কোন এক কাশবন/ আফরোজা পারভীন

কোন এক কাশবন

কোন এক কাশবন

কোন এক কাশবন/ আফরোজা পারভীন

 

ভ্যাপসা গরম । দুপুরের পর থেকেই মেঘলা হতে শুরু করে। তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। কখনও নামে মুষলধারে। টানা সে বৃষ্টিতে পথঘাট তলিয়ে যায়। অথচ এখন শরৎকাল। পূর্বাচল দিয়াবাড়ি, আরও কত জায়গায় কাশফুল ফুটেছে। আকাশে মেঘের পালের ভেসে বেড়ানোর কথা। টুপটাপ শিউলি আর ভোরের শিশির ঝরে পড়ার কথা দূর্বাদলে। পড়েও হয়ত কোথাও কোথাও। 

মৌমি থাকে একটা বহুতল ভবনে। সে ভবনের ছাদ ব্যবহারের অনুমতি নেই। ছোট্ট একচিলতে বারান্দায় রোদের দেখা মেলে না। পুরোনো দিনের বউয়ের মতো তিন হাত ঘোমটা টেনে কখনও কখনও আসে সহসা। এসেই মিলিয়ে যায়। সে  রোদমুখের দেখা পাওয়া বড় কঠিন। তাই ফুল  নেই গাছে, পাতাও হলুদ হয়ে যায় । মানুষের মতো গাছেরও  খাবার লাগে। গোড়ায় জল লাগে, কর্ষণ লাগে, সার লাগে। আর সবচেয়ে বেশি লাগে রোদ্দুর। দূর্বাদল মৌমি পাবে কোথায়! বাড়ির চারপাশে শুধু দালানের পর দালান। রমনা বা সোহরাওয়ার্দীতে আছে কিছু ঘাস কিন্তু সেতো বহুদূর। রফিককে অত দূরে নিয়ে যাওয়া সহজ না। যদি গাড়ি থেকে নামলেই ঘাসে পা দেয়া যেত তাহলে  নিয়ে যেত। কিন্তু অনেকটা হাঁটতে হয়। মৌমি কষ্টে সৃষ্টে পারলেও রফিক পারবে না। তাই সে সাধ অপূর্ণই থাকে। 

প্রতিবছর দু’ একবার ওরা দিয়াবাড়ি বা পূর্বাচলে যায়। আগে ভালো লাগত, এখন তেমন ভালো লাগে না। প্রকৃতি যতই নাগরিক আর সভ্য হয় ততই তার সৌন্দর্য হারায়। প্রকৃতিতে হাত মানেই মৌলিকত্ব হারানো। পূর্বাচলে এখন প্রচুর লোক সমাগম । লোক সমাগম মানেই হোটেল রেস্তোরা জমজমাট। খাওয়া গান বাজনা চুড়ি ফিতে খেলনার দোকানে চারদিক সয়লাব। মানুষ আগে ওখানে প্রকৃতি দেখতে যেত, এখন যায় পরোটা হাসের মাংস কিংবা পিঠা পুলি খেতে। বাণিজ্যও হয় বেশ। শহরের লোক দেখে কৃষকরা সবজি, জেলেরা মাছ নিয়ে বসে পড়ে। ৫০ টাকার লাউ ১০০, ৫০০ টাকার মাছ ১০০০ টাকায় কিনে মধ্যবিত্ত হাসিতে খুশিতে মত্ত হয়ে বলে, খুব সস্তায় কিনেছি। কী টাটকা দেখেছ, কী তরতাজা! কৃষক আর জেলে মুচকি হেসে ভাবে, শহরের লোকগুলো এক একটা হাঁদারাম! ওরা অশেষ তৃপ্তি পায় ঠকিয়েছে বলে শুধু নয়, শহরের লোক হাঁদা বলে। ওখানে দেশি মুরগির ডিম পাওয়া যায়। যেটা এখন বিরল। ওই আকর্ষণেও অনেকে যায়। অনেকে যায় হাঁসের ডিম কিনতে। ওটা খেতে নাকি বেশি সুস্বাদু। মোদ্দা কথা কাশফুল, শরৎ-এর আকাশ, শিউলি তখন গৌণ হয়ে যায়। খাদ্য ছাড়া জীবন চলে না এটা যেমন সত্য, বেশি খাদ্যে রুচি বিকৃতি ঘটে এটাও সত্য।  সে কারণেই বুঝি অধিকাংশ বড় কবি সাহিত্যিক শিল্পির খাবারের অভাব ছিল, তারা দরিদ্র ছিলেন। 

