এ জার্নি স্ট্রার্টেড এন্ড ফিনিশ্ড বাই রিকশ/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

এ জার্নি স্ট্রার্টেড এন্ড ফিনিশ্ড বাই রিকশ

এ জার্নি স্ট্রার্টেড এন্ড ফিনিশ্ড বাই রিকশ

এ জার্নি স্ট্রার্টেড এন্ড ফিনিশ্ড বাই রিকশ/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

 

স্কুলে পড়ার সময় রচনা লিখতে হতো জার্নি বাই বোট অথবা ট্রেন। আজ সেই স্কুলে পড়ার সময়কার এক জার্নির রচনা লিখতে বসলাম। ভ্রমণের দীর্ঘ পথে, বিভিন্ন প্রকার যানবাহনে চড়েছিলাম। তবে শুরু এবং শেষটা রিকশ দিয়ে। তাই লেখার শিরোনাম দিলাম ‘এ জার্নি স্ট্রার্টেড এন্ড ফিনিশ্ড বাই রিকশ’। ১৯৬৭ সালের কথা। বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে আমাদের পরিবারের সকলের চট্টগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো। তবে কবে, কীভাবে, কোনপথে যাওয়া হবে এগুলি সব আব্বা টেলিফোনে বড় দুলাভাইয়ের সাথে ঠিক করলেন। যিনি সেই সময় ফরিদপুরে ম্যাজিষ্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন। সেই অনুযায়ী বাড়িতে সফরের সকল প্রস্তুতি চলতে থাকল। কিন্তু বাধ সাধলো এক জায়গায়, স্কুলে আমার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। পরীক্ষা আগষ্টের এক তারিখ থেকে শুরু। চিন্তা-ভাবনা করে এর একটা সমাধান বের করা হলো। আব্বা স্কুলের প্রধাণ শিক্ষক বরাবর সঠিক কারণ জানিয়ে একটা দরখাস্ত দিলেন। তাতে পরীক্ষা না দেওয়া ও ছুটি মঞ্জুর করার আবেদন করলেন। তিনি আবেদন মন্জুর করার পর, আমার যাওয়া নিশ্চিত হলো।

 

এক দিন সকালে যশোরের বাড়ি থেকে আমরা সবাই রিকশ করে রওনা হলাম আরবপুর বাস স্টপেজের উদ্দেশ্যে।  শহরের মধ্য দিয়ে তখন কোন বাস চলাচল করতো না। সব বাসকে বাইপাস রোড ব্যবহার করতে হতো। সুতরাং বাড়ির কাছের স্টপেজ থেকে ওঠাই আমাদের জন্য ছিল সুবিধাজনক। সেখানে পৌঁছে খুলনা টু কামারখালীর মেইল বাসে চড়লাম ফরিদপুরে যাওয়ার জন্য। বাস ঝিনাইদহ, মাগুরা হয়ে মধুমতি নদীর তীরে এসে থামল। নৌকায় নদী পার হয়ে, কামারখালী ঘাট থেকে লোকাল বাস ধরে ফরিদপুরে পৌঁছালাম। শহরের বাসস্টান্ডে নেমে রিকশ করে আমরা দুলাভাইয়ের সরকারী বাসায় যাই। আধা দিনে, আধা পথ গেলাম। প্লান অনুযায়ী পরের দিন সকালে আমরা এবং ওনারা একসাথে সড়ক পথে ঢাকায় রওনা হবো। সন্ধ্যায় মুরব্বীরা বিয়ের বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে বসলেন। ছোটদের বলা হলো তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়তে। কেননা পর দিন খুব সকালে রওনা হতে হবে। বলাবাহুল্য, আমি সেই সময় ছোটদের দলে পড়ি।

 

পরদিন সকাল বেলা ইপিআরটিসি’র ১২-১৩ সিটের একটা মাইক্রোবাস আসল বাসার সামনে। আমরা তাতে উঠলাম। সেই মাইক্রোবাস দেখতে এখনকার মত নয়। ইঞ্জিন জীপের মত সামনের দিকে আগানো। গাড়িটার আকৃতি কেমন ছিল, তার একটা ছবি নেট থেকে নিয়ে এখানে পোস্ট করলাম। আমাকে বলা হলো একেবারে পিছনের লম্বা সিটে বসতে। আমার জন্য ভালই হলো, জানালার পাশে বসে বাইরেটা ভালভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। তখনকার দিনে ঢাকার এত কাছের জেলা শহর হয়েও ফরিদপুর আমার কাছে পশ্চাৎপদ জনপদ মনে হলো। অনেকটা আমাদের মাগুরা মহকুমা শহরের মতো। ঘন্টা দেড়েক চলার পর আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটা গোয়ালন্দ ঘাটে এসে ভিড়ল। খানিক সময় বাদে সেটা ফেরিতে ওঠার পর, ফেরি ছাড়ল। একে বর্ষাকাল, তার ওপরে ঝড় বৃষ্টি আসায়, উন্মত্ত পদ্মা নদী দেখলাম। মাছ ধরার অগণিত নৌকা পদ্মার বুকে ভেসে চলেছে। হলুদ রঙের একটা স্টিমারও আমাদেরকে ক্রস করে চলে গেল। ফেরীতে ওঠার অভিজ্ঞতা  আমার সেই প্রথম। দুপুরে কমলাপুর বাস ডিপোতে এসে নামার পর, খুব কাছেই রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে এক নিকট আত্মীয়র বাসায় গেলাম, কয়েক ঘন্টা বিরতি নেয়ার জন্য। আবার ছোটদেরকে বলা হলো খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে, কেননা রাতে ট্রেন জার্নি করে চট্টগ্রাম যেতে হবে।

 

রাত ন’টার দিকে কয়েকটা রিকশ করে মতিঝিল গুলিস্তান হয়ে ঢাকা স্টেশনে (ফুলবাড়িয়া) যেতে হলো। পথে অনেক স্থাপনা যেগুলো আগে ছবিতে দেখেছি কিংবা নাম শুনেছি তা পথে দেখতে পেলাম যেমন- নটরডেম কলেজ, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক, গুলিস্তান সিনেমা হল, চো চিন চৌ রেস্তরাঁ। ট্রেন ছাড়ার খুব একটা দেরি ছিল না, তাই তাড়াহুড়া করে ব্যাগপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম মেইলের নির্ধারিত কামরায় সবাই উঠে পড়লাম। যাত্রী বিন্যাসে এটা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর ছোট বগী। ভিতরে লাল রঙে লেখা ছিল ‘১২ জন বসিবেক’,…. ‘অযথা চেইন টানিলে ৫০ রুপি জরিমানা করা হইবেক’। এটা রেলওয়ের কি ধরনের ভাষা ব্যবহার তা বোধগম্য হলো না। হয়তো ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশের লোকদেরকে এভাবেই নির্দেশ দিত, সে সময় পর্যন্ত ঐ ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। যাহোক, রেলের কামরার মেঝেতে হোল্ডল পেতে সে রাতের মত ছোটদের শোয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে ঘুম যখন ভাঙলো, তখন দেখি বাড়বকুন্ডু স্টেশনের কাছে ট্রেন থেমে আছে, সামনে কোথায় যেন কি সমস্যা হয়েছে, তার কারণে। রেললাইনের পাশে গান্ধারা ইন্ড্রাষ্টিজের কারখানা (বর্তমানে প্রগতি) চোঁখে পড়ল। শুনলাম, এখানে নাকী গাড়ি তৈরি হয়। যাহোক, দুই-তিন ঘন্টা দেরি করে আমরা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। আমাদের নিতে আসা গাড়ি সেখানে অপেক্ষা করছিল, তাতে আমরা আগ্রাবাদের সরকারী কলোনীর বাসায় পৌঁছালাম। 

 

বিয়েরদিন বাদ দিয়ে যে চার-পাঁচ দিন আমরা চট্টগ্রামে ছিলাম, প্রতিদিন বিকালে ভাই আমাদেরকে গাড়িতে করে  বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময় যে সব জায়গা দেখেছি বলে মনে পড়ে, তার মধ্যে রয়েছে পতেঙ্গা বীচ, কোর্ট হিল, বাটালী হিল, নিউ মার্কেট, খাস্তগীর স্কুল, চেরাগী পাহাড়, সিআরবি, সদর ঘাট, বায়েজিদ বোস্তামী ও শেখ ফরিদের মাজার। যে দিন পতেঙ্গা বীচে গেলাম, সে সময় একটা অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণী জোয়ারে ভেসে এসে মরে পড়েছিল। আমাদের কৌতুহল দেখে পাশে দাড়ানো একটা লোক বললো ‘এইবা দইয্যাত্তুন ওডি আস্সিদে’। যার অর্থ দাঁড়ায়- এটা সাগর উঠে এসেছিল। আগেই গল্প শুনেছিলাম, চট্টগ্রাম নিউমার্কেটে না কী চলন্ত সিড়িঁ আছে, যা দেশের আর কোথাও নেই। আর গাড়ি ঘুরে ঘুরে নাকী তিনতলায় ওঠা-নামা করে। যেদিন নিউ মার্কেটে গেলাম, সেদিন এই সিড়িঁ দিয়ে ওঠার সুযোগ হলো। আবার নামার সময় গাড়ির পথে নামলাম। এক বিকালে শুনলাম বাসার কেউ কেউ সিনেমা দেখতে যাবেন। আমিও বায়না ধরলাম তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। নিউমার্কেট পার হয়ে লায়ন সিনেমা হলে সেদিন ‘আনোয়ারা’ ছায়াছবি দেখেছিলাম। এর আগেই বড়দের মধ্যে ফিরে আসার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। আমার ধারণা ছিল, যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরবো। কিন্তু সিদ্ধান্ত হলো অন্যরকম। ফেরার জন্য ট্রেনের টিকিট কাটা হলো চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর, সেখান থেকে স্টিমারে করে গোয়ালন্দ ঘাট, আবার সেখান থেকে ট্রেনে যশোর। পথে ফরিদপুরে বড় বোনের ফ্যামিলি নেমে যাবেন। 

 

সকালে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ট্রেনে রওনা হয়ে বিকালে এসে পৌঁছালাম। কাছেই ঘাটে স্টিমার ছিল, তাতে উঠলাম। এটা প্রপেলারের স্টিমার। প্রপেলার মানে বিমানের মতো পাখা নয়, এর দুপাশে লোহার চাকা ঘুরলে পানি কেটে চলতে শুরু করে। এর একটা ছবি নেটে সার্চ করে পেলাম। গত শতাব্দীর ২০-৩০ দশকে স্কটল্যান্ডের ড্যানি এন্ড ব্রাদার্সের শিপইয়ার্ডে তৈরী। সে হিসাবে এর এক একটার বয়স ৮০-৯০ বছর পার হয়েছে। এই রকম তিনটা স্টিমার সরকারী সংস্থা  BIWTC’র ব্যবস্হাপনায় এখনও সার্ভিস দিচ্ছে, তবে ধীর গতিতে চলে। তখন বাষ্পীয় ইঞ্জিনে চলতো, পরে ডিজেলে রুপান্তর করা হয়। একে রকেট সার্ভিসও বলে। আমাদের জন্য এতে একটা কেবিন রিজার্ভ করা ছিল, সেখানেই সবাই আশ্রয় নিলাম। কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘনার অপর পার দেখা যায় না, বিশালতা দেখে মনে হয় সাগর। সন্ধ্যার পর একাই কেন্টিনে গেলাম, প্লেটে সাজানো পুডিং দেখে খাওয়ার ইচ্ছে হলো। বিয়েবাড়ির টাকায় তখন পকেট গরম ছিল। সবার জন্য অর্ডার দিলাম। কিছু সময় বাদে বেয়ারা কেবিনে এসে সার্ভ করে গেল। এবারেও রাতের খাওয়া শেষে কেবিনের মেঝেতে হোল্ডল পেতে দেওয়া হলো, ছোটদের ঘুমানোর জন্য। পরদিন সকালে আমাদেরকে যখন ঘুম থেকে তোলা হলো, তখন দেখি স্টিমার গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে। ভীড়ের কারণে নামতে অনেক দেরি হলো। তার ওপরে সারা রাত খালাসীরা কয়লা ঢেলেছে স্টিমারের ইঞ্জিন সচল রাখার জন্য। যার ফলে নীচের ফ্লোর রুটি সেঁকা তাওয়ার মত গরম হয়ে আছে। জুতা থাকার পরও মনে হচ্ছিল পায়ের তলায় যেন ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনকে ইংরেজরা বলতো Gate way of Bengal কেননা এখান থেকে ঢাকা, বরিশাল, চাদপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, আসাম, কলকাতা সব জায়গায় যাওয়া যেতো। এক সময়, এখানে না কী ভারতীয় কোন কর্মী নয়, শুধু ইংরেজ দক্ষ স্টেশন মাষ্টাররা পোস্টিং পেতেন। অথচ ৬৭ সালে এখানকার অবস্হা অত্যন্ত নোংরা ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ যা ভাষায় প্রকাশ করার যোগ্য নয়। লাইনের পাশ দিয়ে অনেকটা পথ হেটে এসে ট্রেনে ধরলাম। দশটার দিকে ওনারা ফরিদপুর স্টেশনে নেমে গেলেন, আর আমরা দুপুর দুটোর দিকে যশোর স্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে রিকশ করে বাড়িতে পৌঁছালাম। শেষ হলো আমাদের জার্নি স্ট্রার্টেড এন্ড ফিনিশ্ড বাই রিকশ। মাঝখানে ছিল বাস-নৌকা-মাইক্রোবাস-ফেরি-ট্রেন-স্টিমার।

কাজী মুজাহিদুর রহমান
কাজী মুজাহিদুর রহমান