রাতুল এগিয়ে নিয়ে চলেছে মিছিল / আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

রাতুল হাঁটতে পারেনা। খুব ছোট থাকতে  পোলিও হয়েছিল । কখন যে অলক্ষ্যে তার একটা পা অবশ হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি বাবা মা। বুঝল রাতুলের হাঁটার বয়স হবার পর। ছেলে কখনও হামাড়ি  দেয়নি। এ নিয়ে বাবা মায়ের যে দুশ্চিন্তা ছিলোনা তা নয়। কিন্তু বাবা মা ভেবেছেন অনেক বাচ্চা হামাগুড়ি না দিয়েই একবারে হাঁটতে শেখে।  কিন্তু যখন ছেলে হাঁটার চেষ্টা করল আর  তার বাম পাটা বেতস পাতার মতো থর থর করে কাঁপতে থাকল তখন  আর্তনাদ করে উঠল মা।  মায়ের সেই হাহাকার আর আর্তনাদের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠল রাতুল। এখন ওর বয়স সাত। দেশে যতোটুকু চিকিৎসা সম্ভব হয়ে গেছে।  বাবা মা চেষ্টায় আছেন বিদেশে নিয়ে যাবার।  টাকাও যোগাড় হয়েছে। কিন্তু  দেশে যুদ্ধ বেঁধে গেছে । সারাক্ষণ মিটিং মিছিল স্লোগান  বেরিকেড  কারফিউ ব্লাকআউট ।  রাতুল অল্পবয়সেই অনেক ভারি ভারি শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছে। বাবা ফিসফিস করে মায়ের সাথে আলোচনা করেন আর সেই আলোচনার ভগ্নাংশ কানে আসতে আসতে ব্লাকআউট বেরিকেট কারফিউ কাঁদানে গ্যাস কামান বন্দুকের মতো শব্দের সাথে তার পরিচয় ঘটে।  আর আক্ষরিক পরিচয়েরও দরকার হয়না, রাত হলেই যখন অন্ধকার নেমে আসে তখনই রাতুল বুঝে যায় ব্লাক আউট চলছে।  দিনের বেলায় যখন রাস্তা খা খা করতে থাকে, ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো পর্যন্ত যখন ডাস্টবিনের খাবার শুকতে ভুলে যায় তখন রাতুল বুঝতে পারে কারফিউ চলছে।  দিন রাতে দুএকঘন্টার জন্য কারফিউ ওঠে। তখন শুরু হয় বাবার ব্যস্ত ছোটাছুটি। চাল, ডিম, ডাল লবণ , মোমবাতি কেরোসিন, দিয়াশলাই আনেন। মা বলেন, এগুলো একটু বেশি বেশি করে কেনো।  আবার কখন কারফিউ উঠবে, উঠলেও জিনিস পাওয়া যাবে কিনা কে জানে।  

ঢাকা চেড়ে চলে গেছে অনেকেই । রাতুলের বাবা মা রফিক শাহানাও যেতে চান কিন্তু যাবেন কি করে । ছেলে যে হাঁটতে পারেনা। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা কোথাও উড়েছে ব্রিজ কোথাও কালভার্ট , পদে পদে ওত পেতে আছে বিপদ।  কতোটা হাঁটতে হবে কে জানে। এ  অবস্থায় হাঁটতে না পারা ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় বেরোনো বোকামি। রাতুল তো আর সেই সাত মাসের রাতুল নেই যে কোলে করে নিয়ে যাবেন। রীতিমতো বড়োসড়ো স্বাস্থ্যবান ছেলে। তাই বাধ্য হয়ে রয়ে গেছেন ঢাকায় । 

রাতুলের জীবন তার ঘরটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।  সারাঘরে  অজস্র খেলনা ছবি বই কার্টুন । একটা হুইলচেয়ারও আছে।  কিন্তু রাতুল সে চেয়ার ব্যবহার করেনা। আল্লাহ  যখন তাকে হাঁটা চলার তৌফিক দেননি তখন সে হুইলচেয়ারে বসে চলতে  চায়না। ওতে তার মানসিক কষ্ট তীব্র হয় । এতো হাঁটা নয়, বসে বসে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরে যাওয়া। তবে হাঁটার, দৌড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা রাতুলের। সে স্বপ্ন দেখে একদিন হাঁটবে, দৌড়াবে, পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলবে । মিছিলের ছেলেদের মতো সে প্ল্যাকার্ড  হাতে দৃপ্তপায়ে সামনে এগিয়ে যাবে।  স্বপ্নে সে বেশ কয়েকদিন হেঁটেছে। প্রতিদিনই সে নিজেকে দেখেছে মিছিলের পুরোভাগে। 

রাতুলের দিন রাতের বেশির ভাগ সময় কাটে দক্ষিণের জানালাটায়। সকালে নাস্তা খাবার পর সে দেয়াল ধরে ধরে এসে দাঁড়ায় জানালাটার পাশে।  জানালার নিচের অংশ বেশ চওড়া। স্বচ্ছন্দে ওখানে বসা যায়। রাতুল একপায়ে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনা। এক সময় বসে  পড়ে জানালায়। বসে বসে সে পেপারওয়ারাকে দেখে , বাদামওয়ালাকে দেখে, তার বয়সী ছেলেদের ব্যাগ কাঁধে  স্কুলে যেতে দেখে। ফেরিওয়ালা মুটে মজুর থেকে শুরু করে কতো লোক যে সে সারাদিন দেখে! কর্মক্লান্ত রিক্সাওয়ালাকে দুপুরের কড়া রোদে হুডের নিচে বসে জিরোতে দেখে তার কান্না পায়। রিক্সাওয়ালার সারা শরীর বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামা ঘাম দেখে রাতুলের মনে হয় ওর শরীর দিয়ে ঘাম নয়, রক্ত ঝরছে।  রাতুলের ইচ্ছে হয় নিজ হাতে গামছা দিয়ে ওর ঘাম মুছিয়ে দিতে। কিন্তু ও যে হাঁটতে পারেনা!  যেদিন হাঁটতে পারবে সেদিন ও রিক্সাওয়ালার ঘাম মুছিয়ে দেবে , ঠেলাওয়ালার ঠেলা ঠেলে দেবে, পাতাকুড়ানি বুড়ির হাতের থলিটা পাতা কুড়িয়ে ভরে দেবে, ফেরিওয়ালার জিনিসগুলো ফেরি করে দেবে।  কিন্তু কবে সে বিদেশে যেতে পারবে, কবে এ যুদ্ধ শেষ হবে! বাবা মা বলেছেন, যুদ্ধ  শেষ হলেই তাকে নিয়ে বিদেশে যাবেন চিকিৎসার জন্য। বাবা আরও বলেছেন, মুক্ত দেশের স্বাধীন মানুষ হিসেবে  প্লেনে চড়বি তুই। ভাবতে ভালো  লাগছে না বাবা? রাতুল মাথা নেড়েছে । মুখে বলেছে তার খুব ভালো লাগছে।  দেশপ্রেমিক বাবা মায়ের সন্তান হিসেব সেও ছেলেবেলা থেকে দেশকে ভালবাসতে শিখেছে। বাবা তাকে বলেছেন দুশ বছর বৃটিশের আর পঁচিশ বছর পাকিস্তানিদের  শাসন নির্যাতন আর বাঙালির বঞ্চনার কথা।  বলতে বলতে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বাবা। উত্তেজিত কন্ঠে বলেছেন , এভাবে আর চলতে পারেনা। আমরা আর  পরাধীন থাকবো না । নির্যাতন বঞ্চনার শোধ  নেব আমরা। মা বলেছেন, চুপ চুপ আস্তে, কেউ শুনতে পাবে। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন আছে চারপাশে পাকিস্তানিদের ফেউও আছে। মার কথায় বাবার ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তাঁর ভেতরটা তখন দেশপ্রেমের তাজা আগুনে টগবগ করে ফুটছে। বিক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেছেন, তুমিতো সারাজীবন আমাকে চুপ করে থাকতেই বললে।  না যেতে দিলে যুদ্ধে না করতে দিলে দেশের কাজ 

রাতুল এগিয়ে নিয়ে চলেছে মিছিল / আফরোজা পারভীন: এটা তুমি কি বলছ! দেশের কাজ তো তুমি সব সময়ই করছ। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করছ।  চারদিকের  এতো ঝুঁকির মধ্যেও তাদের আশ্রয় দিচ্ছ । 

: এতে কি মন ভরে শাহানা। সবাই যুদ্ধে গেছে আর আমি ঘরবন্দি হয়ে আছি। 

: কিন্তু আমাদের ঘরে অসুস্থ সন্তান , তাকে ফেলে আমাকে ফেলে তুমি কিভাবে যুদ্ধে যাবে বলো? 

: যারা যাবার তারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও যায়। দেশের ডাক তাদের সবরকম মায়া মমতা উপেক্ষা করার  শক্তি যোগায়।

  মা বলেন, কিন্তু 

রাতুল বলে, যাওনা বাবা যুদ্ধে । আমাদের কোন সমস্যা হবেনা। তুমি যুদ্ধ জয় করে ফিরলে আমার খুব ভালো লাগবে 

: আমিও তা তাই চাই ।  বেশি করে খাবার দাবার আর হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে গেলে তোরা থাকতে পারবিনা বাবা? আমি মাঝে মাঝে আসব 

: পারব বাবা , খুব পারব। 

দেশমাতা ডাক দিয়েছিল রফিককে তাই এক সকালে সে সত্যিই চলে গেল যুদ্ধে । শাহানা কঠিন মুখে তাকে বিদায় দিলেন। কিন্তু শাহানার প্রতিক্রিয়া  দেখার মতো অবস্থা তখন রফিকের ছিলোনা। তাকে যে যেতেই হবে। সে শুধু রাতুলের মুখ তুলে ধরে বলেছিল, সাবধানে থাকিস বাবা। জানালার পাশে  বসিস না । জানালা বন্ধ রাখিস । চারদিকে গোলাগুলি।  আর শোন দেশ স্বাধীন করে ফিরবো আমি । ফিরেই তোকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবো দেশের বাইরে। তুই  ভাল হয়ে উঠবি, হাঁটবি, দৌড়াবি।  তুই থাকবি সবার সামনে। 

বেরিয়ে গিয়েছিল বাবা। পেছনে ফিরে তাকায়নি। আর সেই মুহূর্তে রাতুলের ছোট্ট বুকটা স্ফীত হয়েছিল গর্ব আর অহংকারে । নির্বাক মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা আমার বাবা যুদ্ধে  গেছে । সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তোমার ভালো লাগছেনা মা? 

: ভাল লাগছে, খুব ভাল  লাগছে বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন মা 

বাবা গেছেন দিন পনের হলো । মার কাছে শুনেছে সারা দেশ জুড়ে যুদ্ধ চলছে।  মুক্তিবাহিনী অমিত তেজে যুদ্ধ করছে  আর পকিস্তানিরা পাখির মতো গুলি করে  মানুষ মারছে  ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে।  গ্রামের পর  গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নারী শিশু বৃদ্ধ কাউকেই ওরা রেহাই দিচ্ছে না। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে। 

এ মধ্যেও থেমে নেই মুক্তিকামী মানুষ। ওরা যেমন একদিকে গেরিলা যুদ্ধ করছে অন্যদিকে করছে মিটিং মিছিল সমাবেশ। বাবা বারণ করছেন তাই আর আগের মতো পাট করে জানালা খুলে বসে না রাতুল। তবে জানালা বন্ধ করেও সে থাকতে পারেনা । এই জানালাই যে তার বাইরের জগতের সাথে একমাত্র যোগসূত্র। 

সেদিনও জানালায় বসে ছিল রাতুল । তবে জানালাটা অর্ধেক খোলা অর্ধেক  চাপানো।  বেশ কদিন ধরে রাতুল লক্ষ্য  করেছে তাদের বাড়ির পাশে ঘুরঘুর  করে কয়েকজন আর্মি। তাদের বাড়ির উপর তীক্ষ্ন নজর রাখে। একদিন তো দুজন আর্মি তাদের দরজায় রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করতে থাকলো । কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে দিয়েছিল শাহানা। ওরা বুটের আওয়াজ তুলে দুটো ঘর পাড়ি দিয়ে রাতুলের ঘরে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল। শাহানা কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে  এসে আগলে দাঁড়িয়েছিল রাতুলকে। বলেছিল ,  আমার ছেলে অসুস্থ, হাঁটতে পারেনা। আর্মিদের মুখ ঘুরে গিয়েছিল শাহানার দিকে। 

:তুমহারা পতি  কাহা গায়া? 

শাহানা ঢোক গিলে  বলেছিল, বাজার মে

: লেকিন হামে খবর মিলা হে কে ও মুক্তি হ্যায় । ও লটে গা তো হামে বাতানা নেহিতো তুমহারা মুশকিল হো যায়গা।   

সেই থেকে শাহানা সারাক্ষণ কাঁপে। দিন রাতের বেশির ভাগ সময় রাতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে । খায়না গোসল করেনা রান্নাও তেমন একটা করেনা। । উন্মাদিনী প্রায় । রাতুল তাই জানালায় বসার সুযোগ  পায়না। আর শাহানারও কঠিন বারণ আছে রাতুল যেন জানালার কাছে না যায়। শাহানা নিজ হাতে জানালা বন্ধ করেই নিশ্চন্ত হয়না, বার বার চেক করে। 

দুদিন পর সেদিন দুপুরে রান্না করতে গেছে শাহানা।  রাতুল দেয়াল ধরে ধরে জানালার পাশে  এসে দাঁড়ায় । সন্তর্পণে জানালা খোলে ।  খুট করে আওয়াজ হয়।  তবে রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ার শব্দে সে আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। রাতুল জানালায় উঠে বসে। সামান্য ফাঁক করে বড় বড় দুচোখ  মেলে তাকায় রাস্তায়। চারদিক শুনশান। যতোদূর  চোখ যায় জনমনিষ্যির  চিহ্ন নেই। কার্ফু চলছে বোধহয়। রাতুল খেয়াল করে দেখে, যে আর্মিরা  তাদের বাড়ির উপর নজর রাখে তারাই  টহল দিচ্ছে  বাড়ির  পাশের রাস্তায়। রাতুল আরও সতর্ক হয়ে যায়। জানালার ফাঁক আস্তে আস্তে কমায়। ঠিক তখনই দূর থেকে একটা মিছিল আসতে দেখে রাতুল্। অনেকগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ  হাত  উত্তোলন করে ওরা বলছে, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, পিন্ডি না ঢাকা,  ঢাকা , ঢাকা। ওরা এগিয়ে আসছে , আসছে। রাতুলদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে প্রায়। রাতুলের বুকের মাঝে একসাথে আওয়াজ তুলছে পদ্মা মেঘনা যমুনা। রাতুলের ইচ্ছে হচ্ছে  দৌড়ে গিয়ে ওই মিছিলের সামনে দাঁড়াতে। সে দাঁড়াবে, অবশ্যই দাঁড়াবে একদিন। ভাবনা শেষ হবার আগেই টহররত আর্মিদের একজনকে মিছিলের দিকে  রাইফেল তাক করতে দেখে রাতুল।  এখনই গর্জে উঠবে রাইফেল। রাতুল আপ্রাণ চেঁচায় । গুলি করছে, গুলি.. রাতুলের গলার আওয়াজের সাথে সাথেই জানালা খুলে যায় পুরোটা । রাইফেলের মুখ ঘুরে যায়। তার পর জানালা ভেদ করে আসে  একের পর এক গুলি। । 

কিছুক্ষণ  পর রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটা  মিছিল। সবার সামনে রাতুলের লাশ। রাতুলকে সামনে নিয়ে মিছিল এগিয়ে চলেছে । রাতুল সবার সামনে থাকতে চেয়েছিল। সে রয়েছে সবার সামনে । 

%d bloggers like this: