নসফেরাতু: এ সিম্ফোনি অফ হরর
নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে মার্স্টার্স করার সময় সবচেয়ে বিরক্তিকর যে কয়েকটি বিষয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল হিস্ট্রি অফ ফিল্ম। আর কোন কারণ নয়, দিনরাত স্যুটিং শেষে ১০০ বছরের পুরানো ফিল্ম দেখার শারিরীক বা মানসিক শক্তি থাকতো না। সেই ক্লাসেই বাধ্য হয়ে একের পর এক জার্মান এক্সপ্রেশনিসম ফিল্ম দেখা, আর সেজন্যই বহুবছর ধরে আমার লিস্টে জমে থাকা ফিল্ম ‘নসফেরাতু’ দেখা।
বাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ নিয়ে জার্মানির মত একটি শিল্পমনা দেশে যে ফিল্ম নির্মিত হয়েছিল লেখকের অনুমোদন ছাড়া তা বিশ্বাস করতে প্রথমে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। তবে জার্মান এক্সপ্রেশনিসমের সময়কাল নিয়ে বিস্তারিত লেখাপড়া করার পর বুঝেছিলাম যে, সেই সময় আসলে জার্মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সামর্থ ছিলো না গল্পটির অনুমোদন নেয়ার। ফ্রেঞ্চ আর ইতালিয়ানরা তখন শুরুই করেননি আর আমেরিকানরা বিশ্বময় হন্যে হয়ে বাস্তবমুখী গল্প খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। আর নিজেদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক করে বেড়াচ্ছিলেন যে, অবাস্তব কোন গল্প দর্শকরা গ্রহণ করবে না । তখন এফ ডব্লিউ মার্নও স্বপ্ন দেখেছিলেন বাম স্টোকারের কাউন্ট ড্রাকুলা নিয়ে হরর ফিল্ম নির্মাণ করার। তার সাধ ছিল, জার্মানির সাধ্য ছিল না।
কিন্তু চুরি করে হলেও তিনি ফিল্মটি বানিয়েছিলেন, মূল গল্পের সবকটি চরিত্রের নাম বদলে দিয়েছিলেন, যেমন কাউন্ট ড্রাকুলার পরিবর্তে কাউন্ট অরলক আর ফিল্মের জন্য গ্রহণ করেছিলেন একটি অদ্ভুত নাম ‘নসফেরাতু’। কিভাবে তিনি এই নাম খুঁজে পেয়েছিলেন তা বোধহয় শুধু তিনিই জানেন। ধারণা করা হয় আরবি বা রোমান ভাষায় কোন এক সময় নসফেরাতু বা তার কাছাকাছি কোন শব্দ ছিল যার অর্থ ছিল ভ্যাম্পায়ার।
মার্নও তার স্বল্প আয়োজনে সেই সময়ের জার্মানির প্রচলিত পন্থা ‘এক্সপ্রেশনিসম’ ব্যবহার করে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিশালাকৃতির ছায়া আর অতিরঞ্জিত অভিনয়ের মিশ্রনে বাম স্টোকারের কল্পনার ড্রাকুলা চরিত্রকে সেলুলয়েডে বন্দি করেন আর বিশ্বব্যাপী ফিল্মমেকিংকে অন্য মাত্রায় তুলে ধরেন। দি ডব্লিউ গ্রিফিথ, যাকে পৃথিবীর সর্বপ্রথম পেশাদার ফিল্মমেকার বলা হলে ভুল হবে না, তিনি যখন ফিল্ম বানাতে চাইতেন তখন সবাই তাকে বলতেন, ‘লম্হা শট, ছোট শট এগুলো মানুষ বুঝবে না, তুমি বরং অন্য পেশায় মন দাও।’ গ্রিফিথ তখন বলতেন, ‘কিন্তু চার্লস ডিকেন্স তো তার বইতে এসবই লেখেন, মানুষ কষ্ট করে নিজের কল্পনায় অন্যের চিন্তা-চেতনা বুঝতে পারলে ফিল্ম কেন বুঝবে না? আমি তো তাদের হয়ে কল্পনা করেই দিচ্ছি।’ গ্রিফিথের পরে যখন মানুষ ফিল্মকে গ্রহণ করতে শিখেছে এসময় মানুষের কল্পনার আলসেমি ভেঙে দিয়েছিলেন মার্নও তার নসফেরাতু ফিল্মটি দিয়ে। এখনকার বাচ্চারা অনেক অনেক বেশি ভয়ের ফিল্ম দেখে ফেলেছে, কল্পনাশক্তি তাদের অসীম, সহজেই তারা সব কিছুকে গ্রহণ করতে পারে। এ ফিল্মটি তাদের ভালো লাগবে না বা আহামরি হরর বলে মনে হবে না কিন্তু ১৯২২ সালের সাহসী যুবকদের জন্য বোধয় ফিল্মটি যুগের চেয়ে বেশিই আধুনিক হয়ে গিয়েছিলো। আর তাই আজ থেকে ৯৫ বছর আগে ঠিক এই দিনে মুক্তি পাওয়া ফিল্ম নসফেরাতু, অনুমোদন ছাড়া বানানো ফিল্ম হলেও নসফেরাতু সর্বকালের চলচ্চিত্রের প্রভাবশালী মাষ্টারপিস হিসেবে আখ্যায়িত হয়। আর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও টিভি রিভিউকারী সংস্থা ‘রোটন টোমাটোর’ রিসার্চ অনুযায়ী নসফেরাতু এযাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বাধিক দেখা হরর ফিল্ম হিসেবেও স্বীকৃত।
পান্থ রহমান
Facebook Comments Sync