জল মাখা জীবন ৭/ আফরোজা পারভীন
সাত
আলতাকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি জয়কলসে এসেছে রমজান মায়মাল। ওদের দেখে ছুটে এসেছে আলতার ভাসুর হারু মায়মাল।
:তা তালতোভাই খবর না দিয়ে আসলেন যে । খবর দিলে আমরাই নৌকা পাঠিয়ে আপনাকে নিয়ে আসতাম। যাকগে এসে পড়েছেন বেশ করেছেন। গরীবের বাড়িতে হাতির পাড়া পড়েছে । এখন আপনাকে আমি কোথায় বসাই কি খাওয়াই।
তাড়াতাড়ি বসার ব্যবস্থা করে হারু মায়মাল। আলতার দিকে তাকিয়ে বলে,
: ছোট বৌ আছো কেমন? চেহারা যেন কেমন পুড়ে পুড়ে গেছে । সেই উজ্জল বর্ণ আর নেই।
পর্দার আড়াল থেকে হারুর বউ বলে,
:আপনারও যেমন কথা। স্বামীই নেই । গায়ের বর্ণ থাকবে কি করে! শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে কি করে!
: তা ছোটবউ তুমি বাইরে বসে রইলে কেন। বাড়ির ভিতরে আসো। এবার এখানে থেকে যাবে তো ? এবার আর তোমাকে যেতে দেব না । আমাদের এতোবড় বাড়ি আর তুমি একজনমাত্র মানূষ । কেন যে গেলে আমরা বুঝি না । মাঝে মাঝেই তোমার কথা বলি। বউ আসো, ভেতরে আসো ।
আলতা ঘোমটা আরো একটু ভাল করে টেনে দিয়ে ভেতরে ঢোকে । মনে মনে সে আবেগ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে । এ বাড়ি তার কতো আপন! একদিন এ বাড়িতেই সে বউ হয়ে এসেছিল । তারপর ছয় ছয়টা বছর আদরের বউ হয়েই ছিল এ বাড়িতে । ছোট দেবর ছরু মায়মাল তখন বিয়ে করেনি। সে বিয়ে করেছে তার ভাই নুরু মায়মাল মারা যাবার পর।
যে কদিন এ বাড়িতে ছিল সবার চোখের মণি হয়ে ছিল আলতা । স্বামী নুরু মায়মালের একটা সন্তানের বড় শখ ছিল। অনেক তাবিজ কবচ পানি পড়া খাইয়েছে আলতাকে । মুসলমান হলেও এ পরিবার অনুকূল ঠাকুরের ভক্ত। অনুকূল ঠাকুরের শিষ্যের আখড়ায়ও আলতাকে নিয়ে গিয়েছিল নুরু । সেখান থেকে তাবিজ এনেছিল । তারপরও সন্তান হয়নি আলতার। কিন্তু সন্তান না থাকার জন্য স্বামী , দেবর, ভাসুর , জা কোন যন্ত্রণা দেয়নি আলতাকে । আলতা বরং মাঝে মাঝে তার স্বামীকে বলেছে,
:তুমি একটা বিয়ে করো । আমার কোন আপত্তি নাই। আমার মন বলে আমার সন্তান হবে না।
স্বামী বলেছে ,
: ওসব অলুক্ষুণে কথা বলো নাতো আলতা বউ। সন্তান হলে এখানে তোমার গর্ভেই হবে, না হলে না।
আলতাকে আলতা বউ বলে ডাকতো তার স্বামী। এ ডাকের কারণে বড় ভাবি কতো ঠাট্টা মস্করা করত। সেই ভাল মানুষ স্বামীটা মাছ ধরতে যেয়ে আর ফিরে এলো না। মিয়াভাই বলে, তার স্বামীকে দেবর ভাসুর মেরেছে তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য। অলতার তা মনে হয় না। এ বাড়িতে যতোদিন ছিল আলতাকে আদরেই রেখেছে ভাসুর জা। ওদের কখনও লোভী মনে হয়নি। বরং ভাইটাকে তারা বড়ই ভালবাসতো। ভাই-এর মৃত্যুতে ওদের সেকী উথাল পাথাল কান্না!
সেই বাড়িতে এসেছে জমি ভাগ করতে। ভাবতেই খারাপ লাগে আলতার । কি করে বলবে সে জমি ভাগ করার কথা। সে কিছুই বলতে পারবে না । যা বলার মিয়াভাই বলুক।
গুড় মিষ্টি কুমড়ো মুগের ডাল হিদল আর যতোসব প্রিয় জিনিস আছে সবই হাজির করা হল একে একে । হারু মায়মাল রমজানকে বলল,
:তাহলে বিয়াই ছোট বউকে রাখার জন্যই এসেছেন। আমরা বড়ই লজ্জিত। অনেক আগেই বউমাকে আমাদের নিয়ে আসা উচিত ছিল।
রমজান মায়মাল হেলেদুলে বসে। এসব মিষ্ট কথায় ভুলবার পাত্র সে নয় । মিষ্টি কথায় ভুুলার জন্য অতোদূর থেকে বিধবা বোনকে সাথে করে সে এখানে আসেনি। ইতোমধ্যে হারু মায়মালের বাড়িঘর দেখে নিয়েছে রমজান। তার মতো বড় মহাজন না হলেও অবস্থা নেহায়েত মন্দ নয় । কয়েক শত বিঘা জমি এদের আছে নিশ্চিত । ভাগের ভাগ পঞ্চাশও যদি আলতা পায় সেওতো অনেক। এইতো কিছুক্ষণ আগেও হারু ছোটভাই ছরুর সাথে আলাপ করছিল ধান বিক্রি নিয়ে । আগামীকাল সকালে নিগার আসবে ধান কিনতে। আগাম টাকাও নাকি দিয়ে গেছে । এই ধানে তার সৎ বোন আলতারও ভাগ আছে। তাহলে টাকার ভাগ কোথায়?
খেতে খেতে হারু মায়মালের দিকে তাকিয়ে গুছিয়ে কথা বলল মরজান । বলল,
:আসলে তালতোভাই আলতা এসেছে তার জমি জমার ভাগ বুঝে নিতে । অনেকদিন তো হলো । আপনারা অনেকদিন তার জমি ভোগ দখল করলেন। এবার সে তার হিস্যা বুঝে চায়।
:মানে? চমকে উঠলো হারু মায়মাল। মেজ বউ এর আবার ভাগ কি?ওর তো কোন ছেলে পুলে নেই।
ততোক্ষণে ছিরু মায়মালও এসে বসেছে পাশে । সেও গলা মিলালো ভাই-এর সাথে।
রমজান বলল ,
:কথা আপনারা ঠিকই বলেছেন । তবে কথা হচ্ছে আলতার নামে কিছু জমি রেখেছিল নুরু। নিজের রোজগার থেকে নিজের সত্রীর নামে। আলতাকে তো সে খুবই ভালবাসতো।
দুই ভাই পরস্পরের দিকে তাকায় । চোখে চোখে কথা হয় । হারু বলে,
: কিন্তু সে জমিতো অনেক আগেই আমাদের কাছে বিক্রি করে গেছে নুরু।
:একজনের জমি আরেকজন বিক্রি করে কি করে। ওসব ধানাই পানাই বাদ দেন। অনুকূল ঠাকুরের কথা আছে,
দেখ নাই যাহা নিজ নয়নে
বিশ্বাস করোনা গুরুর বচনে।
জমি বিক্রি করতে আমি দেখিনি । আলতাও দেখেনি । কাজেই আমরা বিশ্বাস করি না। এবার আমাদের জমি জমা ভাগ করার ব্যবস্থা করেন। গড়িমসি করলে পঞ্চায়েত ডাকব।
পঞ্চায়েত ডাকার প্রয়োজন হলো না। ইচ্ছে করলে অনেক ঝামেলা করেতে পারতো হারু ছরু ।
বিশেষ করে তাদের বাড়িতেই যখন আলতা আর রমজান মায়মাল এসেছে। কিন্তু কিছুই করলো না তারা। অতি সহজেই জমি ভাগ করে দিলো। আর সে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে ফিরে এলো আলতা। আসার সময় আলতা হারু মায়মাল আর জাকে বলল,
:আমার উপর মনে কষ্ট রাখবেন না ভাইসাহেব, ভাবিজান । আপনারা আমারে কোনদিন খারাপ জানেননি। কিন্তু মিয়াভাই -এর ইচ্ছে তার গ্রামে জমি কিনে দেয়ার।
:না বউ, তোমার উপর আমাদের কোন রাগ নেই। তবে কাজটা তুমি ঠিক করলে না। তোমার ভাই কথা রাখার মানুষ না, কথা রাখবে বলে মনে হয় না।
ভাসুর জায়ের কথা ফলে গেল সপ্তাহ খানেকের মধ্যে। নিজ বাড়িতে এসে প্রথমেই টাকা পয়সাগুলো নিজের হাতে নিয়ে নিল রমজান। আলতা মৃদু বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করল।
: থাক না আমার কাছে । জমি জমা যখন ঠিক ঠাক হবে তখন না হয়…….
আলতার পিঠে আদরের হাত রাখে রমজান। :তাহলে বোন তুই আমারে বিশ্বাস করিস না। আমি আরও ভাবলাম তোর ভালোর জন্য টাকাগুলো আমার হাতে থাকা ভাল। টাকা হাতে থাকা মানে বোঝা হাতে থাকা। দিনকাল ভালো না। তাছাড়া লোকজন জানে তুই শ্বশুরবাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে এসেছিস । হাতে কাঁচা টাকা। কার মনে কি আছে কে জানে। তার চেয়েও বড় কথা ঘরে রয়েছে বিভীষণ । লেখাপড়া করতে শহরে পাঠালাম। দু দুবার ম্যাট্রিক ফেল দিয়ে নবার বাড়ি ফিরল। সারাক্ষণ টাকার জন্য ছোঁক ছোঁক। সেইবা টাকার গন্ধ পেয়ে কি করে বসে কে জানে। তবে যাকগে বোন তোর মনে যখন সন্দেহ তো থাক। বরং আগে জমি জমা দেখি । তোরে একটু সুস্থির দেখতে পারলেই আমার স্বস্তি। ভাই বলিস বোন বলিস তুই আমার একা। তা মনে দুঃখ থাকল তুই আমারে বিশ্বাস করলি না………….কথা শেষ করার আগেই বাড়ির মধ্যে ঢুকল শরীফ। মুখে সিগারেট , পানে ঠোঁট রাঙা, মুখে গান । আলতাকে দেখে থেমে দাঁড়াল,
:তুমি তাহলে এসে পড়েছ ফুফু। তাহলে বাপজান তার দিলের মকসুদ পুরা করে ফিরেছে । তা করুক যার যার দিলের মকসুদ পুরা। আমারও দিলের মকসুদ পুরা ফুফু।
:কি বলিস বুঝি না।
:বুঝবা কি। বুঝলে তো আর আমার বাপজানরে বিশ্বাস করতে না। যাকগে শহরে গিয়েছিলাম সিনেমা দেখতে। তা যা একখান থার্ড ক্লাস ছবি দেখলাম ফুুফু। স্টোরি ভি নাই , কিস ভি নাই, ডান্স ভি নাই।
:চুপ চুপ কুলাঙ্গার।
ওরে কেন খালি খালি বকো মিয়াভাই। কি নাই বাপজান?
ফুফুর কথার উত্তর না দিয়ে বাপের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে ঘরে চলে যায় শরীফ।
:এই কুলাঙ্গার ঘরে থাকতে তুই মেয়ে মানুষ হয়ে নিজের কাছে টাকা পয়সা রাখতে চাস। আপন ভাইরে বিশ্বাস করিস না? তোর জব্বর সাহস!
:না মিয়াভাই, তোমারে আমি ষোলআনা বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি বলেইতো জমি জমা বেঁচে আনলাম। নইলে ম্বশুরবাড়ির ওরা মানুষ খারাপ না। এই নাও টাকা। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমারে কিছু জমি কিনে দাও।
পরদিন থেকে দৃশ্য বদলে গেল। মাত্র এক রাতের ব্যবধানে আলতা হয়ে উঠল এ বাড়ির চাকরানি। উঠতে গালাগালি, বসতে গালাগালি। থাকার খোটা, খাওয়ার খোটা। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে তাকে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবার তাগিদ। কোথায় জমি কেনা আর কোথায় নগদ টাকা।
আলতা জমি কেনার কথা বললে রমজান বলে, :জমি কিনব কি দিয়ে। জমি কিনতে টাকা লাগে না?
:তোমাকে যে অতোগুলো টাকা দিলাম মিয়াভাই।
:তুই টাকা দিল আমাকে! কবে কখন! এসব জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা ধর্মেও সইবে না। আমি বলি কি তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে । তুই বরং শ্বশুর বাড়িতে চলে যা। আমার ঘরে বৌ নেই, পাগল পালা আমার কর্ম না।
চোখের জলে ভাসে আলতা । একে বলে, তাকে বলে কোন ফল হয় না। শেষপর্যন্ত দৌড়ায় পঞ্চায়েতের কাছে। পঞ্চায়েত দিন দুয়েক পরে বিচারের আশ্বাস দেয়। পরদিন গলায় কলসি বাঁধা অবস্থায় আলতাকে পাওয়া যায় সুরমা নদীর পানিতে। রমজার মায়মাল কাঁদতে কাঁদতে বুক চাপড়ে বলে,
:বোনটার আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সুনামগজ্ঞে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো বলে মনস্থ করেছিলাম। সে সুযোগ দিলো না বোন আমার । আহারে আল্লাহ, আহারে সোনার বোন আমার।
লাশের গন্ধ পেয়ে থানার দারোগা ছুটে এলো । লাশের গন্ধ ছুটছে। প্রশ্ন এটা হত্যা না আত্মহত্যা । পোস্টমর্টেম করতে হবে। পঞ্চায়েত দশ হাজার পেল । দারোগা পেল দশ হাজার । মার্ডার কেস হয়ে গেল সুইসাইড । দাফন হল আলতার। শুধু তার কবরের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে গেল সিধু পাগলী বার কয়েক। বুকে বাড়ি দিয়ে হাসল আর বলল,
:আমি সব দেখেছি , সব জানি। সব জানি। মানুষ বড় বেঈমান।
Facebook Comments Sync