রবীন্দ্রনাথের রস-রসিকতা ২/ রক্তবীজ ডেস্ক
ছয়.
একদল ছাত্রছাত্রী ও অতিথি সাথে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে বেরিয়েছেন শান্তিনিকেতনের আশপাশে। বেড়ানো শেষ করে ফিরছেন তখন। হঠাৎ ‘গুম’ করে একটা শব্দ হলো। অনেকে এদিক ওদিকে চেয়ে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, ‘কিসের শব্দ কিসের শব্দ।’ রবীন্দ্রনাথ গম্ভীরভাবে বললেন, ‘সাড়ে নয়টার তোপ পড়ল।’
তাঁকে সবাই ভীষণ মান্য করত। তিনি যা বলতেন তাই বেদবাক্য জ্ঞানে বিশ্বাস করত। তিনি ঠাট্টা-তামাশা বা মজা করতে পারেন এটা কেউ ভাবতো না।
একটি মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ কোথায় তোপ পড়ল?’
রবীন্দ্রনাথ গম্ভীরভাবেই বললেন, ‘ ফোর্ট উইলিয়ামে।’
সাত.
রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে বেরিয়েছেন। সাথে নির্মলকুমারী মহলানবিশ, তাঁর স্বামীসহ অনেকে। সবাই মিলে কেনাকাটা করতে গেছেন। একসময় রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করলেন নির্মলকুমারী নানা দোকান থেকে নানা সাইজের আবলুশ কাঠের হাতি কিনছেন। গুরুদেব নির্মলকুমারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার, এত হাতি কিনছ কেন?’
নির্মলকুমারী লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘তিনি (প্রশান্ত মহলানবিশ) এ ধরনের হাতি পছন্দ করেন।’
রবীন্দ্রনাথ অপাঙ্গে মোটাসোটা, শ্যামা রংয়ের নির্মলকুমারীর দিকে চেয়ে মজা করে বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝতে পারছি প্রশান্তর কেন তোমাকে এত পছন্দ!’
আট.
সেবার শান্তিনিকেতনে শারদোৎসবে নাটক অভিনয়ের আয়োজন হয়েছে। অভিনয়ের মহড়া হচ্ছে। ছাত্র, শিক্ষক, এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যোগ দিয়েছেন অভিনয়ে। মহড়ার জন্য একজন ছাত্রের ডাক পড়ল । ছাত্রটি তখন অঙ্ক শিক্ষক জগদানন্দ বাবুর ক্লাসে অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য সাধুকে বলা হলো ক্লাসে গিয়ে ছাত্রটিকে ডাকতে। সাধু গিয়ে জগদানন্দ বাবুকে জানালো গুরুদেব মহড়ার জন্য ছেলেটিকে ডাকছেন। জগদানন্দ আগে থেকেই ছেলেটির উপর বিরক্ত ছিলেন। তার অঙ্কের অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। তিনি সাধুচরণকে সাফ বলে দিলেন, ‘আমার ক্লাসের সময় ছেলেরা নাচানাচি করতে যাবে না। যাও, গুরুদেবকে গিয়ে বল, এখন ছেলেটাকে ক্লাস ছেড়ে যেতে দেয়া হবে না।’
সাধুচরণ ফিরে এসে কাঁচুমাচু মুখে সব কথা জানালো। সবাই বিব্রত। পাশেই বসে আছেন গুরুদেব। তিনি সবই শুনেছেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার! গুরুদেব মোটেও রাগ করলেন না। বরং যেন মজা পেলেন। বললেন, ‘ আর এদিকে ঘেঁষে দরকার নেই, ব্রাহ্মণ চটে গেছে। ব্রাহ্মণের রাগ আগুনের মতো, সব ভস্ম করে দেবে!’
‘তাহলে মহড়ার কী হবে?’
রবীন্দ্রনাথ নিজেই পথ বলে দিলেন। বললেন, ‘স্বয়ং জগদানন্দবাবুকেও শারোদৎসবের অভিনয়ে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ কর। তাহলে তাঁর সঙ্গে ওই ছেলেটাও মহড়া দিতে আসবে।’
জগদানন্দবাবু সেবার লঙ্কেশ্বরের চরিত্রে অভিনয়ে করে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন।
নয়.
কবি বেশ কয়েকবার মংপুতে কিছুদিন করে থেকেছিলেন। এ সময় তাঁকে নিয়মিত প্রবাসী পত্রিকায় জন্য লেখা পাঠাতে হতো। একবার মধু নিয়ে তিনি একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। কবিতা প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর পার্সেলে তাঁর কাছে এক বোতল মধু আসে মংপুতে। পাঠিয়েছেন কবির এক অচেনা ভক্ত। কবি মৈত্রেয়ী দেবীকে পার্সেলটি দেখিয়ে বললেন, ‘ দেখেছ তো, মধুর বিষয়ে কবিতা লেখার পর মধু আসছে।’
তখন আড্ডা চলছিল। ঘর ভরতি লোক। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ কৌতুক করে বললেন, ‘এরচেয়ে আপনি যদি চাল, ডাল, তেলের ওপর কবিতা লিখতেন তবে চাল, ডালও ঘরে আসত। সংসার খরচ কিছুটা সাশ্রয় হতো।’
এমন সময় সুধাকান্ত রায়চৌধুরী বললেন, ‘ডাক্তার সেনও লুকিয়ে একটি মন্তব্য করলেন, তিনি বললেন মধুর কবিতা লিখে যদি মধু আসে, তাহলে মধুর বদলে বধুর কবিতা লিখতে পারতেন।’
কবি বললেন ‘মনোমোহন এ কথা বলে বুঝি? সাধু! এত উত্তম প্রস্তাব, ভেরি গুড সাজেশন।’
দশ.
ঠেকায় পড়ে অনিলকুমার চন্দকে একবার ‘তাশের দেশ’ নাটকে অভিনয় করতে হয়েছিল। রুইতনের অভিনয়। সংলাপ খুবই সামান্য । কিন্তু অনিলকুমার অভিনয় করতে রাজি হচ্ছিলেন না। আপত্তি জানালেন। কারণ হিসেবে তিনি বললেন তঁর কথায় সিলেটি টানের কথা। তিনি মেঘকে ম্যাগ বলেন । একথা শুনে সংলাপ বদলে রবীন্দ্রনাথ ‘ মেঘ’ বদলে বসালেন কুয়াশা।
একদিন মহড়া চলাকালে বনমালী কেক নিয়ে উপস্থিত হলো। কোন এক দিদিমণির নাম করে বলল., অমুক দিদিমণি ক্যাক করে পাঠিয়েছেন, আপনি একটু ক্যাক খান।’ কবি বললেন, ‘ওটা খেয়ে আমার কাজ নেই, যারা মেঘকে ম্যাগ বলে তাদের ক্যাক খাওয়াও গে।’
এরপর তিনি কেকের থালা অনিলকুমারের দিকে এগিয়ে দিলেন।
Facebook Comments Sync