গ্রহণের পরে / তাহমিনা কোরাইশী

গ্রহণের পরে

গ্রহণের পরে

গ্রহণের পরে / তাহমিনা কোরাইশী

 

মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে রুমা। এতোদিনের লালন করা স্বপ্ন যখন বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে তখন এমন উদ্ভট কথায় ওকে করে তোলে বেদনাতুর। আজকাল তো আর দশ বার বছরের বিয়ের যুগ নেই। মোটামুটিভাবে প্রায় তেইশ থেকে পঁচিশ হয়েই যায়। কারো ত্রিশও ছুঁই ছুঁইতে বিয়ের ঘন্টি বাজে। নিজের লেখাপড়া কেরিয়ার তৈরীতে সময় লেগেই যায়। তারপর যদি প্রেগনেন্সিতে সময় নষ্ট করে তবে অনেক রকম ঝামেলায় জড়াতে হয়। রুমার সুখবরে বাড়ির সবাই খুব খুশি। নানী নানা দাদী দাদা স্বামী পারভেজ। কিন্তু এর সাথে হঠাৎ করেই একটা কিন্তু এসে যুক্ত হয়ে ওদের পুরো পরিবারের ওপর পড়েছে দুঃশ্চিন্তার বলিরেখা। না করতে পারছে আনন্দ উল্লাস না করতে পারছে ঘটা করে সাতমাসি! দুরু দুরু প্রাণে রুমা মনঃপীড়ায় নিজেকে কেমন আড়াল করে রেখেছে। পরিচিত ডাক্তারদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপও করেছে। তবুও একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারছে কই! ব্লাড  টেস্ট করেই জানতে পারলো প্রথম তিন মাসের মধ্যে রুমার রুবেলার ভাইরাস পাওয়া গেছে। এক ধরণের মিজেলকে জার্মান মিজেল বলে। যদি কখনও মায়ের হয়ে থাকে তার জীবাণু সে অনেক দিন বহন করে। প্রেগনেন্সিতে আবার তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এতে জরায়ুতে বাচ্চাটির বেশ ক্ষতি হতে পারে। হার্ট, ব্রেইন বা অন্য অনেক ধরনের সমস্যা। এই তো কিছুদিন আগে ওর এক বান্ধবীর এই একই প্রবলেম হলো। সে জোর করেই বলেছিল, ‘ম্যাডাম আমি চাই আমার বাচ্চাটা থাকুক, এবোরশন করবেন না’। ডাক্তার ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘পরবর্তীতে যদি আরো খারাপের দিকে যায় তখন কি হবে? চিন্তার বিষয় না?’ ওর বান্ধবী নন্দিতা বলেছিল, ‘তখন দেখা যাবে।’ সত্যি তার সমস্যা হয় প্রায় ছয় মাসের মাথায়। তখন বাচ্চাকে এবোরশন করতে হয়। জীবন-মরণ সমস্যায়। বাচ্চার হার্ট ডেভেলপ হয়নি ঠিকমত। 

রুমা এসব শুনে শুনে ভীত আতংকিত! কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। রুমার এক খালা ডাক্তার, চাইল্ড স্পেশালিস্ট । তিনি ওকে সাহস দিয়ে বললেন, ‘তোমার তো তেমন বেশী পায়নি। পার্সেন্টেজ কম ছিল রুবেলা ভাইরাসের। এই রকম বা এর একটু বেশী হলেও অসুবিধা হয় না।’ উনার কথার ওপর ভরসা আর ওপরে আছেন আল্লা তায়ালার ওপর ভরসা করে সময় পার হতে থাকলো। উনার কথার ওপর রিস্ক নিয়ে পিচ্ছিল পথে হাঁটতে শুরু করলো। কপালে কি আছে বিধাতাই জানেন! জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে জীবনের চলার পথের ডোর তাঁর হাতেই বাধা। আমরা তো পুতুল মাত্র। রুমার মনে নানান ধরনের ভালো মন্দের মাঝেও উদ্ভট চিন্তা। নিজেকে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে না। আমার জরায়ুতে একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে। এই তো নড়ছে। এই তো লাফালাফি করছে। সারা গায়ে শিহরিত অনুভব। পারভেজের সাথে শেয়ার করে। তবুও ক্ষণে ক্ষণে উদাস হাওয়ায় মন ভরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দুঃশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না। দু’চোখে আসে জল। কায়মনোবাক্যে আল্লাহতায়ালার কাছে পানা চায়,  হে খোদা তুমি আমাকে স্বপ্নে দেখাও এই সন্তানটি সুস্থ হবে। আমি মন স্থির রাখতে পারছি না। আমাকে শান্তি দাও। শান্তি দাও। সম্পূর্ণভাবে আমি তোমার কাছে আমাকে সঁপে দিলাম। তোমার যা ইচ্ছা তাই আমি মেনে নেবো। ধীরে ধীরে রুমার মনটা স্থির হয়ে আসে। ওর মন বলেছে, তোমার অপেক্ষায় রইলাম হে আমার আনন্দ। তুমি আসবে, পৃথিবীর আলো হাওয়া তোমাকে ছুঁয়ে থাকবে। আমার কোল জুড়ে জোছনা মাখা রূপে রঙের ছড়াছড়ি। আনন্দরা ডানা মেলে সাতরঙ রঙধনু হবে। তুমি আসবে হে অনাগত! 

রুমাকে সান্ত্বনা  দিতে ওর মা তাকে কত কিছু বলে বোঝান। আগের দিনে আল্ট্রাসনো ছিল? আমরা কিছু দেখতে পেয়েছি? বাচ্চা কেমন হবে। তার হাত পা কেমন হবে।  ছেলে না কি মেয়ে হবে? আমরা কেবল মুরুব্বিদের কথামত চলেছি। তারা বলেছেন, সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে না যেতে, চুল ছেড়ে ঘোরাঘুরি না করতে, কোমরে কালো কাইতনে একটুকরো লোহা বেঁধে রাখতে। মাথার বালিশের নিচে একটা দিয়াশালাই, একটি চাবির গুচ্ছ আর এক পোটলা কালো জিরা রসুন দিয়ে বেঁধে রাখতে। সব বালা মুসিবত, খারাপ নজর থেকে বেঁচে থাকা যায়। আমরাও তাই করেছি। 

রুমা বোঝে মায়ের কথা। কিন্তু বর্তমান যুগ তো পাল্টে গেছে, উন্নতির চরম শিখরে। সব কিছুই মানুষের নক্ষদর্পণে। যদিও ভালো দিক আছে। তবুুও অনেক সময় মনে হয় অজানার যুগই ভালো ছিল। ঘড়ির কাটায় দ্রুতই দিন ছুটে চলে। সেই দিনটিতে হাজির হলো রুমা। রুমার ইচ্ছা সন্তান প্রসবের বেদনা অনুভব করতে। সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী সনাতন এই ব্যথার মাধ্যমেই জন্ম হোক। জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসুক ওর আকাঙিক্ষত সন্তানটি। চিৎকার করে কেঁদে উঠুক পৃথিবীর আলোয়। আগের দিনে মা খালাদের যেভাবে সন্তান হতো ওরও ইচ্ছা ছিল সেইভাবে একটি সন্তান পেতে।

 ব্যথা শুরু হয়েছে রুমার। ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। লেবাররুমে অনেক মহিলা। কারো সিজার হচ্ছে কারো নর্মাল। চারিদিকে চিৎকার চেচামেচি। রুমাকেও ওদের কাপড় পরিয়ে দিল। চুল আঁচড়িয়ে দুই বেণী বেঁধে দিল। সময় গড়িয়ে যেতে থাকে, ব্যথা বাড়তে থাকে। এভাবে রুমা অস্থির হয়ে ওঠে। হঠাৎ তীব্র বেদনায় চিৎকার করে ওঠে রুমা। ডাকে, ডাক্তার ম্যাডাম আমি পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। আমাকে সিজার করে ফেলুন। ওহ্ আল্লাহ্। ক্ষমা কর। ডাক্তার রেডি করা কাগজপত্রে সিগনেচার নেয়ার ব্যবস্থা করে নেন সাথে সাথে। ফুটফুটে চাঁদের মত সুন্দর কন্যা শিশুটিকে বের করে মায়ের সামনে ধরলেন। মায়ের চোখে মুখ প্রশান্তির সুনিবিড় ছায়ায় মাখামাখি! আনন্দ অশ্রুতে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আল্লাহতায়ালার কাছে হাজার কোটি শুকরিয়া আদায় করে! 

দিন যত গড়াতে থাকে ততই রুমা আরো ক্রেজি হয়ে ওঠে সন্তান অধরার প্রতি। নিবিড় পর্যবেক্ষণে ওর সময় কাটে। শিশুটি ঠিক মত কাঁদছে কিনা, হাসছে কি না, হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে কিনা? ডাক্তারি পরীক্ষার কমতি নেই। এভাবেই মাস যেতে থাকে।  কথা ফুটতে একটু দেরি হয়। দুঃশ্চিন্তায় রুমার ঘুম নেই  এই অবস্থায় দিনযাপন। তার সন্তানটি খেলাধুলা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী কিনা। মেধা মননে কেমন। এভাবে প্রায় দুই তিন বছর গড়িয়ে যায় সে নিজেকে সাইকিক পেশেন্ট করে তোলে। তাকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দেয়া শুরু হয়। 

অধরাকে  স্কুলে দেবার সময় হলো। আইকিউ টেস্টে সে ভালো রেজাল্ট করলো। রুমা যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলো। আল্লাহ্তায়ালার কাছে শুকরিয়া জানালো। সত্যি তো মেডিকেল সাইন্স হেরে যায় আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ রহমতে। পূর্ণ আস্থায় সবই সফল পরিপূর্ণতায় ভরে ওঠে। সুস্থ সুন্দর শিশুটি মায়ের পাঁজরের অবিশ্বাসের গিঁট খুলে বিশ্বাসের আনন্দের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করে। রুমার বিষন্নতা নীলিমায় ডানা মেলে উড়াল দেয়। মেয়ের প্রতি নিবিড় গভীর গাঢ় ভালোবাসা উথলে ওঠে। আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় দুচোখে জলের ধারায় স্নাত রুমা। নিজের জীবনের  থই থই সুখ অতি উজ্জ্বল বিভাসে ছড়িয়ে পড়া রহমতের মহিমায় শিশিরের মুর্চ্ছনায় প্রাণ অনুরণন তোলে। সুরভীতে মৌ মৌ করে চৌহদ্দী। নিজের প্রতি আস্থার বিচ্ছুরণ ঘটে।

তাহমিনা কোরাইশী
তাহমিনা কোরাইশী