দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ৯) – আফরোজা অদিতি
অফিসে গুঞ্জন।
ফিসফাস, কানাকানি। ইথিকা-রাকিব। রাকিব-ইথিকা। ইথিকা বুঝতে পারে ওদের জড়িয়েই কানাকানি। এই কানাকানি মানে না রাকিব। কথা বলেই চলে ওর সঙ্গে; ইথিকা বলে কম। ইথিকার অবশ্য কম কথা বলাই স্বভাব। কেউ কথা বললে কথা বলে, না বললে যেচে কথা বলে না কখনও। রাকিব ওর গ্রামের ছেলে, পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছে সেই ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলেছে, মাঠে মাঠে ঝোঁপ-ঝাড়ে বনফুল তুলেছে, কখনও বৃষ্টিতে ভিজেছে। এখন রাকিবের সঙ্গে কথা বলতে ভালোলাগে, তাছাড়া রাকিব এসে কথা বলে ওর সঙ্গে, ও যদি ওর সঙ্গে কথা না বলতো, কথা বলতো না ইথিকাও।
কোন কথায় কান দেয় না ইথিকা; একমনে কাজ কর।, ওর টেবিলে কাজ বেশি। শেষই হতে চায় না কাজ। এ ছাড়াও আছে ক্লিন ক্যাশ মেলানোর ঝামেলা। ও ক্লিন ক্যাশ মিলে গেলে দাঁড়ায় না একদন্ড। চলে যায় বাসায়। আজও কাজ করছিল ইথিকা। পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেল। কে লিখল চিঠি। বাবা মা ভাই সকলে তো এখানেই। তবে…. ভাবতে ভাবতেই খুলল চিঠি। চিঠি পড়ে রাগ হয়ে যায় ওর। একবার দুইবার তিনবার। উঠে যায় রাকিবের টেবিলে। চিঠি সামনে রেখে কথা না বলেই চলে আসে।
একটু অবাক রাকিব।
চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে পড়ে সময় নিয়ে। এসে দাঁড়ায় ইথিকার টেবিলে। অাজও ভুল বানানে ভরা বেনামী এক চিঠি। সান্ত্ব¦না দেয় ইথিকাকে।
‘এই চিঠির জন্য রাগ করতে নেই ইথিকা। এসব নোংরা চিঠি কি লিখতে পারি আমি তুমিই বলো।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাকিব বলে, ‘কে লিখল বলতো। এগুলো ওই পিয়নদের মধ্যে কারো কাজ।’ ওর কথা শুনে খুব রাগ হয় ইথিকার। বলে, ‘পিয়নরা সব তো তোমার পেয়ারের লোক । তাহলে তোমার বিরুদ্ধে কেন লিখল বলতো।’
‘ওরা কারো পেয়ারের হয়না ইথিকা। এখানে সকলে স্বার্থপর। আমি ওদের দুই পাঁচ টাকা দেই বলেই কথা বলে আমার। দেওয়া বন্ধ করলেই আর আমার কথা বলবে না ওর।, এটাই নিয়ম।’
ইথিকা চুপ করে শুনল ওর কথা। তারপর বলল, ‘রাকিব তুমি কি চাও বলোতো।’
‘আমি তোমাকে চাই ইথিকা। তোমাতে চাই, তোমাকে চাই জন্ম জন্মান্তর আমি তোমাকে চাই।’
ওর কথায় অবাক বিস্মিত হয়ে যায় ইথিকা। এভাবে মুখের ওপর এমন কথা এত সহজভাবে উচ্চারণ করতে পারে কেউ তা ওর কল্পনায়ও নেই। ও কথা বলার ভাষা হারিযে ফেলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘না এখান থেকে চলে যেতেই হবে আমাকে।’
‘না না যেয়ো না। তোমাকে না দেখলে আমি মরে যাবো ইথিকা।’ আর্তনাদ বের হয় কন্ঠ চিঁরে ওর। চোখ ছলছল। সেদিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় ইথিকা। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
‘তুই এখানে চাকরি করিস না প্রেম করিস।’ তমিজ কখন এসেছে ওরা জানতেও পারেনি।
‘এটা অফিস তমিজ সাহেব।’ তমিজকে থামাতে চেষ্টা করে রাকিব।
‘তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে নাকি কোনটা অফিস কোনটা অফিস নয়; কোনটা মাঠ কোনটা মাঠ নয়, কোনটা বাড়ি কোনটা বাড়ি নয় তোমার কাছে শিখতে হবে আমাকে!’ তমিজ এক নাগাড়ে চিৎকার করে বলে যায় আবোল-তাবোল। অপমানে ওর মাথা নিচু হয়ে যায়; ওর এখন কোথাও লুকাতে ইচ্ছা করছে। অফিসের লোকজন যে হাঁ করে তামাসা দেখছে সেটাও বোঝে না তমিজ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ইথিকা। ওদিকে চিৎকার করতে করতে হাত ধরে টানতে টানতে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে তমিজ।
‘এখানে আর না। তোমাকে যদি ট্রান্সফার না করেছি তবে আমার নাম তমিজ না।’
ইথিকা চাচ্ছিল ট্রান্সফার। কারণ দিন দিন রাকিবের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিল ও। তমিজের খারাপ ব্যবহার ওর জীবনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তা পূর্ণ হচ্ছিল রাকিবের ব্যবহারে। রাকিব ওর ব্যবহারে ক্রমশ তমিজকে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছিল নিজের। এই জায়গা করতে দিতে চাচ্ছিল না ইথিকা। যত বাধা দিচ্ছিল ইথিকা ততোই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল রাকিব, সরে যাচ্ছিল তমিজ।
দুই দিন পর অর্ডার এসে যায় হাতে। নিউমার্কেট। হাতে চাঁদ পায় ইথিকা। ওর এখানে লজ্জা করছিল থাকতে। তমিজের ব্যবহারে ওর মনে হচ্ছিল ও একটা পণ্যস্ত্রী শ্রেণির মেয়ে। ঘেন্না হচ্ছিল নিজের ওপর। ছি ছি ছি। কতোবার যে নিজেকে ছি ছিক্কার করলো ইথিকা তার ইয়াত্তা নেই। ওদিকে ওর বদলীর অর্ডারে বিচলিত রাকিব। ওর মনে কষ্টের তোলপাড়। চলে যাচ্ছে ইথিকা। হতাশ বিহবল, কথা নেই ওর। ইথিকার রিলিজ হওয়ার আগের দিন এলো কাছে।
‘সত্যি চলে যাবে তুমি? না গেলে হতো না।’ একদম ছেলে মানুষের মতো কথা বলল রাাকিব।
রাকিব মাথা নিচু করে। চুপচাপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘ইথি, রাগ করেছ কি আমার ওপর।’
‘না।’
‘একটা কথা রাখবে। আজ চল বসি কোথাও।’ ইথিকার নিজের মধ্যেও কষ্টের তোলপাড় চলছিল। ওকে ছেড়ে থাকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না ওর। রিলিজের সময় যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই আনন্দের চাঁদটা ডুবে যাচ্ছে মনের ভেতরে। ওর একটু কাছাকাছি হতে ইচ্ছা করছে। রাকিবে কথায় রাজি হয় ও। ওরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে বসে। বাদাম কেনে রাকিব। টুকটাক বাদাম ভাঙার শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই বাতাসে। দুপুর। ওরা দুপুরেই এসেছে। কথা হয়েছে এখান থেকে ইথিকা বাসায় যাবে আর রাকিব ফিরবে অফিসে।
‘কেন ডেকেছ বল।’
‘কী বলবো ইথি। আমার সব শেষ। তুমি চলে যাচ্ছ, আমার সব অন্ধকার। আমার কাছে যে আনন্দের সমুদ্র ছিল তা চলে যাচ্ছে দূরে। চর জমেছে আমার চারপাশে। বহুদূরের আমি এখন দুঃখাক্রান্ত এক মানুষ। ভূমি ধসের ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা এক লাশ।’