এসব ভেবে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় মৌমির। চোখের সামনে দুনিয়াটাকে বদলে যেতে দেখল। মাত্র দুই দশকে ধানমন্ডি গুলশান বনানী বারিধারার যে পরিবর্তন দেখল তা অভাবিত। স্থানিক বদলের চেয়ে  মানসিক বদল আরও ভয়ঙ্কর। এখন আর কাউকেই চিনতে পারে না মৌমি। সবাই যেন অচেনা। প্রত্যেকের চোখে মুখে যেন কিসের একটা শুলুক সন্ধান। তা যদি ভাল কিছু হয় অসুবিধা নেই, কিন্তু ভাল কী? মৌমি সন্দিহান। ওর ভালো লাগে না।

পূর্বাচলের মৌলিকত্ব হারিয়ে যাওয়ায় এখন ওরা যায় দিয়াবাড়ি। দিয়াবাড়িতে এখনও কিছুটা লোক সমাগম কম। গত বছর দিয়াবাড়ি গিয়ে হতাশ হয়েছিল রফিক। কদিন মন খারাপ করে ছিল। শরৎ-এর শুরু থেকেই ও বার বার বলছিল কাশফুল দেখতে যাবে। যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না। দুই ছেলে এক মেয়ে ওদের। সবাই বিদেশে। টাকার অভাব ওরা রাখেনি। অভাব যেটা রেখেছে সেটা স্পর্শের, সান্নিধ্যের। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে মৌমির। একজন ড্রাইভার আর একজন কাজের বুয়া নিয়ে ওদের জীবন। ডিউটি নেই বলে ড্রাইভার বাবুল আসে না। মাস গেলে বেতন নিতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না অবশ্য। অথচ মৌমি ওকে ছাড়তেও পারে না। মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে  যেতে হয়, বাজার সদাই করতে হয়, ওষুধ আনতে হয়। ড্রাইভারের কাজ অতটুকুই। ছেড়ে দিলে পাবে কোথায়! তার বয়স হয়েছে। উবার ডাকা, অনলাইনে বাজার ঘাট রপ্ত করতে পারেনি। চেষ্টাও করেনি। ড্রাইভার বাবুলকে ডেকে এনে গুছিয়ে দিয়াবাড়ি যেতে  বেশ দেরি হয়ে যায়। কিন্তু শরৎ তখনও শেষ হয়ে যায়নি। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে হুইল চেয়ার নামিয়ে রফিককে ঠেলে কাশবনে  নেয়ার আগেই হতাশ কণ্ঠে রফিক বলেছিল,

: আর গিয়ে কী হবে, সব কাশফুল ঝরে গেছে! 

ওর কণ্ঠে ছিল প্রবল হতাশা। বনের দিকে তাকিয়ে মৌমি দেখেছিল আসলেই কাশের অবস্থা হয়েছে ঝড়ে পড়া বকের মতো। 

দুই

 ছেলেবেলায় কাশফুল শিউলি মেঘ কোনটারই বাড়তি কোন মূল্য ছিল না মৌমির কাছে। ঋতু নিয়েও ছিল না মাতামাতি। প্রকৃতি অঢেল দিতো আর ওরাও উজাড় করে নিতো। প্রকৃতির কাছ থেকে চেয়ে বা কুড়িয়ে নিতে হয় এটা তখন ওদের ভাবনাতেই ছিল না। ওরা ভাবত এভাবেই জীবন চলবে। ফুল ফুটবে মেঘ ভাসবে নদী বইবে। চিত্রা নদী যেখানটায় নারীর অপরূপ কোমরের মতো বাঁক নিয়েছে সেখানে ছিল বিশাল এক কাশবন। ওই কাশবনে ঢুকে কত দাপাদাপি করেছে  মৌমি আর বন্ধুরা। গায়ে মাথায় মুখে কাশ মাখিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেয়েছে। যুদ্ধের সময় গ্রামের যে বাড়িতে ছিল মৌমি  সেই বাড়ির পাশেই ছিল একটা বিশাল কাশবন। মৌমি যখনই সময় পেত ওই বনে ঢুকে পড়ত। মা অবশ্য বার বার বারণ করতেন। মৌমি তো তখন ছোট নয়, চৌদ্দ বছরের বেণী দুলানো কিশোরি। আর্মি তখনও ওই গ্রামে আসেনি। কিন্তু রাজাকার আছে। ওই গ্রামে ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু বড় বড় জোতদারদের অধিকাংশই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী। মন মানসিকতা আদব চালচলনে তাদের পাকিস্তানি কেতা। তাই মা মৌমিকে নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কঠোর নজরদারিতে রাখতেন মেয়েকে। একে উঠতি যুবতি তাতে গায়ে গতরে বাড়ন্ত, চেহারায় লাবণ্যের বাড়াবাড়ি। বেশির ভাগ সময় ঘরে লুকিয়ে রাখতেন মেয়েকে। পারলে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু তেমন জায়গা জানা নেই। ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল মৌমি। বাইরে যাবার জন্য তার প্রাণ আইঢাই করত। মায়ের চোখ লুকিয়ে চলেও যেত। বাড়ির পেছনে বিশাল কাকরোল ঝোপ। তারপর খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ওইটুক এক দৌড়ে পার হতে পারলেই বনজঙ্গল। আর তারপরেই কাশ আর কাশ, আদিগন্ত কাশ। সেদিন মা গোসলে গেলে চম্পট দিলো মৌমি। জানে মা বাসায় এসে তাকে খুঁজবে, চিন্তা করবে, বকাবকিও করবে মনে মনে। কিন্তু প্রকাশ্যে না। প্রকাশ্যে করলে সবাই জেনে যাবে। কী এক দিন ছিল তখন! নিজের যে একটা মেয়ে আছে সেটাও জোরে বলা যেতো না। মেয়ে মানেই আতঙ্ক। ছেলে কী আতঙ্ক নয়! ছেলেও আতঙ্ক। কারণ ছেলে শুনলে ওরা ধরে নিতো মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু  ছেলেরা শহিদ হবার ভয় ছিল , ধর্ষিত হবার নয়। পার্থক্য এখানে। আর এ সমাজে পুরুষের অঙ্গহানি হলে সে হয় বীর। নারীর সম্ভ্রম গেলে সে হয় কূলটা। অদ্ভুত এক সমাজ! এতবড় একটা যুদ্ধের পরও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদল হলো না। এসব ভাবার বয়স অবশ্য তখন মৌমির নয়। ও বাড়ি ফিরে মার খানিকটা বকুনি খাবে, এমনকি দু’চারটে কিল থাপ্পড়ও খেতে পারে জেনেই পালালো। আর এক দৌড়ে ফাঁকা জায়গাটুকু পেরিয়ে বন জঙ্গলে কাঁটার আঘাত পেতে পেতে সকালে ঝরে পড়া শুকনো শিউলি বকুল মাড়িয়ে কাশের ঝোপে ঢুকে ডুব দিল। প্রাণভরে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল। হঠাৎ কিসে যেন ধাক্কা খেল ও। পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে দেখল একজন মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আঠারো বিশ বছরের একজন যুবক। তার হাঁটু ঘাড় মাথায় অনেক আঘাত। হাঁটুর কাছে রক্ত জমে আছে। ও এক মুহূর্ত দাঁড়ালো। একবার ভাবলো উল্টে দেখতে চেষ্টা করবে বেঁচে আছে কিনা। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় পেল। দৌড় দিল। দৌড় দৌড়। 

সারা বিকেল সন্ধ্যে গুম মেরে রইল ও। মা বেশ বকাঝকা করলেন। ও কোন উত্তর দিলো না, কথাও বলল না। ও বুঝতে পারছিলো না কি করা উচিত। একসময় মনস্থির করল। মার চারপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগল। মা বুঝলেন মেয়ে কিছু বলতে চায়, সাহস পাচ্ছে না। হাসি পেলো মায়ের। রাগ পড়ে এলো। স্বামী আর দু’ছেলে যুদ্ধে। দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। কতক্ষণ মেয়ের উপর রাগ করে থাকবেন তিনি। 

: কিছু বলবি? 

: হু

: তা ঘুরঘুর করছিস কেন? বল? 

: মা মানে ওই কাশবনে

: কাশবনে কি? 

এরপর হুড়মুড় করে বলে ফেলল মৌমি। মা শুনে কিছুক্ষণ থ মেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,

: সেই দুপুরে দেখে এসেছিস এখন বললি? কোন আক্কেল নেই তোর। কে জানে ছেলেটা বেঁচে ছিল কিনা, কে জানে এখন বেঁচে আছে কিনা। চল। একটাও কথা বলবি না আর চারদিক খেয়াল রাখবি

: তুমি যাবে?

মা কোন কথা বললেন না। হারিকেন হাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত চলতে শুরু করলেন।  

 সেই রাতে দুজনে যে কিভাবে অতটা রাস্তা একজন আহত মানুষকে নিয়ে এসেছিল ওরা ভাবলে আজও অবাক হয়ে যায় মৌমি। ক্রান্তিকাল ছিল বলেই বুঝি সেদিন ওদের গায়ে অসুরের শক্তি এসেছিল। বাড়িতে এনে শুরু হয়েছিল একজন অসুস্থ মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা। মৌমিরা নিজেরাই তখন আশ্রিত। কোথায় খাবার, কোথায় পাবে ওষুধ পথ্য। কিন্তু বিধাতা বাঁচালে ঐশ্বরিক উপায়ে বেঁচে যায় মানুষ। অলৌকিক উপায়েই সেদিন বেঁচেছিল যুদ্ধে পায়ে গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধা! 

তিন 

রফিককে দিয়াবাড়িতে নিয়ে এসেছে মৌমি। গাড়ি থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে কাশবনের কিনারে এনে থামল ও। বনের ভিতরে হুইল চেয়ার নেয়া শক্ত। ঠাসা কাশবন। রফিক বলল, 

: আমাকে একটু ধরে ভিতরে নেবে মৌ। ড্রাইভারকে ডাকো। দুজনে মিলে নাও না

ড্রাইভার বাবুল এলে দুজনের কাঁধে ভর রেখে একটু একটু করে এগোতে লাগল রফিক। ওর একটা পা দুলছে। 

রফিক বলল, 

: এমনই এক কাশবনে আমাদের দেখা হয়েছিল

:  এমনই এক কাশবনে তোমাকে পেয়েছিলাম

: তুমি একজন পঙ্গুকে বিয়ে করেছিলে। তোমার মা বারণ করেছিলেন। তাতে দোষ নেই । সব মাই করবেন

: পঙ্গুকে নয়, মুক্তিযোদ্ধাকে বিয়ে করেছিলাম। মাকে বলেছিলাম, পা কেন যদি জানতে পারি পাঁচ মিনিট পর ওর জীবন চলে যাবে তবুও ওকে বিয়ে করব। 

রফিক মৌমির হাত চেপে ধরে। বাবুল অবাক চোখে দুজনকে দেখে। ওর মনে হয়,  এভাবে ডিউটি ফাঁকি দিয়ে ঠিক করেনি।  আকাশে তখন ভাসছে শরতের মেঘ।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন
%d bloggers like this: