রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ/ অনুপা দেওয়ানজী

 

লকডাউনের জন্যে  ঘরেই বন্দী হয়ে আছি অনেকদিন। এমন দুঃসহ বন্দীদশার জীবন এর আগে মানুষের জীবনে আর  কখনো আসেনি। 

জীবন যে শুধুমাত্র   অনিশ্চিত এক পথের দিকে এগিয়ে  চলেছে শুধু তাই নয়,  এই বিষাদময় বন্দী জীবনে একান্ত প্রিয়জনকেও একটু দেখা বা ছুঁতে না পারার নিষেধের বাণীই বা এর আগে কে শুনেছে!

এমনই দুঃসহ দহনবেলায় মন যখন কিছুতেই স্থির থাকেনা রবীন্দ্রনাথ তখন আমার পাশটিতে এসে বসেন।

গানে,গল্পে,কবিতার বৈচিত্র্যময় উপস্থিতিতে তিনি আমাকে  এই কষ্ট আর বিষাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

 চিরদিনই  খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা এই আমি যখন ঘুম থেকে উঠি, চরাচর জুড়ে তখন দেখি আঁধারের পাতলা একটা স্তর সরের মতো পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকে।

সেই সরের স্তর সরিয়ে খুব ধীরে ধীরে সূর্য যখন তার সাতরঙা  আলোয় উদ্ভাসিত  হতে থাকে তখন ওই সূর্য কিরণের দিকে তাকিয়ে আমার ভারি অদ্ভুত লাগে। মনে এক ধরনের শিহরণ বয়ে যায়।কোথা থেকে সূর্য নিয়ে আসে এই অপরূপ আলো এই প্রশ্নের যখন উত্তর খুঁজি

পাশ থেকে কেউ একজন ঠিক তখন  গেয়ে উঠেন

 ” অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো 

সেই তো তোমার আলো ওগো সেই তো তোমার আলো।

আমি পাশ ফিরে দেখি রবীন্দ্রনাথ আমার মাথায় হাত রেখে স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার পরিচয় তো আর আজ নয়।

মায়ের মুখের ভাষাকে  নিজের মুখে তুলে নেবার সাথে সাথেই যে তাঁর সাথে আমার পরিচয়।

যখন তাঁর সহজ পাঠ বইটি নিয়ে পড়তে বসতাম।

“ছোট খোকা বলে অ আ

শেখেনি সে কথা কওয়া”। 

 তখন থেকেই তো আমি তাঁকে চিনেছি। তখনও  তিনি আমার পাশটিতে এসে বসেছিলেন। নিজের হাতে বইটির পাতা উল্টে দিয়েছিলেন 

আমি বইয়ের পাতায় আঙ্গুল রেখে রেখে পড়তাম

“এ ঐ ও ঔ 

ভাত আনো বড় বৌ”।

তার পর একটু বড় হতেই ভোরের কুয়াশায়, সকালের শিশিরে, পাখি ডাকা সকালে, খাঁ খাঁ করা দুপুরে,  নিস্তব্ধ রাতে কখন তিনি আমার পাশটিতে ছিলেন  না?

সংসার জীবনের রুঢ় বাস্তবতায়,আপন জনের ভুল বোঝাবুঝিতে যখন  খুব কষ্টবোধ হয়  বা নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে তখনও তিনি একান্ত বন্ধুর মতোই   বারেবারে আমার পাশটিতে এসে দাঁড়ান। মুছে দেন আমার একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবনের বেদনাবোধটুকু। 

কোন সময়েই তিনি আমাকে ছেড়ে যাননি।

 আমিও তাই  দুঃখে সুখে,সম্পদে,বিপদে তাঁর কাছেই নিজেকে ধরা দিই।

 ভোরের ওই আকাশের আলোর  মতো  তাঁর আকাশেও আলোর আশ্রয় খুঁজি।

 জানি এই লকডাউন এক সময়ে শেষ হবে। অনাগত সেই দিনগুলি কেমন হবে এটা আমার ধারণাতে নেই।

তবে এটা জানি, সেদিনও তিনি  আমাকে ছেড়ে যাবেন না। এভাবেই  সাহস জোগাতে ঠিক  পাশটিতে এসে দাঁড়াবেন।

আর যদি মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়ায় সেদিনও  তাঁর আশ্রয় নিয়ে  যেন গাইতে পারি।

জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।

সকল মাধুরী লুকায়ে যায় গীতিসুধারসে এসো।

প্রণাম কবি!

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী