পাপ
কেবল ভোর হলো। দূর থেকে আজানের ধ্বনি আসছে। ভক্ত মাঝি তার ছোট জালটা নিয়ে বের হচ্ছে মাছ ধরতে । সাথে একটা বালতি নিয়ে তার বউ সাধনা। পাশে যমুনা নদী। নদীর পাড়ে এসে নদীতে নামবে এমন সময় সাধনা দেখে, নদীর পাড়ে একটা কি যেন নড়ছে। কাছে গিয়ে দেখে পুরাতন কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটা বাচ্চা । ভালো করে দেখতে যেতেই বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে। সাধনা ভক্ত মাঝিকে ডাকে। বলে, “দেখেন কেড়ায় যেন একটা বাচ্চা ছোইল ফেলায় গেছে?”) । ভক্ত আসে, বাচ্চাটাকে দেখে। মায়া হয় খুব ভক্তর। বউকে বলে ” চল বাড়ি নিয়ে যাই, “ এই হামা ঘরের বেটি আজ থেকে।” নিঃসন্তান ভক্তমাঝি বাচ্চাটা কোলে তুলে নেয়। বাড়িতে নিয়ে আসে বাচ্চাটা। গরম কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নেয় সাধনা। ভক্তকে বলে, “যান দুধ নিয়ে আসেন ছোইলটাকে খাওয়াতে হবে।” দুই জন পরম মমতায় বাচ্চাটাকে বাঁচায়।
বিকালের মধ্যেই গ্রামের অনেকেই জেনে যায়, ভক্ত মাঝি আর তার বউ একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছে। অনেকেই দেখতে আসে। কেউ কেউ এসে বলে,” কার না কার পাপের বাচ্চা? তোরা কুড়ায় আনলি কেন? এ তো পাপ!” ভক্ত বলে, ” মানুষের ছোল কেমনে পাপ হয়? এই ছোইলটার কি দোষ? এ তো কোন পাপ করে নাই? এ পাপ কেন হবে? ” সে পরম স্নেহে বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। বউকে বলে,” বউ আজ থেকে এই হামার। বেটির নাম দিলাম ‘সীতা’।”
ভক্তমাঝি আর সাধনার আদর যত্নে বড় হইতে থাকে সীতা। একটু বড় হয়।য় দেখতে খুব ফর্সা আর টানা টানা চোখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো লালচে লালচে চুল।
গ্রামের বড়বাবুদের বাড়িতে পুজো। নিমন্ত্রণ পায় ভক্তমাঝি । ভক্ত মেয়েকে নিয়ে খেতে যায়। সবাই খেতে বসে বারান্দায়। ভক্ত মেয়েকে নিয়ে খেতে বসতে যাবে তখনই বাড়ির কর্তামা বলে, “ ভক্ত”তোর এই বেটিক নিয়ে দূরে বস। এই পাপ যেন আমার ঠাকুর ঘরের বারান্দায় না ওঠে। “৷ ভক্ত কষ্ট পা।য় তাও হেসে বলে, “কর্তামা আপনারা অনেক ধর্ম জানেন। আমি অল্প পড়েছি, প্রাইমারী স্কুলের ধর্ম বইতে। তাতে লেখা আছে পাপ কারে কয়। কই তাতে তো পড়ি নাই মানুষ পাপ হয়? “
কর্তামা বলে, “চুপ কর কে জানে এ কার বাচ্চা ! হয়তো কোন বেশ্যার । তাই ফেলায় গেছে। বারান্দার নিচে বসে মেয়েকে নিয়ে খেয়ে যা। ” ভক্ত বলে, “না গো কর্তা মা, বেশ্যারা তাদের ছোইল ফেলায় দেয় না। দেয় ভদ্র মানুষই। ” ভক্ত মেয়েকে হাত ধরে টেনে বাড়ির দিকে যায়। সীতা বলতে থাকে,” বাবা পাপ কি গো? হামাক সক্কোলে পাপ কয় কেন? ” ভক্ত কিছু বলে না মেয়েকে। কোলে তুলে নিয়ে আদর করে।
একটু বড় হইলে ভক্ত পাশের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দেয় সীতাকে। সীতা স্কুলে যায়। স্কুলে অনেকেই সীতাকে খেপায়; ” তুই পরে পাওয়া ছোইল ! তোর আসল বাপ মা তোকে ফেলায় দিছে! ছি! ছি!” বলে হাসতে থাকে। সীতা কিছু বলে না চুপ করে থাকে। ক্লাস ফোরে ওঠার পর সীতা তার মার কাছে কেঁদে বলে, সে আর স্কুলে যাবে না। তার কাছে কেউ বসতে চায় না। তাদের বাপ মা নাকী সীতার সাথে মিশতে না করেছের মা সীতা বুকে জড়িয়ে নেয়। বলে, “তুই আর স্কুলে যাস না। থাক তুই হামার সাথে সাথে, ই ঘরের কাজ কর। বাপের সাথে হাটে যাস। ”
দেখতে দেখতে বড় হয় সীতা। খুব রূপবতী হয় সে।
খুব একটা বের হয় না। মায়ের সাথেই থাকে। সেবার পুজোর সময় বাপ তার জন্য একটা সোনার নথ বানিয়ে আনে। সীতা খুব খুশী হয়। নাকে নথ পরে মকে দেখায়। মা বলে, ” তোকে তো পরীর মতো লাগতিছে। পুজোর কয়দিন পরে থাক, তারপর খুলে রাখিস। তোর বিয়ের সময় আবার পরায় দিব। ”
মায়ের সাথে পুজো দেখতে যায় সীতা। সামনে হঠাৎ পড়ে অসীম! মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। সীতা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে মা এর পিছন পিছন যায়। অসীম বাজারের বড় দোকানর মালিকের বখাটে ছেলে।
পুজোর পর থেকেই অসীম ভক্ত মাঝির বাড়ির আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে। একদিন সীতাকে সামনে পেয়ে বলে, “ সীতা তুমি খুব সুন্দরী । আমি একদিন দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছি। ” সীতা ভয় পায়। বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু কেমন যেন একটা আকর্ষণ হয়। মাঝে মাঝে বাড়ির পাশে অসীমের সাথে দুই একটা কথাও বলে। একদিন ভক্ত মাঝির নজরে পড়ে যায়। সীতাকে অনেক গালাগালি করে। আর অসীমকে গিয়ে বলে , “তুমি কি সীতাকে বিয়া করবা?” অসীম বলে, “না তো কাকা। ছি ছি তোমার এই পড়ে পাওয়া বেটিকে আমি কেন বিয়ে করব? আমাদের বংশ চেন না তুমি?” ভক্ত বলে, “তাহলে তোমাক যেন আর কোনদিন হামার বাড়ির আশেপাশে না দেখি। যদি দেখি তো মাছ কাটা বটি দিয়ে এক কোপ দিব! তারপর যা হবার হবে। “
বাড়ি এসে সাধনাকে বলে মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে। এই বছরই মেয়ের বিয়ে দেবে।
ভক্ত অনেক যায়গায় প্রস্তাব দেয় মেয়ের বিয়ের জন্য। কিন্তু সবাই বলে, “পড়ে পাওয়া মেয়ে। এই মেয়ের বংশ পরিচয় নাই। এই মেয়েরে তারা বউ করবে না। দিন যায়।
একদিন হাঁটে মাছ বিক্রি করে বাড়ির দিকে আসছিল ভক্।, পিছন থেকে কে যেন ডাকে। ” ও ভক্ত কাকা ও ভক্ত কাকা”। ভক্ত দেখে মনুমাঝি। মনুমাঝির বড় নৌকা আছে, মাছের ব্যবসাটাও বেশ বড় তার। ভক্ত দাঁড়ায়। বলে, “কি কন বাবা? ” মনু কাছে আসে, একথা ও কথায় বলে, একবছরর হলো বউ মরে গেছে। ঘরে একটা ছোট বাচ্চা । একে দেখে কে? বাচ্চার নতুন মা আনতে চায় সে। ভক্ত যদি রাজি থাকে তো তার বেটিক বিয়ে করতে চায়। কিছু যৌতুক দিতে লাগবে না।
ভক্ত একটু চিন্তা করে বলে বাড়ি গিয়ে চিন্তা করে পরে জানাবে।
বাড়ি এসে খাওয়া দাওয়ার পর সাধনাকে ডেকে সব কথা বলে। সে আরো বলে, ছেলেটা কর্মঠ আর ভালো । ভাত কাপড়ের অভাব কখনও হবে না। সীতা হামার সুখে থাকবে। দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নে,য় এখানেই সীতার বিয়ে দেবে। বিয়ে ঠিক করার জন্য মনুকে বলে। মনু তার বড়ভাইকে নিয়েএসে সীতাকে আর্শিবাদ করে যায়। একফাঁকে সে সীতাকে জিজ্ঞাসা করে, তার মা হারা বাচ্চাকে সে দেখবে তো? সীতা লজ্জা জড়ানো কণ্ঠে বলে, “আমার মা বাপ আমাক কুড়ায় এনে ভালোবাসা দিয়ে বড় করছে। তো আমি কেন পাবো না? আমিও পাবো। “বিয়ে ঠিক হয় । আর একমাস পরেই বিয়ে।
ভক্ত মেয়ের বিয়ের জোগাড় করতে থাকে। মেয়েকে নিয়ে শহরে যায় মেয়ের শাড়ি আর সাজ গোজের জিনিস কিনতে। বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাজারের কাছে এসে ভক্ত সীতাকে বলে, ” মা তুই বাড়ি যা! আমি একটু পর আসি। বাজারে কাজ আছে।” সীতা বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।
পাটক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন মুখ চেপে ধরে পিছন থেকে! সীতা আপ্রাণ চেষ্টা করে ছাড়াতে, কিন্তু পারে না। একজন না অনেক কয় জন তাকে চেপে ধরে।
রাতে বাড়ি আসে ভক্তমাঝি। সাধনা বলে, “সীতা কই?” ভক্ত বলে, “সীতা আসে নাই? সীতাক তো সেই সন্ধ্যায় আমি বাড়ি পাঠায় দিছি!!” চিৎকার করে ওঠে ভক্ত, “কই সীতা মা? ” পড়ি মরি করে বের হয় ভক্ত আর সাধনা সীতাকে খু্ঁজতে। হেরিকেন নিয়ে খুঁজতে থাকে, চিৎকার করে ডাকতে থাকে। একসময় পাটক্ষেতের ধারে নগ্ন সীতাকে আধামরা অবস্থায় পায় তারা। সাধনা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, “কোন জাউর্যার বেটা জাউর্যা হামার বেটির এই দশা করলো রে?” নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে জড়িয়ে নেয় সীতাকে। বাড়ি আনে । জল মুখে ধরে। ঘোরলাগা চোখে তাকায় সীতা। রক্তে ভাসে যায় বিছানা। সাধনা ভক্তকে বলে, “যান ডাক্তার আনেন। সীতা তো মরবে তা না হলে। ” ডাক্তার আনে ভক্ত। কিভাবে যেন বেঁচে ওঠে সীতা। একেবারে চুপ মেরে যায়। ঘর থেকে বের হয় না। মা বাপের সাথে কথা বলে না। মাঝে মাঝে গুমরে গুমরে কাঁদে। গ্রামের অনেকেই দেখতে আসে সীতাকে। সান্ত্বনা দেয়ার ছলে যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়। ভক্ত রেগে যায়। সবাইকে বলে, “আসেন না তো হামার বাড়ি। হামার বেটিটাকে বাঁচতে দেন তো “। কয়েকদিন পর ভক্ত দেখা করে মনুর সাথে। বলে, ” ও বাপ বিয়ে ঠিক আছে তো? ” মনু বলে, “না কাকা এই বিয়া আর হবার নয়। আমার বড়ভাই আছে, মা আছে, তারা এই বিয়া করতে না করে। আমারো সমাজ আছে। ” ভক্ত বাড়ি এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সাধনাকে বলে, “কি হবে হামার বেটির এখন?” সাধনাও কাঁদতে থাকে। ঘরে চুপ করে বসে থাকে সীতা।
একদিন হাসতে হাসতে একেবারে বাড়ির ভিতরে অসীম আসে। বলে, ” ও ভক্ত কাকা, তোমার এই বেটিক নিয়ে এখন কি করবা? কে বিয়ে করবে এরে? তোমার বেটির এখন শহরে গিয়ে পাকাখাতায় নাম লেখানো ছাড়া গতি নাই। ” ভক্ত রেগে যায়। বলে, “এখুনি হামার বাড়ি থাইক্কা বের হও। না হলে কিন্তু খারাপ হবে কয়া দিলাম। “
রাতে কেউ আর খেতে পারে না । সবাই চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যায়। সকালে সাধনা দেখে ঘরে সীতা নাই। সীতাকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির পিছনে যায়। দেখে সীতা আম গাছে ফাঁস দিয়েছে। চিৎকার দেয়, “ওরে হামার মারে, এ তুই কি করলি। ” দৌড়ে আসে ভক্ত। আশেপাশের লোকজন নামার সীতার লাশ । অনেকেই দূর থেকে দেখে । অনেকেই বলে, পুলিশ আসবে। ভক্ত গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে যায়। বলে, পায়ে পড়ি পুলিশ যেন না আসে এই ব্যবস্থা নেন। এই নেন হামার বেটির সোনার নথটা। এইদিয়ে ব্যাবস্থা করেন।হামার বেটিক যেন কাটাছেঁড়া না করতে হয় । এই ব্যাবস্থা করেন। পুলিশ আসে না। সারাদিন যায়, সন্ধ্যা হয়। কেউ সীতাকে সৎকার করার জন্য আসে না। ভক্ত একসময় যায় লোক জন ডাকতে। কেউ আসে না। সে যায় গ্রামের পুরোহিতের বাড়িতে। বলে, “ও ঠাকুরমশাই, হামার বেটির সৎকার করতে হবে একবার আসেন।” ঠাকুর বলে, ” আমি যাব না যা। তোর এই পড়ে পাওয়া বেটির জাতের ঠিক নাই। একটা পাপ। আবার শাস্ত্রে আছে দ্বিচারিনী মহা পাপিষ্ঠা। তোর বেটিক না জানি কতো পুরুষে….। আবার সে আত্মঘাতিনী । এতো বড় পাপিষ্ঠাকে দাহ কে করবে? যা তুই আমি যাব না। এর কোন দাহ না করলেও চলবে। এর কোন শ্রাদ্ধও হবে না। ” ভক্ত বলে, “কিন্তু ঠাকুরমশাই কোন কাজটাতে হামার বেটি দায়ী? ইচ্ছা করে তো সে কিছু করে নাই। নিজের জীবনটাও তো দিল হামাক উদ্ধার করতে।” ঠাকুর বলে, “যা তুই বেশী বুঝিস না। ” বাড়ি আসে ভক্ত । সাধনাকে ডাকে । বলে, চল বউ যেখান থেকে হামার সীতাক কুড়ায় আনছিলাম সেখানেই রেখে আসি দুই জনে । দুইজন বের করে সীতার লাশ । দুই একজন রাস্তার সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে।
সব শেষ হবার পর ভক্ত যেন অন্য মানুষ । যেন কিসের ঘোর! বাড়ি এসে বউকে বলে,” আচ্ছা বউ তুই কি জানিস পাপ কি? ” সে খাওয়া দাওয়া করে না। বের হয় যায় মাস্টার এর বাড়ি। ” ও মাস্টার আপনি তো অনেক বই পড়ছেন। বলেন তো পাপ কি? আচ্ছা হামার বেটি কি পাপ করেছিল? যায় ঠাকুমশায়ের বাড়ি। ও ঠাকুরমশাই, পাপ কি হামাক বুঝান তো?”
দিন যায়। গ্রামের সবাই প্রায় ভুলে যায় সীতাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে শোনে এক পাগলা খালি পা, ছেঁড়া জামা পরে সারাদিন একা একা কথা বলে! আর সবাইকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা পাপ কি? হামাক বুঝান তো!” গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা ভক্তকে দেখলে বলে, “ওই দেখ ওই দেখ পাপ পাগলা যাচ্ছে। “
Facebook Comments Sync