পাথরের কান্না সুলতানা রিজিয়া

অনেক কষ্টে দুচেখের পাতা খুললো সালেহা খাতুন। কিছুই ঠাওর করতে পারছে না। সব কেমন যেনো ঝাপসা। ছোটবেলায় নদীতে ডুব দিয়ে তাকিয়ে যেমন দেখতো ঠিক তেমন। চেনা অচেনার ঘোরে আবার চোখ বোজে।

অচেতনে মাথার পাশ থেকে খুব চেনা কন্ঠের কান্না ভেসে আসে। খুব চেনা। সালেহা খাতুন মনের সমুদ্র হাতড়ায়, মনে করার চেষ্টা করে। আবছা অবয়ব ফুটে উঠে। সালেহার শুষ্ক ঠোঁট ছাড়িয়ে চোখের ভাঁজে যেনো খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ে।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সালেহার একমাত্র সন্তান।

রানু, বানুর বাপ। তার চোখের মণি।

মনে মনে বলে –

কান্দো কেন বাপ? আমি তো মরি নি, জেতাই আছি। হাত বাড়াতে চায় মাথার কাছে। পারেনা। মনের শক্তি নিস্তেজ হয়ে শরীরের দুই পাশে জমে থাকে।

তারপরও ঘুম ঘুম ঘোরে সালেহা খাতুন উঠে বসতে চায়। সন্তানের মায়ামুখ দেখার তৃষ্ণায়। আচমকা বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা খামচে ধরে। কঁকিয়ে উঠে সালেহা। শব্দটা কন্ঠার কিনারায় লটকে থাকে। শোনা যায়না।

হাসপাতালের ছোট্ট ঘরে জনে জনে ভরে ওঠে।

এ যায়, সে আসে। নাতিদের কলকাকলিতে ঘরটায় যেনো নিঃশব্দ পায়রা উড়ে বেড়ায়। সালেহা খাতুন খুশ মনে মানুষের কথাগুলো শুনতে থাকে।

বুজির কি মনে খুব কষ্ট ছিলো সাবু?

ছোট বোনের প্রশ্নে সালেহা ঘাপটি মেরে থাকে।

 

ছেলে সাহাব উদ্দিন ওরফে সাবু খালার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,

মার বয়স হয়েছিলো। দুর্বল শরীরে এক একা রাতদুপুরে বাথরুমে পড়ে গিয়েই এমন বিপদ। বামপাশের পাঁজরের কয়টা হাড় ভেঙ্গেছে। জানো তো আমি ব্যস্ত মানুষ। পুরো সংসারের ভার আমার কাঁধে। বাচ্চাদের নিয়ে তোমাদের বৌমা সাতসকালে ওদের দিতে স্কুলে যায়। সময় মতো টের পেলে এমনটা হতোনা। হাসপাতালে আনতে আনতেই সব শেষ। ডাক্তারও বললো বড় দেরি হয়ে গিয়েছে।

সালেহার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বড় দেরির জন্য আফসোস হলো তার । কত বার সাবু সাবু করে ডেকেছে, বৌমা, নাতনিরাও উত্তর করেনি।

নাকি তারা সালেহার ডাক শুনতেই পায়নি!

খালা এখন মার লাশ বাড়িতে নিতে হবে।

সাবুর কথায় চমকে ওঠে সালেহা খাতুন।

লাশ? লাশ কোথায়? সেতো সব দেখছে, সব শুনছে, তাহলে?

সালেহা হু হু করে ডুকরে কেঁদে উঠে।

কেউ যে তার কান্নার মর্ম বুঝতে পারছে না! এই শোকেই সালেহা খাতুন পাথরের মতো জমতে থাকে।

সুলতানা রিজিয়া
সুলতানা রিজিয়া