জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৫ / বেগম জাহান আরা

ড. বেগম জাহান আরা

পাঁচ                            

হামবুর্গের শরত কাল। গরম তো নেইই বরং একটু ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস। শীত লাগে না। ভালোই লাগে। এখানে ঘুঘু ডাকে বেশ। তাদের সাইজ কি বড়ো! প্রায় কবুতরের মতো। কাঠবেড়ালিরা সামনে দিয়েই ছুটোছুটি করে। মুখে ওক গাছের বিচি। কোথাও লুকিয়ে রাখবে শীতকালের খাদ্য হিসেবে। বেচারারা নাকি পরে সেটা আর খুঁজেই পায় না অনেক সময়। আমি যে থেরাসে বসে আছি, জেগে থাকা একটা মানুষ, তবু আমাকে গণ্যই করে না। এদেশে তো ওদেরকে কেউ তাড়া করে না। ভারি মজার অভয়ারণ্য পাখি প্রাণির জন্য। দু একটা পাখি, দেখতে কিছুটা দোয়েল বা ফিঙের মতো। সামনেই ঘাসের ওপর নেচে নেচে কি যেনো টুকে টুকে খায়। ফুড়ুত ফুড়ুত উড়ে এদিক ওদিক যায় ইচ্ছেমতো। যেনো তাদের নিজের সম্পত্তির ওপর চরে বেড়াচ্ছে। কার কি বলার আছে?

 

ঝাঁঝাঁলো রোদ উঠেছে। দুপুরে গরম পরতেও পারে। বাগানে অজস্র ফুল ফুটে আছে। আকাশি, হাল্কা বেগুনি আর সাদা ভুঁই চাঁপারগুচ্ছ বাগান আলো করে রেখেছে। জান্নাতের কথা মনে পড়ছে বাগানের ভুঁই চাঁপা ফুল দেখে। ওর খুব পছন্দের ফুল। কাছে তো নয় যে এক থোকা ফুল পাঠিয়ে দেবো। এবার জার্মানি আসার কদিন আগে জান্নাত ফোন করেছিলো। এই কেমন আছি, কি করছি, কি লেখালেখি হচ্ছে, এই সব কথা। বললো, মেলায় আপনার চারটা বই দেখেছি। বাংলা একাডেমির ভেতরের স্টলে। আমি জানতে চাইলাম, রমনা মাঠের ভেতর যে স্টল হয়েছে, সেদিকে যাও নি?

– এতো ধুলো ম্যাডাম! যেতে সাহস করলাম না। আমার ধুলোর এলার্জি আছে।

– ওখানে আরও পাঁচটা বই আছে।

– আপনি পারেনও ম্যাডাম। বর্ন জিনিয়াস।

– ওসব বলো না বাবা। কি আর করবো বলো? সময়গুলো কাজে লাগাই।

– বইয়ের নামগুলো বলেন ম্যাডাম, আমি আনিয়ে নেবো।

আমি একটা কাগজে লেখে রাখি। নিজেরই মনে থাকে না। জোর জোরে পড়লামঃ প্রবাসের দিন রাত, ফুল ফোটানোর খেলা, চোরাবালি, আমার ভাগ্যলেখা (ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ), প্রমিত বাংলা বানান ২০১২ঃ পরিমার্জিত সংস্করণ, প্রমিত বাংলা ভাষার বাংলা বানান, প্রমিত বাঙলা উচ্চারণঃ বিধি ও রীতি (একাদশ সং), বাংলা ফর ফরেইনারস (সিডিসহ, চতুর্থ সং), বৃহত্তর পৃথিবীতে (কবিতা সম্পাদনা)।

– অসাধারণ। এতো কাজ করেন কখন ম্যাডাম? কি ভাবে করেন?

– থাক ওসব কথা। এসো কিছুক্ষণ গল্প করি।

– এবার জার্মানি যাবেন না?

– যাবো। স্পনসরশিপ এসে গেছে। আগামি সপ্তায় যাবো ভিসার ফর্ম জমা দিতে।

– কতোদিন থাকবেন?

– জানি না কবে ফিরবো বাবা।

আঁতকে ওঠে জান্নাত।বলে, কি বলছেন ম্যাডাম? আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবেন?

মনে মনে বিষাদের দহটার দিকে তাকাই। কেউ কি এই পৃথিবীতে অপরিহার্য? বলি, আমার সিদ্ধান্তের কি দাম আছে বলো? ঐ ওপরওয়ালা যেটা যখন চাইবে, সেটাই তখন হবে। বলি, সত্যি খুব কঠিন কাজ সেটা। কেমন করে যে তোমরা এতো আপন হয়ে গেলে!

– শিশু একাডেমি-তে আপনার সাথে কাজ করে কি আনন্দই যে পেয়েছি।

– তোমরা না থাকলে আমি কি এতো কাজ করতে পারতাম? এখনকার পরিচালক কেমন?

হাসে জান্নাত। বলে, কি আর বলবো ম্যাডাম? এখন চাকরি করি। আপনার সময়ে করতাম কাজ।

খুব সুন্দর করে বললে তো। আসলে তোমরা সবাই খুব কাজের মানুষ ছিলে। আমি তো দেখেছি, জেলা শহরগুলোতে শিশু একাডেমির কর্মকর্তারা ছিলো টগবগে তরুণ। যে কাজে লাগিয়েছি, সেটাই করেছে ভালবেসে।

– ওরা এখনও আপনার কথা বলে।

– আমারও মনে পড়ে ওদের কথা। এই অভাগা দেশ তোমাদের মতো কাজের ছেলেমেয়ের মেধাকে ব্যবহার করতে পারে নি, পারবেও না।

সত্যি শিশু একাডেমিতে পরিচালক হিসেবে একটা বছর ছিলাম, কিন্তু কাজ করেছি দুই বছরের। একাডেমিতে প্রতি বছর একবার জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা হতো। পনরো কি ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা, এসবের প্রতিযোগিতা হতো। প্রায় মাস দুই ব্যাপী আয়োজনে চলতো বিশাল কর্মকান্ড। সারা দেশ থেকে শিশু  প্রতিযোগিরা আসতো। তাদের সঙ্গে অভিভাবক হিসেবে আসতো মা বাবা বা ভাই বোন। শিশু একাডেমির সারাটা ভবনে গিজ গিজ বা গম গম কোনোটাই বলা যায় না, মহা গোলমালে ত্রস্ত থাকতো বলা ভালো।

 

প্রত্যেক আইটেমের জন্য বিচারক ডাকাটাও একটা মস্ত কাজ ছিলো। তাদের চা নাশতা এবং সম্মানীর ব্যবস্থা রাখতে হতো। কতো পুরনো পরচিত বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে তখন দেখা হয়েছে। কেউ খুশি হয়েছে। হিংসেও করেছে কেউ। কিছু তো আর রাখা ছাপা থাকে না। বোঝাই যেতো। আর পুরস্কার কেনা নিয়েও কম সময় যেতো না। কর্মকর্তারা কাজ করতো প্রাণ ঢেলে। বিশেষ করে জান্নাত, ইকবাল, আতাউর এবং আরো কয়েকজন মেয়ে কর্মকর্তা (নাম বলতে না পারার জন্য দুঃখিত) অসাধারণ সার্ভিস দিয়েছে।

 

অন্যদের সহযোগিতার কথাও গণ্য করি। আমার পি এস, ক্লাস থ্রি এবং ক্লাস ফোর এমপ্লয়িদের কারো কারো কথা এবং আমার ড্রাইভার ইমরানের কথাও মনে করি।

 

তো আমি জানুয়ারি মাসে পরিচালকের চেয়ারে বসার এক মাসের মধ্যে গত বছরের জাতীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আর জুন মাসে করতে হয়েছে চলতি বছরের জাতীয় পুরস্কারের আয়োজনও। সে একেবারে হিমশিম ব্যবস্থা। সরকারিভাবে সে বছরকে ঘোষণা করা হলো ‘জাতীয় গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে। বছরের তখন মাঝামাঝি সময়। ভাবলাম,কিছু একটা করতে হবে মাইলফলকের মতো। একাডেমিতে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, শিশু একাডেমি থেকে আমরা একশো গ্রন্থ প্রকাশ করবো। চৌষট্টি জেলা থেকে চৌষট্টিখানা বই, আর ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হবে ছত্রিশটা বই।

 

একাডেমির চেয়ারম্যান জুবাইদা গুলশান আরাও ছিলো মিটিং-এ। লেখালেখির জগতে অনেকদিন থেকেই আমরা পরিচিত ছিলাম। নাম ধরেই ডাকাডাকি ছিলো। জুবাইদা আমাকে আপনি করে কথা বলতো কিছু সিনিয়র হিসেবে। আমি বলতাম তুমি করে। তো একাডেমিতে চেয়ারম্যানের পদ হলো পরিচালকের ওপরে। কিন্তু চেয়ারম্যান হলো একাডেমির শোভা। সমস্ত রকম নির্বাহী ক্ষমতা হলো পরিচালকের। এটা তার কিছুতেই সহ্য হতো না। কখনো গাড়ি নিয়ে, কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে, কখনো জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন নিয়ে, কখনো চেয়ারম্যানের বাথরুম মেরামতিতে দেরির অজুহাত নিয়ে, কখনো বা ফাইলে সই করা নিয়ে রীতিমতো মেজাজ দেখাতো। ফাইলে যে তার সই করারই কথা নয়, এটা কিছুতেই মানবে না। এসব কথা সে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রীকেও বলতো। মহিলা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলো তার ছাত্রি, তাকেও বলতো। কিন্তু আইনগতভাবে কিছুই হলো না। একজন মনোনীত এমপিও তার ছাত্রি ছিলো, তাকেও বলতো।

 

আমাদের সম্পর্কটা তিক্ত হয়ে গেলো। সপ্তায় একদিন এলেও তার চলে। কিন্তু সে প্রতিদিন আসতো অফিসে। তার নিজের গাড়ি আছে। তবু একাডেমির গাড়ি তাকে বিধির বাইরে দিতে হতো। পরিচালকের জন্য পাজেরো গাড়ি। সেটা প্রায় প্রায় মন্ত্রনালয় থেকে চেয়ে পাঠাতো। একাডেমির প্রভুদেরকে পাঠাতেই হতো গাড়ি। জুবাইদা থাকে কাছে। আমি বলতাম, চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ধানমন্ডি যাই। তাতে সে খুব অখুশি হতো। তার ইচ্ছে, গাড়ি তাকে একাই নিয়ে যাবে। এবং সে আগে যাবে, আমি বসে থাকবো। গাড়ি ঘুরে এলে পরে বাসায় যাবো আমি। 

 

একদিন বলেই বসলো, আমাকে আর তুমি তুমি করে কথা বলবেন না, পদাধিকারে আমি আপনার চেয়ে বড়ো। আপনি করে কথা বলবেন। তাই বলা শুরু করলাম। আজও দেখা হলে আপনি করেই কথা বলি। ও হয়তো সম্মানবোধ করতো। আমি করুণা করতাম ওর হীনমন্যতার জন্য। হাসতাম মনে মনে। আমার দিক থেকে বন্ধুত্ব আর ভালো সম্পর্কটা হারিয়ে গেলো। সে এখন প্রয়াত। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসি করুন।    

 

যাই হোক একাডেমি থেকে একশো গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে তার আপত্তি। কারণ, এতো কাজ স্টাফরা করতে পারবে না। শুনতে পেলাম আমাদেরই কিছু লোক, যারা শিশু একাডেমির প্রকাশনা দপ্তরে কাজ করে, তারা জুবাইদার বাসায় গিয়ে এই অসম্ভব প্রজেক্টের ব্যাপারে কান কথা বলে এসেছে। জুবাইদা তো আমার বিরুদ্ধে কথা পেলে লুফে নেয়। তাই নিলো। কিন্তু লাভ হলো না। কাজটা আমি করেই ছাড়লাম।

 

আমি প্রকশনা বিভাগের লোকজনকে ডাকলাম। একাডেমি থেকে মাসিক একটা ‘শিশু’ পত্রিকা বের হতো। সারা মাসে চার পাঁচটা লোকের ওটুকুই কাজ। আমি এসে দেখলাম, প্রতি মাসে পত্রিকার প্রচ্ছদ আঁকা নিয়ে ছুটোছুটির অন্ত নেই। সেখানে ভালো টাকাও দিতে হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের শিশুদের আঁকা যে সব ছবি পুরস্কার পায়, সেখান থেকেই ছবি বাছাই করে প্রচ্ছদ ছাপা হবে। তাদের পত্রিকা, তাদের হাতের আঁকা ছবি দিয়েই কাজ করবো আমরা। মেনে নিলো সবাই। বন্ধ হলো প্রচ্ছদের জন্য ছুটোছুটি, সেই নিয়ম আজো আছে বলেই জানি। যাই হোক, আমি বললাম, আমরা একশো গ্রন্থ প্রকাশ করবো এই গ্রন্থবর্ষে।

 

প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নাজিম বললো, অসম্ভব আপা।

– কেনো অসম্ভব, সেটা বলেন।

– অনেক কাজ। অনেক দৌড়াদৌড়ি।

– কাজের জন্যই তো প্রকাশনা বিভাগ। শুধু মাসিক একটা পত্রিকা প্রকাশে আর কতো শ্রম লাগে?

– আমরা তো প্রেসক্রাইবড প্রেসছাড়া কাজ করতে পারি না।

– কয়টা প্রেস আমাদের প্রেসক্রাইবড?

– দেখতে হবে আপা।

– ঠিক আছে, দেখে এসে বলেন।

– আজই?

– হ্যাঁ। সময় তো বেশি নেই।

– আসলে কাজটা যতো সহজ মনে করছেন আপা, ততো সহজ না।

– তবু চেষ্টা করি। আজকাল কম্পিউটারের যুগ। একটা বই কম্পোজ করতে কয়েক দিন লাগবে। প্রুফ দেখতে আর কদিন লাগবে? তারপর ছাপা এবং বাঁধাই।

– আমি কিন্তু আশাবাদি নই আপা। নাজিম আবার বলে।

 

আমি বেশ বিরক্ত হলাম ওর কাটা কাটা কথা শুনে। বুঝলাম, পেছনে লোক না থাকলে এতো সাহস হতে পারে না। বলি, এখন প্রেসের সংখ্যাটা দেখে আমাকে জানান।

 

এরপরেও নাজিম অনেক কিছু বললো। আমি বলতেও দিলাম। তারপর বললাম, আমাদের তালিকাভুক্ত প্রেসের সংখ্যাটা জানা দরকার প্রথমে।

– যতোটা মনে পড়ে আট নয়টার মতো হবে।

– মানে ঠিক সংখ্যা জানেন না?

– দেখতে হবে আপা।

– সেটাই তো বলছি ভাই। ও হ্যাঁ, ঘরবন্দি কাগজ আছে কয় রিম?

– ফাইল না দেখে বলতে পারবো না আপা।

-সেটাও তাহলে জানেন না? আবার বলি, কম্পিউটারে একটা পাঁচ ছয় ফরমার বই কম্পোজ করতে কদিন লাগে?

– কি করে বলি আপা?

– আমি বলতে পারি। বেশি হলে এক সপ্তায় হয়ে যাবে। তারপর কয়েক সপ্তায় প্রুফ দেখা  ভাঁজাই বাঁধাই এই সব। হাতে যে সময় আছে তাতে কাজ  না হওয়ার কথা নয়।

– বই তো মেলা আপা।

– সব তো আর আমরা কেন্দ্র থেকে করবো না। চৌষট্টি জেলা করবে চৌষট্টিটা। বাকি থাকে ছত্রিশটা। এখন জুন মাস। ছয় মাসে ছত্রিশটা বই হবে না? প্রেসও তো নিদেন পক্ষে আটটা মনে হয়।

 

– এতোগুলো প্রচ্ছদ কেমন করে এতো তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে?

– একটা মাত্র প্রচ্ছদ চাই আমাদের। সমস্ত বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙের একই প্রচ্ছদ যাবে। মানে, দশ জেলা করে ভাগ করে নেন। তার মানে, দশটা রঙের প্রচ্ছদ হবে। চৌষট্টি জেলায় যাবে চৌষট্টি প্রচ্ছদ,আর বাকি থাকবে আমাদের কেন্দ্রের জন্য। তাহলে কাজ কমে যায় না? কি বলেন?

হিসেব করে দেখা গেল, কাগজ আর প্রচ্ছদের বোর্ড কিছুই আমাদের কিনতে হবে না। সরকারের ঘরে অব্যবহারের টাকা ফেরত না দিয়ে কাগজ কিনে রেখেছিলেন আগের পরিচালক। সেটা কাজে লাগানো হোক। নাহলে তো কাগজ ড্যাম্প হয়ে যাবে।

– আপনি এখন বুঝতে পারছেন না আপা, আসলে অনেক  কাজ।

– বার বার অনেক কাজ, অনেক কাজ, বলে লাভ নেই। এই অনেক কাজটা যে করতেই হবে নাজিম।

– এরকম করলে তো চাকরি ছেড়ে দিতে হবে আপা।

– সেটা আপনার ব্যাপার। তবে কম্পিটারের যুগে এই কাজটা আমাকে করতেই হবে। এবং আমি খুব ভালো করেই জানি, এটা অসম্ভব নয়।

 

তোলপাড় পড়ে গেলো প্রকাশনা বিভাগে। এবার আমার নিজেদের জন্য পান্ডুলিপি সংগ্রহের ব্যাপার। প্রকাশনা বিভাগে বছরের পর বছর পান্ডুলিপি পড়ে থাকে। পছন্দের লোকদের বই ছাপানো হয়, অপছন্দের লোকদের বই পড়ে থাকে। দশ পনরো বছর আগে জমা দেয়া পান্ডুলিপিও পড়ে আছে জানা গেলো। সবই শিশুদের  জন্য লেখা বই। আমার শ্রদ্ধেয় শিকক্ষ ডঃ মঞ্জুশ্রী চৌধুরি জানালেন, তাঁর একটা পান্ডুলিপি পড়ে আছে দশ বছর থেকে। সব পান্ডুলিপি গুদাম ঘর থেকে বের করা হলো। বিচারক মন্ডলি তৈরি করা হলো। প্রকাশযোগ্য পান্ডুলিপি বাছাই শুরু করলেন তাঁরা। সেকি একটা দুটো পান্ডুলিপি? ঝেড়ে মুছে তুলতেই গেলো কয়েক দিন। ছাপার যোগ্য অনেক বই পাওয়া গেলো।

 

অন্য দিকে জেলা কর্মকর্তাদের সব জানালাম। ওদের তো জেলায় বলতে গেলে কোনো কাজ নেই। মানে কাজ দিতে পারেনা সরকার। বই প্রকাশের কাজ পেয়ে ওরা খুশি হলো। কেন্দ্র থেকে গ্রন্থে লেখার বিষয়বস্তু ঠিক করে দেয়া হলো। আমরা কাগজ প্রচ্ছদ আর কিছু টাকা দিলাম। আর বললাম, সামান্য কিছু বিজ্ঞাপন স্থানীয়ভাবে জোগাড় করবে যদি প্রয়োজন হয়। এতে ওরা আরো খুশি হলো। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন তো আগেই নিয়েছিলাম। 

 

আমার পরিকল্পনা ছিলো, প্রতিটা জেলার স্থানীয় সামাজিক ও ভৌগলিক ইতিহাস এবং স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা যেনো উঠে আসে। জেলার সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক, সমাজসেবী, সবচেয়ে পুরনো স্থাপনা তা সে মসজিদ মন্দির স্কুল যাই হোক, সেগুলোর কথা তুলে ধরতে হবে। কুড়ি একুশটার মতো বিষয় দেয়া হয়েছিলো। বইটা হাতে নিলে একটা মানুষ যেনো একটা জেলা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা চিত্র পেয়ে যায়। জেলার শিশু কর্মকর্তা ছেলে মেয়েরা চমৎকার

কাজ করলো। এক হাজার করে বই ছাপা হয়েছিলো প্রতি জেলায়। প্রচ্ছদের রঙ আলাদা করে দেয়াতে একই প্রচ্ছদ হওয়া সত্ত্বেও নতুনত্ব ছিলো বইগুলোতে। আশা ছিলো এই প্রজেক্ট পরেও চলবে। কিন্তু চলেনি। পরে অনেকে চৌষট্টি জেলার বইয়ের সেট কিনতে চেয়েছিলো শুধু মূল্যবান তথ্যের জন্য। কিন্তু দিতে পারি নি আমরা। কেউ তো পরামর্শ দেয়নি বা কাজটার উপযোগিতা নিয়ে ভালো কথা বলেনি।  তবু আমি বলবো সফল প্রজেক্ট হলো ওটা।

 

আমাদের শত গ্রন্থমালা প্রজেক্ট অন্য অনেক মন্ত্রণালয় পছন্দ করেছিলো। আর কোনো দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান গ্রন্থবর্ষে শিশু একাডেমির মতো সাহসী প্রকল্প নিতে পারেনি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্র একদিন বলেই ফেললো, তারা এমন একটা প্রজেক্ট করতে পারলে ভালো হতো। অন্যদিকে আমি যতো সফল হই, আমার চেয়ারম্যান ততোই ক্ষেপে যায়।

 

ঢাকা কেন্দ্রের কাজও চললো জোরে সোরে। প্রকাশনা বিভাগের সকলেই প্রেসে যায় আসে। ছোটাছুটি করে। প্রুফ দেখে। আমি দেখি। খুশি হই কাজের গতি দেখে। নভেম্বরের শেষে নিরানব্বইটা বই হয়েই গেলো প্রায়। চেয়েছিলাম বিজয় দিবসের উপহার হিসেবে শত গ্রন্থমালা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছে দেবো। সেটা হয় নি। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষে নিরানব্বইটা বই দিতে পেরেছিলাম। একটা কেন্দ্রীয় গ্রন্থ থেকে গেলো অসমাপ্ত। অনেক রথি মহারথি যথাসময়ে লেখা দিতে পারেননি বলে। সেটা সমাপ্ত হলো পর বছর মে বা জুন মাসে। আমি তখন নেই একাডেমিতে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়ার পরই বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো আমাকে। এক বছরের চুক্তিতে কাজে যোগ দিয়েছিলাম।আজো অবাক লাগে, চুক্তিভিত্তিক কাজে তো সম্মানী একটা দিতে হয়। মন্ত্রনালয় কি হিসেব নিকেষ করলো, অতি নগণ্য টাকা আমার যাতায়াত বাবদ দিয়েছিলো। মাথা ঘামাই নি আমি। কাজের জন্য যাওয়া, কাজ করবো মন দিয়ে। করেছিও দাপটের সাথে। কিছুটা গাধার মতো।

 

ইউনিসেফের একগাদা বই আসলো একদিন ট্রাকে করে। বাচ্চাদের বই। মাত্র মাসখানেক হলো আমি বসছি অফিসে। হোমরা চোমরা লোকজনের সাথে মিটিং হবে অনুদানের বইগুলো হস্তান্তরের সময়। ঝকঝকে নতুন বই। শিশু এবং শিশুর ক্রমবিকাশ  সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তৈরি বই। পর্যাপ্ত ছবি আছে বইয়ে। শতকরা পঁচানব্বই ভাগ ছবি দরিদ্র আদিবাসিদের মেয়ে ও শিশুদের। প্রচ্ছদে একটা উদোম শিশু মায়ের কাছে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। ভেতরের একটা ছবিতেও উদোম দেহে একটা মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। আমার বাংলাদেশি ইগোতে লাগলো। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু উদোম দেহের ছবি তুলে বিকোনোর জাতি নই। বাচ্চারা এই বইগুলো দেখবে। ওদের জন্য স্কুলে ফ্রি ব্যাবহারও করা হবে এগুলো। এমন ছবি দেখে হীনমন্য হবে ওরা ছোটো থেকেই। হবে অসভ্য। নিজেদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে ছোটো মন নিয়ে বেড়ে উঠবে।

 

ইউনিসেফের এমন সেবা নিতে রুচিতে বাধলো আমার। সামান্য আলোচনার পরে ব্যাপারটা আমি কমিটির ওপর ন্যস্ত করলাম। জানতে চাইলাম, আমাদের দেশের ধর্মপরায়ণ এবং পরদা পুশিদা মানা মানুষ উদোম বুকে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর এই রকম ছবি কি মেনে নেবে? মোল্লা মুসল্লিরাও কি ছেড়ে কথা বলবে? আপনারাও একটু চিন্তা করেন। অজ গাঁয়েও আমি গেছি। অপরিচিত লোক দেখলে ন্যাংটো বাচ্চাকে মায়েরা আঁচল দিয়ে ঢাকে। অপরিচিত লোকের সামনে বুক খুলে বাচ্চাকে খাওয়ানোর দৃশ্য কোথাও দেখিনি। তাছাড়া এই ছবি তো শুধু শিশুরা দেখবে না, দেখবে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষও।

 

ওরা চিন্তায় পড়ে গেলেন। আবার আলোচনা শুরু হলো। আমি বললাম। আদিবাসিদের ছবি কিছু কমিয়ে দেয়া যায় না কি? এই দেশে আরও লোক তো আছে! কিন্তু বই তো ছাপা হয়ে গেছে। ইউনিসেফের  কর্মকর্তাদের এবং কমিটির অন্যদের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট দেখা গেলো। কারণ উত্তর দেয়ার কিছু নেই তাঁদের। কেনো তাঁরা এমন বই তৈরি করলেন সেটা আমিও বুঝতে পারলাম না। প্রচ্ছদে ন্যাংটো ছেলের ছবি দিয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র তুলে ধরা শুধু নয়, গরিবের  যাপিত জীবনের সংস্কৃতির দুঃস্থ চেহারা দেখানোর প্রয়োজনই বা কি ছিলো? অনুদান দেয় বলে ওরা আমাদের শিশুদের কাপড় খুলে দেখাবে বিশ্ববাসীকে? মায়েদের উদোম বুক দেখাবে? তাছাড়া ভেতরের ছড়াগুলোও খুব নিম্নমানের, সে কথাও বললাম। 

 

আলোচনার পর ঠিক হলো, প্রচ্ছদের ছবি এবং মায়ের ঐ ছবি বদল করতে হবে। ভেতরের ছবির অনুপাত যতোটা সম্ভব ঠিক করা এবং ছড়াগুলোর কিছু সংস্কারও করা হবে। জানি না ইউনিসেফের মতো প্রতিষ্ঠান এমন বিপাকে আর কোনোদিন পড়েছে কি না? বুঝতে পেরেছিলাম, কাজটা ওঁদের জন্য ঝামেলার হবে। কিন্তু সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত তো হয়েই গেছে। তারপর ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যেতে হলো বইগুলো। তোলপাড় উঠে গেলো আমাদের অফিসে এবং মন্ত্রণালয়ে। কাছের স্টাফরা অবাক হলো আমার সৎসাহস দেখে। কাঞ্চনে হাত ভরিয়ে ফেলতে পারতাম। রুচিই  হলো না।

 

এই সৎ সাহসের কট্টর প্রতিদানও আমি পেয়েছি। এটিএন বাঙলায় আমি ‘হাট্টিমা টিম টিম’ নামে শিশুদের একটা প্রোগ্রাম করেছি তিন বছরের বেশি। একবার ইদে আউট ডোর শুটিং-এ গিয়ে ‘চাঁদের হাসি’ নামে ঐ শিশুদের প্রোগ্রাম করেছিলাম। এটিএন বাংলা ঐ অনুষ্ঠানটা ইউনিসেফ-এর  শিশু অনুষ্ঠান-এর প্রতিযোগিতায় জমা দিয়েছিলো। অনেকের ধারণা ছিলো ওটা পুরস্কার পাবেই। কিন্তু পায় নি। বিদেশিরা অপমান ভোলে না। বাংলাদেশিদের উঁচু মাথা ওদের সহ্য হয় না। সুযোগ পেলে বাড়ি মেরে মাথাটা ভেঙে দেয়ার তালে থাকে। ঘটনাটা আমি বুঝেও কাউকে বলি নি। দেশ দেশাচার দেশজ সংস্কৃতির পক্ষে কাজ করতে গেলে এমন পুরস্কার যদি জোটে, তাহলে তাই সই।

 

এটিএন বাংলাও কম যায় নি। ‘হাট্টিমা টিম টিম’ প্রোগ্রামে পাঁচ বছরের বেশি বাচ্চাদের নেয়ার নিয়ম ছিলো না। কিন্তু কিছু অফিসারের তরফ থেকে কখনো একটু বড়ো বাচ্চাকেও প্রোগ্রামে নেয়ার অনুরোধ আসতো। সেই অনুরোধ বাড়তে থাকলো। কিন্তু আমি বড়ো বাচ্চাদের নিতে চাইতাম না। কখনো নিতেই পারতাম না। দাঁত দেখেই বোঝা যেতো যে বাচ্চাটা ছয় বছর বা  তার বেশি। অনুষ্ঠানের নিয়ম হলো, পাঁচ বছরের মধ্যে বাচ্চাদের বয়স হতে হবে। আমি সেটা মানতে চেয়েছি। আমার এই নিয়ম মেনে চলাটা অনেকের ভালো লাগলো না। অনুষ্ঠান তৈরি এবং প্রচারের ক্ষেত্রে কিছু অসহযোগিতা দেখা গেলো। মানে, নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠান প্রচার করতে দিতো না মাঝে মাঝে। বলতো সম্পাদনা হয় নি। একবার আমি বললাম, আমাকে সিডিটা দেন, আমি বাইরে থেকে টাকা দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে আনি। সেটাও দেবে না। এমন সময় রোজার মাস এলো। আমাকে বলা হলো, রোজার মাসে এই প্রোগ্রাম সাময়িক বন্ধ থাকবে। সেই সাময়িক বন্ধই স্থায়ী হয়ে গেলো। ঐরকম প্রোগ্রাম পরে আর করতেও পারেনি এটিএন । বহুবার ভেবেছি, কি হতো যদি বড় বাচ্চাকে নিতাম প্রোগ্রামে? আসলে অন্যায়ভাবে মানুষকে খুশি করতেই যে পারিনি কোনোদিন। দোষ বা গুণ যাই বলা হোক, এটাই আমি। ধান্দা করতেই শিখিনি কখনও। সেজন্য ভুগেছিও যথেষ্ট। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু অনুতাপ হয়নি।

===========