মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা –  শারমিনা পারভিন হ্যাপি

শারমিনা পারভিন 

শারমিনা পারভিন 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। তারা পুরুষের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দেওয়ার পর পরই নারী সমাজ বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। তাঁরা বাংলার বিভিন্ন শহর-বন্দরে সংগঠিত হতে থাকেন। নিজেরা যেমন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তেমনি  স্বামী সন্তান ও আত্মীয়স্বজনকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুপ্রেরণা দেন। এক্ষেত্রে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নাম ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি তাঁর নিজ পুত্রকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

নারী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে সশস্ত্র ছাত্র বিগ্রেড গড়ে তোলা হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রীদের নেতৃত্বে বিগ্রেড পরিচালিত হতে থাকে। যারা এ বিগ্রেড পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন-বেগম রোকেয়া, কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা, ফোরকান বেগম, মমতাজ বেগম।

যুদ্ধ শুরু হলে নারী নেত্রীরা অন্যদের মতো পালিয়ে ভারতে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাঁরা সেখানে বসে থাকেননি, আরাম আয়েশে দিন কাটানোর চেষ্টা করেননি, তাঁরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেগম মতিয়া চৌধুরী ও মালেকা বেগম নারীদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ পরিচালনা করেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতের গোরা ক্যাম্পে নারীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁর নেতৃত্বে এ ক্যাম্পে প্রায় ৪০০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সাজেদা চৌধুরীকে এ আন্দোলন পরিচালনায় কৃষ্ণা রহমান ও ফজিলাতুন্নেসা সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া আরও অনেক সাহসী নারী মুক্তি সংগ্রামের সময় বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীরা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা যুদ্ধের সময় নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। আবার অনেক নারী যুদ্ধের সময় পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান করে সরাসরি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন।

আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিভিন্ন রণাঙ্গনে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল উল্লেখ করার মতো। এক্ষেত্রে যাঁরা উজ্বলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁরা হলেন-ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, কাকন বিবি, তারামন বিবি প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে এসব নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাঁদেরকে স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িত না থেকেও এদেশের বহু নারী পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করেছেন, বাড়ী ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, গোপনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে খবর আদান- প্রদান করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নারীরা অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের দিনের পর দিন সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। তাঁদের অসীম মমতায় মুক্তিযোদ্ধারা সুস্থ হয়ে পুনরায় রণাঙ্গনে ফিরে গেছেন।

নারী শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ধরে রাখার পক্ষে কাজ করেছেন। তাছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নারী শিল্পীরা অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ সময়ে প্রায় ২৫ জন নারীর সমন্বয়ে “মুক্তি সংগ্রামী শিক্ষা সংস্থা” নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এ সংগঠনটির শিল্পী ও কলা-কুশলীরা মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময়ের গানগুলো মানুষকে উজ্জীবিত করে ছিল।

যেমন- মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি/ তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে/    মুজিব বাইয়া যাও রে/    কারার ঐ লৌহ কপাট/    ও আমার দেশের মাটি।

এসব গান মুক্তিযোদ্ধা তথা আপামর জনসাধারণকে উদীপ্ত করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন-সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল, ডঃ মাখদুমা নার্গিস রত্না, বেগম মুসতারি শফি, ফরিদা আক্তার, মনিরা আক্তার, ডঃ ফৌজিয়া মোসলেম, মিনু বিল্লাহ প্রমুখ।