খোকা থেকে শেখ মুজিব/ শারমিনা পারভিন

খোকা থেকে শেখ মুজিব শারমিনা পারভিন

খোকা থেকে শেখ মুজিব/ শারমিনা পারভিন

 

আজ মহান স্বাধীনতা দিবস।  সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার রূপকার, বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই  বিনম্র শ্রদ্ধা। 

 

ঐ মহামানব আসে;

 দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে

মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।

 

যুগে যুগে এ ধরণের মহামানব বার বার আসে না। এরা একবারই আসে। আনে বিশ্বে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেদিন সূর্য ওঠে নতুন ভাবে, পূর্ব দিগন্তে রক্তিম আলো ছড়ায়। 

 

আজকের আকাশে অনেক তারা

দিন ছিল সূর্যে ভরা

আজকের জোছনাটা আরো সুন্দর

আজকের পৃথিবী তোমার জন্য

পড়ে থাকা ভাল লাগা, মুখরিত হবে দিন

আগামীর সম্ভাবনা

 

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালে ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলায় টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা  শেখ লুৎফুর রহমান, মাতা- সায়েরা খাতুনের সংসারের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। পিতা-মাতার আদুরে ডাক নাম ছিল খোকা। শৈশবে তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে বাংলা, আরবী, ইংরেজী, গণিত শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৭ সালে। ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় চোখ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় লেখাপড়ার ব্যাঘাত হয়। পরবর্তীতে মিশনারী স্কুলে ভর্তি হন। 

 

ফুটবল ও ভলিবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ১৯৪০ সালে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের সাথে জড়িত ছিলেন। স্বল্পভোজী ও দানশীল ছিলেন তিনি। সাহসী ছিলেন। যেকোন অন্যয় দেখলে প্রতিবাদ করতেন। নিজের গায়ের জামা  ও গোলার বীজ মানুষকে দিয়ে দিতেন। সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অনেক। স্কুল জীবনে মুসলিম সেবক সমিতি গঠন করেছিলেন। মুষ্টি চাল নিয়ে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলি করতেন। 

১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্কুল পরিদর্শনে আসেন। বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের পক্ষে দাবি তোলেন, আমাদের স্কুলের বোর্ডিং নষ্ট হয়ে গেছে, বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। ঠিক করে দিতে হবে। মন্ত্রীদ্বয় তৎক্ষনাৎ আদেশ দিয়েছিলেন। 

 

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৩০ জেলা প্রাদেশিক ছাত্রলীগের প্রাদেশিক কাউন্সিলর  নিযুক্ত হন। ১৯৪০ ফরিদপুর জেলার সহ সভাপতি, জেলা ডিফেন্স কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৫ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়  সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষার দাবীতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চ তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী টানা অনশনে অসুস্থ্ হয়ে পড়লে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে গোপালগঞ্জের মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামান-কে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। সমবায়, কৃষি ও শ্রম মন্ত্রী হন। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। 

 

১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম লীগ কথাটি বাদ দেয়া হয় এবং তিনি পুনরায় সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। 

 

১৯৫৪ সালে ৩০ মে বঙ্গবন্ধু আবার গ্রেফতার হন। উনি জামিনে মুক্তি পেলে জেলগেটে তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণ পরিষদে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে পল্টনের জনসভায় তিনি সর্বপ্রথম স্বায়ত্বশাসনের দাবী করেন। ১৯৫৮ সালে জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, হয়রানি করা হয়। ১৯৬৪ সালে ২৫ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন তিনি। 

 

১৯৬৪ সালে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ৬ দফা গৃহিত হয়।  ছয় দফার পক্ষে তিনি সারাদেশ পরিভ্রমণ করেন। সারা দেশের জনগণকে তিনি সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে এক নম্বর আসামী করে সি.এস.পি অফিসারদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। তিন মাসে তিনি ৮ বার গ্রেফতার হন। শেষবার তাঁকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়।

 

বঙ্গবন্ধুকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে  আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ায় বঙ্গবন্ধু  প্রস্তাব  ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামী সার্জেন্ট জহুরুল-কে হত্যা করলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। 

 

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ডাকসু এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করে। এ অধিবেশনে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা করেন, শেখ মুজিবুর রহমান  এখন থেকে আর শেখ মুজিব শুধু নন, এখন থেকে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু।’ তিনি  জনগণের বন্ধু। 

 

১৯৭০ সালে নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৬৭টি আসন পায় আওয়ামীলগি। জুলফিকার আলী ভুট্রো ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে তালবাহানা শুরু করেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক স্বাধীনতরার ডাক দেন। তিনি বলেন-

 

এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়

বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো।।

 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে।  সেটা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ -এর মাধ্যমে পাখির মত নির্বিচারে হত্যা করা হয় এদেশের নিরীহ জনগণকে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা  একটা দেশ পেলাম। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হলো । ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু  স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। 

 

দেশে প্রত্যাবর্তন করেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুননির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, চারিদিকে মহাশ্মশান। একটি দেশকে পুননির্মানে যথেষ্ট সময়ের দরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কেবলমাত্র বাংলাদেশে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে। সেই সময় সেনাবাহিনীর এক বিপথগামী বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নৃশংস, নিন্দনীয়, বর্বর ঘটনা আছে কীনা আমার জানা নেই!  লজ্জা পেল দেশ, লজ্জা পেল পতাকা, লজ্জা পেল মানচিত্র। ইতিহাসের এক সূর্য সন্তানের বিদায়! 

 

ইতিহাসে মরেও মরেনি যারা। সেই সূর্যসন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

এভাবেই টুঙ্গীপাড়ায় খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা,  সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি। 

 

ও ক্যাপ্টেন মাই ক্যাপ্টেন

তোমাকে জানাই বিনম্র  শ্রদ্ধা

আজ বড় বেশি মনে পড়ে 

জীবনানন্দ দাশের বোধন কবিতা

হে মহামানক, শুধু একবার 

এসো ফিরে,

শুধু একবার চোখ মেলো

এই গ্রাম নগরের ভিড়ে

 

তোমার মৃত্যু নেই হে পিতা।

শারমিনা পারভিন