মুজিবের তর্জনী/ আফরোজা পারভীন
বিশাল প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। ঢাকা থেকে দুদিন পর পর মন্ত্রীরা আসছেন আয়োজন পরিদর্শন করতে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিন রাত নেই। অবিরাম খেটে চলেছেন তারা। কোথাও যেন কোনো খামতি না থাকে, যেন হয় নিঁখুত, নিপাট ব্যবস্থা। হেলিকক্টার নামা, সার্কিট হাউসে নেয়া, বিশ্রাম, খাবার- দাবার, সভাস্থল, ফুল-মালা সব যেন হয় মনোরম। সভায় যেন তিল ধারণের ঠাঁই না থাকে সেদিকে নজর রাখছেন স্থানীয় নেতারা। লিডার খুশি হলে তবেই না ভাগ্য খুলবে তাদের। ডিসি সরেজমিনে দেখছেন, মাননীয়কে খুশি করতে পারলে নিশ্চয়ই তার ভালো পোস্টিং হবে। পোস্টিং হবে আরো কোনো বড় জেলায়। একই স্বপ্ন দেখছেন জেলা পুলিশ সুপার। স্থানীয় এমপির স্বপ্ন লিডারকে খুশি করতে পারলে নিদেনপক্ষে একটা প্রতিমন্ত্রি হবার সুযোগ হয়ত হতে পারে। এলাকায় কোনো মন্ত্রী নেই, অনুন্নত এলাকা। মন্ত্রী হলে তিনি বদলে দেবেন এলাকার চেহারা। কেন্দ্রে চেনা-জানা, কাছের লোকদের বুঝাচ্ছেন তিনি এ কথা। যেন একটিবার তারা লিডারকে বলেন তার বিষয়ে। এতদিন রাজনীতি করছেন, একবার মন্ত্রী না হলে কী মানায়! এলাকার লোকের কত আশা ভরসা তাকে নিয়ে। এলাকার গ্রহণযোগ্য মানুষের কয়েকজনকে ঠিক করে রেখেছেন সভা শেষে অথবা সুযোগ পেলে সার্কিট হাউসে তারা মাননীয়কে বলবেন এমপির গুণপনার কথা। আব্দার করবেন তাকে মন্ত্রী বানাবার। তরুণ কর্মিরা বলছে, প্রয়োজনে বাস ভাড়া করে ঢাকা অবধি যাবে তারা । এবার তাদের মন্ত্রি চাই-ই চাই।
কেন্দ্র থেকে খাবারের লিস্ট এসেছে। তিনি কি খান কি খান না তার ফর্দ। তিনি কি ভালবাসেন কি ভালবাসেন না তার ফর্দ। থাকবেনই তো মাত্র কয়েকঘন্টা, তার জন্য চিন্তার অবধি নেই প্রশাসনের। বাথরুম পছন্দ হবে কীনা, বিছানা পছন্দ হবে কীনা, খাবার পছন্দ হবে কীনা কে জানে। ডিসি অবশ্য জানেন বাহুল্য পছন্দ করেন না তিনি। খুব সাধারণ খাবার খান। কিন্তু তা বলে তো আর ঝুঁকি নিতে পারেন না তিনি। ঘামছেন এমপি ডিসি এসপি।
যাকে নিয়ে এতো ভাবনা সেই শেখ মুজিব তখন ঢাকায়। সবে গণভবনে অফিসের কাজ সেরেছেন। বড্ড খাটুনি গেছে সারাটা দিন। একের পর এক মিটিং ব্রিফিং বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সৌজন্য সাক্ষাৎ। একটু হেলে পাইপে একটা লম্বা টান দিলেন তিনি। মনে পড়ল পাকিস্তানের জেলে থাকার দিনগুলোর কথা। তিনি যে বেঁচে ফিরবেন এ কথা না ভেবেছে তার পরিবার, না ভেবেছে দেশের মানুষ, না তিনি নিজে। যার ডাকে এদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো, তাকে পাকিস্তানিরা বন্দি করে মেরে না ফেলে বাঁচিয়ে রাখবে এটা দুরাশা। তিনি শুধু চেয়েছিলেন মারা যাবার আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে এই খবরটা যেন পান। স্বাধীনতার স্বপ্নে কেটেছে তাঁর কতো বিনিদ্র দিন রাত। তাঁকে তো মেরে ফেলতোই। মারতে পারেনি শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে।
একটা লম্বা শ্বাস ফেলেন তিনি। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে । বড় দাম দিয়ে কেনা এ স্বাধীনতা! কত কত প্রিয়মুখ চিরতরে হারিয়ে গেছে। আর কোনদিন তিনি দেখতে পাবেন না তাদের। কতো অচেনা অজানা মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে, তাদেরও তিনি কোনোদিন চিনতে পারবেন না, বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন না। এ কষ্ট তিনি বইতে পারছে না। রাতে ঘুম আসে না। আগে ঘুম হতো না দেশ স্বাধীন করার চিন্তায়। এখন ঘুম হয় না শহিদ ভাই বোনদের হারানোর যাতনায়। ‘তোমরা আমার বীর ভাই বোন, আর কোনোদিন দেখতে পাবো না তোমাদের। তোমাদের রক্তে অর্জিত হলো যে দেশ সে দেশে তোমরা কোনো দিন নিশ্বাস নিতে পারবে না।’ বিড় বিড় করেন তিনি। চোখ থেকে গড়িয়ে দুফোঁটা জল নামে টেবিলে। টেবিলের ওপর মাথা এলিয়ে দেন। বড় কষ্ট হচ্ছে তাঁর। টেবিলের কাঁচে জমছে জলের ফোঁটা । আচমকা কে যেন তার কাঁধে তপ্ত শ্বাস ফেলল। কে কে ? চমকে উঠলেন তিনি। চারদিক তাকালেন । কেউ কোথাও নেই । তবে কী কোনো এক শহিদ ভাই বুঝিয়ে দিলো তার অস্তিত্ব। শ্বাস ফেলে বলে গেলো,‘কে বলে আমরা নেই, কে বলে আমরা এ মুক্ত মাটিতে নিঃশ্বাস নিই না। এ স্বাধীন দেশের পরতে পরতে আছে আমার শ্বাস আমার অস্তিত্ব। যেমন তুমি পেলে তোমার কাঁধে।’
তিনি সোজা হয়ে বসেন। কাঁধে হাত বুলাচ্ছেন। যেন সেই অমর প্রাণের স্পর্শ নিচ্ছেন। কাল তার অনেক কাজ । ঢাকার বাইরে যাবেন। দেশে ফিরে নড়াইলে এই তাঁর প্রথম জনসভা। এদেশের মুক্তিযুদ্ধে নড়াইল-যশোরবাসীর অবদান অনেক। নড়াইল-যশোরের মানুষ লড়াকু, সংগ্রামী। তেভাগা, কৃষক আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে তারা। ইংরেজরা নড়াইলে অনেকগুলি নীলকুঠি বানিয়েছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই জনপদের প্রতিটি মানুষ যেন এক একজন যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণবাজি রেখে লড়েছে তারা। যশোর ক্যান্টমেন্ট ছিল পাকিস্তানিদের গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাস। নড়াইল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল দল মার্চ করে যশোরে এসেছিল দা সড়কি বল্লম বাঁশ এসব দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। তিনদিন যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে রেখেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। ‘যশোর মার্চ’ ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ জন্ম দিয়েছে নড়াইল যশোর-এ। ত্যাগে অনন্য তারা। অনেকবার নড়াইল-যশোরে গেছেন তিনি। পেয়েছেন অফুরান ভালবাসা আন্তরিকতা সমর্থন। এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাবেন । মুজিব মনে মনে বলেন, ‘পদে আমি প্রধানমন্ত্রী, আসলে আমি তোমাদের ভাই।’
চেয়ার ছেড়ে ওঠেন তিনি। বেরিয়ে আসেন রুম থেকে । বাসায় যাবেন। গাড়িতে ওঠেন ধীর পায়ে।
২
মজিদা বেগমের ছেলে ফরিদ নড়াইল ডিসি অফিসের পিয়ন। স্বামী কায়জার শহিদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ফরিদ মজিদা-কায়জারের একমাত্র সন্তান। সন্তানটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তাদের। ভালো করে মানুষ করবেন, লেখাপড়া শেখাবেন। বড় চাকরি করবে ছেলে। ফুটফুটে বউ আনবে। ছেলে হবে মানুষের মতো মানুষ। সারাদিন সময় পান না কায়জার-মজিদা। বাজারে ছোট্ট একটা দোকান আছে কায়জারের । আর আছে দেশের কাজ। মজিদাও সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছেলে, শাশুড়িতে দেখেন। রাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বোনেন।
দেশে যুদ্ধ চলছে। আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত কায়জার। শেষ নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। নৌকার জন্য কাজ করেছেন। পাশ্ববর্তী চাঁচড়ায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল । সেখানে নিয়মিত মহড়া নিয়েছেন কায়জার। অংশ নিয়েছেন যশোর মার্চে। মজিদাকে, মাকে, ছেলেকে কিছুটা সময় দেয়া দরকার । দিতে পারেন না তিনি। তা নিয়ে মনে কষ্ট আছে। অপরাধবোধও আছে কিছুটা। কিন্তু দেশ তো সবার আগে!
সেদিন ১৭ জুলাই অতর্কিতে তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে রাজাকাররা। তুলে নিয়ে যায় কায়জারকে। পেছনে পেছনে গিয়েছিলেন মজিদা। কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেছিলেন স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে। রাইফেলের বাট দিয়ে বাড়ি মেরেছিল তাকে পাকিস্তানিরা। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। সেই যে স্বামী গেলেন আর ফেরেননি। মজিদা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। নিরেট পাথর যেন। ফরিদকে নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না তার। বোবার মতো বসে থাকতেন ঘরের দাওয়ায়। সন্তান কি খেলো কি খেলো না কিছুই দেখতেন না। শাশুড়িও তখন শোকস্তব্ধ । তারপরও শাশুড়িই ছেলেকে দেখতেন। শুধু শহর থেকে কেউ এলে ছুটে যেতেন মজিদা। জানতে চাইতেন তার স্বামীর খবর কেউ জানে কীনা। কেউ বলত তার স্বামীকে পাকিস্তানে নিয়ে গেছে, কেউ বলত যশোর ক্যন্টনমেন্টে আটকে রেখেছে। প্রতীক্ষার দিন গুনতেন মজিদা। তারপর একসময় বুঝে যান স্বামী কোনদিন ফিরবে না। ছেলেটাও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। সংসারে তীব্র অভাব। ছেলেকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারেন না। অর্থাভাবে পড়াতে পারলেন না। অষ্টম শ্রেণি পাশ করার পর ছেলেকে ঢুকিয়ে দিলেন পিয়নের চাকরিতে। নড়াইল কালেক্টরেটের পিয়ন ছেলে। তা সেই ছেলে একদিন অফিস থেকে ফিরে ভাত খেতে খেতে দাদিকে বলল, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব আসবেন নড়াইলে। তার আসা নিয়ে সাজ সাজ রব চারদিকে। ছেলে সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগল আয়োজনের খুঁটিনাটি। দাদি মন দিয়ে শুনছেন। দাদির সাথেই ছেলের যত গল্প। ছেলের কথা শেষ হওয়ামাত্র মজিদা বলল,
