দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ১৩) – আফরোজা অদিতি

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় আফরোজা অদিতি

 

রাহার জন্মদিন।

অনেকের সঙ্গে এসেছে রাকিব। রাকিবকে বলেনি ও। রাকিব কখনও দুঃখ পাক তা ও চায় না। তবে এ বাড়িতে এলে রাকিব দুঃখ পাবে কি পাবে না তা কখনও ভেবে দেখেনি ইথিকা। কখনও এ বাড়ির কোন আনন্দ কাজে না ডাকারই ইচ্ছা ওর। রাকিবকে ডেকেছে তমিজ। কী জানি কেন এই ডেকে আনাটা ভালো লাগেনি ওর। রাকিব রাহাকে আদর করছে। গল্প বলছে রাহাকে। রাজার গল্প। এক রাজা ছিল। তার এক ছিল রাণী। রাণীটা রাজার কাছে থাকতো না। ওকে বন্দী করে রেখেছিল এক রাক্ষস। রাজাও যেতে পারে না রাণীর কাছে রাণীও আসতে পারে না রাজার কাছে। বন্ধ ঘরের জানালা দিয়ে শুধু বাইরের রাস্তা দেখে রাণী। মাঝে মধ্যে রাজা এসে দাঁড়ায় জানালার কাছে। রাণী চোখের জলে হাসে।

‘চোখের জলে আবার হাসা যায় নাকি আঙ্কেল।’  ছোট্ট রাহার প্রশ্নে চমকে ওঠে রাকিব। একি গল্প বলছে রাহাকে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না কিছু। রাহাকে বলে, ‘যায়, বাবা যায়। বড় হও বুঝবে।’

‘আমি তো বড় হয়েছি আঙ্কেল।’ কোল থেকে নেমে হাত উঁচু কর বলে, ‘ অ্যাই দ্যাখ আঙ্কল, কত্তো বড় আমি।’ রাকিব ওকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বলে, ‘আরও বড় হও ঠিক আমার মতো।’ এরপর আর থা বলে না রাকিব। ও রাহাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন ও স্পর্শ পেতে চাইছে ইথিকার।

ইথিকা কাজ শেষ করে কাপড় পাল্টে এ ঘরে আসে। সবাই ওর পরিচিত। সকলের সঙ্গে হাই-হ্যালো করে, কুশল জিজ্ঞেস করে।

‘এস রাহা’। রাহাকে ডেকে নেয় ইথিকা। রাকিবের চোখে থৈ থৈ সমুদ্র। বুকের ভেতর চেপে থাকা নিঃশ্বাস দীর্ঘশ^াস হয়ে মিশে যায় ঘরের বাতাসে। রাকিবের এই ভেসে যাওয়া রূপ দেখতে পারে না ইথিকা, রাহাকে নিয়ে সরে যায় ও। মনে মনে কথা বলে ইথিকা। ‘কতোদিন আর কতোদিন এভাবে দগ্ধে মরবে রাকিব। আর কতোদিন কষ্টে থাকবে তুই, কষ্টে রাখবি আমাকে।

 

বুকের ভেতর ঝরা পাতার শব্দ। ওর মনে হয় একটা বিশাল অজগর ঠান্ডা শরীর দিয়ে আষ্টেপষ্টে পেঁচিয়ে ধরেছে ওকে। ও সরতে পারছে না, নড়তে পারছে না, যেতে পারছে না কোথাও! ওর কান্না পায়, কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে যায় এ ঘর থেকে। এভাবে কেন বেঁচে থাকে মানুষ। একে কি বেঁচে থাকা বলে! এ শুধু কেটে যাচ্ছে দিন,বয়ে যাচ্ছে সময়! এই কেটে যাওয়া, বয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে কতোটা পথ চলা যায়! ও চলবে কীভাবে? ওর সেই শক্তি কোথায়? এসবের উত্তর জানা নেই ইথিকার। রাকিবের কি জানা আছে?

নিশ্চয় জানা আছে ওর। জানা যদি নাই থাকবে তবে এ অবস্থার সৃষ্টি কেন করেছে? কেন করলো মালা বদল? কেন ডাকলো বউ?

বউ যদি ডাকলো তবে কেন অধিকার আদায় করতে আসে না। কেন ছেড়ে দিয়েছে এই বাড়িতে? কেন ছেড়ে দিয়েছে তমিজের কাছে!

কেন একা একা পাথর হয়ে আছে মন্দিরে বিগ্রহের মতো। কেন কথা বলে না। কেন কেন কেন? এত সব কেন ভাল লাগে না ইথিকার। ওর মনের ওপর এই কেন অদ্ভুত রকমের ছাপ ফেলে, চাপ সৃষ্টি করে। ওর মাথা ঘুরে ওঠে, চেতনা হারিয়ে পড়ে যায়!

 

বাড়ির মধ্যে হৈ চৈ। কী হয়েছে  উৎকন্ঠিত রাকিব। বেশ কয়েকদিন এসেছে এ বাড়িতে কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢোকেনি কখনও।

বাইরের ঘর থেকে চলে গিয়েছে রাকিব। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ঘরের দরজায়; মেঝেতে পড়ে আছে ইথিকা। ওর চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে হাসুনি। ইথিকাকে দেখে ভালো লাগে না রাকিবের। কী হয়েছে ওর? কাকে জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস তো করতে পারে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে তমিজকে দেখতে পেলো। বিরক্ত মুখে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে পায়ে তমিজের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে ইথিকার?’

তমিজ কথার জবাব না দিয়ে বিড় বিড় করে কী বললো বুঝতেও পারলো না রাকিব। শুধু কানে এর ‘ঢঙ্গী’ কথাটা। রাকিবের মন খারাপ ছিল এমনিতেই, খারাপ হয়ে যায় আরও। ওর একবার মাত্র ইচ্ছা করলো ইথিকার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে, ছুঁয়ে দেখে ওর মুখ,হাত, চোখ। ও এক পা, দুপা করে ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। ওকে দেখে রাহার ফুপু বলে, ‘আরে, আরে আপনি এখানে কেন। বাইরের ঘরে গিয়ে বসুন। কিছুই হয়নি। সেরে যাবে এখনি। সারাদিন কাজ করেছে তো।’ রাকিব লজ্জা পেয়ে প্রায় দৌঁড়েই এ ঘরে চলে আসে। তারপর কাউকে কিছু না বলে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। ইথিকাকে বলে যাওয়ার জন্য রাস্তা থেকে ফিরে আসে। গেটের কাছে দাঁড়ায়, ভাবে। জানে ইথিকাকে বলে যেতে পারবে না, তবুও দাঁড়ায়। খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গেটের ভেতর ঢোকে না। পকেট থেকে গোলাপ পাপড়ি গেটের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে জোরে জোরে পা চালিয়ে ও বাড়ি থেকে দূরে চলে আসে। যেন এভাবেই ও চলে যেতে পারবে এ বাড়ি থেকে অনেক অনেক দূরে, ইথিকার ছায়া থেকে দূরে, বহু দূরে! শুক্র শনিবার মাঝখানে রেখে বৃহস্পতি ও রবিবার বন্ধ থাকায়

৪ দিন বন্ধ পড়ে গিয়েছে অফিস। সুযোগ হয়েছে বেড়াতে যাওয়ার।  কোথাও যাওয়া যায কিনা সেই সম্পর্কে কথা বলার জন্য তমিজ আর ইথিকাকে ডেকেছে শরীফা। শরীফা ওদের চা দেয়। সঙ্গে নুডুলস। এখানে এসে রিয়াকে দেখতে পায় ইথিকা। ওকেও ডেকেছে। চা খেতে খেতে রিয়ার সঙ্গে কথা বলে ইথিকা।

 

শরীফার পাশের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে সঙ্গে ওর ভাবী। হাকিম মারা যাওয়ার পরে রায়ের বাজারের বাসা ছেড়ে দিয়ে এখানে উঠেছে রিয়া। রিয়ার আগের বাসাতে দেবর মারা যাওয়ার আগে একবার মাত্র গিয়েছিল ইথিকা। আর যায়নি। যাওয়া হয়ে উঠেনি ওর। ওদের ওই বাসাটা চমৎকার ছিল। খোলামেলা। টিনশেড বাড়ির ভেতরে মস্ত উঠোন। ইথিকার উঠোনের খুব শখ কিন্তু এই বাসায় উঠোন নেই। কাপড় শুকানোর জন্য বারান্দায় তার টাঙ্গানো হয়েছে। ইথিকার খুব বাগান করার শখ। রিয়ার উঠোনে বাগান ছিল এখন তো ফ্ল্যাটে থাকে বাগান করেছে কিনা জানতে চায় ইথিকা। ‘তোমার তো খুব বাগানের শখ, বাগান করেছ রিয়া।’

‘না, ভাবী সময় পাই না। আর টবে বাগান করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর আপনার দেবরই নাই; ওর সঙ্গে সঙ্গে আমারও সব শখ চলে গেছে ভাবী। তাছাড়া মেয়েটা খুব জ¦ালাতন করে।’

‘আরে না না, মামণি তো খুব লক্ষী। তাই না এষণা মনি।’

‘হ্যাঁ লক্ষী, গিয়ে দেখে এসো। ঘরে গিয়ে দেখে এসো ঘরের এমন অবস্থা যেন ডাকাত পড়েছে।’ ওরা কথা বলতে বলতেই শোনে শরীফার সঙ্গে কথা বলছে তমিজ।

‘কি ব্যাপার আপা। ডেকেছেন কেন?’

‘কক্সবাজার যাবো সকলে মিলে।’

‘কক্সবাজার এসময়!’ বিস্মিত ইথিকা।

‘অসুবিধা কি?’ শরীফা বলে। ‘এখন্ তো সময়। না গরম না ঠা-া; বেড়াতে যাবার উপযুক্ত সময়।’

‘নাহ্ অসবিধা কেন হবে।’ বলে ইথিকা।

‘না, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমার ইচ্ছা করছে না যেতে।’ শরীফা বলে। কথা বলে না ইথিকা।  ও জানে কথা বললেই ঝগড়া শুরু করবে তমিজ। মন খারাপ হবে সকলের। যা চায় না ইথিকা।

 

ইথিকার হয়েছে মহা মুশকিল। রাকিবকে ছাড়া এখন ওর ভাল লাগে না কোথাও। জীবনের প্রেরণা এখন রাকিব। ওকে দেখলে সমুদ্র দেখার ইচ্ছা চলে যায়, চলে যায় পাহাড় দেখার ইচ্ছা, আকাশ ফুল লতা পাখি কিছুই আর দেখার ইচ্ছা থাকে না ইথিকার। রাকিবের ভালবাসার জলে তো ভেসে বেড়ানোর ইচ্ছা ওর। ওর ইচ্ছা ভালবাসার সমুুদ্রে জোয়ার এসে ওকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে প্রদীপ করে তুলুক। মনে মনে গুনগুন করে, “আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ করো…।” রাকিব ছাড়া এই জীবনে আর কোন ইচ্ছা নেই, নেই কোন আকাক্সক্ষা! আর এই সময় যাবে কক্সবাজার একা একা। না না তা হয় না। রাকিবকে জানাতে হবে। কিন্তু ওরা যদি টের  পেয়ে যায় তবে তুলকালাম কান্ড হবে। হলে হবে। ফোন করে ইথিকা। ওদের কক্সবাজার যাওয়ার কথা বলে। রাকিব রাগ করে। ভাল-মন্দ নানা কথা বলে। কাঁদে ইথিকা।

‘কি করবো বল। আজ প্রায় দুই বছর হতে চললো তুমি কিছুই করলে না। আমাকে অপমান, অসম্মানের মধ্যে রেখে আবার রাগ করো।

রাগ তো করবো আমি, তুমি না।’ ইথিকা কাঁদতে কাঁদতেই বলে। তুমি এখানেও থাকতে বলো আবার এদের সঙ্গে না মেশার পরামর্শও দাও। দুই রকম করলে তো হয় না, হবে না। একই সঙ্গে দুই রকম আচরণ করতে পারি না আমি। বরের মা, কনের মা হতে পারবো না আমি।’ রাগ করে ফোন রেখে দেয় ইথিকা। একটু পরে আবার ফোন বেজে উঠে। ফোন ধরে। ফোন না ধরলে অন্য কেউ ধরে ফেলবে। তাই ফোন ধরে। কথা বলে না। ওপাশে রাকিব। ‘কি হলো সোনা বউ, রাগ করে না। আমার কথা বাদ দাও, যাও তুমি।’

 

কক্সবাজার এসে ভালো লাগে না ইথিকার। সন্ধ্যায় সানসেট দেখতে গেছে সকলে। ও ঘরে একা। ওর ভাল লাগেনি যেতে।

এত লোকের ভীড় ভালো লাগছে না। তমিজ ঘ্যান ঘ্যান করছে কিছুক্ষণ। কেন যাবে না কি হয়েছে, আগে বললেই তো হতো তাহলে আসতো না। এহেন সাত-সতেরো নানা কথা সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে গেল তমিজ। সব কথার কিছু শুনলো, কিছু শুনলো না। শুধু একটা কথাই বললো ও, ‘মাথা ধরেছে।’

ওরা চলে গেছে।

ও শুয়ে আছে রূমে। এভাবে একা থাকতেও ইচ্ছা করছে না, আবার যেতেও ইচ্ছা করছে না। ইথিকা স্তব্ধ। ওর ভালোবাসার ভাবনাতে  বুকের মধ্যে খুলে যাওয়া হাজারো নদী এক নিমিষে বদ্ধ জলাশয় হয়ে যায়। বদ্ধ জলাশয় স্তব্ধ তবুও গভীর কাকচক্ষু জল! ইথিকা জলের ভেতর উঁকি দেয়। জলের নিচে এক মন্দির। সেই মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। সম্মুখে এক পূজারী। পূজারী আর কেউ নয়, রাকিব। ইথিকার মুগ্ধ হৃদয় বিষন্ন। মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতে দেখতে পায় উধাও হয়ে গেছে যুগল বিগ্রহ, উধাও হয়ে গেছে পূজারী; মন্দিরে শুধু রাধা-প্রতিমা একা শুধুই একা! রাধা-প্রতিমা দেখতে ওরই মতো। তাছাড়া মন্দিরের চার দেয়ালে শুধু ওরই ছবি, শুধু ওর। আশ্চর্য হয়ে মন্দিরের প্রতিমা আর ছবি দেখতে থাকে। হঠাৎ নজরে পড়ে মন্দিরের ঠিক মধ্যখানে ভেঙে চুরে বসে আছে রাকিব; বসে আছে নিবিষ্ট।

 

হঠাৎ ওর ছবির ভেতর থেকে বের হয়ে এল একটি মানুষ।

মুখটা ঈগলের মতো আর দেহটা মানুষ। ওই মানুষটির চোখে ধূর্ততা, কঠোরতা, হিং¯্রতা আর ঠান্ডা চাহনি। মানুষটি এসে এক ধাক্কায় ফেলে দিল রাকিবকে তারপর হাতে ধরা বর্শা আমূল বিধিয়ে দিয়ে তীক্ষè ঠোঁট বাঁকিয়ে দিল রাকিবের চোখের দিকে। উ:! মাগো, কী ভয়ংকর। বর্শা বেধা রাকিবের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বলে, রাকিব এসো দুজন একসঙ্গে মরে যাই আজ। বর্শা বিঁধেছে বুকে, রক্ত ঝরছে তবুও কথা বলছে রাকিব। এই তোমার ছেলে আছে না!

আছে।

তাহলে।

ওসব কথা বাদ দাও ইথিকা। আমরা দুজনেই বাঁচবো, বাঁচার মতোই বাঁচবো। এইভাবে প্রতিদিন মরে মরে বাঁচবো না! এভাবে কতোক্ষণ নিজের মন-মন্দিরে কথা বলছিল খেয়াল নেই ইথিকার। পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। দরোজা খোলার শব্দে পাশ ফিরে দেখে রাকিব। আনন্দ খুশিতে উদ্বেল হয় ইথিকা।

 

কক্সবাজারে তিনদিন কাটিয়ে ওরা ফিরে আসে ঢাকা। কক্সবাজার থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে তমিজ। তমিজ কথা বলেনি যেমন, বলেনি ইথিকাও । ইথিকা ওর গম্ভীর হওয়ার কারণও জানতে চায়নি। অবশ্য ইথিকা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি, হোটেলে রাকিবকে দেখেছে তমিজ। মনের ভেতর রাগ টগবগ করলেও বলেনি কিছুই। তমিজ প্রতিজ্ঞা করেছে কিছু বলবে না ইথিকাকে। ভালবাসবে এখন। ইথিকার মন থেকে রাকিবকে তাড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেছে; কিন্ত ও জানে জোর করে মন থেকে কাউকে মুছে দেওয়া যায় না। কৌশল করতে হবে আর তমিজ কৌশল করতে ওস্তাদ! ইথিকা তো ওর বিয়ে করা বউ। ওর আপনজন! এখন থেকে অনেক অনেক ভালবাসবে ওকে। তমিজ এসব ভাবে কিন্তু দেরী হয়ে গেছে অনেক; ইথিকা আজ অন্যের। ইথিকা বেঁচে থাকার উৎস খুঁজে পেয়েছে। তমিজকে আজ আর প্রয়োজন নেই ওর।

 

কক্সবাজার থেকে ফেরার পথেই দুজনের মধ্যে ঠান্ডা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এ সম্পর্ক জোড়া দিতে জোর করে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করে তমিজ। চেষ্টা করা সত্ত্বেও ওর সন্দেহ বাতিক মন এবং স্বভাব আর অভ্যাসে হঠাৎ হঠাৎ গরম হয়ে ওঠে। একা একাই বকবক করে।

ইথিকা কথা বলে না, বলতে ইচ্ছা করে না ওর।

ইথিকা সন্তান সম্ভবা।

রাকিব খুশি, তমিজের ক্ষোভ। ইথিকা একটু ভীত। অফিস আর সংসার দুটো নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মধ্যেও ভাবনা যে করেই হোক এ সন্তানকে আনতেই হবে এই পৃথিবীর আলোতে! কথা দিয়েছে ও রাকিবকে। সন্তান দেবে ওকে! সন্তান নষ্ট করার জন্য অনুরোধ করে তমিজ। তারপর রাগারাগি। সময় নেই, অসময় নেই ক্ষোভ প্রকাশ করছে সে। এই সন্তান কিছুতেই এই বাড়ির আলো-হাওয়ায় বাঁচতে পারবে না, এখানে আসার কোন অধিকার নেই ওর। আমার সন্তান চাই না এখন। এসব কথা ভাল লাগে না ইথিকার। ইথিকা জবাবও দেয় না এসব কথার। ইচ্ছে করে না, রাগাতে চায় না ওকে। কোন রকমে শুধু এ সন্তানকে আনতে হবে এ পৃথিবীতে। এ রাকিবের সন্তান। কথা দিয়েছে ওকে। ওর চোখে ভাসে রাকিবের আনন্দময় মুখ। শরতের আকাশে যেখানে স্বচ্ছ সুন্দর আলো হয়ে হাসে, যেখানে ওড়ে শুভ্র বালি হাঁস সেখানের সেই আকাশ, সেই সুন্দর আলো, সেই বালিহাঁসের ওড়ার আনন্দ স্থির হয়ে আছে রাকিবের দুই চোখে আর মনে।

 

রাকিবের মুখ মনে করে ইথিকা; রাকিবের মুখ মনে করতে চাইলেই ওর চোখে ভেসে ওঠে কাক চক্ষু স্বচ্ছ দীঘির নিচে মন্দির। সেই মন্দিরের চার দেয়াল ছোয়, ননীচোর কৃষ্ণ। নানা বয়সের, নানা ঢং এর, নানা ভঙ্গীর। মন্দিরের মেঝেতে বসে আছে রাকিব। ওর চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। সেই আলো একটু একটু করে জমাট বেঁধে হয়ে উঠছে ওর অবয়ব। ও দুই হাত বাড়িয়ে দিতেই কৃষ্ণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওর কোলে। একবার দুইবার তিনবার, বারবার। ওর কোলে কৃষ্ণকে দেখে হা হা হাসিতে ভেঙে পড়ছে রাকিব।

তমিজ খিটমিট করতে না চাইলেও করে ফেলে। যতোই ইথিকাকে দেখে ততোই রাগ হয় ওর। ওর মনে হয় এ সন্তান কি ওর? না অন্যের!

কক্সবাজার হোটেলে এক রূমে ছিল ওরা। কিন্তু এ সন্তান যে ওর নিজের না তাই বা বলে কি করে। তমজের সন্দেহবাতিক মন অসহায় হয়ে থাকে ওর ভাবনার কাছে; এ সন্তান ওর না রাকিবের? প্রশ্নটা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। এই কথা ভাবতে ভাবতে প্রায় পাগলের মতো আচরণ শুরু করে তমিজ।

ও দিন ক্ষণ হিসেবে করে। হিসেবে করেও স্থির করতে পারে না কিছুই। ওর শুধু রাগ হয় রাগ হয় রাগ হয়। তমিজের রাগে ইথিকার খারাপ লাগে। সব সময় কি মানুষের শরীর মন ভাল থাকে, থাকে না। তাই একদিন জবাবও দিয়ে ফেলে। ‘দেখ তমিজ আমাকে যখন তোমার পছন্দ নয় তখন বলো তো চলে যাই আমি।’ স্ত্রীর কথার উত্তরে বলে তমিজ ‘চলে যাওয়ার কথা তো আসছে না, তুমি শুধু সন্তান নষ্ট করে ফেল।

‘কেন নষ্ট করবো। ভ্রুণ হত্যা করা পাপ।’

‘পাপ পূণ্য বুঝি না। আমি শুধু বুঝি এ সন্তান চাই না আমি।’

‘তুমি না চাইলেও চাই আমি।’

‘চাও, কেন!’

‘সন্তান এসেছে বলে, চাই।’

‘তাই! নাকি রাকিবের সন্তান বলে চাও।’ এতোদিনের ভালোমানুষির মুখোশ খুলে পরে তমিজের।

ইথিকা হাসে, মধুর সে হাসি। হাসতে হাসতেই বলে, ‘যদি তুমি তাই জান তবে কেন নষ্ট করতে বলো। আর তুমি তো নিজেই বলেছো, এবং বিশ্বাস করো  দ্বিতীয়বার যাদের বিয়ে হয় তবে প্রথম স্বামীর অস্তিত্ব মাটিচাপা দেওয়া ফসিলের মতো বিদ্যমান থাকে জীবনে। আমারও তাই, তুমি তো আমার দ্বিতীয় স্বামী তাই বুঝতেই তো পারছো…।’ কথাগুলো বলে আবারও হাসে ইথিকা। সে হাসি যেমন মধুর তেমনি আনন্দের, তেমনি আবার ক্ষুরধার। এই ক্ষুরধার হাসি হাসতে হাসতেই বলে, ‘এতোদিন তুমি আমার সঙ্গে যা ইচ্ছা ব্যবহার করেছো আজ আমি এর প্রতিশোধ নিয়েছি।’

‘ইথিকা।’

‘চোখ রাঙিয়ো না। চোখ রাঙানোকে আমি যে আর ভয় করি না, কেয়ার করি না বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়।’

‘তুমি কেন আমাকে কেন এভাবে ঠকালে বলো তো।’

‘আমি তো ঠকাইনি তোমাকে। তুমি নিজেই ঠকেছ নিজের কাছে আর ঠকিয়েছ আমাকে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,‘ এ বিষয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাই না। শুনবো না।’ এই কথা শোনার পরে তমিজের ভেতরে আগের মানুষটা ফিরে আসে। হাত উঠায়। কিন্তু কি ভেবে উঠানো হাত নামিয়ে নেয় আবার। বের হয়ে যায় ঘর থেকে।

 

তমিজ বের হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। তারপর টেলিফোন করে রাকিবকে। রাকিব সিএনএন-এ দেখছিল টুইন টাওয়ার ধ্বংসের খবর। সন্ত্রাসী হামলায় ধ্বংস হয়েছে টুইন টাওয়ার। আমেরিকার মতো জায়গায় সন্ত্রাসী হামলা। হাইজ্যাক করা যাত্রী বিমান নিয়ে হামলা।  কতোলোকের যে ক্ষতি হলো তার ইয়াত্তা নেই। এখনও খবরে সব আসেনি আসবে আস্তে আস্তে। আহা….আহা!

 

এরপর কি হবে। আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আছর পড়বে বাংলাদেশে। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্ব জুড়েই। প্রথমেই তো আক্রমণ করা হবে আফগানিস্তান। লাদেন, লাদেন আর লাদেন। এই আক্রমণে কি মারা যাবে লাদেন? যাবে না। মারা যাবে নীরিহ নারী- পুরুষ-শিশু। রাকিব দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেখছিল খবর আর ভাবছিল। ফোন বেজে উঠতেই ইথিকার কন্ঠ পেয়ে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে ওর মনে। ভুলে যায় টুইন টাওয়ার। ভুলে যায় অসহায় মানুষের দুঃখ।

‘কেমন আছে আমার সোনামনি জান।’ একথার জবাব না দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইথিকা। কান্না জড়ানো কণ্ঠে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে, ‘আমাকে নিয়ে চল রাকিব। আমি আর থাকবো না এখানে।’

‘কি হয়েছে সোনা।’ রাকিবের কণ্ঠে উদ্বেগ। অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে আদরের ছোঁয়া। ‘কান্না থামাও জান। তারপর বলো কী হয়েছে।’

‘তমিজ খুব যাচ্ছ তাই ব্যবহার শুরু করেছে আবার।’ চুপ করে নিজেকে সামলে নেয় ইথিকা। সাধরণত এতো অল্পে ওর কান্না পায় না। এমন মেয়ে নয় সে। রাকিব চিন্তা করে তাহলে খুব বেশি কিছু হয়েছে! মুখে বলে, ‘দাঁড়াও আসছি আমি। এমন কিছু করো না সোনা, তুমি জানোই তোমার ভেতরে আছে একজন সে আমার জানের জান।’

 

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এসে হাজির হয় রাকিব। ওকে দেখে সব অপমান সব দুঃখ ভুলে যায় ইথিকা। কথা বলে ওরা। তমিজ গিয়েছিল বোনের বাসায়; ফিরে আসে। হাসুনিকে পাঠিয়ে ডেকে আনিয়েছে শাশুড়ি। জরুরী দরকার। বাইরে থেকে গেট খোলাই ছিল। তমিজ ঘরে ঢুকে রাকিবকে দেখতে পেয়ে ভাবে বিগলিত হয় তমিজ। বলে,‘হায় রাকিব কেমন আছো।’

‘ভাল, আপনি?’

‘আমি তো ভালোই।’

‘তা কী মনে করে।’

‘খালাম্মা নিতে পাঠিয়েছে ইথিকাকে, নিতে এসেছি।’ রাকিব আসার আগে ফোন করেছে খালাম্মার কাছে, বলেছে ইথিকার কথা;বলেছে আপনি অনুমতি করলে নিয়ে আসবো। ইথিকার মা অনুমতি দিয়েছে। রাকিবের কথা শুনে হা হা করে ওঠে তমিজ। ‘না না এখন কোথাও যাওয়া ঠিক না। শরীর ভালো না ওর। এ সময় বেশি হাঁটাহাঁটি করা উচিত না।’

‘হাঁটাহাঁটি করতে হবে কেন? দরোজার গোড়ায় সিএনজি নিয়ে আসবো। সিএনজি’তে গেলে কোন অসুবিধা তো হওয়ার কথা নয়। আর আপনার যদি আপত্তি থাকে আপনিও চলুন। রাহা তো যাবেই, আপনিও চলুন।’ আবার বলে রাকিব।

ইথিকা শুধু রাকিবকে দেখে আর শুনে যায় ওর কথা; নিজে কোন কথা বলে না। ওর কথাতে এবার বলে তমিজ, ‘না না যাবো না আমি। ইথিকাও না।’ একগুঁয়ে জিদ্দি বালিকার মতো ইথিকা। ‘আমি যাবো।’ কথা বলার পরপরই উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর তৈরি হয়ে দাঁড়ায় এসে। রাকিব উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চলো, ইথিকা, চলো।’ তমিজ পথ আগলে দাঁড়ায়। রাকিবের সম্মুখেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যায় ওকে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দরোজার দিকে এগুতে থাকে। তমিজ তাড়াতাড়ি দরোজা বন্ধ করে আর হাসুনিকে ডেকে সদর-দরোজা বন্ধ করতে বলে। টানতে টানতে ঘরে নিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনী দিয়ে রাখে। হতাশ রাকিব ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। ওকে দেখে ইথিকা জোড়হাত করে ক্ষমা চায়। চলে যেতে বলে!

 

%d bloggers like this: