বোরকা – তসলিমা পারভীন

তসলিমা পারভীন

আমি উত্তর বঙ্গের মানুষ। মাথায় আয়োডিনের অভাব। মেধা বুদ্ধি কম। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় পরীক্ষার খাতায়, পা হতে মাথা পর্যন্ত এর এক কথায় প্রকাশ,লিখেছি বোরকা।সেই  বয়সে হঠাৎ কখনো কাউকে কালো বোরকা পরিহিত দেখলে ভুত মনে করে ভয় পেতাম। তখন বনেদি ঘরের দুই একজন বয়স্কা নারী ছাড়া তেমন কেউ বোরকা পরতো না। অথচ আজ আমাদের দেশে বোরকা একটি খুব জনপ্রিয় পোশাক।  আজকাল বিপুল সংখ্যক নারী এ পোশাক পরে। শুধুমাত্র ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে নারীরা বোরকা পড়ে, এমনটি নয়। স্কুল, কলেজের ছাত্রীরা নিরাপত্তার কারণে বোরকা পরে। বোরকায় মুখসহ সারা শরীর ঢাকা থাকে ফলে বখাটেরা বুঝতে পারে না,বালিকা না বৃদ্ধা, তরুণী  না মহিলা। তবে বোরকা পরলেই যে তরুণীরা ইভটিজিং বা সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পাবে তা কিন্তু নয়। নুসরাত হত্যা তার প্রমাণ। নুসরাত মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল, বোরকা পরতো। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা বোরকা থাকলে একাধিক ও দামী পোশাক কেনার সমস্যা থেকে রক্ষা পায়। সাধারণ পোশাকের উপর বোরকা পরে তারা অনায়াসে যে কোনো অনুষ্ঠানে, বা কোথাও বেড়াতে যেতে পারে। সম্ভবত এই কারণেই  হয়তো, গ্রামাঞ্চলে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মুসলিম নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের নারীরা যাদের ভালো কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই, তারা কোন রকমে একটি বোরকা কিনে রাখে। বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে সেটা পরে। হয়তো সেকারণেই অধিকাংশ নারী বস্ত্র কর্মী বোরকা পরে । আজকাল গৃহকর্মীরাও বোরকা পরে চলাফেরা করে । আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, গৃহকর্মকে ( বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, রান্না করা  ইত্যাদি) মর্যাদার চোখে দেখে না। তাই অভাবের কারণেই যারা পরের বাসায় কাজ করে , তাদের অনেকেই বোরকা পরে। যাতে চলাচলের সময় কেউ চিনতে না পারে। যে কেউ যে উদ্দেশ্যেই বোরকা পরিধান করুক না কেন, এতে তাদের পর্দা করা হয়ে যায়। ফলে বদলোকের কুনজর থেকে এ নারীরা রক্ষা পায়। আমার এক ননদকে হঠাৎ বোরকা পরতে দেখে শুধালাম, তুমি এ পোশাক কবে থেকে পরা শুরু করেছো? সে বললো ” আর বলো না ভাবি, আমাকে দিনের বেলা কয়েকবার বাসার বাইরে  যেতে হয়। তিন সন্তানকে তিন স্কুলে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আনা নেওয়া করতে হয়। কাঁচাবাজার মার্কেটিং, তার উপর মাকে দেখতে যাওয়া আমাকে একাই করতে হয়। বাইরে যাওয়ার সময় কতবার পোশাক পাল্টাবো। ঘরে পরা কাপড় পরে তো আর বাইরে যাওয়া যায় না। বাচ্চাদের স্কুলে দেখি মায়েরা প্রতিদিন নিত্য নুতন ড্রেস পড়ে আসে যেন ফ্যাশন শো। কে কত দামী ও বাহারী পোশাক পরে আসতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে। আমি মধ্যবিত্ত মানুষ, প্রতিদিন আমাকে ঘরের বাইরে যেতে হয়। একেকদিন একেকরকম পোশাক পরা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় সে প্রতিযোগিতার সামিল হওয়া। তাই অনেক চিন্তা করে এই বোরকাটা কিনেছি। ঘরে  পরা কাপড়ের উপর এটা পরে নিয়ে সবখানে যাই। এতে আমার পর্দা করাও হয়ে যায়। “এ শুনে আমি বুঝে নিলাম , ননদিনীর ঘটে বুদ্ধি আছে বটে। ননদিনীর ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, তারা ভার্সিটি পাশ দিয়েছে। কিন্তু সেদিন সে বাস্তবতার প্রয়োজনে, যে বোরকা পরা শুরু করেছিল আজও সেটা ছাড়েনি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে। আমার ননদিনী আজ ধর্মপরায়ণা, পর্দানশীন নারী।

অনেকে বোরকা পরাকে ফ্যাশন হিসেবে দেখে। তাদের একাধিক রং বেরং এর বাহারি ঝলমলে বোরকা থাকে। সে কি কারুকাজ। হাতে বুকে গলায়, লেস লাগানো, ঝালর লাগানো, পুতি ও কাঁচ বসানো, কতো রকমের আকর্ষণীয় কারুকাজ। যা দেখে  চোখ ঝলসে ওঠে। লোকে তাকাতে বাধ্য হয়। ফলে আপাদমস্তক ঢাকা পোশাক পরেও শালীনতা রক্ষা হয় না।

বোরকা হবে  ঢিলে ঢোলা, যাতে শরীরের অবয়ব ফুটে না ওঠে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে অনেক তরুণী, এমন টাইটফিট বোরকা পরে যা  পর্দা রক্ষার পরিবর্তে বেপর্দা ও রুচিহীনতার পরিচয় দেয়। তাদের শারীরিক সৌন্দর্য এতে প্রদর্শিত না হলেও বোরকা প্রদর্শনী হয়ে যায়। ফলে বোরকা পরার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আমি উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের পার্কে বিকেলবেলা হাঁটতে গিয়ে, বোরকা পরিহিতা অল্প বয়সের তরুণীদের দেখেছি তারা   (সম্ভবত তারা স্কুল কলেজে পড়ে এবং কোচিং- এর নাম করে পার্কে এসেছে) পার্কের পরিবেশ নষ্ট করে। পার্কে হাঁটতে আসা বয়স্কদের অস্বস্তিতে ফেলে। বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিতে কিংবা প্রেমিকের সাথে অশালীন ভাবে বসে থাকতে, এবং অন্তরঙ্গভাবে সেলফি তুলতে দেখেছি। এসব তরুণীর মায়েরা নিশ্চিন্তে  থাকেন এই ভেবে যে, আমার মেয়েতো বোরকা পরে শালীনতার সাথে স্কুল /কলেজ ও কোচিং- এ যায় । বোরকা পরিহিতা তরুণীর মনে কুবুদ্ধি থাকলে, বোরকা নিরাপত্তা না দিয়ে বরং ভুল পথে পা বাড়ার সু্যোগ করে দেয়। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পড়শী ভাবির (এক কৃষিবিদ ভাইয়ের স্ত্রী) সাথে বোরকা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আজকাল স্কুল, কলেজের অনেক মেয়ে বোরকা পরে, এই প্রসঙ্গে  তিনি বলেন, আমি কখনো মেয়েকে বোরকা পরতে দেব না। কেননা মেয়ের মনে যদি দুষ্ট বুদ্ধি থাকে, তাহলে বোরকা পরে, তার পছন্দের ছেলের সাথে রিক্সায় চড়ে, আমার সামনে দিয়ে চলে যাবে, আমি বুঝতেও পারবো না। ভাবির যুক্তি অকাট্য। অপরাধচক্রে ও অপরাধ কান্ডে জড়িত নারীরা বোরকা পরে জনারণ্যে মিশে গিয়ে ঘুরাফেরা করে এবং অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়। বোরকা পরিহিত  থাকায় কেউ সন্দেহ করে না। কিছু দিন আগে এক মার্কেটে বোরকা পরিহিতা এক নারীর সাথে আমার ধাক্কা লাগে। পরে দেখি আমার ভ্যানিটি ব্যাগে  রাখা টাকা উধাও। নুসরাত হত্যার সাথে জড়িত নারী, যে নুসরাতের  গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে সে বোরকা পরিহিতা ও তার মুখ ঢাকা ছিলো।  আমার কাছে মনে হয় দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে  পুরুষের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক নারীর মধ্যে, ধর্মীয় চিন্তা চেতনা ও মুল্যবোধ এবং নিষ্ঠার সাথে ধর্মীয় আচার পালন করার অভ্যাস  বেড়েছে। এসব ধর্মপরায়ণা নারী পর্দা করার জন্যই বোরকা পরে। আমাদের চারপাশে যা দেখেছি এবং তা দেখে যা বুঝেছি তাই নিয়ে আমার এ লেখার অবতারণা। আমি নিজেকে  মুক্তমনা, স্বাধীন চিন্তা চেতনার মানুষ বলে মনে করি। অন্যের স্বাধীন চিন্তা চেতনাকে শ্রদ্ধা করি। কে কেমন পোশাক পরবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।

 

%d bloggers like this: