দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা পর্ব ৭

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় আফরোজা অদিতি

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 সকাল সাড়ে আটটা।

রুমাল, মানিব্যাগ খুঁজছে তমিজ। আজকের আগে এগুলো সবসময় হাতের কাছে তৈরি পেয়েছে ও। ইথিকা নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুছিয়ে দিয়েছে ওরটাও। সবসময় তৈরি জিনিস হাতের কাছে পেয়ে পেয়ে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ওর। আজ অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটায় রাগ হচ্ছে । মানিব্যাগ, রুমাল খুঁজে না পেয়ে ডাকে কাজের মেয়েকে।

:হাসুনি এ হাসুনি। হন্তদন্ত ছুটে আসে হাসুনি। হাতে ডিম সিদ্ধ। রাহার জন্য। 

:ভাইজান ডাকছেন?

: আমার মানিব্যাগ রুমাল কলম দে।

হাসুনি ওগুলো ড্রয়ার থেকে বিছানায় রেখে বলে,

: নাস্তা খাইবেন না ভাইজান? 

: না।

 না খেয়েই বের হয়ে যায় তমিজ। পেছন থেকে ডাকে মা।

:খোকা, ও খোকা।

 ফিরে তাকায় না তমিজ। যেতে যেতেই বলে,

: আমি খাব না। তোমরা খেয়ে নিয়ো।

 ছেলে না খেয়ে গেল। মায়ের মন টনটন করে। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে বউ-এর ওপর। গজগজ করতে থাকে মা।

: কী বউ আনছে। আর বউরে শাসন করতে পারে না, আমাদের ওপর রাগ দেখায়।’ বিয়ের পরে এতোটা বছর হয়ে গেল,  রাগ যায়নি মায়ের। ইথিকার ওপর রাগ। বিধবা মেয়ে এইজন্য রাগ; ছেলে তাদের অমতে বিয়ে করেছে তারজন্য রাগ। বউ বাপের বাড়ি যাওয়াতে রাগ! বাপের বাড়ি কাছে তাই এই অবস্থা; কথায় কথায় বাপের বাড়ি! তার সময় তো বাপের বাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই আসতো না। কত মার খেয়েছে, বকুনি খেয়েছি তবুও এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা মনেই আসেনি। বাপের বাড়ি যদি থাকবি তবে বিয়ে করা কেন বাপু?

 একটু চুপ করে থেকে আবার শুরু করে তমিজের মা।

 : মেরেছে বেশ করেছে। একটু চা-ই না হয় শরীরে পড়েছে, তাতে কি শরীর ক্ষয়ে গেছে। ওইটুকু মাইরে কি কিছু হয়? হয় না। বেঁধে মারল না কেন তমিজ।

 মা নিজের মনেই বলে, ছেলেটা একটা বোকার হদ্দ! যেমন বোকা তেমনি বউয়ের আঁচল ধরা! হাসুনির কাছে শোনা কথাগুলিই আবার ভাবে। তমিজ মেরেছে। মনে মনে খুশিই হয়। শাশুড়ি কাজ করছে আর একা একাই গজ গজ করছে। মেরেছে বেশ করেছে। একবার ঘর ভাঙা মেয়ে কি কখনও সংসার করে? করে না। সংসার করা দেখে মনে হয়, এটা ওর সংসার না, কেউ ধরে বেঁধে সংসার করাচ্ছে ওকে। শাশুড়ির রাগের কারণ আছে আরো। অফিসে থাকার সময়টুকু ছাড়া এ সংসারের যাবতীয় কাজ সামলিয়েছে ইথিকাই। বউ না থাকাতে এখন সব কাজ সামলাতে হচ্ছে শাশুড়িকে। কাজ করতে হচ্ছে, ছেলে না খেয়ে গেল সব কিছুর রাগ গিয়ে পড়েছে বউ-এর কাঁধে। এই সমাজ সংসারে এটাই নিয়ম! বউ হলেই তার কোন নিজস্বতা থাকতে নেই, থাকতে নেই কথা বলার অধিকার। বউ হলো গৃহপালিত প্রাণি। 

:ভাইজান নাস্তা খায়নি, আম্মা?

 হাসুনির কথাগুলি বেসামাল করে দেয় শাশুড়িকে আরো। চিৎকার করে ওঠে।

: খায়নি তো আমার মাথা কিনেছে। তেজ দেখায়। আরে তেজ কি খাবারের পর। বউ-এর পরে দেখা, তবেই না বুঝবো বাপের ব্যাটা, পুরুষ মানুষ। পুরুষ ছিল ওর বাপ। চোখের দিকে তাকাতে ভয় পেতাম। তরকারিতে নুূন হল কিনা চাইতাম দশবার। কোন ভুলে কি হয় সবসময় ভয়ে কাতর থাকতাম। এত সামাল দিয়ে থেকেও রক্ষা পাইনি কখনও সখনও।

তখনতো খড়ির চুলায় রাঁধতাম। একদিন তো ভাত রাঁধতে দেরি হওয়ায় চুলা থেকে আগুনমুখো খড়ি দিয়ে ছ্যাকাই দিল পিঠে। কথাগুলো মনে হতে বিষণ্ন হয়ে যায় শাশুড়ি। কান্না পায়। চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় অতীতে। বাবা মা ছিল না। ভাই এর সংসার। ছেলে-মেয়ে ছয়জন। এদের ছেড়েও যেতে পারতো না, আর এতগুলো বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অন্যের সংসারে যেতেও পারতো না কখনও। তাই স্বামী সুযোগ নিয়েছে। 

: কান্না কইরেন না আম্মা। সান্ত্বনা দেয় হাসুনি।

: নারে কাঁদবো কেন। ওর বাপ যে কেবল মেরেইছে তাতো নয়। যেদিন মেরেছে, সেদিনই এনেছে মিহিন শান্তিপুরি একসঙ্গে তিনটা, কখনও ছয়টাও।

 

 তারপর এই মারামারি থেমেছে তার চাকরি যাওয়ার পর।

তখন তো বলার মুখ নেই তার। ছয় ছয়টা ছেলে-মেয়ে নিয়ে সব ভোগান্তি তো তাকেই পোহাতে হয়েছে। জামা-কাপড় সেলাই, কাঁথা সেলাই, হাঁস মুরগী লালন পালন করে চালিয়েছে এই সংসার। মানুষ করেছে ছেলে-মেয়েকে।  এতো কষ্ট করে যে ছেলেমেয়ে মানুষ করেছে, গুছিয়েছে যে সংসার, সেই সংসার, সেই ছেলে যাবে অন্যের দখলে! না, তা কখনও হবে না, হবে না হবে না।

  শাশুড়ির না খাওয়ার সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। এই তমিজকে না খেয়ে খাইয়েছে, মানুষ করেছে, সে কিনা তার বিনা অনুমতিতে বিয়ে করলো এক ধিঙ্গি বিধবাকে। আবার বিয়ে করা বউকে সামালও দিতে পারে না। আরে ওর তো খুঁত আছে। ওতো তোর কথায় উঠবে আর বসবে। আর গাধার বাচ্চা পয়লা রাতেই যদি না নাচাতে পারিস তাহলে কি আর নাচে? নাচে না। এখন কথায় কথায় যায় বাপের বাড়ি। বিয়ের মাস খানেক পরেই তো চলে গিয়েছিল বাপের বাড়ি। কি না কি বোনকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। ন্যাকামি যতো! তখন অবশ্য বলেই গিয়েছিল তমিজকে। তমিজকে বললেই হবে। এ বাড়িতে কি মানুষ নেই আর। আমরা কি মানুষ না! বাড়ির সবার কাছে পারমিশন নিতে হবে! না বলে গিয়েছে, আর আমিই কী কম যাই! যেমন বলে যায়নি তেমনি কাপড়-চোপড়সহ স্যুটকেস দিয়েছি আটকিয়ে, দিইনি।

ভাই পাঠিয়েছিল কাপড়- চোপড় নিতে।  দিইনি। শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা স্যুটকেস দেখেছিল তার ভাই। ভাই দেখেও গিয়েছিল শেকল বাঁধা স্যুটকেস। আশ্চর্য মেয়ে! একমাস ছিল বিনা কাপড়-চোপড়ে। মনে মনে জয়ের হাসি হাসে শাশুড়ি। 

 

‘দেমাগ।’

: কার দেমাগ মা?

 মেয়ে শরীফা। অফিস যাওয়ার পথে মেয়েকে দিতে এসেছে মায়ের কাছে। বিপাশা, শরীফার মেয়ে। স্কুলে যাবে সামনের বছর। শরীফা চাকরি করে ব্যাংকে। সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। ওর স্বামীও ব্যাংকে। সাসপেন্ড হয়ে আছে। সেন্ট্রাল স্টেশনারিতে ছিল। স্টেশনারির মাল চুরির অভিযোগে সাসপেন্ড। এন্ট্রি করাপশনে কেস চলছে এখন। শরীফার স্বামী, বিরাজউদ্দীন লোক হিসেবে ভাল। কিন্তু কেমন করে এ কেসে জড়িয়ে গেল তা কেউ বলতে পারে না, সে নিজেও নয়।

    সব সময়ের জন্য কাজের লোক পাওয়া যায় না। একটা ঠিকা ঝি আছে। তাছাড়া কাজের মানুষের ওপর সব সময় ভরসা করা যায় না, করতে পারে না শরীফা। বিপাশাকে রেখে যায় মায়ের কাছে। এটুকু সুবিধার জন্যই মায়ের বাসার কাছে বাসা নেয়া।

:আয় বিপাশা। নানি ডাকে।

: নাস্তা খেয়ে নে।

: রাহা কোথায় মা?

: তোর বাপের সঙ্গে গেছে বাইরে। আজ কেবলই মা মা করছে। কেন যায়নি তোর ওখানে?

: গিয়েছিল সকালে। কিন্তু থাকলো না।

: রাহাকে না দিয়ে কি খারাপ করলাম শরীফা? যে গাছের যে ফল।

: কেন মা, তোমার একথা মনে হচ্ছে কেন?  বড় ভাল করেছ। একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। তাছাড়া ওই রাহার জন্যই সুড়সুড় করে চলে আসবে তোমার বউ।

 মাকে উসকিয়ে দিয়ে যায় মেয়ে। 

:আমি যাই মা। তমিজ কি অফিসে গেছে?

: হ্যাঁ।’

মেয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে আসে। মায়ের কাছে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,

 : তুমি ভুল করেছো কখনও মনে করো না মা। রাহা আমাদের বাড়ির ছেলে, ওর কেউ না। বাড়ির ছেলে বাড়িতেই থাকবে। কয়েকদিন কান্নাকাটি করবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি না মা। শরীফা চলে যায়। 

   শরীফা খুব ভাল আছে। মা খুশি। মেয়ে চাকরি করছে। নিজের উপার্জন নিজের। স্বামী মেয়ে নিয়ে সংসার। মা খুশি এজন্য মেয়ের শ্বশুরকুলের কোন আত্মীয়-স্বজন এসে থাকে না কখনও। শরীফাও যায় না। যাবে কেন? শরীফা যে হাতের মুঠোয় রাখতে পেরেছে স্বামী। হাত তুলে শোকর গুজার করে আল্লাহর কাছে। মেয়ে আরও সুখে থাক। মেয়ের জন্য দোয়া করে। আমিন বলে মুখে হাত বুলিয়ে চুমু খায়।

আমিন বলে মুখে হাত বুলিয়ে চুমু না খেলে কোন দোয়াই কবুল হয় না। মা তাই মনে করে।

: আম্মা, ভাত কি চুলায় দিমু? হাসুনি পাতিল হাতে দাঁড়ায়।

সুখের বাতাসে কাঠি দেয় হাসুনি। শাশুড়ি রেগে যায়।

: এতো তাড়াতাড়ি ভাত চুলায় দেয়ার কি হল। পরে দিবি যা।

: ভাবী, কবে আইবো আম্মা?

: কি জন্যে?’

:ভাবী একটা ওষুধ দিব কইছিল।

: কিসের ওষুধ?

: প্যাটের ব্যথার।

: ও আবার ওষুধের কী জানে। ওকি ডাক্তার। আর কথায় কথায় তোর পেটে ব্যাথা হয়, কেবল কাজে ফাঁকি দেয়া, যা কাজ কর।’

     অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আজ একটু অন্যমনস্ক হচ্ছে তমিজ। ওর শাশুড়ি ফোন করেছিল। ওখানে কেন ইথিকা?  কেন তমিজ শ্বশুর বাড়ি যায়নি এতদিন; ঝগড়া হয়েছে নাকি দু’জনের মধ্যে! রাহা কেন এলো না সেদিন। এতো সব কথার জবাব দিতে পারেনি তমিজ। কি জবাব  দেবে? শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে খারাপ ভাবমূর্তিতে উপস্থাপিত হতে চায়না ও। এ কাজ, সে কাজ অনেক কাজের কথা বলে শেষে শাশুড়িকে কথা দিয়েছে, যাবে আজ।

     অনেকদিন পর মনে পড়ে ইথিকাকে। ওর সঙ্গে ও রকম ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। কিন্তু কি করবে হঠাৎ রাগ চড়ে গেল। কি নিয়ে রাগ হয়েছিল। ঠিকই তো বলেছে ইথিকা। রাহার জন্য কিছু করাতো উচিত। রাহা তো ওরও সন্তান। আজ যাবে শ্বশুরবাড়ি।

যা হোক করে রাজী করাতে হবে ইথিকাকে। রাহা কান্নাকাটি করছে। মা মা করছে থেকে থেকেই। ছোট মানুষ বলতে তো পারেনা,  তবে এ ঘর ওঘর ও খুঁজে বেড়াচ্ছে ইথিকাকেই। তমিজের এতদিন লজ্জা লেগেছে আবার ভয়ও করেছে, ইথিকা সব যদি বলে দিয়ে থাকে। নাহ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে। ইথিকা বলেনি কাউকে। শ্বশুর খুব রাগি মানুষ। শুনলে আবার কি না কি করে বসে তার ঠিক তো নেই। রিকশায় যেতে যেতে ইথিকার কথা ভাবে তমিজ। আসলে ইথিকাকে আনতেই চাইছিল তমিজ কিন্তু ইথিকার কাছে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।

    আসলে একা থাকতে পারছে না। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। তখন শরীর চায় ইথিকাকে। সত্যি কি ইথিকাকে? নিজেকেই প্রশ্ন করে তমিজ। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরে, পেয়েও যায়। নাহ ইথিকাকে নয়! চায় একটা শরীর, মেয়ে মানুষের শরীর। আর এই শরীর সে বউ ছাড়া আর কোথায় পাবে? অন্য মেয়ে মানুষ পাওয়া যায়; তবে বদনামও আছে, আবার টাকাও লাগে! টাকা দিলে অবশ্য বদনাম চাপা পড়ে যাবে কিন্তু অতো টাকাই তো নেই ওর। টাকা যদি থাকতো তবে কি আর আজ রিকশায় চেপে যেতে হতো এই রাস্তায়। নিঃশ্বাস ফেলে তমিজ। নাহ, টাকা ওকে করতেই হবে। অনেক টাকা। অঢেল, বিস্তর।

 শ্বশুর, শাশুড়িকে ছালাম করে তমিজ। অফিস ফেরত এসেছে জামাই, মরিয়ম বেগম চা নাস্তার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছেন। রাতের খাবারও। ওদের সঙ্গে কথা বার্তার পর ইথিকার ঘরে ঢোকে তমিজ।

অফিস থেকে এসে শুয়ে ছিল ইথিকা। তমিজের আসার খবর পেয়েছে কিন্তু ওঠেনি। তমিজ ওর পাশে এসে বসে।

ইথিকা কথা বলেনা। পাশ ফিরে শুয়েই থাকে। একটু ঘনিষ্ঠ হয় তমিজ। : ইথিকা মাফ কর আমাকে। ভুল হয়ে গেছে আমার। বাড়ি চল।

: কিসের ভুল। তোমাদের তো ভুল হয় না।

:  সরি মাফ করে দাও।’ আরও একটু ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে ব্যর্থ তমিজ বলে, 

: দেখ হঠাৎ রাগ হয়ে গেল কি বলব। প্লিজ ইথিকা’

দুই হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করে তমিজ। সেদিকে তাকিয়ে থাকে ইথিকা। উঠে বসে, খাটে হেলান দেয়।

ভাবে, তমিজের এ নতুন ঢং। এ ঢং তো আগে ছিল না। ও একটু অবাক। নতুন আবার কি চাল চালবে এই সংসার নামের দাবার কোটে। ইথিকার ভাবনাটা সত্যি হয়ে গেল পর মুহূর্তেই। মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়ল তমিজ।

 : আমার জন্য না হোক, রাহার জন্য চল।

 কিন্তু নাছোড়বান্দা ইথিকা।

 : রাহাতো আমার নয়।

: ছি: একথা বলে না। এবার বাড়ি গিয়ে বলব আপাকে।

: কি বলবে?  আমি রাহাকে দেব না। রাহা এখন থেকে আমার কাছে থাকবে, ওরা যেন রাহার কথা ভুলে যায়।

 ইথিকা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তমিজ ব্যস্ত হয়।

 :ইথিকা প্লিজ, প্লিজ।

ইথিকাকে খুব সহজে আনতে পারতো না তমিজ। ইথিকা নিজে থেকেই এসেছে। কারণ মা এখানে থাকা পছন্দ করছে না। বিকেলে মা অনেক কথা বলেছে। জবাব দেয়নি ইথিকা।

কী বলবে মাকে!  মা তো বিশ্বাসই করতে চায় না ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তমিজ। কিন্তু জানে ইথিকা,তমিজ কেমন মানুষ। কি ব্যবহার করতে পারে আর না পারে। মা বলে, ওতো ভাল ছেলে।  তাই মা, বোন, বাড়ির সকলে ওর ব্যবহারে লজ্জিত। মায়ের বিশ্বাসে আঘাত দিতে চায় না ইথিকা, তাছাড়া কী হবে বলে। তার চেয়ে যাক না জীবন এক ভাবে। যেদিকে বাঁক নেবে সেদিকেই চলবে জীবন!  

     বিকালেই বলে রেখেছিল তমিজ নিতে আসবে ওকে। কোন কথা যেন না হয়, চলে যাবে বলেছিল মা। ইথিকা মায়ের কথা অমান্য করেনি। চলে এসেছে। মাকে পেয়ে খুশি রাহা। মা মা বলে জড়িয়ে ধরে। কোলে নেয় ইথিকা। বুকের মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়ে ওর। আঁকড়ে ধরে ছেলেকে এমনভাবে যেন সমুদ্র জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে কূলহীন ওই একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন, খড় কুঁটো।

ছেলেকে নামিয়ে দেখা করে শশুর শাশুড়ির সঙ্গে। আড় চোখে শাশুড়ির পানের টেবিলের নিচে তাকায়।

না এবারে আর স্যুটকেস বেঁধে রাখেনি কেউ। বিয়ের একমাস পর যখন বাবার বাড়ি গিয়েছিল বোনের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তখন বেঁধে রেখেছিল ওর স্যুটকেস। সেদিন এ বাড়িতে আসতে বলেছিল তমিজ নিজেই। কাপড় নিয়ে আসবে কথাও দিয়েছিল কিন্তু পরে আর কাপড় নিয়ে যায়নি। ও বাড়িতে এসে দেখে স্যুটকেস টেবিলের পায়ার সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা। আজ স্যুটকেস বাঁধা নেই।

এ জীবন ভালো লাগে না ইথিকার। এই জীবনে ফিরে আসতে চায়নি তবুও ফিরে আসতে হল। ফিরে আসতে হল রাহার জন্য, ফিরে আসতে হল মা-বাবার জন্য। এ সমাজের জন্য। বাঙালি সংস্কারে স্বামীর ঘরই মেয়েদের ঘর। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরস্পরার কাছে হেরে গিয়ে ওকে ফিরে আসতে হল এই জীবনে।

( চলবে)

 

আফরোজা অদিতি