গঙ্গার ওপারে হাওড়া/লিয়াকত হোসেন খোকন

গঙ্গার ওপারে হাওড়া/লিয়াকত হোসেন খোকন

কেউ বলে হুগলি নদী, গঙ্গা কিংবা ভাগীরথীও বলা হয় এই নদীকে। এর ওপারেই হাওড়া জেলা। আর এপারে কলকাতা জেলা। হুগলি নদীর ওপর সেই ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল হাওড়া ব্রিজ। রবীন্দ্র সেতু নাম দেওয়া হলেও কেউ তা বলতে চায় না। হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু দেখে মনে মনে ভাবলাম, আমাদের ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা। এই জিঞ্জিরাও হতে পারে জেলা, আর বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নাম নজরুল সেতু হলে তো ভালোই হতো। হাওড়া জেলার পূর্বে হুগলি নদী, কলকাতা জেলা, উত্তরে হুগলি জেলা, দক্ষিণে হুগলি নদী, নারায়ণ নদী আর মেদিনীপুর জেলা।

২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী হাওড়া জেলার লোকসংখ্যা ৪৮,৪১,৬৩৮। আয়তন ১৪৬৭ কিমি। মহকুমা ২টি হাওড়া ও উলুবেড়িয়া। এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন বেলুড়, কোলাঘাট, হাওড়া স্টেশন (পুরাতন), হাওড়া স্টেশন (নতুন)। পুলিশ স্টেশন – আমতা, বেলি, বাগনান, দাসনগর, দমজুর, হাওড়া, শিবপুর, শ্যামপুর, বেতলি, রানিহাতি, উলুবেড়িয়া।
হাওড়াকে কেউ বা বলেন নদীর দেশ। বয়ে গেছে হুগলি, রূপনারায়ণ, দামোদর। দামোদরের, দুই উপনদী রয়েছে এই হাওড়া জেলায়। একটির নাম কানা দামোদর, অপরটি পুরনো দামোদর।

হাওড়ায় তো অনেকবারই গিয়েছি, দিল্লি, লখনৌ , অমৃতসর, মুম্বাই, চেন্নাই যাবার জন্য হাওড়া স্টেশনে আসা। একবার ভাবলাম, হাওড়া হয়ে কত না জায়গায় যাচ্ছি, এবার হাওড়ায় দু-চার দিন থেকে দেখি না এই জেলাকে। হাওড়া ও কলকাতাকে আমার কাছে জোড়া শহর বলেই মনে হয়েছে। হাওড়া কিন্তু পশ্চিম বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ব্যবসায়ী শহরও বলা হয়। অসংখ্য শিল্পকলকারখানা রয়েছে হাওড়ায়। এখানে আছে পাটকল, ক্যামিক্যাল ফ্যাক্টরি, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বোটানিক্যাল গার্ডেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি।

বিদ্যাসাগর সেতু, হাওড়া ব্রিজ, রেলস্টেশন, বেলুড় মঠ এখানের অন্যতম আকর্ষণ।

১৯৯৩ সালের কথা :
হাওড়াকে ভালোভাবে দেখা ও জানার জন্য উঠলাম হাওড়ার ‘রামকৃষ্ণ’ হোটেলে। বিকেলে বসে আছি বারান্দায়। হঠাৎ দেখি কৃষ্ণ হেঁটে যাচ্ছে। হাত উঠিয়ে বললাম, ‘এই যে কৃষ্ণ, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

একটু হেসে বলল, ‘গত রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, তাই এ পথে যে এলাম।’ কথাটা বলে কৃষ্ণ আমার খুব কাছে এল।

এবার আমরা দুজনে চললুম বেলুড় মঠ দেখতে। দক্ষিণেশ্বর থেকে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে জিটি রোডে গড়ে উঠেছে মঠ বেলুড়ে। কলকাতা থেকে দূরত্ব ১০ কিমি আর হাওড়া থেকে ৬ কিমির মতো। বাস ও মিনিবাস যাচ্ছে কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে হাওড়া হয়ে। তবে দক্ষিণেশ্বর ভ্রমণার্থীদের নৌকায় বেলুড় যাওয়াই সুবিধার। নৌকা থেকে ১৯২৭ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তৈরি বিবেকানন্দ সেতুটির সৌন্দর্য দেখে চলা যায়। বাসও যাচ্ছে ৫১ ও ৫৬ রুটের দক্ষিণেশ্বর হয়ে বেলুড়ে। ১৮৮৬ সালে প্রয়াত ঠাকুরের পূত অস্থি ৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ কাঁধে বয়ে এনে প্রতিষ্ঠা করেন বেলুড়ে। আর ১৯৩৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্বামী বিবেকানন্দ পরিকল্পিত এই মঠ রূপ পায় সেই পুণ্য ভূমে। এখানে মঠের স্থাপত্যে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন রয়েছে। চার্চ, মসজিদ, আর মন্দির – এই তিনের সমন্বয়ে রূপ পেয়েছে বেলুড় মঠ। মঠটি পরিচালনা করেন ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন। মিশনের মূল দপ্তরও এই মঠে। মাত্র ৩৮ বছরে বয়সে ১৯০২ সালের ৪ জুলাই দেহ রাখেন বিবেকানন্দ। সমাধিও হয়েছে মঠ প্রাঙ্গণে। মঠের উত্তর-পূর্ব গঙ্গার তীরে দ্বিতল বাড়ি – স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন ওখানে। স্মারকরূপে স্বামী বিবেকানন্দের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের প্রদর্শনী বসেছে।

এক পলক দেখা :
স্বামী বিবেকানন্দের এ বাড়িতে ঢুকে ফিরে গেলাম আরেক জগতে। সঙ্গে কৃষ্ণ। দুজনে তন্ময় হয়ে দেখেই যাচ্ছি। এখান থেকে বের হতেই মুখোমুখি হলাম একজনার। মনে হয় তাকে অনেক দেখেছি। ঠিক স্মরণে আনতে পারছিলাম না। কৃষ্ণই বলল, চিনলেন না?
বললাম, চেনা চেনা লাগে…।
কৃষ্ণ হেসে – উনিই তো সেকালের নায়িকা সুচিত্রা সেন।
ততক্ষণে উনি অনেক দূরে চলে গেছেন।

গঙ্গার তীরে :
গঙ্গার পাড়ে এসে বসলাম। দু’নয়ন ভরে দেখে যাচ্ছি গঙ্গাকে। এক রাখালকে দেখেই কৃষ্ণ গান ধরল : দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে
আমার বাটে বটের ছায়ায় সারা বেলা গেল খেলে
গাইল কী গান সেই তা জানে,
সুর বাজে তার আমার প্রাণে
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কাছে আভাস পেলে আমি তারে শুধাই যবে ‘কী তোমারে দিব আমি’
সে শুধু কয়, আর কিছু নয়, তোমার গলার মালাখানি দিই যদি তো দাম দেবে যায় বেলা সেই ভাবনা ভেবে ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশিটি তার গেছে ফেলে…। ”

কৃষ্ণের কণ্ঠে এ গান শুনে দুজনে নৌকায় উঠে গঙ্গাকে দেখলাম দু’নয়ন ভরে। কৃষ্ণ বলল, এই গঙ্গার পাড়েই ব্রহ্মানন্দ মন্দির, মাতৃমন্দির, স্বামীজির মন্দির ও রামকৃষ্ণ শিষ্যদের সমাধি পীঠ।
শ্রীরামকৃষ্ণ মিউজিয়াম দেখে তো আরও অবাক হলাম। দেখলাম, শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়াও নানান শিষ্যের স্মৃতি পূত সম্ভারের সাথে তদানীন্তন পরিবেশ নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। এদিকে সারদা মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ রামকৃষ্ণ দর্শন অর্থাৎ ছবি ও পুতুলে ঠাকুরের কথামৃত রূপ পেয়েছে। ওখানে গিয়ে আরও জানলাম, সকাল ৬.৩০ থেকে ১০.৩০ আবার বিকেল ১৫.৩০ থেকে সন্ধ্যা ১৯.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে বেলুড় মঠ।

এক ঠাকুর কানন দেবীর কথা বলেছিলেন…….
বেলুড় মঠের এক ঠাকুরের সঙ্গে যেচে আলাপ করলাম। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বিখ্যাত ব্যক্তিরা এখানে কে কে আসেন? দেখুন, আমার বয়স আজ নব্বই। ফিল্মস্টারদের মধ্যে অনেকেই তো আসতেন। এখন আর আসেন না। তবে কানন দেবীর কথা খুব করে মনে পড়ে। সেই যৌবনে তাকে দেখেছি, তখন তো তিনি নায়িকা চরিত্র থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ১৯৫৫ – ৫৬ সালের কথা। উনি প্রতি মাসে একবার করে এই মঠে আসতেন। শুনেছি, হাওড়ার কোনো এক গ্রামে তার জন্মস্থান। বেলুড় মঠে আসতেই দেখলাম কানন দেবীকে ঘিরে অসংখ্য মানুষের ভিড়।
ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলাম, কানন দেবী কি আপনার সঙ্গে কখনো কথা বলেছিলেন?
ঠাকুর একটু হেসে – বারে উনি এখানে এলে প্রথমেই আমাকে খুঁজতেন। দেখতাম, সঙ্গে থাকতেন তাঁর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য। তারপর কত বছর চলে গেছে, উনি বৃদ্ধা হলেন – ওপরওয়ালার ডাক পেলেন। তারপর? তার আর পর নেই।

%d bloggers like this: