বঙ্গবন্ধু  ও বাঙালির  আত্মপরিচয় / শারমিনা পারভিন

বঙ্গবন্ধু ও বাঙ্গালির আত্মপরিচয়

বঙ্গবন্ধু ও বাঙ্গালির আত্মপরিচয়

বঙ্গবন্ধু  ও বাঙালির  আত্মপরিচয় / শারমিনা পারভিন

 

 এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?

 তেমন যোগ্য  সমাধি  কই? 

মৃত্তিকা  বলো, পর্বত বলো,

অথবা  সুনীল -সাগর- জল

 সব কিছুই  ছেঁদো, তুচ্ছ  শুধুই!

তাইতো রাখিনা,এ লাশ আজ 

মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,   

হৃদয়ে  হৃদয়ে  দিয়েছি ঠাঁই। 

 

বঙ্গবন্ধু  শেখ  মুজিবুর  রহমান   বাঙালি  জাতির  স্বাধীনতার অগ্রদূত, স্থপতি, রুপকার, জাতির  পিতা, হাজার  বছরের স্রেষ্ঠ বাঙালি।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম  নাহলে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম না। এখনো  পরাধীনতার  শৃঙ্খলে আবদ্ধ  থাকতাম। এদেশ ছিল  বিদেশি  শত্রুদের দখলে। সেই  বিদেশি  শক্তির  হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য  নেতৃত্ব  দেন বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীতে  যত নেতা আছেন,তার মধ্যে  বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথম কাতারে, প্রথম সারিতে।

তার অসামান্য  নেতৃত্বের  কারণে তিনি মাতৃভূমি রক্ষায়  সবস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
ছিনিয়ে  এনেছেন দেশের  স্বাধীনতা, এনেছেন একটি স্বাধীন  রাষ্ট্র।
আমরা পেয়েছি  একটি নতুন রাষ্ট্র,  একটি পতাকা, মানচিত্র, স্বাধীনতার স্বাদ।


গোপালগঞ্জ  জেলার টুঙ্গিপাড়া  গ্রামে এই মহামানবের জন্ম।

ঐ মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ  লাগে

তিনি এসেছিলেন  এভাবেই।
বঙ্গবন্ধুর পিতার নাম শেখ,লুৎফর  রহমান,মায়ের নাম সাহেরা খাতুন। বাবা মায়ের অত্যন্ত আদুরে সন্তান। ডাক  নাম খোকা।
ছেলেবেলা  থেকেই  মমতার আধার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারও ছাতা নেই, হাতের ছাতাটা দিয়ে  বাড়ি চলে আসলেন।কেউ অভাবী, গায়ের জামাটা তার গায়ে চড়িয়ে দিলেন। চাতালের ধান সবাইকে  বিলিয়ে দিতেন।
অসম সাহসী  ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী  তখন প্রধানমন্ত্রী  স্কুল  পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ,বঙ্গবন্ধু  অসীম সাহসিকতার সাথে স্কুলের ছাদ মেরামতের  কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী  মুগ্ধ  হয়েছিলেন,এতটুকু  বালকের সাহসিকতা দেখে।
ছোট বেলা থেকেই  ওনার মধ্যে  জন্ম নেয় এক অগ্নি স্ফুলিঙ্গ।
এভাবেই  তিনি একদিন  সেই  আদুরে খোকা থেকে শেখ মুজিব, মুজিব  থেকে মুজিবুর  রহমান, বঙ্গবন্ধু, জাতির  পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। হয়ে গেলেন। সবার নয়নের  মণি, পারের কান্ডারী।  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক  ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের  সময় তিনি  ছিলেন তরুণ ছাত্র নেতা। দেশ ভাগের সময় দাবি আদায়ে  ছিলেন  সোচ্চার। পালন করেছেন  অগ্রণী ভূমিকা।

যে স্বপ্ন  নিয়ে  দেশ ভাগ হয়েছিল, তা অচিরেই  ধূলিসাৎ  হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা শুরুতেই আমাদের  ভাষার উপরে আঘাত হানে। মায়ের  ভাষাকে কেড়ে নিতে চায়।

মোদের  গরব মোদের আশা
আ মরি বাংলা  ভাষা।

তারা আমাদের  সামাজিক, রাজনৈতিক, অথনৈতিক সবদিকেই  সুবিধাবঞ্চিত করে।
আমাদের  যা কিছু  ভাল,সব ওদের  দিতে হবে।
রুনা লায়লা , শাহনাজ রহমতউল্লাহ  ভাল গান করে, ওদের  দিয়ে দাও।
শাবানা,শবনম  ভাল অভিনয়  করে,ওদের  চাই।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়  এদেশের  সন্তানরা ভাল করা সত্ত্বেও  তাদেরকে চাকরিতে ঢুকতে দেয়া হতোনা।  সব কিছুতেই ছিল  তাদের  একচ্ছত্র  ক্ষমতা।

ভাষার দাবিতে বারবার জেল খেটেছেন বঙ্গবন্ধু। এমনও হয়েছে জামিনে  মুক্তি  পাবার পর জেল গেট থেকে পূনরায়  গ্রেফতার হয়েছেন।
১৯৫৮ সালে সামরিক  শাসন,১৯৬২ সালের শিক্ষা  আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদ ছিল  অত্যন্ত দৃঢ়।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু  ঐতিহাসিক  ছয়দফা  দাবি  উথাপন করেন। যেটা ছিল  বাঙালির বাঁচা  মরার দাবি।
তারপর ১৯৬৮ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে  আগরতলা  মামলা করা হয়।যেটা ছিল  সম্পূর্ণ  মিথ্যা মামলা।
এর প্রতিবাদে১৯৬৯ সালে ছাত্র জনতার গণঅভুথান হয়।অসংখ্য  ছাত্রনেতা, নিরীহ  জনগণ  প্রাণ হারায়। এ রোষানল  দেশব্যাপী ছড়িয়ে  পড়ে।

আসে ১৯৭০ সালের  নির্বাচন। আওয়ামী  লীগ সংখ্যা  গরিষ্ঠতা  অর্জন করে। কিন্তু  পাকিস্তান  সরকার টাল বাহানা শুরু  করে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে বিভিন্ন  ছলচাতুরীর আস্রয় নেয়।
তারপর রেসকোর্স  ময়দানে  ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু  দেন স্বাধীনতার ডাক। লাখ লাখ মানুষ সমবেত  হয়েছিল  শুধু  বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য, তার মুখের  কথা শোনার জন্য। সেদিন  জনস্রোত হয়ে মহাসমুদ্র  হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু  ডাক দিলেন  স্বাধীনতার। বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী  ভাষণে দেশের সর্বস্তরের মানুষ  ঐক্যবদ্ধ হল।
২৫ মার্চ-এর কাল রাএিতে পাকিস্তানীরা শুরু করলো অপারেশন  সার্চ লাইট। পাখির  মত গুলি করে রাতের অন্ধকারে শুরু করে  হত্যাযজ্ঞ।
বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য   প্রস্তুত হল, গড়ে উঠলো মুক্তিবাহিনী। তারা গেরিলা  পদ্ধতিও যুদ্ধ করল। অসীম বুদ্বিমত্তায় পাকিস্তান  বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
দীর্ঘ  নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম,তিরিশ  লাখ শহীদ,আর অজস্র  মা বোনের  ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন  হল।
ইতিমধ্যে  বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের  কারাগারে  আটকে রাখে হানাদার  বাহিনী। ।সেখানে  বঙ্গবন্ধুকে মানসিক  শারীরিক  পীড়নে রাখা হয়েছিল। তিনি  মানবেতর জীবন  যাপন করেছেন সেখানে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর  বিজয় অর্জন করার পর বাংলাদেশ  একটি  স্বাধীন  রাষ্ট্র  হিসেবে  পরিচিতি পেল।
আমরা পেলাম সবুজের মধ্যে  লাল বর্ণিল পতাকা।
আমরা বলতে পারলাম, I have land,

বঙ্গবন্ধু  স্বদেশ  প্রত্যাবর্তন করলেন। দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ  করলেন। সমস্ত  দেশ শ্মশানে  পরিণত হয়েছে তখন।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত  দেশের  পুনঃগঠনে হাত লাগালেন। দেশের  দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সর্বস্তরের  কাজ করতে লাগলেন। বিভিন্ন  রাষ্ট্রের  সাথে সুসম্পর্ক  স্থাপন করলেন। কীভাবে দেশের  উন্নয়ন  করা যায়। কীভাবে  আমরা সঙ্কটকালীন অবস্থা  দূরীভূত করতে পারি সে চেষ্টা করতে লাগলেন। ভিটে মাটি হীনদের ঘর বাড়ির  ব্যবস্থা করলেন।
এমতাবস্থায়  একটু সময়তো  নতুন সরকারকে দিতে হবে। সবাই  নব উদ্দীপনা  নিয়ে  দেশ গড়ার কাজ করছে, তখন এলো সে ভয়াল রাত-

সেদিন  ভোর ঐ বেতারে
রুদ্ধ  কন্ঠে  এলো খবর
আর বেঁচে  নেই
নেই  রে বেঁচে
বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর
হতবাক বাঙালি  শুনে সমাচার
ছেড়ে দিয়ে  নিদ্রা হাহাকার

তখন ভোরে সুমধুর  কন্ঠে  মুয়াজ্জিনের  আজান  বাতাসে ভেসে আসছে। শ্রাবণের ভোর, ঝির ঝির ঠান্ডা  বাতাস বইছে।
ঘিরে ফেলেছে  ৩২ নম্বরের  বাড়িটি। একে একে বিস্বাধীনতা বিরোধী  একটা দল ঢুকে পড়লো। উপর্যুপরি গুলি চালালো। একের পর এক লুটিয়ে পড়তে লাগলো,বঙ্গবন্ধুর প্রাণপি্রয় সন্তানেরা, পুত্রবধুরা।
বঙ্গবন্ধুর পরনে চেক লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি।
সিঁড়িতে দাড়িয়ে  চিৎকার  করে  বললেন, কি চাস তোরা? কোথায় নিয়ে  যাবি আমারে?,
সময় দিল না ঘাতকেরা। একে একে নয়টি গুলি ঝাঁঝরা করে দিলেন বঙ্গবন্ধুকে। লুটিয়ে  পড়লেন বঙ্গবন্ধু।
তারপর বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা,  শিশুপুত্র  রাসেল ও রক্ষা পেল না।

মহান ইতিহাসে  এক যবনিকাপাত হলো।
চলে গেলেন।স্বাধীনতার মহিরুহ।

বাঙালি জাতির জন্য  এরচেয়ে  লজ্জাজনক,নিন্দনীয়, দুঃখজনক  আর কী হতে পারে! পৃথিবীতে  এরকম হৃদয়স্পর্শী  ঘটনা  আর আছে কীনা আমার জানা  নেই।
আমরা স্বাধীনতার স্থপতিকে মেরে ফেললাম।


সেদিন  সূর্য টা আলো দিয়ে  নয়
উঠেছিলো  শুধু  রক্তমেখেে
অবাক চোখ মেলে বিশ্ববাসী
বীভৎস এক দৃশ্য  দেখে
ঘাতকের গুলিতে ঝাঁঝরা হলো
জাতির  পিতার বুকের জমিন।
কাঁদো  বাঙালি  কাদো সবাই
কাঁদতেই সবার সুখ
কোটি মানুষের  প্রাণ স্পন্দন
পিতা  তুমি  বাংলার মুখ।

জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে সেদিন  ভাগ্যক্রমে বেঁচে  গিয়েছিলেন আমাদের  মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী  শেখ  হাসিনা ও ছোট  বোন শেখ রেহানা।,বঙ্গবন্ধু  কন্যা শেখ  হাসিনা  আমাদের  সরকার  প্রধান। অত্যন্ত সফলভাবে  উনি  দেশকে এগিয়ে  যাচ্ছেন। অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাএায় দেশ এগিয়ে  যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ,বাংলাদেশ, আত্মপরিচয় পরষ্পর  প্রতিশব্দ। বঙ্গবন্ধু  না এলে স্বাধীন বাংলাদেশের  সৃষ্টি  হতো না। আমাদের  কোন আত্মপরিচয় ছিল না।বাঙালি  জাতি রাষ্ট্র, জাতিসত্বা,জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু। আমরা সমস্বরে  বলতে পারি, আমি  বাঙালি, এই আমার আত্মপরিচয়।

তোমার হৃদপিন্ড  আজও সুগন্ধ ছড়ায়
তোমার সবুজ শ্যামল বাংলায়
পাখি গায় শোক গান
বাতাসে শোকের আবহ
শরতের  নীল  আকাশ
বেদনায় হয় আরও নীল
শুধু  তুমি  নেই  বলে হে বঙ্গবন্ধু
চারিদিকে  শোকের মিছিল
পতাকা ব্যানারে সজ্জিত  হয় চারিদিক
তোমার সন্তানের  দুচোখের পাতা
উষ্ণ  হলে ভিজে
ছলছল চোখে তোমায় খোঁজে
হে বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু  স্বপ্ন  দেখতেন সোনার বাংলার।
আসুন আমরা সবাই  ঐক্যবদ্ব হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে বাস্তবায়িত করি।
বঙ্গবন্ধু  ৪৬ তম শাহাদত বাষিকীতে বিনম্র  শ্রদ্ধা।

ও আমার বঙ্গপিতা
ক্ষমা করো আমায় তুমি
৭৫ এর ১৫ আগষ্টে
ঘাতক চালায় গুলি
ঐদিনের কথা কেমন করে ভুলি!


এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই  তুমি  করে গেলে দান।

হে পিতা ঘুমাও। ১৮ কোটি জনতা এখনও জেগে।

শারমিনা পারভিন 
শারমিনা পারভিন