: আমি নড়াইল যাবো। মুজিবের সভায় যাবো।
ফরিদ অবাক। অবাক শাশুড়িও। কায়জার মারা যাবার পর মজিদা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলেন। এখন তিনি আগের থেকে স্বাভাবিক হলেও পুরো স্বাভাবিক নন। মাঝে মাঝেই ডুকরে কাঁদেন। পুকুরপাড়ে বসে থাকেন। খাওয়ার কথা মনে থাকে না। সারারাত উঠোনে হাঁটেন। ফরিদ মাকে কোনোদিন নানাবাড়ি বা আশপাশের কোথাও বেড়াতে যেতে দেখেনি। অনেক বলেও কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি। মা জোরে হাসে না, সাজে না। সেই মা বলছে নড়াইল যাবে। অবাক ফরিদ বলল,
: কেন মা তুমি সভায় যেয়ে কি করবা? ওখানে অনেক ভিড় হবে। কতক্ষণ লাগবে তার ঠিক নেই। বসার জায়গা পাবা কিনা তাও ঠিক নেই
: আমি যাবো। আমারে নিয়ে যাবি।
আর কোনো কথা না বলে মা ঘরে ঢুকে গেলেন। ফরিদ বুঝল মাকে মুজিবের জনসভায় তাকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে নেবে? সেই বা ছুটি পাবে কি করে! বন্ধের দিন। কিন্তু অফিস থেকে নির্দেশ দিয়েছে সবাইকে থাকতে হবে। কীভাবে যে সে ম্যানজে করবে!
তিন
ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের একটা দোতলা বাড়ি। খাবার টেবিল ঘিরে সবাই বসা। ফজিলাতুন্নেসাকে মুজিব রেনু ডাকেন। হাসিনাকে ডাকেন হাসু, রেহানাকে মুন্না। বড় কাঁচের বাটিতে কই মাছ। পেটভরা ডিমসমেত ইলিশের পেটিও আছে। আরো তিন চারটে আইটেম থাকলেও মুজিব কই মাছের বাটিটা টেনে নিলেন। রেনু বলেন,
: আগেই মাছ নিলে যে। তোমার পছন্দের আরো আইটেম আছে তো। আগে তো সবজি খাবে, তারপর মাছ
: আজ মাছই আগে খেতে ইচ্ছে করছে। আর এত আইটেম করেছ কেন? নতুন দেশ। একটা দুটো আইটেমের বেশি তো লাগে না।
: সবসময় তো তাইই করি। তুমি কতদিন পাকিস্তানের জেলে আটক ছিলে। কী খেয়েছ না খেয়েছ। তাই একটু ভালো-মন্দ করেছি।
মুজিব রেনুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
: জানো রেনু কাল নড়াইল যাবো। দেশে ফেরার পর এই আমার প্রথম নড়াইল যাওয়া। আমার খাবারের পছন্দের কত বড় লিস্ট যে ওরা নড়াইলে পাঠিয়েছে কে জানে। এসব আমার খুব অপছন্দ। আমি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ যা খায় আমিওতো তাই খাই। ভাত মাছ ডাল। তার জন্য এত আয়োজন কিসের। আমার খারাপ লাগে। বলিও মাঝে মাঝে, কিন্তু কাজ হয় না। রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল বড় মারাত্মক!
: হ্যাঁ ওসব জোগাড়যন্তর করা তো সমস্যা। মানুষের কষ্ট হয়। তুমি খাও এক দুই পদ। রেনু বলল।
হাসিনা জয়কে নানার পাশে রাখা ছোট্ট চেয়ারটায় বসিয়ে দিলো। এক হাতে ওকে ধরে রাখল রাসেল। হাসিনা রেহানা চেয়ারে বসল পাশাপাশি। মুজিব জয়কে গাল টিপে আদর করলেন খেতে খেতেই। রাসেলকে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়ালেন । রাসেল বলল,
: আমি মাংস খাবো
: খাবে বাবা। শুধু মাংস খেলে কি হয় মাছও খেতে হয়। বুঝলে শরীরের জন্য প্রয়োজন সুষম পুষ্টি। খেতে হয় শাক সবজি ডাল আর প্রচুর পানি বুঝেছ?
বয় বাবুর্চি আছে। তবু নিজেই খাবার পরিবেশন করেন রেনু। তুলে তুলে খাওয়াতে ভীষণ আনন্দ পান তিনি। মেয়েদের ভাত ডাল দিতে দিতে রেনু ভাবলেন, আল্লাহর অসীম রহমতে তিনি স্বামীকে ফেরত পেয়েছেন। ২৬ মার্চ মুজিবকে গ্রেফতার করার পর ধানমন্ডির যে বাড়িতে তাদের এরেস্ট করে রাখা হয়েছিল সেখানে কারো সাথে কথা বলতে দেয়া হতো না। বের হতে দেয়া হতো না। সে ছিল এক দুঃসহ জীবন । কামাল জামাল তখন যুদ্ধে। হাসু অন্তঃসত্তা। কীযে দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি! সে সময় তাঁর একমাত্র আরাধ্য ছিল স্বামীর দেশে ফেরা আর দেশের স্বাধীনতা। মুক্ত স্বাধীন দেশ।
রেনু ভাবেন মুজিবের কথা আর খেতে খেতে মুজিব ভেবে চলেন রানুর কথা। বড় ভাল মেয়ে এই রেনু। পিতৃহারা মেয়েটিকে মা নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। দুঃখে কষ্টে অভাবে অনটনে কেটেছে তাদের জীবন। কখনও কোনো অভিযোগ করেননি রেনু। সংসারের কোনো দায়-দায়িত্ব মুজিবের কাঁধে চাপাননি। জীবনের একটা বড় অংশ জেলে অথবা আত্মগোপনে থেকেছেন মুজিব। তা নিয়ে রেনু কোনোদিন অভিযোগ করেননি। নিজের চেষ্টায় খেয়ে না খেয়ে সংসার চালিয়েছেন। যখন মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন, দেখেছেন রেনু তার জন্য সুটকেস গুছিয়ে রেখেছে। রাজনীতিকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিয়েছিলেন রেনু। মুজিব ভাবেন, আজ যে তিনি প্রধানমন্ত্রী এর পেছনে সব চেয়ে বড় অবদান রেনুর। রেনু সাপোর্ট না দিলে তিনি রাজনীতি করতে পারতেন না, গণমানুষের নেতা হতে পারতেন না, স্বাধীনতার ডাক দিতে পারতেন না। ভাবতে ভাবতে আচমকা গলায় ঠেকে যায় মুজিবের। কাশতে থাকেন তিনি। রেনু পানির গ্লাস এগিয়ে দেন। মুজিবের পিঠে চাপড় দেন। একসময় কাশি থেমে যায়। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েন তিনি। রেনু পেছনে যেতে যেতে বলেন, শুয়ে পড়ো। আজ আর রাত জেগোনা। কাল তোমার অনেক কাজ।
মুজিব যেতে যেতে থমকে দাঁড়ান। এগিয়ে যান রেলিং-এর দিকে। রেনু পেছন থেকে বলেন,
: কি হলো থামলে যে?
: রেনু এদিকে আসো । দেখো।
রেনু মুজিবের পাশে দাঁড়ান। মুজিব রেনুর কাঁধে হাত রাখেন। আকাশ জুড়ে জোছনার ঢল নেমেছে। আদিগন্ত প্লাবিত সে জোছনা এক অপার মুগ্ধতায় ছেয়ে ফেলে মুজিবকে। মুজিব জোরে জোরে আউড়াতে থাকেন,
পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী ।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগাঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।
হাসু মুন্না এসে দাঁড়ায় তার পাশে। মুন্না গেয়ে ওঠে,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধ্যা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।
হাসু গলায় মেলায় সে গানে।
অঝোর জোছনায় স্নাত হতে থাকে চারজন। রাত এগিয়ে চলে তার নিজস্ব পথে।
৪
হেলিকপ্টার থেকে নামলেন মুজিব। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন গার্ড অব অনার দেবার জায়গায়। সালাম নেয়া শেষে হাঁটতে শুরু করলেন। ডিসি এসপি এগিয়ে এলেন
: স্যার একটু রেস্ট নিয়ে নিলে হতো না। সব ব্যবস্থা করা আছে। সভার তো কিছু সময় এখনও বাকি।
মুজিব ঘড়ি দেখলেন। একবার ভাবলেন সার্কিট হাউসে গিয়ে রেস্ট নিয়ে আসবেন। পর মুহূর্তে বাতিল করলেন সে চিন্তা। জনগণ সারা জীবন নেতাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। আজ না হয় তিনি জনগণের জন্য অপেক্ষা করবেন। বললেন,
: সভাস্থলে চলেন
মুজিব সভাস্থলে প্রবেশ করামাত্র স্লোগান উঠল, জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। জনতার মাঝে বাধবাঙা উল্লাস। সবাই এক নজর লিডারকে দেখতে চায়। অনেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। পেছনের লোকেরা টান দিয়ে বসিয়ে দিলেন তাদের। মুজিব মঞ্চে উঠে হাত নাড়লেন। জনগণ উল্লাসে ফেটে পড়ল। সময়ের একটু আগেই শুরু হলো সভা।স্থানীয় নেতারা বক্তৃতা করছেন একের পর এক। জনগণ উন্মুখ হয়ে আছে কখন তাদের প্রিয়নেতা কথা বলবেন। কখন তার মুখ থেকে শুনবেন আশার বাণী। একসময় নেতাদের বক্তৃতা শেষ হলো। উপস্থাপক ঘোষণা করলেন,‘এতক্ষণ যার কথা শুনবার জন্য আপনারা অধীরভাবে অপেক্ষা করছেন এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। এবার বক্তব্য প্রদানের জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে’। মুজিব চেয়ার থেকে উঠে পোডিয়ামের সামনে দাঁড়ালেন। জনতা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকলো। স্লোগান উঠল আবারো। সে স্লোগান আর যেন থামেনা। মুজিব তর্জনী উত্তোলন করতেই থেমে গেল সব স্লোগান । তিনি জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ভায়েরা আমার, আমাকে বলা হয়েছে আমি এদেশের প্রধানমন্ত্রী । প্রধানমন্ত্রী একটা পদ। রাষ্ট্র চালাতে গেলে পদের প্রয়োজন হয়। আসলে আমি আপনাদের মুজিব, মুজিব ভাই.. বক্তৃতা দিয়ে চললেন মুজিব। উপস্থিত জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সে বক্তৃতা।
মাজেদা বেগম বসে ছিলেন সভার মাঝামাঝি জায়গায় এক কোণে। ফরিদ বলেছিল,
: মা এখানে বসো না। মাঝের দিকে চলো। সিট তো খালি আছে। এখান থেকে দেখতে পাবে না।
: আমার দেখার দরকার না, শোনার দরকার।
কথা শোনেনি মা। বসে পড়েছে এক কোণায়। সেখান থেকে ভালো করে মুজিবকে দেখা যায় না। মা কেন যে এখানে বসল বোঝেনি ফরিদ। মায়ের অনেক কিছুই সে বোঝে না। গ্রামের লোক বলে তার মায়ের মাথা খানিকটা খারাপ। ফরিদের অবশ্য তা মনে হয় না। আসলে অকালে স্বামী হারিয়ে মা দিশেহারা গোছের হয়ে গেছে। তবে মার অনেক কাজ সত্যিই সে বোঝে না। যেমন আজ বুঝলো না। কী কষ্টে যে সে আজ ছুটি জোগাড় করেছে তা শুধু সেই জানে! কী দরকার ছিল এ সভায় আসার!
বক্তৃতার খানিকটা হবার পরই চেয়ার থেকে উঠে পড়ে মজিদা। সামনের দিকে এগোতে থাকে। ভলেন্টিয়াররা বাধা দেয়।
: বসুন বসুন উঠছেন কেন?
: আমি সামনে যাব
: এখন সামনে যাওযা যাবে না। বক্তৃতা চলছে।
: আমি মুজিবের সাথে দেখা করব। বক্তৃতা শেষ হলেই তো উনি চলে যাবেন। ওনাকে পাবো না। আমাকে যেতে দাও বাবারা।
ভলেন্টিয়াররা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাইয়ি করে।
: মুজিব মানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন আপনি? সেটা কি করে সম্ভব? আর কেনই বা দেখা করবেন?
: আমার দরকার আছে। সম্ভব বাবারা। আমাকে যেতে দাও সামনে । উনি ঠিকই দেখা করবেন।
ফরিদ অনেক চেষ্টা করেও মাকে থামাতে পারে না। ওর ভয় করে। না জানি কী কান্ড আজ ঘটে। মৃদু হৈ চৈ শুরু হয়। মুজিবের বক্তৃতা তখন শেষের দিকে। উনি বক্তৃতা করতে করতেই লক্ষ্য করেন কিছু একটা ঘটছে। বক্তৃতা থামিয়ে বলেন,
: কী হয়েছে, কী ঘটেছে?
কেউ কথা বলেনা। ডিসি এসপি এমপি ছুটে আসেন। তারা মজিদাকে থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মজিদা ওনাদের দেখে আরো ব্যাকুল হয়ে বলে,
: আমাকে ওরা মুজিবের কাছে যেতে দিচ্ছে না। আমি মুজিবের সাথে কথা বলব।
মঞ্চ থেকে মুজিব আবারো বলেন,
: কি হয়েছে?
এবার মঞ্চে ছুটে যায় এমপি ডিসি এসপি। মুজিবকে ভয়ে ভয়ে বলে,
: স্যার, এক মহিলা আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। সম্ভবত মাথা খারাপ। সরি স্যার কীভাবে যেন এই মাথা খারাপ মহিলা সভায় ঢুকে গেছে
: মাথা খারাপ জানলেন কী করে? আমি ওনার কথা শুনব বক্তৃতা শেষ করে। ওনাকে সামনে নিয়ে আসুন।
মুজিবের বক্তৃতা চলতে থাকে। মজিদা বেগমকে সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। ভয়ে ভয়ে সাথে এলো ফরিদ। কটমট করে সবাই তাকায় ওর দিকে। কী এক বিপদে ওদের ফেলেছে আজ এই মহিলা!
মুজিব বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে মজিদার সামনে দাঁড়ান।
: কি হয়েছে বোন, কি বলবেন?
: আমি তুলারামপুরে থাকি। আমার স্বামী কায়জার রহমান তরফদার মুক্তিযুদ্ধে শহিদ।
: হ্যাঁ জানি। আমি তুলারামপুরের সেই মর্মান্তিক কাহিনি শুনেছি। জীবন্ত সমাধি দিয়েছে কায়জারকে আমার রাজনীতি করত এই অপরাধে। আমি দুঃখিত বোন!
মজিদা বেগম হতভম্ব! হতভম্ব ফরিদ!
: আপনিআমার স্বামীকে চিনতেন? আমার স্বামী ঠিকই বলতেন, আপনি এক অসাধারণ নেতা। আমার স্বামী বলতেন, আপনার অঙ্গুলি নির্দেশে সে দেশের কাজে নেমেছে। আপনার অঙ্গুলি নির্দেশে সে জীবন দিতে পারে।
: কিন্তু বোন, আপনি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন?
: কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। কিচ্ছু চাইতে আসিনি। আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, অঙ্গুলি কি? সে বলেছিল আঙ্গুল। আপনার যে আঙ্গুলের নির্দেশে সে জীবন দিলো আমি সেই আঙ্গুল একবার ধরতে চাই।
মুজিব তাঁর আঙ্গুলগুলো মজিদার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। একহাতে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। মজিদা একটি একটি করে আঙ্গুল স্পর্শ করে চেপে ধরলেন তাঁর তর্জনী। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করছে । মজিদার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই সে চেপে ধরে আছে মুজিবের তর্জনী।
Facebook Comments Sync