‘আজে বাজে বকো নাতো।’ ধমক দেয় ইথিকা।
‘দেখ রাকিব পাগলামী করো না এমন। আমার ছেলে,স্বামী আছে, আছে সংসার। এমন করে আমাকে দুর্বল করে দিয়ো না, দুর্বল হয়ো না নিজেও। আর একটা কথা, এই চাকরি ছেড়ে দিয়ো না আবার। একটানা কথা বলে দম নেয় ইথিকা। ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাকিব। চোখে বিস্ময় আনন্দ। ইথিকা সেদিকে তাকিয়ে হাসে একটু। সে হাসিতে লজ্জা মিশানো নরম চাঁদ এসে বাসা বাঁধে; সেই চাঁদের আলো উদ্বেল করে, আবেগি করে তোলে রাকিবকে। রাকিবের চোখে মুখে ঝরে পড়ে আবেগ। ওর উচ্ছল উজ্জ্বল আনন্দময় মুখটি দেখে আরও নরম কন্ঠে কথা বলে ইথিকা।
‘দেখ চাকরি পওয়া খুব কঠিন আজকাল। তুমি তো পাগলামী করো, আর পাগলামী করো না। বয়স হয়েছে তোমার, । এখন কিন্তু চাকরি ছাড়ার বয়স নেই আর।’ ওর কথায় হাসির রেখা ফুটে ওঠে রাকিবের ঠোঁটের কোণে। ওর এই হাসি দেখে যে কেউ বলতে পারে এমন হাসি যে হাসতে পারে সে সব কছিু করতে পারে, এমনকি জীবনও দিতে পারে!
‘এবারে উঠি চল। অফিসে যাবে তো তুমি।’ ইথিকা বলে।
‘না যাবো না।’ বললেও উঠে দাঁড়ায় রাকিব। একটা আংটি বের করে ইথিকার হাতটা টেনে পরিয়ে দেয় আঙুলে। তারপর হাত ধরে রেখেই বলে, ‘আমার স্মৃতি চিহ্ন। এটা তোমার বুকের কাছে থাকবে, মনে করবে এটা আমিই। আমিই থাকবো তোমার কাছাকাছি সবসময়।’
কথা বলে না ইথিকা। তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। এ কেমন পাগল মানুষ। এতো করে বোঝাই বুঝেনা কিছুই। ওর কি ভালমন্দ জ্ঞান হবে না কখনও। চোখ ছলছল করে ওর। চোখের জল লুকাতে চেষ্টা করে। চোখ এড়ায় না রাকিবের। রাকিব ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘আর কিছু বলতে হবে না ইথিকা। আমার যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। আমি চাকরি ছাড়বো না। আমি আজীবন আজকের এই চোখের জলটুকু নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো।’
ইথিকার বুকের ভেতর সাগরের উত্তাল ঢেউ ভাঙে। স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে মন। রাকিবের বুকে মুখ রাখে ইথিকা। রাকিব ওর ঘন চুলে মুখ ডুবিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দুহাতের তালুতে মুখ তুলে চুমু দিয়ে তুলে নেয় চোখের জল। বলে, ‘আজীবন তোমার চোখের জল তুলে নেব আমার ঠোঁটে।’ বেলা পড়ে আসছে। লোকজনের ঘোরা ঘুরি বাড়ছে ধীরে ধীরে। ছায়াচ্ছন্ন বিকেলে উদ্যানের কোন গাছ থেকে হঠাৎই একটা কোকিল ডেকে উঠল কু উ উ কু উ উ কু উ উ।
নিউ মার্কেট শাখায় এসেছে ইথিকা। কেউ সহজ ভাবে গ্রহণ করছে না ওকে। কেন গ্রহন করছে না তা যে বুঝতে পারছে না তা নয়। প্রথম প্রথম নতুন কোন জায়গায় গিয়ে আসন করে নেওয়া একটু মুশকিলের ব্যাপার। বেশিরভাগ মানুষই নতুনকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ওর ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। তখন ক্লাস নাইন। ক্লাস করছিল ওরা। মনোযোগ দিয়ে পড়া দাগ দিচ্ছিল। হঠাৎ হাসির হুল্লোড় উঠতেই মুখ তুলে তাকায়; কেন হাসছে বুঝতে সময় লাগে ওর। নতুন একটি মেয়ে এসেছে; ভর্তি হয়েছে। গ্রাম থেকে এসেছে। লম্বা জামা পড়েছে। ওড়না জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। ওদের হাসিতে মেয়েটি কোন অস্বস্তি বোধ করছে না, শুধু চুপ করে আছে।
ক্লাস টিচারের সঙ্গে পরিচয়ের পালা শেষ হয়। ওর নাম লতিফুন্নেছা। নামটাও সেকেলে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর জেনেছিল ওর দাদী নাম রেখেছিল ওর। দাদীর পছন্দকেই বহন করছে একালের মেয়ে লতিফুন্নেছা। পোশাক আর নাম দুই-ই হাসির কারণ হয়েছে কয়েকজনের! ওকে ওরা বসার জায়গাও দিতে চাইছে না। লতিফুন্নেছাকে ডেকে পাশে বসিয়েছিল সেদিন। লতিফুন্নেছার সঙ্গে পরিচয় গাঢ় হতেই বলেছিল একদিন, ‘তুমি কি এই নামটা নিয়ে বোর ফিল করো।’ সুন্দর হাসি হেসে বলেছিল, ‘না তো।’
‘আচ্ছা, তুমি তো ক্লাস নাইনে এখন নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। নাম পাল্টে দিতে পারো।’
‘নাহ্। আমার এই নামটা চেঞ্জ করতে বলছো! যদি চেঞ্জ করি তবে আমার দাদীকে অস্বীকার করা হবে। আমার পূর্বপুরুষকে কি করে অস্বীকার করি বল। ওদের কাছে তো আমাদের অনেক ঋণ।’
‘ঠিক কথা।’ ওর কথা শুনে ইথিকার মনে ওর জন্য অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কথাগুলি ওকে ভাবায়। আসলেই তো পূর্বপুরুষের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। জন্মের ঋণ, রক্ত-সংস্কৃতির ঋণ। সর্বোপরি আছে স্বাধীনতার ঋণ।
লতিফুন্নেছা এখন কোথায় কে জানে। অনেকদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা না হলেও ওর কথাগুলি স্পষ্ট মনে আছে ওর। ভাবনার ভেতরে ডুবেছিল। পিয়নের ডাকে চমকে ওঠে। ম্যানেজার সাহেবের খাস পিয়ন রহিম এসে জানায় ওকে। ‘ স্যার ছালাম দিয়েছে।’
ম্যানেজারের চেম্বারে গিয়ে ঢোকে। ছালাম দেয়। সিসি (ক্যাশ ক্রেডিট) ভাউচার আনেন। রহিমকে ভাউচার আনতে বলে। রহিম সিসি ভাউচার এনে দিলে নিয়ে যায় ম্যানেজারের কাছে। জমা ভাউচার লিখে ম্যানেজারের কাছে থেকে টাকা নিয়ে রহিমকে দেয় টাকা জমা দেওয়ার জন্য। ম্যানেজারের বন্ধুর এ্যাকাউন্ট। ম্যানেজার সাহেব নিজেই টাকাটা জমা দিতে পারতেন কিন্তু ওকে ডাকলেন। মেয়েদের চাকরিতে এমন বিড়ম্বনাও মাঝে মাঝে সহ্য করতে হয়। নারী এগিয়েছে অনেকটা দূর কিন্তু আজও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। একা কেউ যদি এই রকম ঘটনার প্রতিবাদ করে তবে মেয়েরাই বিপক্ষে যাবে; বলবে এতে হয়েছে কী? এটাও তো কা।, ঠিক এটা কাজ তবে ওই কাজ চেম্বারে না ডেকে পিয়নকে দিয়ে টেবিলে পাঠিয়ে দিলেই হয়ে যেতো। এসব নিয়ে কথা বলে না ইথিকা, তুমি একা একা কিছুই করে উঠতে পারবে না। এই সমাজ তোমাকে প্রচলিত কোন ব্যবস্থার বিপরীতেই যেতে দিবে না তোমাকে বাধা দিবে। নিজেই বলে নিজেকে।
ছুটির সময় বের হয়ে রিকশা নিতে যাবে ইথিকা। রাকিব দাড়িয়ে ফুটপাতে। ওকে দেখে এগিয়ে যায় ইথিকা। ‘কি ব্যাপার!’
‘কী করবো বলতে পারো। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও যাচ্ছে না ইথিকা।’
‘কেন এমন করছো রাকিব। ইচ্ছার লাগাম দিতে শেখ। জান আমার বিয়ে হয়েছে, স্বামী, ছেলে আছে। তবু এমন পাগলামী…’
‘পাগলামী নয়! তোমার স্বামী সংসার থাক, ছেলে নিয়ে চল আমার সঙ্গে।’
‘আশ্চর্য। তুমি পরকীয়ায় জড়াতে চাও আমাকে; আমি পরনারী।’
‘এসব কিছু জানি না ; শুধু জানি তুমি, তুমি আমার।’
রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। হাঁটছে ওরা।
‘বাসায় পৌঁছে দেই তোমাকে।’ হাঁটতে হাঁটতে বলে রাকিব।
‘আচ্ছা, তোমার কি ভয় লজ্জা কিছুই নেই। সেদিন তমিজ এমন ব্যবহার করল তার পরেও আবার।’
‘আমার লজ্জা ভয় কিছু নেই ইথিকা।’ দীর্ঘশ্বাস বের হয় রাকিবের বুক চিঁরে।
‘ভালবাসা তো লজ্জা জানে না ইথিকা। কথায় বলে না, লজ্জা, সংকোচ, ভয়/ তিন থাকতে প্রেম নয়।’ নিজের কথায় নিজেই হেসে সারা হয়। ওর হাসিতে রাগ হয় ইথিকার। রাগ ঝরিয়েই বলে, ‘তুমি যাও রাকিব।’
‘না যাবো না। চল চা খাই। আজ তোমার মুখ থেকে না শুনে কিছুতেই যাবো না। আজ দুজনে চা খাবো আর তুমি ভালবাসো আমাকে এই কথাটা বলবে মুখে, আমি শুনবো। বলতে হবে একথা। না শুনে যাবো না আমি। এক পা নড়বো না।’ দাঁড়িয়ে পরে রাকিব। ইথিকা না দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। রাকিব কেন এতো অবুঝ, কেন বুঝতে চায় না কিছু। রাকিবের কথাগুলো যেমন ভাল লাগে, তেমনি ভালোলাগে রাকিব; তেমনিতো ভালোলাগে সংসার! তমিজকে ভাল লাগে না ঠিক কিন্তু ভালো লাগে রাহা, তমিজের সন্তানকে। ওই সন্তানের জন্যই তো এই বেঁচে থেকেও মরণ ইথিকার; বয়ে চলেছে এই সংসারের ঘানি, এই জীবন। মেয়েদের এই এক সমস্যা সন্তান! সন্তানের জন্য সংসারে থাকতে হয়! স্বামীকে ভালো লাগুক না লাগুক সন্তানের জন্য সংসারে তাকে থাকতেই হয়। প্রতি রাতেই ধর্ষিত হয়েও থাকতে হয় তার শরীরের অংশ এই সন্তানের জন্য। কারণ এই সংসার থেকে চলে গেলে সন্তানকে দেওয়া হয় না মায়ের কাছে। সন্তানকে নিতে হলে কোর্ট কাছারির হাঙ্গামা পোহাতে হয়। যা পোহানোর শক্তি দেশের বেশির ভাগ নারীর মতো ওরও নেই। তাই সবকিছু সহ্য করে থাকতে হচ্ছে। এটা অবশ্যই ঠিক কাউকে যদি ভালো না লাগে তার সঙ্গে একত্রে বসবাস করাটা পতিত বৃত্তির সামিল। ভালোবাসাহীন সংসারে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা এক ধরনের পতিতাবৃত্তি।
একটা রিকশা নেয় ইথিকা। পাশে রাকিব। চুপচাপ ইথিকা। কথা বলে না। রাকিব ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে দোল খায় নীলকষ্ট। টলমল করে জল। ‘কথা বল ইথিকা। তুমি কি চাও না তোমার কাছে আসি আমি। যদি না চাও আসবো না আর। এই ঢাকা ছেড়ে চলে যাবো দূরে বহু দূরে।’ রাকিবের কথা শুনে ওর একটা হাত ধরে ইথিকা; হাতের স্পর্শে সমস্ত দুঃখকে শুষে নিতে চায় নিজের মধ্যে! দুঃখাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, ‘রাকিব মুখের কথাই কি বড় হলো; কথা ছাড়া কী আচরণে বোঝা যায় না কিছু।’ রাকিব ঐ বিষয়ে আর কোন কথা বলে না। হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশের রেস্টুয়ারেণ্টে ঢোকে। ‘চল চা খাবো এখানে। একসঙ্গে থাকি কিছুটা সময় দুজনে।’
‘না আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে। রাহা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিশ্চয়।’
‘ও।’ ইথিকার উত্তর শুনে শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করে চুপ হয়ে যায় রাকিব। ইথিকাও। দুজনের মনে দুই রকমের ভাবনা কাজ করে। রাকিব ভাবে ভুলে যাবে ইথিকাকে। কী হবে অন্যের সংসারে ঝরা পাতার মতো বিছিয়ে থেকে। ইথিকা ওকে চাইলেও আসতে পারছে না ওর কাছে। ওর সংসার, ওর ছেলেই সব! এখন অনেক ভাগে বিভক্ত ইথিকার মন। ভাগ করা ওই মনের মধ্যে ওর জায়গা কোথায়? ইথিকার মনে দোল খায় রাকিবের ভালোবাসার উন্মাদনা। ওর মাতাল ভালবাসা ইথিকার মন প্রাণ ছুঁয়ে হৃদয়ে জ্বালে আলো। ইথিকা হাজার প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ওর ভেতরে শুরু হয় দেয়ালী উৎসব! ইথিকাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে রাকিব বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
তমিজ আর রাকিব। দুজন পুরুষ। ওর জীবনের দুই দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পুরুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। দুইয়ের তুলনায় হেরে যায় তমিজ। রাকিব পুরোপুরি দখল নেয় তমিজের স্থান। একথা রাকিবের কাছে প্রকাশ করে না ইথিকা। একি বলার কথা। ওর ভাল লাগে ঠিক।
ভালোবাসেও। তবুও আছে সংসার, সন্তান; আর এই সন্তানের জন্যই আছে সন্তানের পিতা। ইথিকা রাকিবের ভাবনায় এতোটাই ডুবে ছিল যে রিকশা থামতেই চমকে ওঠে। তিনজন ছেলে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ওদের পথ আটকে দিয়েছে। চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। কিন্তু এ পথে! ইথিকা স্তম্ভিত। খেয়াল করেনি ইথিকা রিকশাওয়ালা যে এপথে নিয়ে এসেছে। এই পথে সাধারণত আসে না ও।
ওর পেটের ওপর পিস্তল ধরেছে একজন আর রিকশাওয়ালার বুকে ছুরি ধরেছে একজন। রিকশাওয়ালাকে কয়েকটা ঘুঁষিও মেরেছে ওরা। এই রাস্তা নির্জন। রাস্তার বাঁদিকেই গলি। ওই গলি দিয়েই ঢুকতে হবে। ঢোকার আগেই এই অবস্থা। গলিতে ঢুকতে চায় না ও। আজ খেয়াল না রাখাতে রিকশা ঢুকে পরেছে।
‘যা আছে দিয়ে দিন।’ ওদের একজন বলে।
‘কেন?’ বলে ইথিকা।
‘আমরা চাচ্ছি তাই।’
‘কেন চাচ্ছ।’ ইথিকার যেন ভয় নেই মনে। ও চিৎকার দিচ্ছে না। চিৎকার দেওয়ার কথা মনেও নেই ওর। ও স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলে যাচ্ছে এ যেন রাস্তায় চলতে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওর নির্বিকার ভাবের জন্য খেপে গেল ছেলে তিনটে। পিস্তল দিয়ে খোঁচা দিল পেটে।
‘দেখুন কথা বলবেন না। দিয়ে দিন। না হলে…’
‘না হলে……।’
কথা না বলে ইশারায় পিস্তল দেখিয়ে একটু জোরে ঠেলে ধরল পিস্তল। ইথিকা একে একে খুলে দিল সব কিছু।
ওর গহনা টাকা সব নিয়ে গেল এ নিয়েও ভাবছে না, ও ভাবছে এই সব ছেলেরা কেন এ পথে? এ কি সঠিক গাইড লাইনের অভাব নাকি বাবা মায়ের সময়ের অভাব। নাকি ব্রোকেন-ফ্যমিলির সন্তান! এখন উচ্চাভিলাষের যুগ, প্রতিযোগিতার যুগ। কে কাকে রেখে এগিয়ে যাবে, কাকে ঠকিয়ে কে বড় হবে, কে উঠবে উপরে, কার চেয়ে কে ধন সম্পদের দিক থেকে উচুতে থাকবে এই নিয়ে সবসময় ব্যতিব্যস্ত সকলে, সন্তানের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই বাবা-মায়ের। এছাড়াও আছে ছোট ছোট ঘর, ছোট সংসার। একান্নবর্তি পরিবার ভেঙে যাওয়ার ফলে সকলেই যার যার মতো নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। আর জীবন যাপনের কাঠিন্যের কারণে বাবা-মা দুজনকেই বাইরে কাজ করতে হয়। আরও আছে ক্লাব, পার্টি-সংগঠন। সন্তানেরা একলা সময় কাটায় বাড়িতে; ওদের সঙ্গী টেলিভিষণ আর টেলিফোন। আর কাজের বয়া। এই কারণে কী ছেলেরা এমন ছন্নছাড়া, ভবঘুরে, নেশাসক্ত! না কি দায়ী বাবা-মা পৃথক থাকার দরুণ মানসিক চাপ।
আসলে দায়ী কোন একটা বিষয় নয়; এইসবই সমাজের মূল্যবোধ ধ্বংসের জন্য দায়ী।
ইথিকার মনে পড়ে রাহার কথা। তমিজের সঙ্গে যে টানাপোড়েন চলছে, রাহাও কি হবে এদের মতো। নাহ্! তা হবেনা, হতে পারে না। যথেষ্ট সচেষ্ট ও। ‘কিছু কইলেন আফা।’
‘না চল।’ ও কিছু বলার আগেই রিকশা গলির মধ্যে ঢুকে গেছে। বাসায় পৌঁছে দেখে শুয়ে আছে তমিজ। টেবিলে ব্যাগ রেখে কাপড় বদলে নেয় ইথিকা। হাত মুখ ধুতে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করে। ‘রাহা কোথায়? চা খেয়েছো?’ কথা বলে না তমিজ।
‘কি হল উত্তর দিচ্ছনা কেন?’
‘কোথায় ছিলি।’
‘কোথায় আবার অফিসে। আমি চাকরি করি একটা।’
‘এতো বেলা পর্যন্ত অফিস হয়, আমাকে কী বোঝাতে চাস হারামজাদী।’
‘ দেখ অযথা বকাবকি করো না। ভালো লাগে না সারাদিন পর অফিস থেকে এসে এসব প্যানপ্যানানি শুনতে ভালো লাগে না।’
‘তা লাগবে ক্যান। ওই শালা হারামীর বাচ্চার কথা তো কানে লেগে আছে। আমার কথা শুনতে ভাল লাগবে ক্যান।’
ইথিকা কথা বাড়ায় না। জানে কথা বাড়িয়ে কোনই লাভ নেই। তাছাড়া এই রকম একজন মানুষের কাছে বলবে ওর কষ্টের কথা। বলবে হাইজ্যাকার ধরেছিল। বললেও কি বিশ্বাস করবে। করবে না। বলবে গহনা বিক্রি করেছে না হয় রাকিব কে দিয়েছে। যা ভেবেছে তাই। ও ব্লাউজ চেঞ্জ করতে গেলেই দেখে ফেলল তমিজ গলায় হারটা নেই। হারটা কি করলে। কথা বলে না ইথিকা। কথা বলছো না কেন? রাকিব শালারে দিয়েছ নাকি। ও মা চুড়ি, আংটি কিছুই নেই দেখছি। হাত তুলে, কানে হাত দিয়ে এমনভাবে দেখলো হাইজ্যাকার ধরেছিল বলতে রীতিমতো ঘেন্নাই করল ইথিকার। ও হাত মুখ ধুতে চলে যায় বাথরুমে। বুক ভেঙে কান্না আসে। যার জন্য এতো ভালোবাসা উপেক্ষা করছে, অবহেলা করছে ভালবাসার মানুষকে তার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার না পাক সৌজন্য আচরণ তো আশা করতে পারে, নাকি পারে না। কিন্তু ইথিকা সৌজন্য আচরণ কি একটু ভালো কথাও শুনতে পায় না; এখন তো শুনতে পায় না, আগেও পায়নি!
রাকিবকে কষ্ট দেওয়ার এই ফল। আর কষ্ট দেবে না রাকিবকে। ভাবে ইথিকা। বাথরুমে কাঁদে অনেকক্ষণ। এই কান্না রাকিবের জন্য এই কান্নার জলে মনের কোণে তমিজের জন্য যেটুকু মায়া অবশিষ্ট ছিল, অবশিষ্ট ছিল যেটুকু স্থান সেটুকু মুছে গেল, তলিয়ে গেল। নতুন এক মানুষ হলো ইথিকা। এ সংসারের মানুষ থাকলো ঠিকই কিন্তু এই সংসার আর নিজের থাকলো না। আগে যতটাই আপন ছিল, এখন ঠিক ততোটাই পর হয়ে গেল এরা, এ সংসারের মানুষগুলো। ইথিকার যন্ত্রণার সূত্রপাত হয়ে গেল এখানেই, এই মুহূর্তেই। ওর আদর্শের বিপরীতে হয়ে গেল যখনই তখনই মনে হল এ সংসারে থাকা চলে না আর! তমিজের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাও ঠিক না। এখানে এই সংসারে সব কিছুই ওকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করলো। খোঁচাতে শুরু করলো তীব্রভাবে। তমিজ এখন বেগানা, পর-পরুষ হয়ে গেল ওর চোখে। ওর দ্বৈত জীবনের সূত্রপাত হয়ে গেল এভাবেই। একদিকে ভালবাসা, অন্যদিকে ভালোবাসাহীন সংসার। সংসার ছাড়তেও পারছে না, ধরতেও পারছে না, আবার যেতেও পারছে না ভালোবাসার কাছে। এ এক বিচিত্র অনুভূতি!
Facebook Comments Sync