ধাওয়া / শাহানাজ শাহীন

ধাওয়া 17-19

ধাওয়া

ধাওয়া / শাহানাজ শাহীন

১৭

রবিবার মানেই নতুন সপ্তাহ। আমি কলেজে যাচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম ,

কেমন ছেলেকে আমি পছন্দ করবো , বিয়ে করবো–

 প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জোর করে মেঘের চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। সুহাসিনী ক্লাশের বারান্দায় ওঠে। মিলি তাঁকে দেখে এগিয়ে গেল।

“দেখ তালিকা ?”

সুহাসিনী দেয়ালে ঝুলানো বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। কবিতা উৎসবে বিজয়ীদের নামের তালিকা। মিলি হাতে চিমটি কেটে বলে

” দেখ তোর হিরো মেঘের নামও আছে।”

“তোর প্রধান খাদ্য। “

” ফাজলামো রাখ। খাদ্য আমার না তোর। “

“হুম খেতে চেয়েছিলাম। তবে পারিনি। তোর পাতে চলে গেছে। “

” জেনে রাখ, মেঘ আমার প্রধান খাদ্য নয়। “

সুহাসিনী অবজ্ঞার ঢংয়ে বললো।

” আচ্ছা তাহলে তুই খাদ্য সংযমে লেগে আছিস।

ইংরেজীতে যাকে বলে ডায়েট।”

“এটা ডায়েট না মিলি। “

মিলি সুহাসিনীর ভাল বন্ধু। অনেক কিছুই তারা নিজেদের মধ্যে বলে।

“তাহলে কি ?”

“মেঘ আমার মধ্যে আর নেই। “

” ওহ , তাই? প্রফুল্ল হলাম জেনে। “

কারণ গুজব রটেছে তোর কারণে মেঘ সারাকে অপছন্দ করে। “

সারা?

সুহাসিনী মুখে ভেংচি কেটে বলে।

সেই বিকেলে, আমি নিজেকে কবিতার নিলাম বালক মেঘের দরকষাকষি আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম। মেঘের দরকষাকষি চলছে মিলি, সারা ও আমাকে ঘিরে।

 

১৮

আমার বিকেল কাটে মুরগির পরিচর্যা করে।

মুরগিগুলোকে খাবার ও পানি দেয়া। বাবাকে বলে বাজার থেকে মুরগীদের জন্য খাদ্য কিনিয়ে এনেছি।

সেই খাবার এখন ছিটিয়ে দিচ্ছি মুরগিগুলোকে।

কিন্ত আজ কিছুতেই মন বসছে না কাজে।

কেবলই মেঘের কথা মাথার মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিচ্ছে ।

মিলি বলেছে আমার কারণে মেঘ, মিলি অথবা সারা কারো সাথেই প্রণয়ে ভাসতে পারছে না। কী আশ্চর্য!

আমাকে কেনো এ বিষয়ে ভাবতে হবে। আমি কী তাদের বলেছি তোমরা মেঘ থেকে দূরে থাক? এমনকি মেঘের সাথে সম্পর্ক করার কোনো চিন্তাই আমার মাথার মধ্যে নেই। আমি এসব থেকে নিজেকে বের করে এনেছি। মেঘ আমার জীবনে নেই কোনো ভাবেই। যতোটুকু ছিল, কবিতা উৎসবের দিন ক্যান্টিনে তার ইতি টেনেছি। কী করে সে পারল এতো মানুষের সামনে ঝড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে !

কতো বড় দুঃসাহস! একটা বিষয় অবাক হলাম, আমার মুরগির ডিম থেকে অর্থ উপার্জন যেনো পিছনে ঘুরঘুর করছিল। আমি টিনের বক্সটি খুললাম। ডিম বিক্রি থেকে অনেকগুলো টাকা জমেছে। একটা পথ দরকার ছিল অর্থ অপার্জনের। সে পথে এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি। খুবই সামান্য কিছু টাকা। কিন্ত নিজ উদ্যোগে । এটাই আসল ।

শুরুতে প্রতিবেশীরা আমার কাছে জানতে চাইতেন,

“তোমার মুরগির ডিম আছে? “

“আছে “

“বিক্রি করবে? “

আমি দ্বিধান্বিত হই । বিক্রির চিন্তা কখনোই মাথায় ছিল না । ঘরে জমিয়ে রাখা ডিম উপহার স্বরূপ দিয়ে দিতাম। এক সময় তারা উপহার নিতে আপত্তি জানান। আমার অর্থ আসতে শুরু করে।

যদি এই টাকাগুলো তাদের ঘরে ফেলে রাখতাম,

যদি বলতাম, ” ছিঃ ছিঃ কি বলছেন !

টাকা লাগবে না । যখন লাগবে বলবেন ।

ঘরে থাকলে নিয়ে যাবেন।

তাহলে হয়তো অর্থের সাথে আমার লোভ নিশ্চুপ থাকত । অর্থের লোভ কম বেশি সবার আছে ।

আমারও আছে। ডিমের বিনিময়ে অর্থ নিচ্ছি এতে দোষের কিছু নেই । খালি ভান করতে হবে আমি টাকা পয়সা নিতে চাই না। কারণ আমি আসলেই নিতে চাইতাম না যদি বাবার অনেক অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা থাকত ।

 

মিলি পিছন থেকে আমাকে বলছিল,

” শুনলাম কবিতা উৎসবে তুই নাকি মেঘের কবিতা নিলামে কিনতে চাইছিস? “

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মিলি দাঁত বের করে হাসছে। এর মধ্যে হাসির কি আছে বুঝতে পারছি না।

” কি ? কে বললো তোকে? না , আমি নিলামে কারো কবিতা টবিতা কিনছি না। আমার অত পয়সা নেই। “

” আজকে সকালে কেউ একজন দেখেছে তোর হাতে টাকার বান্ডিল। কতো আছে তোর কাছে? “

” এটা তো তোর জানার প্রয়োজন নেই, তাই না?

আর আমি নিলাম ক্রয় করছি না । বুঝলি?

মেঘকে আমি পছন্দ করি না । “

সারা ঠাট্টা করে বললো,

“ওহ হো , দেখবো উৎসবের দিন। প্রমাণ করিস। “

“দেখিস এটাই সত্যি। তোর ইচ্ছা করলে কিনতে পারিস। অর্থের অপচয় কর। কে বাঁধা দেয়। “

সারা , মিলি আর সুহাসিনীর মধ্যে কবিতা উৎসবের আগে উপরোক্ত কথাবার্তা চলে। সারা মেঘকে পছন্দ করে। কিন্ত সুহাসিনীর কারণে মেঘ তাকে পাত্তা দেয় না। সুহাসিনী সরে গেলে সারা মেঘের সাথে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভালবাসায় জয় লাভ করতে পারে।

কবিতা উৎসব বড় একটি সুযোগ। সারা এ সুযোগ বিফলে যেতে দিতে চায় না।

সেদিন কবিতা উৎসবে সারা বার বার আমার দিকে চাইছিল। সে বুঝতে চেষ্টা করছিল আমার মনোভাব।

আমি এতোটুকু বলতে পারি, আমার চাওয়া পাওয়াকে একেবারেই গ্রাহ্য করছিলাম না।

আমি দেখছিলাম মেঘ স্যুট টাই পরে হাতে কবিতার কাগজ নিয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ায়। আমার মাথা তখন আবারও ঘুরছিল ।

মিজানের কবিতা খুব সহজেই নিলামে বিক্রি হয়ে গেল। দিনা কিনে নেয়। সারা তখনও আমার দিকে নজর রেখছিল । আমি অন্য কারো কবিতা কিনি তাই ছিল সারার প্রত্যাশা।

যতদূর মনে পড়ছে তারপর ছিল নরেশ। নরেশের নাম্বার ছিল আট। আর তারপরই মেঘ। সর্ব শেষ প্রতিযোগী। নাম্বার নয়। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ছোট্ট করে নরেশ সম্পর্কে বলছিলেন।

নরেশ আমাদের প্যারেড দলের দল নেতা।

সে আমাদের শেষ বর্ষের অতি মেধাবী ছাত্র।

তার শখ বই পড়া। মাছ ধরা। মাছ ধরা বলতেই সকলে হো হো করে হেসে উঠল। মনে হচ্ছিল মাছ ধরা অতি জঘন্য কাজ। জেলে বলতেই হিন্দু সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করে । যেনো মুসলিম জেলে নেই ।গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলে জাওলা। কাজকেও মানুষ দলে বিভক্ত করে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম দম নিয়ে বললেন,

তোমরা কি জানো নরেশের জীবনের লক্ষ্য কি?

সবাই চুপ করে থাকে। জীবনের লক্ষ্য কারো কি তৈরি আছে? কেউ কেউ বললো,  জানি না ম্যাডাম।

তিনি বললেন, নরেশের জীবনের লক্ষ্য হল উড়োজাহাজ চালানো। নরেশের কবিতার দাম ম্যাডাম পাঁচ টাকা চাইলেন। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম। সবাই নিরব। আমি তখন ভাবছিলাম কেনো সবাই নিশ্চুপ। নরেশ অসাধারণ এক ছাত্র।

সারা আমার বিড় বিড় করা কথা শুনে  বললো

অবশ্যই।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন,

কেউ নেই? আমার নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল উপরে। আমি দুঃখিত মনে বললাম আট টাকা।

যদিও আমার পরিকল্পনা ছিল না নিলামে কিনবার।

কিভাবে ঘটে গেল যে আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

হয়ত নরেশের জন্য আমার খারাপ লাগছিল।

নাকি মেঘের প্রতি আমার অবিশ্বাস ছিল বলে?

যখন আমি ক্যান্টিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম নরেশের সাথে, আমার মাথায় তখন কাজ করছিল, এই বিস্ময়কর ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে ।

নরেশ আমাকে দুপুরের খাবারের জন্য চেপে ধরল।

আমি না বলতে পারিনি। যে ছেলেটিকে আমার এই অর্ধেক জীবনে চাঁদ করে রেখেছিলাম,

আমার তার সাথে বসে খাওয়ার সৌভাগ্য হলো না। যে চিন্তার বাইরে ছিল তার সাথেই খেতে যাচ্ছি।

” তোমাকে ধন্যবাদ জানাই আমার কবিতা কেনার জন্য। এটা ছিল খনিক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে চলে

যাওয়া বাতাসের মতো । “

” একদম ঠিক বলনি। আমি চেয়েছিলাম তোমার কবিতা কিনতে। তাই কিনেছি। কিনতে পেরে আমি আনন্দিত। আমার ভাল লাগছে । আমি শুনলাম তুমি পাইলট হতে চাও । “

“হুম। আমার মা চান আমি পাইলট হই। “

আমি চেষ্টা করলাম আমার মনোযোগ নরেশের প্রতি দিতে। সে যাতে কিছুতেই বুঝতে না পারে আমি তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছি। কিন্ত এটা ছিল খুবই কঠিন। কারণ মেঘ ঠিক তার পিছনেই বসে ছিল ।

যা ছিল আমার সামনাসামনি।

নরেশ কিছু একটা বলছিল। আমি মনোযোগ দিতে পারলাম না । কারণ আমি দেখছিলাম মেঘ তার চেয়ার ছেড়ে সোজা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো করে আমাদের দিকে আসছে। সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,

“সুহাসিনী তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”

 আমি দেখছিলাম সে দুহাত প্রসারিত করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে।

আমি হতভম্ব হলাম তার কাণ্ড দেখে। ক্যান্টিন ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীতে । এই জনবহুল পরিবেশে সে আমাকে জড়িয়ে ধরতে ব্যাকুল হয়ে গেছে। এমন একটি মুহূর্তের জন্য এক সময় আমি অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু এখন সেই সময় আর অবশিষ্ট নেই।

আমি আনন্দিত হবার পরিবর্তে বিব্রত হলাম।

তুমি যদি কাউকে ভালবাস তবে ভরা মৌসুমে বাস।

মৌসুম চলে গেলে আর ভালবাসা পড়ে থাকে না

ঝড়ে পরা ফুলের মত।

আমি এমন করে কখনোই তাকে পেতে চাইনি।

অন্তত আজকের মত করে নয়।

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে আমি যতোটা সম্ভব দ্রুত হাঁটছিলাম । মনে হচ্ছিল আমার ফুসফুস বেরিয়ে আসতে চাইছে। দরজা খুলে দৌড়ে আমার ঘরে গেলাম। মা পিছন দিক থেকে ডাকছিলেন আমাকে। কারো সাথে কথা বলার মতন মানসিক শক্তি আমার ছিল না। আমি খাটের কোণায় বসলাম।

আমার খুব কান্না পাচ্ছিল । খুব জোরে গলা ফাটিয়ে কাদঁতে মন চাইছিল। আমি নিঃশব্দে কান্নার চেষ্টা

করলাম। মা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন।

সেদিন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম চোখের জল কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। নির্জনতা কখনো বিশেষ দরকার পড়ে। মা দরজা ঠেলে ভিতরে আসলেন।

আমার পাশে এসে বসলেন । তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,

” মা কি হয়েছে তোমার? মনটা খারাপ কেনো?

মাকে বল ? “

“বলতে পারবো না মা। তুমি যাও। “

মা আরো শক্ত করে বসলেন।

” লক্ষ্মী মেয়ে বল কি হয়েছে? তুমি নিশ্চয়ই আমাকে বলতে পার। “

” মেঘ আমাকে মানুষের সামনে অপমান করেছে মা। “

” কী সাংঘাতিক ব্যাপার ! কি করেছিল সে?

” ক্যান্টিনে সকলের সামনে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করেছিল । ”

” কী ভয়াবহ কথা !

বাইরের দরজায় তখন কড়া নাড়ার শব্দ।

মা যাচ্ছিল দরজা খুলতে। আমি বললাম,

“মা মেঘ, তুমি দরজা খুলবে না। তার সাথে কোনো কথা নেই। “

“শোন মা মানুষ মাত্রই ভুল করে। এটা স্বাভাবিক আচরণ। সে হয়তো ক্ষমা চাইতে এসেছে।

তুমি কথা বলে বিষয়টি সাধারণ করে নাও। “

“আমি পারবো না মা। আমি পারব না। “

এরপর থেকে মেঘের উৎপাত করা বেড়ে গেল।

আমাকে কিছুতেই একা থাকতে দিচ্ছিল না। ক্রমাগত ফোন। দরজায় ধাক্কাধাক্কি। জানালার পাশে এসে উঁকিঝুঁকি মারা। বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করা। এমনকি আমার রুমের জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা।

” সুহাসিনী দরজা খোল। আমার কথা শোন।”

আল্লার দোহাই লাগে। একবার শুধু শোন।

এক মুহূর্তের জন্য বাইরে আস। “

সে কেনো বুঝতে পারছে না আমি একা থাকতে চাইছি। তার সাথে কথা বলতে আমার মন চাইছে না। দুই তিন দিন পর তার উৎপাত করা বন্ধ হল।

আমি ভাবলাম যাক অবশেষে অবসান হল।

তারপর একদিন আমি সামনের রুমে একটি বই হাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম পড়ব বলে। আমি সোফায় বসলাম আরাম করে। বাবা আমার পাশে বসে আছেন।

বাবা মুখে আঙ্গুল দিয়ে নক খুঁটছেন । আমি উঠোনে মাটি খুড়ার মত এক ধরনের শব্দ শুনতে পেলাম।

জানালা দিয়ে দেখলাম মেঘ আমাদের বাড়ির সামনের উঠোনে। তার হাতে শাবল । সে বিরাট এক গর্ত খুঁড়ছে। দৃশ্যটি দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল!

আমি চিৎকার দিয়ে বললাম,

“বাবা দেখ সে কি করছে? আমি জানালার দিকে যাচ্ছি। “

বাবা আমাকে বললেন,

“সুহাসিনী শান্ত হও। বস এখানে। আমি তাকে অনুমতি দিয়েছি। “

” অনুমতি দিয়েছ? কিসের জন্য? সে তো একটা গর্ত খুঁড়ছে। “

বাবার নির্লিপ্ত ভাবে বললেন,

“আমি বলেছি তাকে। “

“কেনো বলেছ? “

এটা দেখা ছিল আমার জন্য এক রকম শাস্তির মত ,

সে আমার সবুজ ঘাসে মুড়ানো উঠোনের উপর গর্ত করছে আমার বাবার অনুমতি নিয়ে ।

কী করে বাবা তাকে এরকম কাজে অনুমতি দিতে পারল? মেঘ জানে আমি জানালার পাশে লুকিয়ে দেখছি তাকে । তার কর্ম দেখছি। সে মাটি খুঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে জানালার দিকে দেখছে।

আমি দেখছিলাম সে শাবলটি মাটিতে গেঁথে চলে গেল। বাবাকে বললাম। বাবার মধ্যে কোনো বোধ কাজ করল না। তিনি মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন। আমি মুহূর্তের জন্য মেঘের কথা ভুলে বাবাকে দেখছিলাম।

আমার বাবা অধ্যাপক হলে মানাত। কেনো তিনি ট্রাক াঁলকের পেশা বেছে নিলেন? একজন চলকের যে আচরণ বাবার মধ্যে তা দেখিনি কখনোই।

বরং দেখেছি উল্টো। বাবা ছবি আঁকেন। গান শুনতে, বই পড়তে ভালবাসেন। মায়ের সাথে বাবার মধুর সম্পর্ক। আমাদের তিন ভাইবোনকে তিনি প্রাণের চেয়েও ভালবাসেন। তিনি অতি আধুনিক একজন মানুষ। বাবার জন্য আমার শ্রদ্বায় মাথা নত হলো।

আমি বাবার কথা অমান্য করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি লক্ষ করছিলাম বাবা আমাকে আড় চোখে দেখছেন।

আমি বিস্মিত হলাম যখন দেখলাম মেঘ একটি গাছ হাতে করে নিয়ে আসছে। সে গাছটি গর্তের ভিতরে নামাচ্ছিল। সে গাছ লাগাচ্ছে আমাদের উঠোনে ।

আমার ঠোঁটের কিনারে ঈদের চাঁদের মতো এক রেখা হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। আমি টের পেলাম সেটি।

আমার কাছে সব খোলাসা হলো।

কোনো প্রশ্ন নেই করবার মতো। এ গাছ আমার বহু দিনের চেনা।

এর পাতা, ডাল, শিকড় ,গঠন সব আমার বহু দিনের চেনা। আমার প্রাণের নিম গাছ।

১৯

যখন সুহাসিনী দরজা খুলে বেরিয়ে আসল।

আমি ফিরে গিয়েছিলাম সেই প্রথম দেখাতে । সুহাসিনীর কাছ থেকে কি কেউ কখনো দূরে যেতে পেরেছে?

আমি বহুদিনের সেই চোখ দেখলাম আবার।

যে চোখ আমায় টেনেছিল ছেলেবেলায়।

আমার মেঘ। সেই দীপ্তিময় চোখ। আর আমি এও জানি মেঘ এখনো বহন করে চলছে আমার প্রথম ভাললাগা। প্রথম অনুভূতি।

আমার প্রথম ছুঁয়ে দিতে চাওয়া।

যখন আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম,

একটা বিষয় আমি উপলব্ধি করলাম

ফেলে আসা বছরগুলো আমাদের আসলেই সেরকম কোন কথা হয়নি। আমি দ্বিধায় বললাম ,

“মেঘ তোমার কি সাহায্য লাগবে?”0

“অবশ্যই” 

এতগুলো বছর পরে আবার আমাদের নতুন করে শুরু , নতুন পথে পথ, পুরাতন হাতে নতুন করে হাত রাখা।

আমি জানতাম সুহাসিনীর সাথে আবার কথা হবে।

অনেক কথা। সে কথা চলবে লম্বা সময় ধরে।

আমরা দুজনে গাছের গোড়ায় মাটি ভরছিলাম।

মেঘ আমার হাতে হাত রাখে মাটির ছলে

মেঘের কবিতার কথা আমার মনে পড়ে যায়

উড়ে যায় প্রেম —

( সমাপ্ত)

 

%d bloggers like this: