জল মাখা জীবন ৯/ আফরোজা পারভীন

জল মাখা জীবন / আফরোজা পারভীন 

নয়

আগামীকাল শবেবরাত। বাঙালি মুসলমানের ছেলে শবেবরাতের দিনে রুটি হালুয়া খাবেনা তাকি হয়। হোকনা অন্য এলাকা। সেতো আর বিদেশ বিভুঁইয়ে আসেনি। এখানে তো তার মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরাই আছে । অবশ্য ধর্মপ্রাণ হোক আর না হোক শবেবরাতের রুটি হালুয়া সবাই খায় । সে ধর্মের জন্যই হোক আর আনুষ্ঠানিকতার জন্যই হোক। সিলেট সুনামগজ্ঞ এলাকার প্রকট সমস্যা হচ্ছে যার আছে তার প্রচুর আছে , যারে নেই কিছুই নেই। রফিক ঠিক করল একজন সম্পন্ন লোকের বাড়িতে যাবে সে। রহমত শবেবরাত উপলক্ষ্যে দুদিনের ছুটি চাচ্ছে। রফিক শুনেছে ডুবুরিয়া গ্রামে কাশেম সাহেবের বাড়ি । তিনি সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ভেবে চিন্তে রফিক ঠিক করল ডুবুরিয়ায় কাশেম সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে সে রহমতকে ছেড়ে দেবে । তারপর শবেবরাতটা ভালভাবে পার করে আবার ফিরে আসবে হাসনহাটি।  ডুবুরিয়ার কথা  বলতেই চিনে ফেলল রহমত। তার সমীহের ভাব দেখে বোঝা  গেল আশ পাশের দশখানা গ্রামের  সবাই কাশেম সাহেবকে  এক ডাকে চেনে। রহমত মুখে বললও সে কথা। 

ডুবুরিয়ায় কাশেম সাহেবের বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দিয়েই মন ভরে গেল রফিকের। বিশাল এলাকা জুড়ে বিরাট বাড়ি।  কতো যে ঘর দোর তার হিসেব নেই। কিন্তু বাড়িটা সুনশান মনে হল । রহমত তাকে নিয়ে গেল বৈঠকঘরের পাশে। রফিক বলল, 

:একটু ডাক টাক দেও। 

: কই কোথায় আপনারা বাড়িতে মেহমান এসেছে। ঢাকার মেহমান। বড় স্যার। 

ডাক দেয়ামাত্র বেরিয়ে এলো পঁঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। রফিককে দেকেই ব্যস্ত হয়ে উঠল। ভাবখানা এমন যে কোথায় বসাবে কি খাওয়াবে বুঝে উঠতে পারছে না। ব্যস্তভাবে একবার চেয়ার টেনে দিচ্ছে  একবার চৌকিতে বসতে বলছে । 

রফিক সঙ্কোচের সাথে বলল,

:এটা কি কাশেম সাহেবের বাড়ি। ওনার বাড়ি শুনেই এলাম। 

: ঠিকই শুনেছেন এটা ওনারই বাড়ি। আপনি ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন। কাশেম সাহেব আমার চাচা। আমার নাম জয়নাল।  

:জয়নাল সাহেব  এখানে কি দু একদিন থাকা যাবে? মানে কাল শবেবরাত তো। তাছাড়া আমার পিয়নটাও ছুটি চাচ্ছে।

: আলবৎ যাবে। এখানে থাকা যাবেনাতো যাবে কোথায়। এ এলাকায় থাকাতো দূরের কথা বসার জায়গাও আর নেই। আপনি বসেন আমি ভিতর বাড়িতে গিয়ে খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে বলে আসি । 

জয়নাল ভেতরে যায়। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে রফিক বলে , 

:তাহলে জয়নাল তুমি বাড়ি যাও। তবে মাত্র দুদিনেরই কিন্তু ছুটি। দুদিন পর ঠিকমতো চলে আসবে। নইলে কিন্তু আমি বিপদে পড়ব। 

:কিযে আপনি বলেন স্যার। আমরা সিলেটি লোকরা কারো অধীনে কাজ করি না। তবে আপনি যখন আমাদের কাজে এসেছেন আর আমি আপনার কাছে চাকুরি নিয়েছি, তখন  একদম ঠিকঠাক  চলে আসবো আমি। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে। 

ঘরের একপাশে বিছানা বালিশ সুটকেস রেখে চলে গেল রহমত। রফিক গভীর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক শেষ পর্যন্ত তাহলে ভাল একটা আশ্রয় জুটলো। শবেবরাতের দিনটাতে তাকে অন্তত কষ্ট করতে হবে না। ছোট্ট করে একটা শ্বাস লুকালো  রফিক। নিশি তুমি কি জানো আমি এখন কোথায়! তুমি কি জানো আমি এই হাওড়ের বুকে অঁজ গাঁয়ে বসে তোমার একান্ত আপন মুখখানাই বার বার স্মরণ করছি । 

এক জগ  পানি নিয়ে বেরিয়ে এলো জয়নাল। :হাতমুখ ধুয়ে নেন স্যার। ভিতরে রান্নার জোগাড় হচ্ছে । ভাত আর ডিমভাজা । দুপুরের ট্যাংরা  মাঝের তরকারিও আছে।  এতোরাতে  আর কিছু সম্ভব না । কাল ভালমন্দ হবে। 

রফিক হাসে। 

: আপনি যা করেছেন তাইই আমার জন্য যথেষ্ট। আসেন দু চারটে কথা  বলি । 

রফিক হাত মুখ ধুয়ে মুছে খাটের উপর জাঁকিয়ে বসে।  

:বললেন আপনি কাশেমস সাহেরের ভাতিজা। তা কি করেন আপনি?

: লগ্নী ব্যবসা স্যার । এ ব্যবসার মতো ভাল ব্যবসা আর নেই । এই সময় মানে ফাল্গুন চৈত্র মাস অভাবের সময় । কৃষকেরা এ সময় অভাবের শেষ পর্যায়ে থাকে । এ সময় চড়া সুদে লগ্নী হয় স্যার। এখন কেউ পাঁচ পারি ধান দিলে বৈশাখে পায় দশ পারি। পাঁচ হাজার দিলে তিন মাস পরে নগদ দশহাজার। যাকগে স্যার কি বোকার মতো আপনাকে কথাগুলো বলছি আমি । আপনি কি আর খোঁজ খবর না নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন। 

জয়নালের কথা ঠিক বুঝতে পারে না রফিক । বলে,

:এই গ্রামে আপনার ভাল লাগে।  আপনি লেখাপড়া শিখলেন না কেন? আপনিতো ইচ্ছে  করলে সিলেট বা ঢাকা থেকে পড়তে পারতেন। 

:তাইতো ছিলাম স্যার। সিলেটে থেকে ক্লাস  টেনে পড়তাম। পাশেই ছিল মেয়েদের কলেজ।  এক মেয়েকে দেখে খুবই ভাল  লাগল। একদিন বললাম, ভালবাসি। তা জানেন স্যার কি জাঁহাবাজ মেয়ে আমাকে মানুষ জনের সামনে থাপ্পড় মারল।  আমারও জিদ চেপে গেল স্যার। আব্বাকে বললাম মোটর  সাইকেল কিনে দিতে হবে। ভর্তি হয়ে গেলাম করাতে জুডোর স্কুলে। ব্লাক বেল্ট পেয়ে গেলাম। মোটর সাইকেল কেনা হয়ে গেছে ততোদিনে। কলেজের চার পাশে মোটর সাইকেল নিয়ে দিনরাত ঘুরি। পড়ালেখা মাথায় উঠেছে । একদিন মেয়েটা কলেজ  থেকে বেরুচ্ছে। আমি দ্রুত মোটর সাইকেল নিয়ে গেলাম তার পাশে। হ্যাচকা টানে তুলে নিলাম মোটর সাইকেলে । সেখান থেকে সোজা গেলাম ঢাকায়। উঠলাম হোটেলে।  মেয়ের বাবা কেস দিল। দিন সাতেক পরে ধরা পড়লাম মেয়ে সমেত। কোর্টে সবাই বলল বিয়ে করে ফেলতে  । মেয়ের বাবা মাও রাজি হয়ে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে । আমাদের তরফও রাজি। কিন্তু আশ্চর্য জিদ মেয়ের, সে রাজি হল না। কোর্টে দাঁড়িয়ে বলল ওই বদমায়েশ ছেলেটাকে আমি বিয়ে করবো না। আমার জেল হল।  মেয়েকে নিয়ে গেল তার বাবা মা। কয়েকদিন পরে চাচা তদবির করে আমাকে বের করে আনলেন। 

রফিক রুদ্ধশ্বাসে জয়নালের গল্প শুনছিল। এই  ছোট খাট ছেলেটাকে দেখে মনে হয় না জীবনে এমন দুঃসাহসী কাজ সে করেছে। 

রফিক বলল, 

:আপনি বিয়ে করেছেন ?

:অবশ্যই স্যার । আললাহর মাল এক ছেলে।

:আর সেই মেয়েটা? 

:সে এক কেচ্ছা স্যার। আমাকে বদমায়েশ বলে তো বাপ মার সাথে চলে গেল । কিন্তু তারপর কি হল জানেন । বাড়িতে যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজন সমাজ কেউ তাকে গ্রহণ করলো না। সবাই আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ওই যে ওই বিউটিকে জয়নাল উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল । সাতদিন হোটেলে রেখেছিল। 

:তারপর?

:তারপর আর কি স্যার। সে মেয়ে এখন বদ্ধ উন্মাদ। আছে পাবনা মেন্টালে।  যেমন কর্ম তার তেমন ফল। কর্মফল বলে একটা কথা আছে না স্যার। 

রফিক চুপ করে রইল । ভাবল কার কর্মফল কে ভোগ করে। জয়নালের মুখটাকে এখন হায়েনার মুখের মতো মনে হচ্ছে।  এই জয়নালের সান্নিধ্যে তাকে দুদিন কাটাতে হবে। এ বাড়িতে খেতে হবে। বড় ভুল হয়ে গেল। পিয়নটাকেও ছেড়ে দেয়া হল। 

জয়নাল উঠল । 

:বসেন স্যার । ভেতরে দেখে আসি আপনার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কদ্দুর হল। খাওয়ার পর আপনার সাথে আসল আলাপ হবে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো জয়নাল ।

: সামান্য দেরি স্যার। আপনার জন্য  স্পেশাল একটা জিনিস রাননা  করছে  আমার স্ত্রী ।  স্যার আপনার কি ক্ষুধা পেয়েছে ? 

ক্ষুধা রফিকের পেয়েছে প্রচন্ড। কিন্তু সেই কথা কি জয়নালকে বলা যায় । 

না না করে উঠল রফিক। 

জয়নাল বললো ,

:খাবার আসতে যখন একটু দেরি হচ্ছে আমরা  আসল কথাটা সেরে নিই। আপনি কতো টাকা লগ্নী করতে এসেছেন স্যার । 

রফিক ব্যাপারটা বুঝতে চাইল । বলল, 

:কতো লগ্নী করলে কতো দেবেন? 

:যা করবেন তিনমাস পরে তার দ্বিগুণ।  এসব তো আপনার জানাই স্যার। 

:তাতো বুঝলাম। কোন লেখাপড়া? 

:লেখাপড়ার দরকার কি সাক্ষী আছে না। আপনি দু মিনিট বসেন স্যার । 

দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেল জয়নাল। ফিরে এলো আরো দ্রুত । সাথে তিনজন লোক। তিনজনই সমস্বরে বলল, জয়নাল লেনদেনের ব্যাপারে সাচ্চা লোক। বছর পাঁচেক ধরে লেনদেনের ব্যবসা করছে । কখনও কোন সমস্যা হয়নি। আপনি নিশ্চিন্ত মনে লগ্নী করে যেতে পারেন। তিনমাস পরে  এলে চোখ বুজে দ্বিগুন টাকা পেয়ে যাবেন। কোন রকম  সমস্যা হবে না। আমরা সাক্ষী রইলাম। 

রফিক লোকগুলোকে বসতে বলল । তারপর ধীরে ধীরে বলল, 

:আপনারা ভূল বুঝেছেন। আমি এখানে লগ্নী করতে আসিনি। আমি এসেছি একটা প্রজেক্ট নিয়ে । আমার প্রজেক্টের নাম কজেস অব ল্যান্ডলেসনেস । মানে মানুষ দিনে দিনে কিভাবে ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে , এই ভূমিহীন হওয়ার কারণ কি, এসব কারণ উদ্ঘাটন করাই আমার প্রজেক্টের লক্ষ্য। আমি  এসেছি আপনাদের এলাকার দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কিছু কাজ করতে। এ ধরণের লগ্নী কারবার ভালো  নয়।  এতে ধনী আরো ধনী হয়। দরিদ্র কৃষক হয়ে পড়ে নিঃস্ব। আপনারা নিশ্চয়ই গ্রামীণ ব্যাংকের ড. ইউনুসের নাম শুনেছেন? ওনার সাথে আমার ভাল সম্পর্ক আছে । আমি ভাবছি ঢাকায় ফিরে ওনাকে বলব জয়কলসে গ্রামীণ ব্যাংকের একটা শাখা খুলতে । তাতে এ এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের চাকা ঘুরে  যাবে। 

যে তিনজন লোক এসেছিল তারা মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেল। এর দু এক মিনিট পরে উঠে গেল জয়নাল। আশ্চর্য কেউ কোন কথাও বললো না। 

রফিক বসে আছে তো আছেই । খাবার আসার নাম নেই। ক্ষিধেয় আধমরা হবার জোগাড়। রাত ধীরে ধীরে নিষুতি হল । ভিতর বাড়িতে আলো নিভে গেল এক সময় । রফিক অসহায়, রফিক হতবাক। 

এমন সময় বেড়ার ধারে কার যেন পদশব্দ শোনা গেল। কে যেন বেড়া ফাঁক করল একটু। শুধু দুুটো চোখের মণি দেখা গেল অন্ধকারে। সেই চোখ জ্বলা আগন্তুক বলল , 

:আপনি এখনই চলে যান স্যার । জয়নাল আপনাকে খুন করার জন্য মানুষ ঠিক করতে গেছে । 

:কিন্তু কেন?

:আপনি ওর স্বার্থে ঘা দিযেছেন। অতো কথার সময় নেই স্যার । আপনার সময় বড় কম। 

:আপনি কে ?

:আমি একজন ভূমিহীন কৃষক। 

: কিস্তু আমি যে পথ চিনি না। 

:আমার পেছন পেছন আসুন। তবে কতোদূর যেতে পারব জানিনে। 

রফিক দ্রুত সুটকেস পিঠে তুলে নিল। বিছানা নেয়ার অবস্থা এখন নেই। ক্ষুধা তৃষ্ণার বোধ আর নেই। এখন একমাত্র তাড়না বাঁচার তাড়না। 

অচেনা ত্রাণকর্তার পিছু পিছু হাঁটছে রফিক। একসময় দূর থেকে আলো দেখা গেল । মানুষের সাড়া পাওয়া গেল। হারিয়ে গেল ত্রাণকর্তা। যাবার আগে অনুচ্চ কন্ঠে বলল, বামে বামে । বামে কতক্ষণ হেঁটেছে জানে না। একসময় গভীর জঙ্গলে এক কুঁড়েতে  হাজির হল রফিক । ক্ষীয়মান চাঁদের আলোয় সে দেখল তেল চিটচিটে কাঁথার উপর ঘুমিয়ে আছে এক বুড়ি। রফিক বুঝল এই সেই সিধু পাগলি। এর কথা সে শুনেছে লোকমুখে।   ঝপ করে  সুটকেস পড়ে গেল পিঠ থেকে। সে শব্দে চমকে ঘুম থেকে উঠল পাগলী । রফিকের দিকে তাকালো, ফোকলা দাঁতে হাসল । :তোর ভয় নেই । আমি সব জানি। ক্ষিধে পেয়েছে বুঝি । খাবি । মুড়ি আছে । গোগ্রাসে মুড়ি চিবাতে শুরু করল রফিক। 

পরদিন ঢাকার পথে রওনা হল। নিশি ঠিকই বলেছে ঢাকায় থেকেই তার চাকুরির চেষ্টা করা উচিত। দেশের মানুষের সার্বিক চিন্তা চেতনায় চেঞ্জ  না আসলে ওসব প্রজেক্ট করে কিছুই হবে না। 

 

দশ 

ঢাকায়  এসে নিশির খোঁজ করল রফিক । প্রথমে গোপনে খোঁজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে একদিন নিশির মামার বাড়িতেই চলে গেল।  ওকে না দেখে যে এক মুহূর্তও কাটছে না রফিকের। 

মামী বলল, 

:ও তুমি বুঝি নিশির সাথে পড়। তা দুদিন আগে এলে পেতে। এইতো দুদিন আগে চলে গেল লন্ডনে । হঠাৎ করেই প্রস্তাবটা  এলো । পাত্রের বয়স একটু বেশি। কিন্তু ওরতো বরাবরই বড়লোক হবার সাধ ছিল। 

:কি হল বাবা চললে যে । চা খাবে না ? 

: না মামী আমাকে এখন সুনামগঞ্জের বাস ধরতে হবে। ওখানে অনেক কাজ ফেলে এসেছি।     

 

(শেষ)

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন