ধাওয়া-১ /  শাহানাজ শাহীন

ধাওয়া-7,8

ধাওয়া-5

ধারাবাহিক উপন্যাস 

ধাওয়া-১ /  শাহানাজ শাহীন

 

আমি সবসময় চাইতাম মেঘ আমার সাথে ভাব করুক । এক সাথে খেলুক । দোলনায় দুলুক । মাঠে গিয়ে বিকেলে ঘুড়ি ওড়াক । ফড়িং ধরুক । তারপর বড় হলে আমাদের বিয়ে হবে ।

সংসার হবে । ছেলেপুলে হবে । মায়ের মতো আমিও সেরা মা হব । এগুলো সবই ছিল আমার কল্পনা ।

 

মেঘ আমাদের প্রতিবেশীর ছেলে । আমাদের চেয়ে ওরা অনেক ধনী । দোতলা বাড়িটির দিকে তাকালে অনুমান করা যায় । এর ইটের গাঁথনি, দরজা জানালা, বারান্দা ও সামনের ফটক সব কিছুতেই উচ্চবিত্তের একটা ছোঁয়া লেগে আছে ।

বাড়ির ফটকে লেখা আছে ” আমাদের বাড়ি ” ।

স্বতন্ত্র  একটি নাম । সেই থেকে এ বাড়ির প্রতি আমার বিশেষ একটা ভালবাসা তৈরি হয় ।

 

আমি কখনোই একা থাকতে চাইতাম না । এর শুরুটা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে এক গ্রীষ্ম থেকে ।

আমার দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠবার আগে ।

একদিন বিকেলে আমি বাড়ির সামনে রাস্তায় বসে আছি । মেঘেদের খয়েরি রংয়ের জিপটি এসে গেটের সামনে থামলো ।

গাড়ির জানালা দিয়ে মেঘ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি দেখছিলাম ওদের গাড়িটি ।

বাহ্ , কতো সুন্দর ঝকঝকে একটি গাড়ি ! ওদের জিপের পিছনে একটি বড় মাল বোঝাই ট্রাকও এসে থামল ।

 

এই তো আমরা এসে গেছি । মেঘের বাবা গাড়ি থেকে নেমে বললেন । মেঘেদের নতুন বাড়ি ।

আজই তারা সপরিবারে এ বাড়িতে এসে উঠল।

দোতলা বাড়ি । ঢুকতেই কাঠের বিশাল দরজা ।

 

মেঘের বাবা বললেন –কেমন লাগছে তোমাদের বাড়িটি?

 

পিছনের সিটে বসা তার বড় বোন ভালবাসা বললো ,

আমার খুব পছন্দ হয়েছে বাবা ।

 

বাবা খুব নিরিবিলি, মেঘ বললো ।

 

বাবা আমার রুমে কি রঙ করেছো?

ভালবাসা বাবার কাছে জানতে চাইল ।

 

আহা অপেক্ষা করো । এতো উতলা হচ্ছ কেনো?বাড়িতে ঢুকলে সবই দেখতে পাবে । মিসেস ফাহমিদা মেয়েকে বললেন । তিনি গাড়ির দরজা খুলে ছেলেকে নামতে সাহায্য করলেন ।

 

ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা মায়ের সে কী যত্ন ! গরিবের এসব আহ্লাদ দেখানোর সময় নেই । নেই মধ্যবিত্তের । এই দুই শ্রেণির জীবন পার হয় বেঁচে থাকার লড়াই করে । এরা বাবা মায়ের কাছে কেবল তিন বেলা পেট ভরে খাওয়ার আশা করে ।

এতেই তারা খুশি । ধনীদের অভাব নেই ।

কিন্তু অভাব না থাকার অভাব আরো ভয়াবহ !

ধনী পরিবারের পুত্র কন্যারা প্রায়ই জেলখানায় যায় । তারা অভাব না থাকার অভাবে ড্রাগ সেবন আর

বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়। এতে তারা এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করে।

 

চলো চলো ভিতরে যাই । ভালবাসা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গেটের সামনে । ভালবাসা, মেঘের বড় বোন । কী অদ্ভুত নাম ! ভালবাসা এটা একটা নাম হলো? আলম সাহেব ছেলেকে ডাকলেন,

মেঘ , তুমি বাবার সাথে আস । চলো আমরা ট্রাক থেকে মালপত্রগুলো নামাতে সাহায্য করি।

তোমার বোন ও আম্মু ভিতরে গোছগাছ করতে থাকুক । জি আব্বু ।

 

মিসেস ফাহমিদা মেয়েকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন । মেঘের জন্য এ বাড়িতে আসা কোনোভাবেই সুখকর ছিল না । এ বাড়িতে আসা তার জন্য ছিল অনেকটা পঞ্চাশ বছর আগের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মতোই ।

 

আমি হঠাৎ করে উঠে দৌড়ে ওদের ট্রাকের সামনে গিয়ে দাড়াঁলাম । এক লাফে ট্রাকের উপরে উঠে গেলাম । ধনী বাবা ও পুত্রকে সাহায্য করতে

চাইলাম ।

কিন্তু মেঘের বাবা তা একেবারেই চাইলেন না ।

আমি একটা বাক্স তুলে নিতে চাইলাম ।

মেঘের বাবা আমাকে বাধা দিয়ে বললেন ,

আরে, না না । হাত দিবে না । এগুলোর ভেতরে মূল্যবান জিনিসপত্র আছে । যাও যাও ।

তোমার মা হয়তো তোমাকে খুঁজছেন ।

তুমি এখানে এসেছ তোমার মা জানেন?

আমি বললাম, মা জানেন ।

আমি এখানে রাস্তায় বসে থাকি যখন তখন ।

মা সেটা জানেন । তিনি কিছুই বলেন না ।

 

আমি একটি বাক্স নামাতে চাইলাম মেঘের সাথে । কিন্তু মেঘের বাবা আমাকে বললেন,

না না । তুমি বাক্স ধরবে না । নামো । নামো বলছি ।

মেঘ তোমার বিকেলে কি যেনো করার কথা ছিলো মায়ের সাথে?

 

মেঘ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে । তার ঠিক জানা নেই মায়ের সাথে কি কাজ আছে তার ।

বাবার চোখ টিপুনিতে সে বুঝতে পারল ।

বাবা চাইছেন না এই মেয়েটি এখানে তাদের সাথে থাকুক । মেঘ ভান করে বলে,

ওহো তাইত । আমি গেলাম বাবা ।

 

মেঘ এক লাফে নীচে নেমে এল ।

মেঘের সাথে আমিও নেমে আসলাম ।

মেঘ দৌড়ে ওদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে ।

আমি ওর পিছনে দৌড়াচ্ছি । আমরা এখন স্কুলের দৌড় খেলা খেলছি । দৌড়ে আমি ভালো । পিছন থেকে মেঘের হাত ধরে ফেললাম ।

আমি চেয়েছিলাম বিকেলটি মেঘের সাথে কাটুক খেলতে খেলতে । মেঘ আমার হাত ছাড়ার চেষ্টা করছে । আমি আরো শক্ত করে ধরলাম তার হাত ।

মেঘ জোরাজুরি করতে থাকল ছাড়িয়ে নিতে ।

 

ওমা, কি নাম তোমার? এই তো আমার ছেলের

বন্ধু জুটে গেল । খুব ভালো হলো ।

মেঘের মাকে দেখে আমি হাত ছেড়ে দৃরে সরে আসলাম । মেঘ পলকের মধ্যে মায়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল । যেনো সে মহা বিপদ থেকে রক্ষা পেল ।

কী ভীতু ছেলে ! আমি মনে হচ্ছে ভূত ।

 

কি নাম তোমার? মেঘের মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমার নাম “সুহাসিনী ” । আমি আমাদের একতলা টিনসেট বাড়িটি দেখিয়ে বললাম, ঐটা আমাদের বাড়ি। মেঘের মা আমাকে বললেন,

একদিন এসো মাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি বেড়াতে।

( চলবে)

শাহানাজ শাহীন
শাহানাজ শাহীন