ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু / আফরোজা পারভীন
ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু / আফরোজা পারভীন
ভাষা আন্দোলন শব্দটাই বলে দেয় কেন এই আন্দোলন। বলে দেয়, এ আন্দোলন ভাষার জন্য, মাতৃভাষার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। তখনই বাঙালিরা মনে মনে শঙ্কিত ছিল, ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির একটা দেশের সঙ্গে তাদের মিল হবে তো!
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল তাদের আশঙ্কা অমূলক নয়। পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী শাসকরা অবিবেচনাপ্রসূত ও নীতি বহির্ভুত কাজ চালাতে থাকল একের পর এক। যা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থের প্রতিকূল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আঘাত শুরু করল তারা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মেরুদন্ড ভাঙার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল ক্ষমতাশ্রয়ীরা।
শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। আর তখন থেকেই শুরু হল ভাষা আন্দোলনের। সেই চরমক্ষণে একজন পরিত্রাতা হয়ে আবির্ভুত হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব। মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তাই অনন্য।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরপর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী সমবেত হয়েছিলেন। তাদের আলোচ্য বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণ। আলোচনার পর পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন। এই সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাবও গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ এভাবেই ভাষার দাবি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ভারত থেকে পূর্ববাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হলেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।’ ওই পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলির ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ ছিল সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনকেন্দ্র। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষের কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়েত হতো। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্মপরিকল্পনা এখান থেকেই নেওয়া হতো। শেখ মুজিব, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতা ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও ১৫০ মোগলটুলি বিরোধী রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দীন, নঈমুদ্দিনের মতো নেতারা ১৫০ মোগলটুলিতে জমায়েত হতো। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা।
১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তমুদ্দিন মজলিসের আহ্বানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমুদ্দিন মজলিসপ্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করে। এ ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ভূমিকা রাখেন। ওইদিন মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমুদ্দিন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠানের দুজন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এই পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে তরুণ শেখ মুজিব নেতৃত্ব প্রদান করে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরের দিন হরতাল কর্মসূচিতে যুবক শেখ মুজিব এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে।’ মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার।’ ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দিদের চুক্তিপত্রটি দেখানো এবং অনুমোদন নেয়া হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিব চুক্তির শর্ত দেখে অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন। ওইদিন দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায়, দেয়ালে- দেয়ালে পোস্টার, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে বুঝিয়ে এই অবস্থান পরিবর্তন করান। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তার সমর্থন আদায় করেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, ‘ সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়েছি। তাই ওই বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বলি। ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন।’ ওই বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯ জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতিও প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে শেখ মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।’ ২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখিত ভাষণ পাঠ করেন কামরুদ্দিন আহমদ। ওই প্রতিনিধি সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সমর্য় বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচিসমূহে অংশগ্রহণ তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু কারাগারে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।’ বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।’
ভাষা আন্দোলন জোরদার হল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রাণ হারালো সালাম, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা শহিদেরা। এ আত্মত্যাগে দেশব্যাপী আগুন জ্বলে উঠল । ছাত্র আন্দোলন পরিণত হলো ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য গণ-আন্দোলনে। একুশে ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হল ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল ঢাকার বাইরে, সারাদেশে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণার পেছনেও বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালন করা হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাই ছিল প্রধান। সব মিছিলের সামনে ছিলেন তিনি। সব মিটিং-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এরপর ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১ দফার প্রথম দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’
ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহন। তাই ভাষার ওপর আঘাত এলে পুরো জাতি শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হয় আতঙ্কিত। উদ্যোগী হয় আঘাত প্রতিহত করতে। সোজা কথায় কাজ না হলে এগিয়ে যায় রক্তাক্ত পথে। এগিয়ে যায় আত্মদানের রথে । একুশে ফেব্রুয়ারি প্রমাণ করেছে পূর্ব বাংলার জনগণের আচার-আচরণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, জীবনচিন্তা স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্রকে সংরক্ষণ করতে জনগণ প্রাণ পর্যন্ত পণ করে বসে। এই স্বাতন্ত্র থেকেই সৃষ্টি হয় এক নতুন জাতীয়তাবোধের।
৫২’র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, তারপর ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে এক বিরাট ঘটনাবহুল অধ্যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি এ জাতির জীবনে এক অমূল্য সম্পদ। আর এই অমূল্য সম্পদের সৃষ্টি হয়ে থাকে কোনো এক দুর্লভ মুহূর্তকে কেন্দ্র করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনই এক দুর্লভ মুহূর্ত। যার ফলশ্রুতিতে এদেশে স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। ভাষা আন্দোলনই পটভূমি ও গোড়াপত্তন করেছিল মুক্তিযুদ্ধের। অদম্য ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করে, অমিত তেজে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে দক্ষিণ-এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি করে পূর্ব বাংলার মুক্তিপাগল জনগণ বঙ্গবন্ধু এবং অমর ভাষাসৈনিকদের নেতৃত্বে। পূর্ব বাংলার জনগণের হাতে আসে নতুন পতাকা রক্তরঞ্জিত পথে। তারা পায় নতুন পরিচয়, নতুন ঠিকানা।
ভাষা আন্দোলন আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চাই’-এর মতো আবেগময় স্লোগানে স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে ভাষাপ্রেমী জনগণ। পূর্ববাংলার বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নতুন সংবিধানে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে বাধ্য হয় । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বিজয় সূচিত হয় সেদিন। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো মহান ভাষা আন্দোলন দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতির আরেকটি বিশাল বিজয় । ইউনেসকো এই স্বীকৃতি দান করে বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসমষ্টিকে কৃতজ্ঞতাপাশে বেধেছে। কৃতজ্ঞ করেছে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি বাংলাভাষীকে। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো নগরীর ‘হে মার্কেটে’ কিছুসংখ্যক শ্রমজীবী আট ঘণ্টা শ্রমকালের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। তাদের আত্মদানের মাধ্যমে বিশ্বময় স্বীকৃতি লাভ করেছে মে দিবস। বাংলাদেশের দামাল ছেলেরাও তেমনি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে বাংলা ভাষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এই দামাল ছেলেদেও অগ্রভাগে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। তাঁর এই বাংলা ভাষণের কতঅ ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’
বর্তমানে বিশ্বের ২৫ কোটিরও বেশি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর চার সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ফরাসি ভাষার চাইতেও বাংলাভাষী জনগণের সংখ্যা অনেক বেশি। এমনকি সা¤প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী লন্ডনে যেখানে ৩০৭টি ভাষায় মানুষ কথা বলে সেখানেও বাংলা দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন-এ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় শহীদ বরকত, সালাম, জব্বার, রফিকের নাম। উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম।
একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময় কাহিনি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে দেশ ও বিদেশের অসংখ্য মানুষের তীর্থক্ষেত্র। তবে একথা উল্লেখ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হলেও এটি বাংলাদেশের একান্ত আপন অর্জন। বাংলাদেশের বাইরেও বাংলা ভাষা প্রচলিত রয়েছে। আসাম ও ত্রিপুরার বিরাট জনসমষ্টির, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো মহান অধ্যায় কিন্তু রচিত হয় পূর্ব বাংলায়। শহীদ মিনার নির্মাণ হয়, ঢাকায়। কলকাতায় নয়। বাংলাদেশের ভাষা বাংলা সৃষ্টি করেছে স্বতন্ত্র এক আবহ। সৃষ্টি করেছে স্বতন্ত্র এক জীবনবোধ। স্বতন্ত্র এক সংস্কৃতি। এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশি সংস্কৃতি। বাংলাদেশের জনগণ এ জন্য গর্বিত। জাতি হিসেবে গর্বিত মহান একুশের উত্তরাধিকার মাথায় নিয়ে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের বীরনায়কদের সীমাহীন ত্যাগের কাহিনি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। স্মরণ করে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারিকে। শ্রদ্ধাবনত হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পূর্ণস্মৃতি স্মরণে রেখে। শ্রদ্ধাবনত হয় ভাষা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি।
Facebook Comments Sync