সময়ের কাহন-৪ / অনুপা দেওয়ানজী

সময়ের কাহন-৪ / অনুপা দেওয়ানজী

 

 দূর পাল্লার রাস্তাঘাটগুলি সেই সময়ে চলাচলের জন্যে মোটেই উপযুক্ত  ছিলো না।

বিশেষ করে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাওয়ার সময়ে  যাত্রীদের যা ভোগান্তি আর সময়ের অপচয়  হত তা আর বলার নয়।

এখনকার মতো দিনরাত সার্বক্ষণিক  বিরতিহীন ট্রেন বা বাসসার্ভিসের কোন ব্যবস্থাই ছিলো না তখন। যাত্রীরা এজন্যে মেলট্রেনেই আসা-যাওয়া করতেন।

 

মেল ট্রেন সাধারণত লোকাল স্টেশনে থামে না। শুধুমাত্র আখাউড়া জংশনে  ইঞ্জিন বদল করার জন্যে ঘন্টাখানেকের জন্যে থামতো। 

 

ট্রেন ছিলো সন্ধ্যে সাতটায়। আমরা চট্টগ্রাম স্টেশনের ফার্স্টক্লাশ ওয়েটিংরুমে বসে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরেই আমার পাশেই একটি পশ্চিম পাকিস্তানি পরিবার এসে বসলেন। সাথে আমার মেয়ের বয়সী ফুটফুটে একটি মেয়ে । করাচিতে তাদের বাড়ি।ব্যবসার জন্যে চট্টগ্রামে থাকেন।

তবে ঢাকায়ও তাদের আত্মীয় আছে। সেখানেই  তারা বেড়াতে যাচ্ছেন।আমি উর্দু জানি না বলে তাদের সাথে হাসি বিনিময় করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। আমার কর্তাই কথা বলছিলেন ভদ্রলোকের সাথে। 

আমার মেয়ের সাথে তাদের মেয়েটির খুব ভাব হয়ে গেলো।তারা দুজনেও কেউ কারো কথা একবর্ণ বুঝতে পারছে না কিন্তু তারপরও দিব্যি খেলায় মেতেছে দু’জনে। যেন দু’জনেই পরস্পরের কতকালের পরিচিত। 

শিশুদের পক্ষেই বুঝি এটা একমাত্র সম্ভব!

 

 ব্রিটিশ আমলে নির্মিত চট্টগ্রাম স্টেশনটি দেখতে ভারি সুন্দর।   ব্রিটিশ যুগের বনেদিয়ানার চিহ্ন  আজও ম্লান হয়নি। পরিপাটি রেস্তোরাঁ, দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, ওয়েটিংরুম সব কিছু আজও  কার্পেটে মোড়া।

 

সাতটা বাজার কিছুক্ষণ আগে আমরা ট্রেনে উঠে  বসলাম। 

সারারাতের জার্নি শেষে সিলেট পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন সকালের আগে নয়।

আমরা একটা স্লিপিং কুপেতে উঠলাম।ট্রেন যথাসময়ে  যাত্রা শুরু করলে আমার  কর্তা ট্রেনের সিটের ওপরে চাদর বিছিয়ে, এয়ারপিলো ফুলিয়ে  ঘুমাবার ব্যবস্থা করে নিলো।

 ডিনারের জন্যে রেলওয়ে কেলনারে আগেই বলে রাখতে হয়। ট্রেন যখন রাত দশটায় আখাউড়া জংশনে  থামে  তখন রেলওয়ের লোক ডিনার সার্ভ করতে আসে।এখান থেকে ট্রেনের এক অংশ ঢাকার দিকে যায় আর অন্য অংশ সিলেটের দিকে যায়।

 

ট্রেনে ভ্রমণ করতে আমার খুব  ভালো লাগে। দিব্যি আরামে দোল খেতে খেতে   দু’পাশের প্রাকৃতিক  দৃশ্য দেখতে দেখতে যেন অন্য কোন এক জগতে হারিয়ে যাই।

 জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে মনে হয়  দু’পাশের ঘর বাড়ি,গাছ পালা  যা কিছু দেখছি  সব কিছুই দূরন্ত গতিতে আমার চোখের সামনে  ছুটে চলেছে। আমিই শুধু স্থির দর্শক হয়ে বসে আছি।

 নিঝুম চাঁদনি রাতে ট্রেনে যেতে আরও ভালো লাগে।প্রকৃতিকে তখন যেন  রূপকথার বইয়ে পড়া এক স্বপ্নপুরী বলে ভ্রম হয়। সে যেন তখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে স্বপ্নময় কোন এক জগৎ। 

তবে এবারের ট্রেনযাত্রায় চাঁদের দেখা নেই।

 বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি যেন অন্ধকারে  একাকী নীরব ধ্যানে মগ্ন। 

সেই অন্ধকারকে  বিদীর্ণ করে আমাদের  ট্রেনটি যেন  তার ধ্যানমগ্নতায় বিঘ্ন ঘটিয়ে ছুটে চলেছে।

 

রাত দশটার মধ্যেই  আখাউড়াতে প্রবেশ করতেই  ট্রেনের গতি হঠাৎ কমতে কমতে একসময়ে একেবারেই থেমে গেলো।

আখাউড়ার মিষ্টির খুব নাম ছিলো তখন।ট্রেন থামার সাথে মিষ্টি বিক্রেতাদের হাঁক ভেসে আসতে লাগলো  ‘চাই মিষ্টি ”, ‘চাই মিষ্টি ‘, চা বিক্রেতারা চাই গরম চা, গরম চা বলে বলে সমানে চেঁচাতে শুরু করলো।

ট্রেনের জানালা খুলে যাত্রীদের মধ্যেও মিষ্টি কেনার হিড়িক পড়ে গেলো।

আমরাও কিছু টাটকা রসগোল্লা  কিনে নিলাম।

 

এই সময়ে উর্দি পরা   দুজন বেয়ারা ট্রে হাতে আমাদের কুপেতে  ডিনার সার্ভ করে গেলো।

আমি ট্রের ঢাকা খুলে দেখি সরু চালের ভাত,মুসুরির  ডাল,লটপটি ধরনের একটা সব্জিভাজি, রুই মাছ আর মুরগীর মাংস।

সে খাবার দেখতে যতটা ভালো লাগছিলো খেতে আমার মোটেই ভালো লাগলো না।আমার কর্তা দেখি   নিরীহ মুখ করে খেয়ে নিলো।

 

খাওয়াদাওয়ার পরে আমি দিব্যি আরামে একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম আর আমার মেয়ে তার বাবার হাতেই দুধ খেয়ে, খেলতে খেলতে এক সময় বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো।

মেয়েকে আমার পাশে শুইয়ে দিয়ে সে আমার পাশে এসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”তুমি এত রোগা হয়ে গেলে কেমন করে? খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার ওখানে থাকতে?

আমার কর্তার  ওইটুকু কথাতেই সহসা কোত্থেকে প্রচণ্ড এক অভিমান দুর্বার কান্নার স্রোতে আমাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।

আমি  মনে মনে বললাম,” তুমিই তো বলেছো কষ্ট করতে শেখো।”

 

রাতের ট্রেন লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে এসে থামলো। 

ভোরের আলো সবে ফুটে উঠছে তখন। ট্রেন থামার সাথে সাথে যাত্রীদের মালপত্র নামাবার জন্যে কুলিদের দৌড়াদৌড়ি, ব্যস্ততা, হাঁকডাকে স্টেশন সরগরম হয়ে উঠলো।

আমরা ধীরেসুস্থে নেমে ওয়েটিংরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে অপেক্ষা করতে লাগলাম আবার ট্রেনে চাপবো বলে।

এবারের গন্তব্য ছাতক। ঘন্টা দুই কি আড়াই লাগবে সেখানে যেতে।

 ট্রেন ছাড়তেই জানালা দিয়ে  দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলাম। সবুজ আর সবুজ। প্রকৃতি যেন মনের খেয়ালে চারিদিকে সবুজ  রূপের হাট বসিয়ে রেখেছে। সবুজের যে কত রঙ আর তাকে কীভাবে  তুলে ধরতে হয় সে বুঝি প্রকৃতির মতো আর কেউ  জানে না।

মুহূর্তে মনটা  অপূর্ব এক ভালোলাগায় ভরে গেলো।

 

 ছোট ছোট সবুজ  টিলার বুক জুড়ে ছবির মত সাজানো সব বাংলো।

 পাহাড়, টিলা,ঘন সবুজ বন,পাহাড়ি খরস্রোতা নদী, চায়ের বাগান,কমলা বাগান,বিশাল সব হাওর সিলেটকে দিয়েছে অনুপম এক সৌন্দর্য । 

শুধু তাই নয় সিলেটের আবার নামও দুটি। সিলেট আর শ্রীহট্ট। যদিও মানুষের মুখে সিলেট নামটাই উচ্চারিত হয়।

শিলা মানে পাথর আর হেট শব্দের অর্থ হাট।

 প্রাচীন যুগ থেকেই এখানে পাথর আর হাটের আধিক্য থাকায় শব্দ দুটি মিলে নাকি সিলেট শব্দের জন্ম নিয়েছে।

আবার সিলেটের স্থানীয় হট্টনাথের পাঁচালিতে লেখা আছে

 

শ্রীহট্টের পূর্বদেশ নাম গোয়ার – 

একখানি দেশ সেই বড়ই বিস্তার

একদিকে জৈন্তা, হেড়ম্ব একদিকে,

মধ্যদেশে মুকুন্দ আকাঙক্ষা কৈলা তাকে।

সমুদ্র তনয় গৌড় গোবিন্দ নামেতে 

শ্রীহট্ট দেশের রাজা ছিলেন পর্বতে।

পুনির বিল ছাড়িয়া রাজা ছিলটেতে গেল, 

অট্টনাথের পূজা দিয়া ঠাকুরালি পাইল।

 

এই গৌড় গোবিন্দের সাথেই বাংলার প্রবল পরাক্রান্ত নবাব ফিরোজ শাহ-র  যুদ্ধ হয়।  গোঁয়ারগোবিন্দ শব্দটা নাকি গৌড় গোবিন্দ থেকেই এসেছে। যাঁর কাছে দু-দুবার নবাবী ফৌজ পরাজিত হয়।  শেষে সেনাপতি নুরুদ্দিন সাহায্য প্রার্থনা করলেন সাতগাঁও-এর ফকির হযরত শায়খ জালাল উদ্দীন কুনাইবি-র কাছে।  এই ফকিরের নেতৃত্বেই যুদ্ধ করে নবাবী ফৌজ পরাজিত করে গোবিন্দকে। যাঁকে আমরা সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহঃ)।নামে জানি। 

 জনশ্রুতি আছে  পায়ের সামনে পাথর দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘সিল হট।’ অর্থাৎ পাথর সরে যাও।আর তা থেকেই সিলেট শব্দের জন্ম।

 কারও কারও মতে আবার প্রাচীন গৌড়ের রাজা গুহক তাঁর কন্যা শীলার নামে হাট স্থাপন করেছিলেন বলেই নাকি শীলাহাট আর তা থেকে সিলেট। 

তবে অনেকে বলে ব্রিটিশরা যখন এদেশ শাসন করতো তখন তারা শ্রীহট্ট শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতো না তাই তারা সিলেট বলতো আর তা থেকেই সিলেট শব্দের উৎপত্তি। 

আবার সতীর আরেক নাম শ্রী। শ্রীর শবদেহের হাত নাকি এখানে পড়েছিলো। আর হট্ট মানে হস্ত তাই শ্রীহস্ত মানে শ্রীহট্ট। 

কত যে কাহিনি ডালপালা ছড়িয়েছে এর মধ্যে কোনটা সঠিক তা কে বলবে?

সিলেটের প্রধান আকর্ষণ হজরত শাহ্জালাল আর হজরত শাহ্ পরাণের মাজার।

দূরদূরান্ত থেকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এই দুটি স্থানে তাদের মনস্কামনা জানাতে আসে।এছাড়াও  রয়েছে মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের  ভিটে, সুরমা ব্রিজ,হাসন রাজার বাড়ি, রাধারমনের বাড়ি ও আরো নানা সব স্থান।

এখানকার  প্রধান নদী সুরমা,কুশিয়ারা আর পিয়াইন ছাড়াও রয়েছে বিশাল বিশাল সব হাওর। বর্ষার সময়ে দেখলে মনে হয় এ বুঝি সত্যিই অশান্ত সাগর। হাওর নামটিও  সাগর থেকেই এসেছে কারণ  সাগর আগে এদিকেই ছিলো।এক সময়ে তা সরে গেছে তবে তার নামটি ঠিকই রেখে গেছে।

শীতের সময়ে এই দূরন্ত হাওরগুলির রূপ একেবারেই বদলে যায়। তখন তার ভারি স্নিগ্ধ,শ্যামল রূপ।দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবুজে সবুজে তখন তারা সবাই সেজে ওঠে।

 

 শীতপ্রধান দেশ গুলিতে যখন বরফ জমতে শুরু করে তখন পরিযায়ী পাখিগুলি মাইলের পর মাইল উড়ে চলে আসে এইসব হাওরের বুকে আশ্রয় নিতে ।এই হাওরেই তারা স্বল্পকালীন সংসার বাঁধে, ডিম পাড়ে,বাচ্চা ফোটায় তারপর শীতের শেষে ছানাপোনাদের নিয়ে আবার ফিরে চলে যায় নিজেদের দেশে।

হাওর ছাড়াও সিলেটে রয়েছে পাহাড়। তার মধ্যে মেঘালয়ের কোলে শুয়ে থাকা  খাসি পাহাড় আর জৈন্তা পাহাড় অন্যতম ।খাসি পাহাড়ে  আদিবাসী খাসিয়াদের বসবাস। উত্তরের  জৈন্তা পাহাড়ে  একসময়ে ছিলো জৈন্তা রাজার বাস। তাঁদের বসবাসের চিহ্ন আজও আছে।

দক্ষিণে রয়েছে ত্রিপুরার পাহাড় ছাড়াও মেঘালয় সীমান্ত।

সীমান্তবর্তী জাফলংয়ে গেলে দেখা যায় পাথুরে নদীর  ছন্দময়  ছুটে চলা। 

এছাড়াও রয়েছে শ্রীপুরের ঝর্ণা, মাধবকূন্ড। সে বলে আর শেষ করার নয়।

 

এখানকার পাহাড়ের ঢালুতে সবুজ পুরু গালিচার মতো চায়ের বাগান দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। এছাড়াও রয়েছে কমলালেবু সহ বিভিন্ন লেবুর বাগান তার মধ্যে সাতকড়ার নাম উল্লেখ না করলেই নয়।

কমলালেবুর কথায় মনে পড়ে গেলো সিলেটের কৃতী সন্তান  সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা।কবিগুরু যাঁকে আদর করে বলতেন, “আলীর কথা কমলালেবুর ঘ্রাণের কথা মনে করিয়ে দেয়।”

সিলেটে এসে আমার গর্ব হচ্ছিলো এই ভেবে যে আমার ঠাকুর্দা জিতেন হোর  শান্তিনিকেতনে সৈয়দ  মুজতবা আলীর মতো একজন  সহপাঠিকে 

পেয়েছিলেন।

 

সংস্কৃতি যেন  শ্রীহট্টকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। 

খাসিয়াদের জীবনযাত্রা,মনিপুরি উপজাতিদের সংস্কৃতি  এখানকার অধিবাসীদের দিয়েছে এক মনোরম আর সমৃদ্ধ জীবন।

হাসন রাজা আর রাধারমনের গান আমাদের এক বড় সম্পদ।

সিলেটে এ আমার প্রথম আসা নয়।বিয়ের পর পরই আমি এখানে এসেছিলাম।আমার মেয়ে বিপাশার জন্ম এখানেই। 

সিলেট আমার খুব প্রিয় স্থান। আমার ভালোবাসার জায়গা।

 

আমাদের কম্পার্টমেন্টে একজন ব্রিটিশ মহিলাও উঠেছেন।তাঁর পরণের শাড়িটি পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মহিলাদের মতো আটপৌরে ঢঙে পরা। বাংলার বধূদের মতো পান খাওয়ার ফলে ঠোঁট দুখানিও টুকটুকে লাল।হাতে সোনার চুড়ির সাথে কাঁচের চুড়িও আছে। কানে ঝুমকা, নাকে একটা বড় নোলকও আছে।

মাথায় ঘোমটা টেনে তিনি বসে আছেন। পাশেই তাঁর স্বামী। তাঁর পরণে পাজামা আর পাঞ্জাবি। 

আমার চোখে চোখ পড়তেই বৌটি মিষ্টি একটা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, আফনে ছাতখর  কোনহান ঠাকইন ?

আমি বললাম টেংরা টিলা।

মহিলা বললেন আমি  টিল্লাগাঁও।

 সিলেটে এসে প্রথম প্রথম আমি এ ধরণের মহিলা দেখলে কিছুটা অবাক হতাম বৈকি। 

পরে জেনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সিলেট থেকে প্রচুর লোককে  বিলেতে কাজের জন্যে নেয়া হয়েছিলো । তাদের অনেকেই সেখানকার মেয়ে বিয়ে করেছেন,সেই মেয়েরা এ দেশে এসে এদেশের গ্রামীণ জীবন যাপনের সাথে নিজেদের বেশ মানিয়েও নিয়েছেন।

পান চিবোতে চিবোতে  বৌটি যখন স্বামীর সাথে ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজি বলছিলো তখন তা শুনতে যেমন অদ্ভুত লাগছিলো তেমনি আবার সিলেটের বাচনভঙ্গিও ভারি অদ্ভুত লাগছিলো।

 

দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ছাতকে এসে পড়লাম।

ছোট্ট ষ্টেশন। ট্রেন থামার সাথে সাথে হন্তদন্ত হয়ে কর্তার অফিসের আর্দালি হারিস আলী ছুটে এসে সালাম দিয়ে আমাদের কম্পার্টমেন্ট থেকে সুটকেশ নামিয়ে নিলো।

হারিস আলির হাতঘড়িটা সবসময়  ডান কবজিতে বাঁধা থাকে। প্রথমবার যখন ছাতকে আসি তখন সে ট্রেনে উঠে আমার সুটকেসটা মাথায় নিয়ে চলতে শুরু করলে আমি ফিসফিস করে আমার কর্তাকে বলেছিলাম আমার সব গয়নাই যে ওই সুটকেসে।

আমার কর্তা ওর সামনেই আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিলো, ওর নাম হারিস আলি।  আমার অফিসের আর্দালি।তোমার গয়না নিয়ে ভয় নেই।

 

এবারে যখন হারিস আলি আমাদের মালপত্র মাথায় নিয়ে নামলো তখন দেখি  গলায় ঘুন্টি বাঁধা নাদুসনুদুস একটা কালো ছাগলও তার পিছু পিছু চলেছে। তার গলার ঘুন্টিটা বাজছে টুন টুন টুন।

চারিদিকে বেশ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, চেরাপুঞ্জি এখান থেকে খুব কাছে এই বাতাস চেরাপুঞ্জির দিক থেকে আসছে তাই বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ মিশে আছে। 

দূরে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ের ঢেউ খেলানো ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়ের সারি। 

 স্টেশনে নেমেই চারপাশ দেখতে দেখতে  আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম।

আগেও আমি হেঁটে গিয়েছি এই পথ দিয়ে। তারপরও আমার কেমন যেন অন্য একরকম অনুভূতি হয় ছাতকের মাটিতে পা রাখলে।

এর  কারণ ছাতকের পরে রেলপথ বা সড়কপথ এর কোনটাই নেই। এটিই শেষ রেল ষ্টেশন।

ছোট্ট  স্টেশনটি  সুরমা  নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরেই  রেলপথ আর জলপথ দুটোই একই স্থানে অবস্থান করছে।

 

রেল থেকে নামলেই চোখে পড়ে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় পাথরের স্তুপ।   প্রচুর শ্রমিক এক একটা পাথরের স্তুপের সামনে ছাতার নীচে বসে দিনরাত সে পাথর  ভেঙেই চলেছে,ভেঙেই চলেছে।

 

নদীর অনেক ওপর দিয়ে একটানা চলে গেছে রোপওয়ে।সেই রোপওয়ের তারের এক দিকে পাথর নিয়ে দোলনার মতো ঝুলতে ঝুলতে চলেছে লোহার বাকেট।আর অন্য দিকের বাকেটগুলি চলছে খালি।

 

বিশাল এক চিমনি থেকে ধোঁয়া উড়ে উড়ে পরিষ্কার আকাশের মেঘের দলের সাথে মিতালি পাতাবার জন্যে ছুটছে।

এই ধোঁয়া উড়ে আসছে সেই সময়ের একমাত্র বিখ্যাত সিমেন্ট কোম্পানীর চিমনি থেকে। অবিভক্ত বাংলায় যার নাম ছিলো আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানী। 

পাথরভর্তি বাকেটগুলি সেই সিমেন্ট কোম্পানীতে এক দিকের রোপওয়ে দিয়ে পাথর ঢেলে খালি করে অন্য দিকের রোপওয়ে দিয়ে ফিরে চলে আসে।

 

সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে  সুরমা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াতেই নদী আমাকে সাথে সাথে এক ঝলক ঠান্ডা আর মিষ্টি বাতাসের ঝাপটা দিয়ে স্বাগত জানালো।

 

 সুরমা। ভারি সুন্দর একটা নাম। এই নদীকে দেখলেই আমার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া একটি নদীর আত্মকাহিনীর কথা মনে পড়ে যায় যেখানে রচনার শুরুতেই লেখা ছিলো “আমার নাম সুরমা কিন্তু তাই বলিয়া আমি চোখে দেয়া সুরমা নই।আমি একটি নদী।আসামের বরাক নদী হইতে আমার জন্ম।”

 ছোট্ট বেলায় পড়া কল্পনায় দেখা সেই নদীটির সাথে এভাবে আমার দেখা হয়ে যাবে তা কী সেই সময়ে একবারও ভেবেছিলাম?

 

নদীর তীরে তখন আমার  কর্তার অফিসের ছোট্ট প্রমোদতরীটি হাঁসের মতো জলে দুলে দুলে অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্যে।তরী থেকে কাঠের একটি  পাটাতন ডাঙ্গায় লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। 

ঢালু পথ পেরিয়ে তরতর করে নেমে সেই পাটাতন বেয়ে লঞ্চে উঠে গেলাম।বয়েস ছিলো অল্প।শরীর ছিলো হাল্কা।এখন আর ঢালু পথ বেয়ে সেভাবে নামার কথা ভাবতেই পারি না।

 

প্রমোদতরীটি মূলত খুব সুন্দর ছোট্ট একটা লঞ্চ। একটাই তার কেবিন আর কেবিনের সাথে লাগোয়া সারেং আর মিস্ত্রির রুম।

কেবিনটি হাল্কা নীল পর্দা দিয়ে ঘেরা। বৃষ্টি না পড়লে বা একান্ত দরকার না হলে সে পর্দা গুটানোই থাকে।ভেতরে বেতের সোফা আর টেবিল দিয়ে সাজানো।

 

আমরা কেবিনে গিয়ে বসতেই

 সারেং মেশিন স্টার্ট করলো। লঞ্চটা বেশ একটা গর্জন তুলে জল কেটে কেটে চলতে শুরু করতেই আর্দালি এসে আমাদের টেবিলে কফি আর বিস্কিট সার্ভ করে গেলো।

 আমি  দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি ভুলে আরাম করে কফিতে চুমুক দিয়ে নদীর দিকে দৃষ্টি ফেরালাম।

আমার মেয়ে তার বাবার কোলে বসে বাইনোকুলার হাতে নিয়ে বড়দের মতো সেটা চোখে লাগাবার কসরত করতে লাগলো।

(চলবে)।

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী
%d bloggers like this: