হাপচি আর নাপচি – শরীফ শেখ

শরীফ শেখ

ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি

 

ছিমছাম,  চুপচাপ সুন্দর একটি শহর থিম্পু। এ শহরের প্রাণকেন্দ্র বা ডাউন টাউনে রয়েছে একটি টাওয়ার। টাওয়ারটির শীর্ষে একটি চতুষ্কোণাকার ফলকের চারপার্শ্বে চারটি ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে, নগরবাসীর সময় দেখার সুবিধের জন্য। এটি থিম্পুর প্রধান সড়কের পাশে । সড়ক থেকে আনুমানিক একশত ফুট নিচের ধাপের সমতলে। সড়ক থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি স্থাপন করা আছে। এই সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামতে হয় এখানে। বৃহৎ একটি লন পাথরের স্ল্যাব দিয়ে পুরোটা পাকা করা আছে। তার মাঝামাঝি এ টাওয়ার। এখানে একটি গ্রীক প্রোসেনিয়াম টাইপের মঞ্চের মতো করা আছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সভা বা পথনাটকের প্রদর্শনীর জন্য উপযুক্ত। ক্লক টাওয়ার চত্বরের এক পাশ দিয়ে বিভিন্ন শপিংমল, আবাসিক হোটেল, অ্যান্টিকস-এর দোকান ইত্যাদি। ক্লক টাওয়ারের চতুষ্কোণ পিলারের গায়ে খোদাই করা ড্রাগনের ছবি। ড্রাগন মুখ হা করে আছে আর তার লেজ দিয়ে আলোকের ফুটকি বিচ্ছুরিত। আর পায়ের নখরে ধরে আছে মণিমুক্তো।

 

ক্লক টাওয়ারের ওপরের যে প্রধান সড়কের কথা বললাম, সেই সড়ক দিয়ে উত্তর দিকে খানিক দূর গেলে চৌরাস্তায় থিম্পুর একমাত্র ট্রাফিক সিগনাল। একটি গোলাকার বেদির ওপর চারদিকে চিকন পিলা। ওপরে গম্বুজাকৃতির ছাদ দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের দাঁড়াবার ব্যবস্থা আছে। এখানে দাঁড়িয়ে একজন ট্রাফিক পুলিশ দুহাতে সাদা দস্তানা পরে হস্ত নির্দেশের মাধ্যমে ট্রাফিক কন্ট্রোল করে থাকে। এটাই থিম্পুর একমাত্র ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্ট। বেশ একটা আদি অকৃত্রিম ভাব আছে এতে। এই ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্ট পেরিয়ে আরো পনের কুড়ি মিনিট বিরতিহীন হেঁটে একটি তিন রাস্তার সংযোগস্থল। এখান থেকে পশ্চিম দিকে পাহাড়ের ওপরের দিকে হাঁটলে বেশ খানিক দূর গিয়ে বামে মোড় নিলে বাংলাদেশ দূতাবাস। থিম্পু শহরের এ এলাকাটির নাম আপার চুবাচু। আর এই তিন রাস্তার সঙ্গমস্থল থেকে সোজা উত্তর দিকের রাস্তাটি গেছে ভূটান সেক্রেটারিয়েট ও রাজপ্রাসাদের দিকে। রাজপ্রাসাদটি প্রাসাদোপম নয়। গাছপালা ঢাকা ছোট সাধারণ একটি বাড়ি। ভূটানের রাজা ইচ্ছে করলে অত্যন্ত বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ বানাতে পারতেন। কিন্তু রাজার পূর্বপুরুষগণ যেমন জনগণের রাজা ছিলেন, তেমনি এই রাজাও জনগণের রাজা (People’s King)। তিনিও বিলাসবহুল বা বড় অট্রালিকা তৈরি করেননি।

 

হাপচি আর নাপচি - শরীফ রুহুল আমীনরাজপ্রাসাদের অ্যাপ্রোচ রোড বামে রেখে আরো সামনে গেলে একটি নদী। নাম থিম্পু নদী বা থিম্পুচু। ভীষণ খরস্রোতা এই পাহাড়ি নদীর উপর দিয়ে ওপারে যাবার জন্য একটা সেতু রয়েছে। সেতু না বলে এটাকে কালভার্টই বলা শ্রেয়। আমি মাঝে মাঝে আমার পুত্রসহ বা একা এম্ব্যাসি থেকে ভোরবেলা জগিং করতে করতে এই রাজপ্রাসাদের সামনের দিকটা পেরিয়ে ডানদিকের একটি খালি খোলা সমতল মাঠে এসে ব্যায়াম করতাম আর দূর থেকে দেখতাম রাজপ্রাসাদের অ্যাপ্রোচ রোডের মাথায় দুজন সৈনিক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার এই ব্রিজ পেরিয়ে ওপরের রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি/জগিং করতাম। জগিং-এ ক্লান্ত হয়ে পড়লে এই ব্রিজের কাছাকাছি নদীর পাড় থেকে নদীর স্বচ্ছ সলিলে সন্তরণরত শীতল পানির ট্রাউট মাছের ছোট ছোট ঝাঁক দেখে নয়ন জুড়াতাম।

ওপরের রাস্তা মূলতঃ পাহাড়ের ঢালে পাহাড় কেটেই করা হয়েছে। এই রাস্তা ধরে উত্তর দিকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার গেলে পাবেন প্রাক্তন রাজার পুরাতন বাসভবন দেচেনচোলিং প্যালেস। এখানে রাজা বা তাদের আত্মীয়স্বজন কেউ থাকেন না। এটি এখন সরকারি অফিস এবং অতিথিশালা। এখানে মাঝে মাঝে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি হয়। একবার এখানে একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে গিয়েছিলাম। একটু আগে যে ব্রিজ বা কালভার্টের কথা বললাম, তার কাছাকাছি যেখানে দাঁড়িয়ে পাঠক, আপনাদের ট্রাউট মাছের ঝাঁক দেখালাম, সেখানটা ধরে  পূর্ব দিকে পৌনে এককিলোমিটার গেলে নদীর ওপর আরেকটি ব্রিজ পাবেন। তবে তার আগেই একটি বড় আকারের, ধরুন আমাদের গ্রামের স্কুলগুলোর বড় একটি খেলার মাঠের দুটোর সমান আয়তনের একটি সমতল পাবেন। এখানে পাবেন একটি মার্কেট, অনেকটা আমাদের গ্রামের আধাপাকা সেড বিশিষ্ট বাজারের মতো বিপনীকেন্দ্র। এটার নাম হলো ‘ঢাকা মার্কেট।’ এখানে ভূটানি এবং নেপালি ধাতব অ্যান্টিক সামগ্রী পাওয়া যায়। তবে মার্কেটটি ‘ঢাকা মার্কেট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এজন্য যে, এখানে প্রচুর শীতের গরম কাপড় বিক্রি হয়। এসমস্ত শীতের কাপড় ভূটানি নারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঢাকার বঙ্গবাজার থেকে কিনে পোটলা বেঁধে নিয়েিএসে বিক্রি করেন। এখানে একটা ইনফরমেশন পাঠকগণকে দিয়ে রাখি। তাহলো, বাংলাদেশের সাথে ভূটানের এই ইনফরমাল বিজনেস আমাদের অর্থনীতির জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও কূটনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিজনেসের মাধ্যমে দুদেশের পিপল-টু-পিপল যোগাযোগ হচ্ছে। আমাদের দেশে তৈরি গরম কাপড়ে ভূটানের জনগণের শরীর ওম পাচ্ছে। একটি জনমুখী দেশের মানুষের শরীর উষ্ণ হলে সেই দেশের মন উষ্ণ হতে খুব সময় লাগে না। আন্তর্জাতিক দরকষাকষিতে একটি ক্ষুদায়তন দেশের সমর্থনও বড় ব্যাপার হয় অনেক সময়। এছাড়া পাঠকের নিশ্চয়ই জানা আছে, ভূটান আমাদের মহান স্বাধীনতার প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ। সুতরাং ভূটানের সাথে রয়েছে আমাদের একটা আত্মার সম্পর্ক।

তো খারাপ বাপারটি হলো কি বলি। একবার ভূটান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি একটি অনুষ্ঠানের সাইডলাইনে আমাদের মান্যবর রাষ্ট্রদূতকে আলাদা করে বলেন, ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমাদের খেঁটে খাওয়া নারীরা আপনাদের বঙ্গবাজার থেকে কাপড় নিয়ে আসে। কিন্তু বর্তমানে বেশ সমস্যা হচ্ছে।

কী সমস্যা?

সমস্যা হলো এরা ভোরবেলা সড়কপথে চ্যাঙড়াবান্ধা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বঙ্গবাজারের আশেপাশের হোটেলে থেকে পরদিন সারাদিন বাজার করে রাতের বাসে করে বুড়িমারী হয়ে ভূটান রওয়ানা দেয়। কিন্তু কতিপয় অসভ্য লোলুপ বাঙালি ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায়িক সুবিধের কথা বলে হোটেলে গিয়ে তাদের অনৈতিক প্রস্তাব দেয় এবং কিছুক্ষেত্রে কেউ কেউ তাদের লালসার শিকার হয়েছে। এটা তাদের ফ্যামিলিতে জানাজানি হওয়ায় তাদের হাসব্যাণ্ডরা তাদের আর ব্যবসার কাজে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে না, ফলে তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এবিষয়ে, এক্সেলিন্সি, একটু ব্যবস্থা নিন।

 

আমাদের তৎকালীন মান্যবর রাষ্টদূত এ বিষয়ে সেদিনই ঢাকাস্থ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টেলিফোনে বিষয়টি জানান এবং একটি পত্রও প্রেরণ করেন। আমাদের বাংলাদেশীদের নৈতিক মানসিক চরিত্র যদি বিদেশিদের কাছে এরকম বাজে বলে প্রতিভাত হয়, তাহলে দেশ সম্পর্কে কী ধারণা হবে? একই সাথে আমি ভূটানের ওই সরকারি কর্মকর্তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, এ বিষয়টি নিকটস্থ থানায় ডায়রি করতে এবং পুলিশ ফাঁড়িতেও  জানাতে বলেছিলাম। আমার মনে হয় এতে বেশ কাজ হয়েছিল।

এই ঢাকা মার্কেট নদীর ধারে। এখানে আরেকটি ব্রিজ দিয়ে নদীর ওপারে গেলে বেশ বড়োসড়ো একটি মার্কেট। ‘থিম্পু ফার্মার্স মার্কেট’। এখানে চাল ডাল আটা, যবের ছাতু, আটার ছাতু, পেঁয়াজ রসুন, আদা, মসলাপাতি, অ্যাসপারাগাস, বিভিন্ন প্রকার ফলমুল যেমন, আপেল, নাশপাতি, আঙ্গুর, বেদানা কেনাকাটা করতে মানুষ আসে। পাশের বিপনীতে হাড়িপাতিল বাসনকোসনও মেলে। এখানে আপনাদের দুএকটি জংখা ভাষা শেখাই। হাপচি আর নাপচি। হাপচি হলো গমের ছাতু আর নাপচি হলো যবের ছাতু। হাপ মানে গম আর নাপ মানে যব। বাকী প্রত্যয়টার অর্থ নিশ্চয়ই বোধগম্য সবার কাছে, জলের মতো।

(চলবে)