চৈত্র সংক্রান্তি / অনুপা দেওয়ানজী

চৈত্র সংক্রান্তি / অনুপা দেওয়ানজী

চৈত্র সংক্রান্তি / অনুপা দেওয়ানজী

 

সকালে রোদ ওঠার আগেই উঠানের তুলসীতলাটা নিজের হাতে গোবর জলে লেপতে লেপতে ঠাকুমার হাঁক ডাক শুরু হয়ে গেলো , ওরে তোরা এখনো উঠলি না? বেলা যে চড়ে গেলো । তাড়াতাড়ি ওঠ।

জাঁকের ধোঁয়া গায়ে লাগাবি না?

সুয্যিদেব তো আরেকটু পরেই  চড়চড় করে  মাথার ওপর আগুন ছড়িয়ে উঠবে।

জাঁকের ধোঁয়া মানে ঔষধির ধোঁয়া।

 

  বাড়ির চারপাশের আগাছা  আর বিষকাটালি কেটে এনে উঠানের মাঝখানে জাঁক দিয়ে  রাখা হয়েছে। 

ঠাকুমার কড়া আদেশ সকাল সন্ধ্যা তিনদিন সেই স্তুপে আগুন দিয়ে তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বাড়ির ছেলেমেয়ে সবাইকেই সেই  জাঁকের ধোঁয়া নিতে হবে।তাতে নাকি চর্মরোগ হয় না।

ছোটকা তো একথা শুনে হেসেই খুন।

ছোটদের বলে,  ধোঁয়াতে কি চর্মরোগ যায়?  আসলে কিছুদিন পরেই আষাঢ় মাসের ঝুম বৃষ্টি যখন নামবে তখন সাপখোপ এসে সেই ঝোপে  আশ্রয় নিতে পারে তাই জঙ্গল কেটে পুড়িয়ে সাফ করা।

 ছোটকা  হয়তো সত্যি কথাই বলে। 

 

 ঠাকুমার ডাকে ঘুম ছেড়ে সবাই হুড়মুড়িয়ে উঠানে নেমে এলো।

এরপর সেই স্তুপের চারপাশে গোল হয়ে  ঘুরতে লাগলো।

ঠাকুমা তাদের বললেন,  শুধু ঘুরলে হবে না । বল,

জাঁক, জাঁক,জাঁক

মোদের বাড়ির জাঁক

টাকা পয়সা, ধন সম্পত্তি

মোদের বাড়ি যাক।

আপদ, বালাই মোদের ঘরের

বাইরে পড়ে থাক।

 

ঢেঁকি ঘরের পাশেই  নিমগাছটা  ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। কী মিষ্টি একটা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।

কাল ছিল ফুল বিহু। নিম গাছ থেকে তাই  ফুলসহ ডাল ভাঙা হয়েছিল  আর পুকুর পাড়ের কাঠগোলাপ গাছ থেকে মুঠি মুঠি ফুলও তোলা হয়েছিল।

সেই নিমের ডাল, কাঠগোলাপের কলি আর ফুলের মালা গেঁথে বড়দি আর মেজদি  দরজায়  ঝুলিয়ে দিয়েছে।

 

আজ মূলবিহু।

কাকিমা তাই নিম পাতা, কাঁচা হলুদ আর সর্ষে একসাথে পিষছে।

 বিষকাটালির ধোঁয়া গায়ে লাগিয়ে সেই নিমপাতা বাটা গায়ে মাখতে বসে গেছে ছোটরা। মাখা হলেই ঝুপঝাপ  পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে স্নান করে নতুন কাপড় পরতে না পরতেই মা পিঁড়ি পেতে ডাক দিলো, ওরে তোরা আয়।

 

আজ নাকি দই, চিঁড়ে আর  ফল খেতেই হবে। তার পরে খইয়ের লাবন,সীম বিচির লাবন,আটকড়াই, তিলের নাড়ু আর কুলের নাড়ুও আছে। তবে সবার আগে শত্তুর কেটে  নিমপাতা দিয়ে একমুঠো  খই খেতেই হবে।

মাগো!  কাঁচা নিমপাতা কি মুখে দেয়া যায়? ছোটকা তো নিমপাতা আর খই মুখে দিয়েই সাথে সাথে একটা গুড়ের লাবণ টুপ করে মুখে দিয়ে ফেলে।

 

রান্না ঘরের দাওয়ায়  আজ রাজ্যের সবজি।

গুনে শেষ করা যায় না।এই সবজি দিয়ে আজ রান্না করা হবে  পাচন বা শুক্তো! পাচনে কমপক্ষে আঠারো রকমের সবজি দিতেই হয়। স্বর্ণদি পাচনকে পাচন বলে না বলে  আঠোরা।

 আমিষ ছোঁয়া আজ একদম বারণ। 

বৈঠকখানায় বাবা আর কাকা গল্প করছেন ও পাড়ার সনাতন জ্যেঠার সাথে। 

 

ঠাকুমা ততক্ষণে স্নান সেরে গান গাইছেন, 

রাই জাগো রাই জাগো শুকসারি বলে

কত নিদ্রা যাও কালো মানিকের কোলে।—

না,  ঠাকুমার গলা আর শোনা যাচ্ছে না।পূজায় বসে গেছেন মনে হয়।

পূজা সেরে এসে  পেতলের ডাবর খুলে একখিলি পান মুখে দিয়েই ঠাকুমা তরকারি কুটতে বসলে মা  বললো,  পরবের দিন মা। মুখে কিছু না দিয়েই তরকারি কুটতে বসে গেলেন যে ? আপনাকে নিয়ে আর পারি না।

 

রান্নাঘরের উনুনে ততক্ষণে আঁচ পড়ে গেছে। আজ তেমন  বেশী পদ রান্না হবে না। তবে পাঁচরকম ভাজা হবে ।তার মধ্যে ঘিয়ে ভাজা নিমপাতা আর করলাভাজা থাকবেই।  ভাজার সাথে হবে পাচন। সবশেষে কচি আমের টক।

ঠাকুমা তরকারি কুটতে কুটতে ছোটকাকে ডেকে বললেন,   পাঁজিটা খুলে দেখতো এবারে রান্নার ভার  কার হাতে পড়েছে ? দুর্গা বা দ্রৌপদী হলে ভালো হয়। সূর্পণখা হলে তো রান্নাই মাটি।

ছোটকা হাসতে হাসতে বললো , রাঁধবে তো তোমরাই।  বেচারি সূর্পণখার কি দোষ বল? দূর্গা আর দ্রৌপদী আর্য আর সে অনার্য নারী বলে?

ছোটকার কাছে জেনে নিতে হবে আর্য আর অনার্য মানে কি?

 বাড়ির উঠানে ততক্ষণে গ্রামের দুজন মানুষ শিব আর দুর্গা সেজে একপাল ছেলেমেয়েসহ নাচতে নাচতে এসে হাজির। 

তাদের নুপুরের শব্দ শুনে  খাওয়া ফেলে ছোটরা বেরিয়ে এলে ঠাকুমা চিৎকার দেন,  ওরে পাত ফেলে উঠিস না।কে শোনে কার কথা।

শিব দূর্গার নাচ দেখেই ওরা যাবে চড়কের মেলায়।ঠাকুমার কাছ থেকে তাই আগেই মউলি নিয়ে রেখেছে সবাই।

 চড়কের মেলায় আগে নাকি একটা গাছকে চড়ক গাছ বানানো হত। তারপর  লোকের পিঠে বঁড়শি গেঁথে সেই গাছের সাথে  ঝুলিয়ে বাঁই বাঁই করে ঘোরানো হত। এখন আর তা করা হয় না।ছোটকা বলে পূজা না ছাই। আগে কোন কৃষক খাজনা দিতে না পারলে তার পিঠে বঁড়শি বেধে ওভাবে ঝুলিয়ে আসলে শাস্তি দেয়া হত।

ওটাই পূজা হয়ে গেছে।

ছোটরা নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করে,  ছোটকা যা বলে তা হয়তো ঠিকই বলে। কত মোটা মোটা বই পড়ে ছোটকা।

চৈত্র সংক্রান্তির পরের দিন হলো নতুন বছর। সেদিন আর তেতো খেতে হয় না।পাচন বা শুক্তোও না।সেদিন মাছ,মাংস, ডিম,মিষ্টি, নতুন জামা,আলপনা।

চৈত্র সংক্রান্তি এলেই মনে হয় রাত পোহালেই আসবে নুতন একটি বছর।

ঠাকুমা, বাবা,মা,কাকা, কাকিমা,ছোটকা সবাই বলে নূতন বছরের অর্থ হল অশুভ শক্তিকে পেছনে ফেলে শুভশক্তিকে আহ্বান  করা।

 

অনুপা দেওয়ানজী
অনুপা দেওয়ানজী