কথা। বের হয়ে যায়। দরোজা খুলে বের হতে হতে বলে যায় মাকে। ‘মা, রাহাকে আনতে যাচ্ছি আমি।’
ইথিকা চুপ করে পড়ে থাকে বিছানায়। ওর উঠতে ইচ্ছে করে না। মনে পড়ে রাহার কথা। রাহা ছোট্ট একটি নাম। অথচ ওই নামটা ওর বুকের মধ্যে অনুরণন তোলে। নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে রিনরিন করতে থাকে যেন আনন্দ-ভায়োলিনের সুর।
রাহা কি করছে এখন। খেতে দিয়েছে কি কেউ। নাকি দেয়নি। দেবে না কেন? দিয়েছে। নিজের মনেই ভাবে ছেলের কথা। ভাবতে না চাইলেও ভাবনা চলে আসে। মানুষের মন বড় অগম্য ধন! মনের পথঘাট,অলিগলি,সড়কের ভাব বোঝা বড় শক্ত ব্যাপার! অনেক সময় পথ খুঁজেও পথ পাওয়া যায় না! পেলেও মনে ধরে না!
রাহা, ওর রাহা কী করছে এখন! ওকে তো দেখতেই দেয় না রাহাকে। রাহার সব তো করে দাদা, দাদী, ফুফু, চাচা। তাছাড়া কাজের মেয়েও আছে একটা। রাহার তিন চাচা দুই ফুফু। ফুফুদের একজনের বিয়ে হয়েছে, অন্যজনের এখনও হয়নি। বড় ফুফু তো রাহার জন্মের পর থেকেই চোখের কাছে কাছে রাখে ওকে। ছেলে নেই তার। এক মেয়ে। হাসপাতালে রাহার জন্মের সময়ই বলেছিল, ‘ছেলেটাকে দাও আমাকে ইথিকা।’ ইথিকা কথা না বলে হেসেছিল মিষ্টি হাসি। বারবার একই কথা বলাতে বলেছিল,
‘ছেলে তো আপনাদেরই। আমার তো একলার নয়।’
‘তা তো ঠিকই। তবু যদি স্ট্যাম্পে লিখে দিতে ভাল হতো।’
‘কি যে বলেন আপা। লেখা হোক বা না হোক ও ছেলে তো আপনাদেরই!’ কিন্তু বুঝতেই পারেনি যে ঐ কথা জীবনের কাল হয়ে দাঁড়বে! ও বুঝতে পারলে আর না পারলেও ঐ মুখের কথাই কাল হয়েছে শেষ পর্যন্ত! ছেলে এখন ওর নয়, ওর ননদ, শরীফার। আর ছেলেও হয়েছে তেমনি। সকালে উঠেই দৌড়ে চলে যায় দাদুর কাছে। দাদু হাত মুখ ধুইয়ে দিয়ে একসঙ্গে চা-বিস্কুট খেয়ে চলে মেয়ের বাড়ি। ছেলেকে নিজের কাছে পায় না কখনও; অফিস যাওয়ার সময়ও পায় না কাছে, এসেও না। সকাল বিকাল রাতে কোন সময়ই ওর কাছে থাকে না রাহা।
রাহাকে রাখতে চাইলেও রাখতে পারে না ইথিকা। শরীফা বলে, তুমি তো বলেছিলে, রাহা আমার! এই কথার জবাবে কিছু বলতে পারে না ইথিকা। বললেই শুনতে হয়, ‘বউ, যা বলেছিলে তা কী কেবল কথার কথা, তাহলে স্ট্যাম্প আনি, লিখে দাও!’ ঐ একটি কথা ‘ছেলে তো আপনাদের’ ওর জীবনের অপত্য স্নেহের আলো নিভিয়ে দিয়েছে! ওর আকাশে কোন চাঁদ নেই, চাঁদের হাসি নেই। হাওয়ায় কোন সুর নেই, জলে কোন বহতা নেই! সব স্থবির! আশ্চর্য ছেলে ওর, ও ছেলের মা অথচও যেন কেউ না ওর। দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে যায় মন। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে বিষাদের হাসি। প্রাণের ভেতর কষ্টের বাঁশি বেজে যায়! কিন্তু কিছুতেই মানতে পারে না ইথিকা। না হয় বলেইছে ছেলে আপনাদের, তাই বলে ছেলে কি তার হয়ে গেল! ওর কাছে আসতে দিবে না! এই ব্যাপারটার কোন কুলকিনারা পায় না ইথিকা ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ও বুক চিঁরে বের হয়ে মিলিয়ে যায় ঘরের বাতাসে। ‘হায় রে কথা, মুখের কথার মূল্য আছে তা জানে ইথিকা; আর কথা দিলে রাখতে হয় সেটাও জানে ইথিকা! তবুও কথা একটা থেকেই যায়। সব কথাই ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে! ওর এই কথা দেওয়ার বিষয়টা জানে শুধু ওর কয়েকজন বন্ধু। এই কথা দেয়ার বিষয়টা মানতে পারে না ওরা। ওরা সব সময় বলে, ‘তুই এমন কেনরে ইথি।’ ওদের কথার কোন জবাব নেই ইথিকার কাছে। কেন এমন করে; ওর মনটা কেন এমন! ইথিকার এলোমেলো ভাবনায় ছেদ পড়ে মায়ের ডাকে।
‘ইথিকা আয়।’ চা খেতে ডাকছে মা। মায়ের ডাক উপক্ষো করতে পারে না ইথিকা। জবাব দেয়। ‘বাবা আসুক মা। একসঙ্গে খাবো।’ ‘চা বানিয়ে ফেলেছি বাবা।’ ওর মা বেশিরভাগ সময় ‘বাবা’ সম্বোধন করেন। মা বলেন, ছেলে আর মেয়েতে তো কোন তাফাৎ দেখতে পাই না আমি। ছেলে আর মেয়ে জন্ম দিতে একই রকম কষ্ট, বড় করে তুলতেও একই রকম! ইথিকা মায়ের ভাবনা বুঝে আর তার কদরও করে। বেশিরভাগ সময় কষ্ট দিতে চায় না। মায়ের কোন বিষয়ে মনঃকষ্ট হোক তা চায় না কখনও। খুব নরম সুরে বলে মা-কে,
‘দাও না ফেলে মা। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘নষ্ট হবে যে ইথি।’
‘হোক না নষ্ট মা, এক কাপ চাই তো। এক কাপ চা নষ্ট হলে কিছু হবে না মা।’ এক কাপ চা নষ্ট হওয়া তো কোন ব্যাপার নয়। এক নিমেষে মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবনের কতোকিছু, আর এতো শুধুই চা। ওর মনের কথা বুঝতে দেয় না মাকে। কষ্ট দিতে চায় না মাকে।
Facebook Comments Sync