ধাওয়া-১ / শাহানাজ শাহীন
ধারাবাহিক উপন্যাস
ধাওয়া-১ / শাহানাজ শাহীন
আমি সবসময় চাইতাম মেঘ আমার সাথে ভাব করুক । এক সাথে খেলুক । দোলনায় দুলুক । মাঠে গিয়ে বিকেলে ঘুড়ি ওড়াক । ফড়িং ধরুক । তারপর বড় হলে আমাদের বিয়ে হবে ।
সংসার হবে । ছেলেপুলে হবে । মায়ের মতো আমিও সেরা মা হব । এগুলো সবই ছিল আমার কল্পনা ।
মেঘ আমাদের প্রতিবেশীর ছেলে । আমাদের চেয়ে ওরা অনেক ধনী । দোতলা বাড়িটির দিকে তাকালে অনুমান করা যায় । এর ইটের গাঁথনি, দরজা জানালা, বারান্দা ও সামনের ফটক সব কিছুতেই উচ্চবিত্তের একটা ছোঁয়া লেগে আছে ।
বাড়ির ফটকে লেখা আছে ” আমাদের বাড়ি ” ।
স্বতন্ত্র একটি নাম । সেই থেকে এ বাড়ির প্রতি আমার বিশেষ একটা ভালবাসা তৈরি হয় ।
আমি কখনোই একা থাকতে চাইতাম না । এর শুরুটা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে এক গ্রীষ্ম থেকে ।
আমার দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠবার আগে ।
একদিন বিকেলে আমি বাড়ির সামনে রাস্তায় বসে আছি । মেঘেদের খয়েরি রংয়ের জিপটি এসে গেটের সামনে থামলো ।
গাড়ির জানালা দিয়ে মেঘ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি দেখছিলাম ওদের গাড়িটি ।
বাহ্ , কতো সুন্দর ঝকঝকে একটি গাড়ি ! ওদের জিপের পিছনে একটি বড় মাল বোঝাই ট্রাকও এসে থামল ।
এই তো আমরা এসে গেছি । মেঘের বাবা গাড়ি থেকে নেমে বললেন । মেঘেদের নতুন বাড়ি ।
আজই তারা সপরিবারে এ বাড়িতে এসে উঠল।
দোতলা বাড়ি । ঢুকতেই কাঠের বিশাল দরজা ।
মেঘের বাবা বললেন –কেমন লাগছে তোমাদের বাড়িটি?
পিছনের সিটে বসা তার বড় বোন ভালবাসা বললো ,
আমার খুব পছন্দ হয়েছে বাবা ।
বাবা খুব নিরিবিলি, মেঘ বললো ।
বাবা আমার রুমে কি রঙ করেছো?
ভালবাসা বাবার কাছে জানতে চাইল ।
আহা অপেক্ষা করো । এতো উতলা হচ্ছ কেনো?বাড়িতে ঢুকলে সবই দেখতে পাবে । মিসেস ফাহমিদা মেয়েকে বললেন । তিনি গাড়ির দরজা খুলে ছেলেকে নামতে সাহায্য করলেন ।
ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা মায়ের সে কী যত্ন ! গরিবের এসব আহ্লাদ দেখানোর সময় নেই । নেই মধ্যবিত্তের । এই দুই শ্রেণির জীবন পার হয় বেঁচে থাকার লড়াই করে । এরা বাবা মায়ের কাছে কেবল তিন বেলা পেট ভরে খাওয়ার আশা করে ।
এতেই তারা খুশি । ধনীদের অভাব নেই ।
কিন্তু অভাব না থাকার অভাব আরো ভয়াবহ !
ধনী পরিবারের পুত্র কন্যারা প্রায়ই জেলখানায় যায় । তারা অভাব না থাকার অভাবে ড্রাগ সেবন আর
বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়। এতে তারা এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করে।
চলো চলো ভিতরে যাই । ভালবাসা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গেটের সামনে । ভালবাসা, মেঘের বড় বোন । কী অদ্ভুত নাম ! ভালবাসা এটা একটা নাম হলো? আলম সাহেব ছেলেকে ডাকলেন,
মেঘ , তুমি বাবার সাথে আস । চলো আমরা ট্রাক থেকে মালপত্রগুলো নামাতে সাহায্য করি।
তোমার বোন ও আম্মু ভিতরে গোছগাছ করতে থাকুক । জি আব্বু ।
মিসেস ফাহমিদা মেয়েকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন । মেঘের জন্য এ বাড়িতে আসা কোনোভাবেই সুখকর ছিল না । এ বাড়িতে আসা তার জন্য ছিল অনেকটা পঞ্চাশ বছর আগের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মতোই ।
আমি হঠাৎ করে উঠে দৌড়ে ওদের ট্রাকের সামনে গিয়ে দাড়াঁলাম । এক লাফে ট্রাকের উপরে উঠে গেলাম । ধনী বাবা ও পুত্রকে সাহায্য করতে
চাইলাম ।
কিন্তু মেঘের বাবা তা একেবারেই চাইলেন না ।
আমি একটা বাক্স তুলে নিতে চাইলাম ।
মেঘের বাবা আমাকে বাধা দিয়ে বললেন ,
আরে, না না । হাত দিবে না । এগুলোর ভেতরে মূল্যবান জিনিসপত্র আছে । যাও যাও ।
তোমার মা হয়তো তোমাকে খুঁজছেন ।
তুমি এখানে এসেছ তোমার মা জানেন?
আমি বললাম, মা জানেন ।
আমি এখানে রাস্তায় বসে থাকি যখন তখন ।
মা সেটা জানেন । তিনি কিছুই বলেন না ।
আমি একটি বাক্স নামাতে চাইলাম মেঘের সাথে । কিন্তু মেঘের বাবা আমাকে বললেন,
না না । তুমি বাক্স ধরবে না । নামো । নামো বলছি ।
মেঘ তোমার বিকেলে কি যেনো করার কথা ছিলো মায়ের সাথে?
মেঘ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে । তার ঠিক জানা নেই মায়ের সাথে কি কাজ আছে তার ।
বাবার চোখ টিপুনিতে সে বুঝতে পারল ।
বাবা চাইছেন না এই মেয়েটি এখানে তাদের সাথে থাকুক । মেঘ ভান করে বলে,
ওহো তাইত । আমি গেলাম বাবা ।
মেঘ এক লাফে নীচে নেমে এল ।
মেঘের সাথে আমিও নেমে আসলাম ।
মেঘ দৌড়ে ওদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে ।
আমি ওর পিছনে দৌড়াচ্ছি । আমরা এখন স্কুলের দৌড় খেলা খেলছি । দৌড়ে আমি ভালো । পিছন থেকে মেঘের হাত ধরে ফেললাম ।
আমি চেয়েছিলাম বিকেলটি মেঘের সাথে কাটুক খেলতে খেলতে । মেঘ আমার হাত ছাড়ার চেষ্টা করছে । আমি আরো শক্ত করে ধরলাম তার হাত ।
মেঘ জোরাজুরি করতে থাকল ছাড়িয়ে নিতে ।
ওমা, কি নাম তোমার? এই তো আমার ছেলের
বন্ধু জুটে গেল । খুব ভালো হলো ।
মেঘের মাকে দেখে আমি হাত ছেড়ে দৃরে সরে আসলাম । মেঘ পলকের মধ্যে মায়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল । যেনো সে মহা বিপদ থেকে রক্ষা পেল ।
কী ভীতু ছেলে ! আমি মনে হচ্ছে ভূত ।
কি নাম তোমার? মেঘের মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমার নাম “সুহাসিনী ” । আমি আমাদের একতলা টিনসেট বাড়িটি দেখিয়ে বললাম, ঐটা আমাদের বাড়ি। মেঘের মা আমাকে বললেন,
একদিন এসো মাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি বেড়াতে।
( চলবে)
Facebook Comments Sync