বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, শহিদ বুদ্ধিজীবী এবং ছড়াবদলের দিন – রফিক মীরাজ
সেদিনটি ছিল রৌদ্রকরোজ্জল এক সকালবেলার। বর্ণমালার পাঠ চুকিয়ে আমার পাঁচ-ছ জন শিশু বাড়ির বহিরাঙ্গণে নাচানাচি করে খেলা করছি আর সমস্বরে ছড়া আওড়াচ্ছি-
আওলা-ঝাওলা পাকিস্তান,
দেশে আইলো ইরিধান;
ইরিধানের গন্ধে,
নয়াভাবী কান্দে।
কী গো ভাবী কান্দেন ক্যা ?
– আপনের ভাইয়ে মারছে,
মাইরা-টাইরা জিজ্ঞাস করে-
কোন জায়গাটা বেদনা করে?
পাশেই কাচারিঘরে বা বৈঠকখানায় চলছে বসার আয়োজন। কাকু হাঁক-ডাক করছেন, “ওরে ওয়াজেদ, চেয়ারগুলো এদিকে দে, জব্বার তুই বেঞ্চটা ঐদিকে রাখ; এই খালেক, মনীন্দ্রকে নিয়ে বসো; মিলন, তুই চৌকিটার উপর চাদর বিছিয়ে দে; আবুচাঁন, সামনাটা ঝাড়ু দে রে ; এই আয়েশা শোন, ভাবীকে বল চা-পানের ব্যবস্থা করতে; মেলা মানুষজন আসবে আজ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে। এই ছুট্টু, তুই দৌড় লাগা, হরমুজের দোকান থেকে দুই জোড়া চান্দা ব্যটারী লইয়া অখনই আইবে, নতুন ব্যটারী লাগাইয়া ফুল সাউন্ডে রেডিও ছাড়তে হইবো, কারো যেন ভাষণ শুনতে অসুবিধা না অয়”।
যেই কথা সেই কাজ, যেই আদেশ, নিমিষেই তা পালন। পুরো বাড়িজুড়ে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য, উৎসব উৎসব রব, “আজ রেডুতে শেখ সাবের ভাষণ হুনবাম।”
আমরা আমাদের মতো আপনমনে ছড়া কাটছি, নাচানাচি করছি আর লক্ষ্য রাখছি, আজ কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের কাচারিঘরে !
একটু পরেই লোকজনের আসা শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান মুরব্বী, আশপাশের দু-চার গ্রামের ছাত্র-যুবা, বুড়ো-আধাবুড়ো ভিক্ষুকের দল, শ্রমজীবী মানুষ আর আমাদের মতো নাবালক শিশু-কিশোর।
সবাই যার যার আসনে বসে গেছেন। সবারই উৎসুক দৃষ্টি আমার কাকুর (শহিদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলী) দিকে, সবাই যাকে প্রফেসর বা স্যার বলে ডাকে। কাকু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো শিশু-কিশোরদের সতর্ক করে বললেন, “সাবধান! তোমরা কেউই কিন্তু কথা বলবানা, আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনবাম”। কাকু তার জাপানী রেডিওটাতে চোখ বুলিয়ে তা অন করলেন। একটু পরেই শোনা গেল এক মধুর বজ্রকণ্ঠ, চারদিকে পিনপতন নীরবতা- “ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত…….”। আমরা বড়দের দেখাদেখি সম্মোহিত হয়ে বজ্রকন্ঠের আওয়াজ শুনছি আর একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছি অবাক বিস্ময়ে! এদিকে ভাষণের আওয়াজে মাঠ থেকে হালচাষ ফেলে চলে এসেছে চাষী, পথচারী দাঁড়িয়ে গেছে স্তব্ধ হয়ে, নরসুন্দর সুনীলদা থামিয়ে দিয়েছে তার ক্ষৌরকাজ, বউ-ঝিরা ঘোমটা টেনে ভেতর-উঠানে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে, তাদের শ্বাস যেন আর পড়ে না, শুনছে যেন এক অমৃতবাণী। অবশেষে বজ্রকন্ঠে ধ্বনিত হল- এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা !
সেই থেকে স্বাধীনতার ন’টি মাস আমাদের নাচানাচি-খেলার ছড়াটি বদল হয়ে যায়, ছেলেবেলায় ছড়া বলে পাড়া বেড়ানোর হৈ-হুল্লোড়ের ছড়াগুলো বদল হয়ে যায় ! মুখে ঠাঁই করে নেয়, সম্মোহনী নতুন একটি ছড়া-
এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম;
এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা !
Facebook Comments Sync