জ্যোর্তিময় মুজিব / নন্দিতা আহমেদ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে মুজিব ছিলেন তৃতীয়।
স্থানীয় গিমাডাঙ্গা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মুজিব। গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি (২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিলো এ দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত। মরে অমর হবেন বলেই যেন জন্মেছিলেন তিনি। কিউবার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর পাহাড়সম কঠোর ব্যক্তিত্ব, তেজস্বী চরিত্র, অদম্য সাহস দেখে তাইতো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ জনগণকে ভালোবাসতেন শেখ মুজিব। বিশ্বাস করতেন নিজেকে যতটা করেন ততটাই। কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি এদেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে। ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ আবারো প্রশ্ন, ‘আর আপনার দুর্বল দিকটা কী?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ সেদিন যে অমোঘ কথাটি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন সেটাই তাঁর জীবনে সত্য হয়ে যায়। জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসাই তাঁর অকালমৃত্যু ডেকে আনে। সে জনগণের মধ্যে তাঁর বিশ্বস্ত মানুষেরা ছিলেন। তারাই ছোবলটি মারে!
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শেখ মুজিব উচ্চশিক্ষা লাভ করুক। তিনি লেখাপড়ার জন্য ছেলেকে কলকাতা পাঠান। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিলো ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এবং প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। ছিলো আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আই.এ. পড়তে যান পিতার ইচ্ছেয়।
শেখ মুজিব ছিলেন খুব দুরন্ত। ডানপিটে আর একরোখা ছিলেন তিনি। ভয়-ভীতি ছিলো না তাঁর চরিত্রে। তাঁর চরিত্রে সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা ও বলিষ্ঠতার সমাবেশ ঘটেছিল ছেলেবেলাতেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুক উঁচিয়ে দাঁড়াতেন, সত্য ও উচিত কথা বলতেন। এসব চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মুজিব খুবই জনপ্রিয় হয়ে হয়ে উঠেন। তাঁকে সবাই ‘মুজিব ভাই’ বলে ডাকতো। স্কুলে পড়া অবস্থায় তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। নিজেকে গণমানুষের অধিকার আদায়ে সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। দুঃস্থ, গরীব, আর্তদের সেবা করার মধ্য দিয়ে মহানুভবতা আর মানবতার আদর্শে দীক্ষিত হন । সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দরদ, বিপদে-আপদে অকুণ্ঠভাবে সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর চরিত্রের অনুপম বৈশিষ্ট্য।
তাঁর ‘জাতির পিতা’ বা ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনে টুঙ্গিপাড়ার মানুষের বড় ভূমিকা রয়েছে। ছোট্ট অনুন্নত গ্রাম ও তার মানুষের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলার লক্ষাধিক গ্রাম ও কয়েক কোটি মানুষকে দেখেছেন। নিজের দিকে ফিরে তাকাননি। জেল-জুলুম, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, শাসকগোষ্টীর অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিলো বাংলার মানুষের মুক্তি। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি উন্নত জীবনের অধিকারী হোক, বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।
তিনি তখন স্কুলের ছাত্র। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক ও মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক সফরে আসেন। মুজিব তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরে মেরামতের দাবি জানান। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি দেখে দুই নেতাই মুগ্ধ হন। সোহরাওয়ার্দী তাঁকে কাছে ডেকে কথা বলেন। তিনি এলাকার রাজনৈতিক খবরাখবর নেন। নিজের ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখতেও বলেন তিনি। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্ক আমৃত্যু ছিলো। সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে শেখ মুজিব গড়ে উঠতে থাকেন। সেই সফর উপলক্ষে একটি সম্বর্ধনা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে সেই কমিটির একটি গোলমালের ঘটনায় শেখ মুজিবসহ চার পাঁচজনকে আসামী করে বিরোধীরা থানায় মামলা করে। গোপালগঞ্জ থানা হাজতে সাতদিন বন্দি থেকে জামিনে মুক্তিলাভ করেন মুজিব। সেই প্রথম তাঁর কারাজীবন। এ ঘটনা তাঁর জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ‘নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন’-এ যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন ‘বেঙ্গল মুসলিম লীগ’-এ। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা ছিলো।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব ঢাকায় এসে ১৪০ নং মোগলটুলীর ‘কর্মী-ক্যাম্পে’ ওঠেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মাঝে মাঝে থাকতেন তিনি। ঢাকায় এসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মুসলিম ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারিতা ও বাংলা বিরোধী ভূমিকার জন্য তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। তিনি ‘পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করেন। যুবলীগেরও একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলাভাষা বিরোধী ভূমিকা এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ গর্জে ওঠে। তিনি ছিলেন এ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রতিবাদ ও হরতাল পালিত হলে শেখ মুজিবও সবার সঙ্গে গ্রেফতার হন। কারাগারে থাকার সময় তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেল থেকে বের হয়ে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। এরপর তিনি জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিস্কার করা হয়েছিল। জেলে থাকাকালে সরকার তাঁকে জরিমানা ও মুচলেকার প্রস্তাব দেয়। তাঁকে জানায় তিনি যদি রাজনীতি না করেন, তাহলে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিনি দৃঢ়ভাবে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করেন। টুঙ্গীপাড়ার জনপদ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা, রাজনীতিবিদদের ফরিদপুর জেলায় আনাগোনা মুজিবের মনকে আন্দোলিত করতো। বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের এ বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও ব্রিটিশ ভারতের নেতৃবৃন্দের আদর্শ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। এক সময় তিনি অনুশীলন সমিতির সভায় নিয়মিত যেতেন। তাঁর মধ্যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, (পৃষ্ঠা-৯) ‘চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকেলে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজদের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত মাদারীপুরে নেতাজী সুভাষ বসুর দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীর দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সন্ধ্যায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বসুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এস.ডি.ও আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পরে শুনেছি।’
পিতা শেখ লুৎফর রহমান চেয়েছিলেন তিনি লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ুন। কিন্তু শেখ মুজিব বাংলার প্রিয় জনগণকে পাকিস্তানের শোষণের মধ্যে রেখে লন্ডনে যেতে রাজি হলেন না। তিনি বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের দাবিতে রাজনীতি করার লক্ষ্যে ঢাকা চলে এলেন।
পঞ্চাশের দশক তাঁর রাজনৈতিক জীবনের উত্থানকাল। তিনি ক্রমান্তয়ে একজন দূরদর্শী এবং প্রজ্ঞাবান কুশলী রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে মিলে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করেন। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।
এদেশের স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ফসল। ভাষা আন্দোলনে জেল খেটেছেন। ৬৬-এর ৬দফা, ৬৯-এর ১১ দফা, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে বঙ্গবন্ধু এ দেশের জনগণের মনে আসীন হন পাহাড়সম উচ্চতায়। নির্বাচনে জিতলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। এসেম্বলি ডেকে বাতিল করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়েই এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। ২৫ মার্চ বর্বর পাস্তিানিরা আচমকা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিচালনার মাধ্যমে হত্যা করে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ওই রাতেই গ্রেফতার হনবঙ্গবন্ধু। আর ওই রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে সূত্রপাত হয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধেরতা বেগবান হয়। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, তিরিশ লক্ষ শহিদের প্রাণদান, অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনের বিনিময়ে আসে কাঙিক্ষত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বালাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তন করেন বীরের বেশে।
যুদ্ধবিধ্বস্তদেশটির শাসনভার হাতে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সরকার। কিন্তু ঘাতকেরা তৎপর ছিলো। তাকে বাঁচতে দিলো না।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সারা জাতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, কাঁদতে পারেনি ভয়ে। বুকে পাষাণভার। তবু চোখ থেকে পানি পড়া নিষেধ, আর্তি আহাজারি করা বারণ। যে সঙ্গীন কেড়ে নিয়েছিল জাতির পিতা আর তাঁর পুরো পরিবারকে, সে সঙ্গীনের ভয়ে কাঁদতে পারেনি বাঙালি জাতি। শুধু যাদের বুকে সঙ্গীন ধরা যায় না সেই স্বাধীন দেশের আকাশ বাতাসে ধূলিকণা কেঁদেছিল, বাঙালি ফেলেছিল নীরব দীর্ঘশ্বাস!
কী ভয়ঙ্কর, কী নিষ্ঠুর আর কী ভয়াল ছিল সেই দিন রাত! ওই রাতে স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, সহোদর, আত্মীয় পরিজন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্মচারীসহ নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন জাতির জনক।
দৃশ্যত হারিয়ে গেছেনবঙ্গবন্ধু। কিন্তু ফিরে এসেছেন বিপুল হয়ে। তাঁর কীর্তি ও কর্মের আলোয় উদ্ভাসিত বাঙালি। সতত করে নামগান। কবি শামসুর রাহমান লিখলেন,
‘ধন্য সেই পুরুষ, যাঁরনামের ওপর রৌদ্র ঝরে
চিরকাল, গান হয়ে
নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর
কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’
পিতাকে নিয়ে লেখা এ কবিতা পুরোনো হয় না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, পিতার নাম আর মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি স্মরিত হবে ততদিন।
একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারী শিশু বৃদ্ধা বৃদ্ধা না মেনে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে গণহত্যা চালালো পাকিস্তানি হানাদারদের এদেশীয় দোসর কিছু বিশ্বাসঘাতক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কতিপয় রাজনীতিক। নারকীয় এই সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার প্রধান হোতা ছিলেন শেখ মুজিবের সহকর্মী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। সাথে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। প্রবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
কী হয়েছিল সেদিন! মহান মুক্তিযুদ্ধের তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি। সারাদিনের অফুরন্ত কাজ শেষে কর্মক্লান্ত বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য দিনরাত কাজ করছেন তিনি। একদল তরুণ সেনা ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘিরে ফেলল তাঁর বাড়িটি। তখন পবিত্র আজানের ধ্বনি মুখরিত করছে দিকবিদিক। সে আজান ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ছুটে এলো ঘাতকের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে পড়ল সে গুলি। একে একে শহিদ হলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ এক পরিবারের সদস্যরা।
বাড়ির সিঁড়িতে অযত্ন অবহেলায় পড়ে ছিল জাতির জনকের মৃতদেহ। এদিক ওদিক ছড়ানো-ছিটানো ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী ও পুত্র পরিজনের লাশ।
বঙ্গবন্ধুরহত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও মর্মান্তিক ঘটনা। মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিঙকন, পেট্রিস লুমুম্বা, এডওয়ার্ড কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধীও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এদের কাউকে বঙ্গবন্ধুর মতো সপিরবারেপৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়নি। পাকিস্তানিরা যা করেনি, করতে সাহস পায়নি তাই করল বঙ্গবন্ধুর আশে পাশে থাকা এদেশের ঘাতকরা।
১৬ আগস্ট তাঁর মরদেহ জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র পনের মিনিটে সামরিক তত্ত্বাবধানে মাটির নিচে শুইয়ে দেয়া হয় হিমালয়সম এই মানুষটিকে। বনানী কবরস্থাানে দাফন করা হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের। তাঁকে শেষ গোসল করানো হয়েছিল লাইফবয় সাবান দিয়ে, দাফন করা হয়েছিল রেডক্রসের কাপড় দিয়ে। আশপাশের একজন মানুষ, একজন আত্মীয়কেও আসতে দেয়া হয়নি শেষবারের মতো একটিবার পিতাকে দেখতে।
বহুবছর পনের আগস্ট ছিলো রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারিক কার্যক্রম। দীর্ঘ কাঁকর বিছানো পথ ডিঙিয়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ৬জন খুনিকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বিদেশে পালিয়ে থাকা অন্য খুনিদের দেশে ফিরিয়ে ফাঁসি কার্যকর না করা পর্যন্ত শাপমুক্ত হবে না বাংলার মাটি।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ। এই উপলক্ষে ১৭ মার্চ ২০-১৭ মার্চ ২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী । একসময় যেসব জাতীয় ও দলীয় বিশেষ দিবস ও কার্যাদি পড়বে তা গুরুত্বের সাথে পালিত হবে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত থাকবে এই কর্মকান্ড। এই উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকি উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি গঠন করেছে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি। তাছাড়া সরকারি আধাসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। নানান উন্নয়নও গঠনমুলক কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তি ও জনকের জন্মের একশ বছর পালিত হবে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দেশের প্রতিটি মানুষকে সম্পৃক্ত করে।
শেখ মুজিব একমৃত্যুজয়ী বীর, যিনি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষেরঅন্তরে বুনেছিলেন বাঙালিত্বের চেতনা। আজীবন লড়াই করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। কবি সুফিয়া কামালবলেছিলেন, ‘এই বাংলার আকাশ-বাতাস/ সাগর-গিরিও নদী/ডাকিছে তোমারেবঙ্গবন্ধু/ ফিরিয়া অসিতে যদি!
ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে ঠিকই,কিন্তু জনগণের মন থেকে তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শেরমৃত্যু ঘটাতে পারেনি। তাদেরঅন্তরে গ্রোথিত রয়েছে তাঁর ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা। তিনি চিরঞ্জীব, বাঙালির মন থেকে কেউ কখনই তাঁকে মুছে ফেলতে পারবে না।
Facebook Comments Sync