ঈদ আসে মোষের শিংয়ের মতো চাঁদের মাথায় চড়ে! / শফিক হাসান
ঈদ আসে মোষের শিংয়ের মতো চাঁদের মাথায় চড়ে! / শফিক হাসান
ঈদ কি শুধু খুশিই নিয়ে আসে! খুশির পাশাপাশি, কারও কারও জন্য অখুশিও কি বয়ে আনে না! ঈদে আনন্দের পরিবর্তে নিরানন্দ ও পানসে অনুভূতি নিয়ে থাকে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু তারা এসব ধামাচাপা দিয়ে খুশি খুশি ভান করতে চায়! দেখুন, ঈদের আনন্দবেদনার গল্পগাথা!
ঈদের সুবিধা
* অপছন্দ করা যায়, এমন শ্রেণির যে কারও বাসায় এদিন অনায়াসে ঢুকে পড়া যায়। ঈদের দিন বলে কেউ অনুপ্রবেশকে গ্রাহ্য করবেই না, উল্টো শুকনো মুখে হলেও ভালো খাবারের অংশটা পরিবেশন করবে!
* ফাঁকিবাজ কতিপয় লোক আছে যারা একটু সুযোগ পেলেই কাজে গাফিলতি করে! ঈদের পুরোটা দিন তারা ‘ফাঁকি’ দেওয়ার আনন্দে মশগুল থাকে!
* পত্রিকা আর ফ্যাশন হাউজের ‘ক্যাটালগ’ দেখে কেনা হয় নানা রকম পোশাক। ক্রয়কৃত রঙবেরঙের কাপড় পরে মডেল মডেল ভাব নেওয়া যায়!
* লোক থাকে দু’চোখের বিষ, যাদের এমনিতেই কিছু করা যায় না। কিন্তু ঈদের দিন কোলাকুলির নাম করে ঠেসে বুকের সাথে চেপে ধরে মৃদু পানিশমেন্ট দেওয়া যায়!
* ‘আনলিমিটেড’ খাওয়া যাবে, ভোগবিলাসে মত্ত হওয়া যাবে, এই আনন্দের কথা ভেবে খাদক শ্রেণির মন ফুরফুরে হয়ে যায়!
ঈদের অসুবিধা
* ছোটদের সালাম গ্রহণ করতে হবে এটা ভেবেই অনেকের আতঙ্কে বুক ধড়ফড় করে! শুধু সালাম হলে সমস্যা ছিল না, সেটার সাথে আবার সালামি মানে নগদ লেনদেনও জড়িত!
* স্বনামধন্য ঘুষখোরদের টানা ৩ থেকে ৭ দিন ঘুষ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। যদিও এ সময়ে তারা স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করেন। তবু ঘুষ খেতে না পারার বেদনা কি সহজে ঘোচার!
* পত্রিকাগুলো সাড়ম্বরে উৎসবের নানা অনুষঙ্গের ছবি প্রকাশ করে। এটা কোনোমতে পরিবারের নতুন বউ কিংবা আহ্লাদি শ্রেণির মহিলার হাতে পড়লে কেল্লাফতে!
* বেহিসেবি খাওয়াদাওয়ার ফলে অনেক সময় পেট নেমে যায়। পেট নামার সাথে মৃদুভাবে গজিয়ে ওঠা ভুঁড়িটাও নেমে যায় নাÑ এটাই দুঃখের কথা!
* পৃথিবীর সব কিছুই একসময় ফুরিয়ে যায়! যেমন ফুরিয়ে যায় হাঁড়িতে মজুদকৃত লোভনীয় খাবার! তখন মাথায় এক ধরনের বজ্রাঘাতই পড়ে যেন!
ঈদুল ফিতর বনাম ঈদুল আজহা
বছরে দুটি ঈদ। দুটি ঈদেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তুলনামূলক চিত্র
* রমজান মাসে মানুষ কেনে কাপড়চোপড় অন্যদিকে ঈদুল ফিতরে কেনে শুধু গরু (কেউ কেউ গরুর গলার মালাও কেনে)!
* রমজান ঈদের দিনে ফুরফুরে মেজাজে সবাই এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতে যায় আর সেমাই-ফিরনির সদ্ব্যবহার করে। অন্যদিকে কোরবানির দিন ব্যস্ত থাকে গরু-ছাগল নিয়ে। পশু জবাই করা তারপর মাংস কাটা। আবার সেই মাংস চিবানো। বুড়ো গরু হলে রাবার-শক্ত মাংস চিবাতে চিবাতেই ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়!
* সুখের কিংবা দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোরবানি ঈদের দিনটা থাকে প্রায় সব বাড়িতে ‘মেহমান প্রুফ’! বিপরীতে ঈদুল ফিতরে মেহমানের সারি লেগেই থাকে!
* ঈদুল ফিতরে লাখ টাকায় লেহেঙ্গা কিননেওয়ালারা সংবাদপত্রের পাতা দখল করেন অন্যদিকে ঈদুল আজহায় সর্বাধিক দামি গরু কিননেওয়ালারা। তবে বিশ্বের সবচেয়ে দামি গরুর ক্রেতাকে দুর্মুখেরা ‘ফুটানির রাজা’ উপাধি দিতে ভোলে না!
* রমজান ঈদের আগের দিন মানুষ ব্যস্ত থাকে চিকন চাঁদ দর্শনে। এই চাঁদের দেখা পেলে অনেকেই যেন ‘আকাশের চাঁদ হাতে পায়’! অন্যদিকে ঈদুল আজহার চাঁদ বাঁকা কি সোজা, সরু কি মোটা সেদিকে তেমন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না! যতটা আগ্রহ থাকে গরু-ছাগলকে নিয়ে, গরুর শিংয়ে কেউ কেউ দেখতে পায় বাঁকা চাঁদের হাসি!
সালামি ঠেকানোর পদ্ধতি
হাড় কিপ্টাদের কথা বাদ দিলেও অনেকের কাছেই ঈদের সালামি দেওয়া কষ্টের। ছোটদের এই ‘নীরব অত্যাচার’ সহ্য না করে উপায়ও থাকে না। কিন্তু জগতের সব সমস্যারই সমাধান আছে! সালামি থেকে রক্ষা পাওয়ার কিছু কৌশল:
* শহর-বন্দরে যারা থাকেন, তারা বাড়ি যাবেন মোটামুটি ঈদের ২/৩ দিন পর! ততদিনে পিচ্চিরা সালামির কথা ভুলে অন্য কিছু নিয়ে মেতে উঠবে!
* পিচ্চিরা সালাম করতে এলে বলতে হবে ‘তোমরা সাবধানে পায়ে হাত দিও না, আমার কিন্তু খোসপাঁচড়া আছে!’ সালামি দূরে থাকুক, কিছু না খেয়েই পিচ্চিরা ভাগবে!
* হাজী মুহাম্মদ মহসিন ভাব নিয়ে মানিব্যাগ থেকে চকচকে এক হাজার টাকার নোট বের করে দিতে হবে পিচ্চিদের হাতে। দিয়ে বলতে হবে, ‘তোমাদের কাছে কি ভাংতি আছে? আমার সব ভাংতি টাকা শেষ!’ পিচ্চিরা ভাংতি দিতে অপারগ হয়ে টাকা ফেরত দেবে!
* পিচ্চিদের সাথে সুকৌশলে নিজেদের অতীত দরিদ্রতার গল্প জুড়ে দিতে হবে। ২৫ পয়সা সালামি দেওয়ার জন্য বাবা ৩০ পয়সা সুদে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন; সেই ঋণ শোধ করতে না পারায় আরও ৩০ পয়সা জরিমানা গুনতে হয়েছিল এমন ‘মর্মান্তিক’ কেচ্ছাকাহিনী শুনতে শুনতে তারা অশ্রুসজল হয়ে উঠবে। সালামি চাওয়ার কথা মনেই থাকবে না!
* শ্রমের মর্যাদা নিয়ে বিশেষ কোচিং শুরু করতে হবে। অন্যের দেওয়া টাকা নেওয়ায় কোনো গৌরব নেই, নিজের কষ্টার্জিত টাকাই মানুষকে দিতে পারে সঠিক সুখের সন্ধান এমন হাইথট যুক্তি শোনার ভয়ে পিচ্চিরা উল্টো সালামির বিপরীতে কিছু নগদ টাকা দিয়ে যাবে!
ঈদে বেড়ানো
ঈদে কোথায় বেড়াতে যাবেন এটা অনেকেই ঠিক করতে পারেন না। অথচ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নেওয়া প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই জরুরি। সঠিক জায়গায় বেড়ানোর সম্ভাব্য কিছু স্থান,
সিনেমা হল : বাংলা সিনেমায় কী হয় সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তারকার সাথে ঈদ করতে পারাটা। তারকারা ঈদকে সামনে রেখে জাতিকে ‘স্পেশাল’ অভিনয় উপহার দেন। সেটার সাথে একাত্মতা পোষণ করে দেশপ্রেমের পরীক্ষাও দিয়ে ফেলা যায়! নায়ক পাতলা খানের বিপরীতে স্বাস্থ্যবতী নায়িকার নর্তন-কুর্দন আনতে পারে বিনোদনের বাড়তি মাত্রা!
চাঁদের দেশ : ঈদ ও চাঁদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চাঁদ এলে ঈদ আসে। সুতরাং কোন দেশ থেকে এই চাঁদ আসে, আবার কোথায়ইবা চলে যায় এটা খুঁজে বের করার মহান দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে চাপানো যেতে পারে! এতে করে বেড়ানোর পাশাপাশি আবিষ্কারও হয়ে যাবে!
মামাবাড়ি : ছড়া-কবিতায় মামাবাড়িতে আম-জাম কুড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসময়ে কয়জন আর মামাবাড়িতে আম (কিংবা বরই) কুড়ানোর চিন্তা করে! বিবাহিতরা মামাবাড়ির বদলে শ্বশুরবাড়িকেই গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। মামাবাড়িতে বেড়াতে গেলে আত্মীয়তা যেমন গাঢ় হবে তেমনি কিছু অর্থ সাশ্রয়ও হবে!
গরুর হাট : গরুর হাট ঈদের আগে ছিল গরুতে ভরপুর, ঈদের পরে অবশ্যই সেখানে বিরাজ করবে খাখা শূন্যতা। এই শূন্যতার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য গরুর হাটে ভ্রমণের বিকল্প নেই!
শপিং কমপ্লেক্স পরিদর্শন : সবাই চাইলেও সবকিছু কিনতে পারে না। দামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতাও থাকে না সবার। তাই কে কোন পোশাক কিনছে, কেমন দাম, সাজলে কেমন লাগছে এসব দেখার জন্য হলেও শপিং কমপ্লেক্সে যাওয়া উচিত। এতে কোনো খরচ নেই, উল্টো মুফতে পাওয়া যাবে এয়ারকুলারের কুলকুল ঠাণডা বাতাস!
ঈদ কীভাবে আসে জানতে মোষের বাথানে পর্যটন : রোজার ঈদে চাঁদ উঠলে সেটাকে বলা হয় ‘বাঁকা চাঁদের হাসি’। এটার সঙ্গে বকরি ঈদের চাঁদকে বলা যায়, ঈদ আসে মোষের শিংয়ের মতো চাঁদের মাথায় চড়ে। আগ্রহীরা মোষের বাথানে কিংবা গোচারণ ভূমিতে গিয়ে মোষের শিং দেখতে পারে। এই শিং কোরবানির চাঁদের সঙ্গে কতটা সাজুয্যপূর্ণ সেটা নিয়ে বড় একটি গবেষণাকর্মও সম্পাদন করা যায়!
Facebook Comments Sync