চন্দনের গন্ধ ৩/ আফরোজা অদিতি
পর্ব ৩
আজকের হাইজ্যাকের কথা বলে না কাউকে। রাতে খাবার টেবিলে তিমিরকে সকালের ঘটনার
কথা খুলে বলে। বাড়িতে সবার কাছে এই কথা বলতে না করে তিসু। তিসুর সব কথা শুনে তিমির
বলে, ‘এখন থেকে তোমাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে আমি অফিস যাব।’
‘না, না। তোমার অনেক ঘোরা পথ হবে। আমার পথ একদিকে, তোমার পথ অন্যদিকে।’ তিসু বাধা দেয়।
‘হোক। তবুও তোমাকে আর একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’
তিসু হেসে বলে, ‘বেশ তো নামিয়ে দেবে কিন্তু আনবে কে? তুমি কি অফিস ফেলে আনতে যাবে আমাকে?’
‘তাই তো কী করা যায়! না একটা গাড়ি কিনতেই হবে।’
তিমিরের কথা শুনে এবারে জোরে হেসে ওঠে তিসু। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলে, ‘থাক আর চিন্তায় মাথায় আকাশ নিতে হবে না। আমাকে কেউ মেরে ফেলবে না, ধরেও নিয়ে যাবে না।
আমাকে রক্ষা করতে আমিই পারব ইন শা-আল্লাহ। তুমি ভাত খেয়ে নাও তো।’ তিসু নিজের পরিবর্তন টের পায় কারণ কখনও ইন শা-আল্লাহ বলে না কিন্তু আজ বলেছে। এই ভাবনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে তিমিরের থালাতে আর একটি মাছ তুলে দেয়। খাওয়া শেষে তিসু খাবার তুলে রেখে
ঘরে এসে দেখে তিমির বই না পড়ে শুয়ে পড়েছে। অথচ ঘুমানোর আগে বই পড়ার অভ্যেস ওর।
তিসু চুল বাঁধতে বসে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে চুল না বাঁধলে ওর ঘুম আসতে চায় না।
তিমিরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী ব্যাপার বল তো তুমি বই পড়ছো না? আজ পড়তে ভালো লাগছে না বুঝি। তোমার তো বই না পড়লে ঘুম আসে না।’
তিমির চুপ করে থাকে। এপাশ ওপাশ করে। তিসু চুল বাঁধা শেষে ওর পাশে বসে। বলে, ‘ঘুম আসছে না বই পড়ো।’
‘না, কেন যেন ঘুম আসছে না, বই পড়তেও ইচ্ছ করছে না।’
‘চুলে বিলি কেটে দেই, তাহলে ঘুম আসবে।’ তিমিরের মাথার কাছে বসে ওর মাথায় বিলি কেটে দিতে থাকে তিসু। তিমিরের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে নিজেই ঘুমিয়ে যায় তিসু। তিমিরের ঘুম আসে না। অনেকক্ষণ তিসুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে তিমির। ওর মুখ অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? কেমন যেন একটা দুশ্চিন্তার ছাপ লেপ্টে আছে মুখে! মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে! ওর কি অসুখ করেছে কোন? অসুখ হলে বলবে না, এটা কেমন কথা হলো; বউ তাঁর সুবিধা-অসুবিধার কথা তো স্বামীকেই বলবে! তাহলে। ওদের বিয়ের বয়স সাত মাস মাত্র। এখন পর্যন্ত কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। মা-বাবা একত্রে, বড়ো ভাই-ভাবী একসঙ্গে, আর ওরা; পৃথক সংসার, পৃথকান্ন! কেউ কারো সাতেপাঁচে থাকে না! তিমির আলতো করে বউকে আদর করে।
মনে মনে বলে, ‘তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি সোনাবউ।’
মধ্যরাতে বউয়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় তিমিরের। তিসু খুব কাঁপছে। ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ভীত মুখের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে। তারপর বলে, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না। স্বপ্ন দেখেছি।’
‘স্বপ্ন দেখে এমন চিৎকার করলে। কী স্বপ্ন?’
‘তেমন কিছু না।’ লজ্জা জড়িত কণ্ঠে বলে।
‘তেমন কিছু না বলছো, আবার কাঁপছো! ফ্যান চলছে ফুলস্পীডে তবুও ঘামছো।’
তিসু একটু ধাতস্ত হয়। নিজেকে শান্ত করে। ওয়াসরুমে যেতে যেতে স্বামীকে বলে, ‘তুমি শুয়ে পড়ো, আমি হাতে মুখে পানি দিয়ে আসছি।’ তিসু ওয়াসরূমে গিয়ে কাঁদতে থাকে। খুব কান্না পায়! কেন কান্না পায় নিজেই বুঝতে পারে না তিসু। তিসু আধা ঘন্টা হয়ে গেল ওয়াসরূম থেকে বের হচ্ছে না দেখে ওকে ডাকে তিমির। তিসুর কোন উত্তর না পেয়ে রীতিমতো ভয় পেয়ে যায় তিমির। দরোজায় দাঁড়িয়ে ভেতরের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করে। কান্নার শব্দ পেয়ে দরোজায় ধাক্কা দেয়। ‘কী হলো, তুমি ওয়াসরূমে বসে কাঁদছো কেন?’
‘তুমি ঘুমাও। আমি ঠিক আছি।’
‘তুমি ঠিক নেই তিসু! বের হয়ে এস।’
‘আমি ঠিক আছি, তুমি ঘুমাও তো।’
‘বারবার বলছো ঠিক আছ, কিন্তু তুমি ঠিক নেই। বিয়ে পরের তুমি আর আজকের এই তুমি;
এই দুই তুমির মধ্যে বিস্তর ফারাক! তুমি বদলে গেছ তিসু। তুমি বাইরে এস, বল আমাকে তোমার স্বপ্নের কথা। সোনাবউ বল না কী স্বপ্ন দেখেছ?’ অনুনয় ঝরে পড়ে তিমিরের কন্ঠে।
কোন কথা বলে না তিসু। ওকে কথা বলতে না দেখে বলে, ‘কিছু না তো তুমি এতক্ষণ কাঁদছিলে কেন? কেনই বা স্বপ্ন দেখে অমন চিৎকার করলে? কেন আমার ঘুম ভাঙালে?’
এবারে তিসু খুব লজ্জা পেয়ে বলে, ‘সরি, ভুল হয়েছে আমার। তুমি ঘুমাও।’ তিসু পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
তিমির বিরক্ত হয়। বিরক্তি চেপে রাখতে পারে না তিমির। বলে, ‘কেন রাত দুপুরে এমন করছো বলতো।’
‘ কোথায় কী করছি? আমি স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে বলব না, এই তো। এতে বিরক্ত বা রাগ হওয়ার কি হয়েছে।’ এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘ঠিক আছে তোমাকে আর কিছু বলব না, আর কাঁদবো না। নাও শুয়ে পড়ো।’ ওদের মধ্যে আর কোন কথা হয় না। দুজনে দুপাশে মুখ করে শুয়ে থাকে। দিন দশেক পরে আবার ভয় পায় তিসু। বিছানায় বসে কাঁদে। তিমির কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারে না। বিরক্ত হয়। তিমির একটু বিরক্ত হলেই ওর রাগ হয়ে যায়! আজ বিরক্ত হয়ে ভেতরে রাগ হলেও কিছু বলে না। তিসুকে কয়েকদিনের জন্য ওর বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিবে স্থির করে। বলে, ‘তুমি কয়েকদিন বাবার ওখানে থেকে আস। আমি তোমাকে কাল সকালে নিয়ে যাবো। তোমার জায়গা বদল হলে যদি কিছুটা ভালো লাগবে।’ তিসু কোন কথা বলে না। তিসুর
মা নেই। যখন মা মারা যায় তখন ওর বয়স মাত্র পাঁট বছর। মায়ের কথা খুব একটা মনে নেই তিসুর।
আবছায়া মনে পড়ে; ওর মা ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতো ওকে; গান গাইতে গাইতে, ছড়া শোনাতে শোনাতে খাইয়ে দিতো। স্নান করাতো, জামা পড়িয়ে কোলে নিতো। সব সময়েই একটা একটা গানের কলি গুনগুন করে গাইতো ওর মা। এখনও এই বয়সেও জোছনা ঝরা রাতে
মায়ের গানের সুর ভেসে আসে কানে। গানের কথা মনে পড়ে না কিন্তও সুর মনে পড়ে! সেই সুর ওকে একটা কষ্টের অনুভূতির দুয়ারে পৌঁছে দেয় । ওকে বাবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসার কথা শুনেই ওর কান্না পেলো। তিসু আবার কাঁদে। মনে মনে বলে, ‘সবার তো মা আছে, তুমি
কেন আমাকে ছেড়ে ঐ তারার দেশে চলে গেলে মা।’ পাশ ফিরে কাঁদে। এই কান্না কথা জানতে দিতে চায় না স্বামীকে।
Facebook Comments Sync