আলোর অভিযাত্রী – শাহনাজ পারভীন

আলোর অভিযাত্রী - শাহনাজ পারভীন

ওয়াসফিয়া নাজরীন। নামটা সকলেরই পছন্দের, আদরের, আনন্দের, ভাললাগার, ভালবাসার। তার চাইতেও যদি বলি নামটা সবার পরিচিত, সেটাই মানানসই । তার পরিচিতির ব্যাপকতায়  দেশের আকাশ ছাড়িয়ে অন্য দেশের আকাশের লালিমা পাল্টে যায় নিরন্তর। তার নামের মধ্যে ঢুকবার আগে আমি ছোট্ট করে বলে নিতে চাই, আজকের স্বনামধন্য মৃত্যুফাঁদের অভিযাত্রী হিসেবে পরিচয় পাবার আগেই এবং তার নাম এভাবে আকাশে, বাতাসে, পাহাড়ের উচ্চতায় ভেসে বেড়াবার আগেই তার নামটি আমার পছন্দের ছিল। বলতে পারেন একেবারে নিজের মত করে। সে গল্পটা বলি। আমার দ্বিতীয় এবং ছোট মেয়েটা জন্মের আগে এবং পরের ছাব্বিশদিন পর্যন্ত (তার নাম রাখার আগ পর্যন্ত) তার নাম নিয়ে ছিল আমাদের ফ্যামিলির একটা সংশয়। সে অর্থে বড় মেয়েটির নাম আমরা সহসাই রাখতে পেরেছিলাম (তাসনিয়া তাবাস্সুম তিসা) তো ছাব্বিশ দিনের মাথায় ছোট মেয়ের জন্য দুটো নাম আমরা সিলেক্ট করতে পারলাম। তাসফিয়া তারান্নুম তিফা এবং ওয়াসফিয়া ওয়াসী তাহান। দুটোই যখন আমার পছন্দ তো টস করে তাসফিয়াকে পেলাম। আর ওয়াসফিয়াকে রেখে দিলাম আমার অনাগত তৃতীয়ার জন্য। (যদি আদৌ আমার ভাগ্য খোলে!) তো সেই থেকে ওয়াসফিয়া আমার তাসনিয়া, তাফফিয়ার পাশাপাশি রোজ রাতে দিনে আমার পাশে পাশে থাকে। আমি তাকেও স্নেহ দেই, মায়া দেই, ভালবাসা দেই। তাকে ভুলি না কখনো। অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমার তৃতীয়ার নাম হলো নাসিফ মুনিম নাফি। আর ওয়াসফিয়া থেকে গেল আমার ভ্যানিটিতে। ব্যাগের চেন খুললেই সে রোজ উঁকি দেয়, আঁকুপাঁকু করে। তাকে কখনো আমি চকলেট দেই, মিমি দেই, টক কুল দেই আবার কখনো তাড়াহুড়োয় চেন টেনে রাখি। সে নড়াচড়া করে, উসখুস করে। কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি করে না। চুপ করে ঘুমায়। জেগে ওঠে। আবার যখন তাকে হাসিমুখ দেখাই সেও হেসে ওঠে আমারই সাথে। তো সেই ওয়াসফিয়া। আমার প্রাণের! আমাদের ভালোবাসার!

 

বাহ! এই তো! সকালের কাজের ফাঁকে তাকে দেখেও ফেলি এক ঝলক টিভির স্ক্রিনে। তিনি মৃত্যূকে দেখে এসেছেন মাত্র এক নিঃশ্বাসের দূরত্ব থেকে। তার উচ্ছ্বাসভরা আনন্দ চিৎকার-

‘বেঁচে আছি। সামিট করা শেষ। ভালো আছেন তো বন্ধুগণ! আপনারা?’

মৃত্যুর রোমান্টিসিজমের পথ এড়িয়ে সে হাসছে। তার হাসিতে ঝরে পড়ছে এভারেস্ট শৃংগের জমাট বরফের কণা কণা শুদ্ধতা, স্নিগ্ধতা, মায়া আর বিজয়ের রাশি রাশি ফুল…।

 

হ্যাঁ, বলছিলাম ওয়াসফিয়ার কথা।

 

ওয়াসফিয়ার জন্ম ঢাকায়। তার পিতার নাম নাজমী জাহান চৌধুরী, মাতার নাম মাহমুদা নাহার রুবি। তার মাতা একজন শিল্পী এবং স্কুল শিক্ষক । পিতা একজন চাকুরিজীবি। তার দাদার পৈতিক নিবাস ফেনী জেলায়। জন্মের কিছুুদিনের মধ্যে তার পরিবার খুলনায় যান। তার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার পরিবার খুলনা থেকে পুনরায় চট্টগ্রাম বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে তার পাহাড়ের সাথে মিতালি। পাহাড়ের সাথে ভালবাসা শুরু। সেই হাঁটি হাঁটি পা পা কাল থেকেই পাহাড়ের পাশে থাকবার সুপ্ত বীজ উপ্ত হয় তার মগজে, তার মননে। অতিক্রমকে দুরতিক্রমে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ওয়াসফিয়া পাহাড়ের রাজহংসী এক!

 

 

সেখান থেকেই পাহাড়ের বীজ বুকে বুনে নিয়ে আবারো আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন স্কলাসটিকা স্কুলে।  অ এবং ঙ লেবেল সম্পন্ন করেন কৃতিত্বের সাথে। যুক্ত হয় সমতল, সমভূমির সাথে মিতালি। খুলে যায় চোখের সামনে বৈশ্বিক সকল বন্ধ দরজা। এরপর বিশ্ব তাকে হাতছানি দেয় আর তিনিও তাতে সায় দিয়ে সাঁ সাঁ উড়ে চলেন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায়। এগনেস স্কট বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক মনোবিজ্ঞান ও স্টুডিও আর্ট এ তার উচ্চতর শিক্ষা শুরু হয়। প্রকৃতি, সমাজ, সামাজিকতা, আর্ট, শিল্প, সাহস সমন্বয় করেন মনোজগতের এক নতুন অধ্যায়ে। যেভাবে বেড়ে ওঠেন মননে সেভাবেই বেড়ে ওঠেন সামাজিকতা এবং পরিবেশের ছায়াতলে। এরপর স্কটল্যান্ডে  কিছুদিন পড়াশুনা করেন একনিষ্ঠতায়।

 

এরই মধ্যে তিনি সাত সাতটি পর্বত জয় করেছেন। আমার ভ্যানিটি থেকে কখন যেন সেই প্রিয় নামটি সাগর, মহাসাগর, মহাদেশ ছাড়িয়ে আমার একার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পৃথিবীর সবার হয়েছে। জনে- জনে। আমি খুশি। পরিষ্কার মৃত্যুতে মোড়ানো পথ ধরে যে অবলীলায় হেঁটে চলে এদেশ থেকে ও দেশ, এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়, এ মহাদেশ থেকে ও মহাদেশ এবং সমতল ভুমিতে হেঁটে চলে আড্ডাবাজি, উচ্ছ্বল হাসি আর প্রাণ-প্রাচুর্যে! তার কথা শুনি, তাকে দেখি আর ভাবি বরফে চিমসে হয়ে থাকা বহু বছরের মৃত দেহগুলো হয় ডানে অথবা বামে কিংবা সামনে অথবা পেছনে রেখে অবলীলায় মৃত্যুর ঘর থেকে হাসিমুখ ফিরে আসে প্রতিনিয়ত। এমনি টিভির স্কিনে ফুটে ওঠে তার প্রিয় মুখ। তার স্বপ্ন তখন তার হাতের মুঠোয় খেলা করে যেন! শুধু হাতের মুঠোয় কেন? কখন যেন লাফিয়ে পড়ে। ছড়িয়ে যায়। গড়াগড়ি খায়, গড়িয়ে পড়ে। বসন্তের শাখে শাখে, কোকিলের কুহু কেকায়, নদীতে, জলে, স্থলে, আম, লিচুর বোলে বোলে, পাকা কুলের টক ঘ্রাণে, ফাল্গুনের প্রথম ঝড়ের কোটি কোটি ঝরা পাতার সাথে উচ্ছ্বলতা দাপিয়ে বেড়ায় প্রকৃতিতে। সবশেষে বৃষ্টিস্নাত ¯স্নিগ্ধ সকালের মত পরিচ্ছন্ন উজ্জ্বলতায় হেসে ওঠে ঘুম ভাঙা ভাল লাগায়!

 

অথচ তার স্বপ্নের দুয়ারে কড়া নাড়তে এই পিচ্ছিল পথ মসৃণ করতে তাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে নানারকম প্রতিকূলতার বন্ধুর পথ। এই তো সেদিনের কথা,

এই মেয়ে সাইকেল চালাও কেন?

সাইকেল চালাতে আমার পছন্দ!

সাইকেল চালাতে পছন্দ? বলে কি মেয়ে?

আবার বাইকে চড়ো?

অসুবিধা কোথায়, আপনার?

বাইকে চড়া যাবে না, বাইরে একা একা হন হন করে ঘুরে বেড়াও, এটা কি ভাল দেখায়?

যত্তোসব…

আশে পাশের লোকজনের দৃষ্টি তীক্ষ্ন ছুরির ফলার মত চকচকে। কথা কাটে ঘচঘচ। তারো আগে কেটে যায় মন। রক্ত গড়ায় ফিনকি। সহসা ভিজে যায় সবকিছু। ক্ষত হয় দগদগে… কিন্তু তা কেউ দেখতে পায় না। একা একাই ওয়েন্টমেন্ট লাগায় সেখানে। ক্ষত সারিয়ে তুলতে নিজেকেই নিজে সাহায্য করে দিনরাত।

পাশের বাসার খালার একমাত্র কাজ যেন ওয়াসফিয়ার সারাদিনের রোজনামচার দিকে,

 

‘এই মেয়ে ঐ হোলা-হুপ নিয়ে খেলবে না। এগুলো নিয়ে আমাদের দেশের মেয়েরা খেলে না। দেখতে ভাল লাগে না।’

আপনার সমস্যা কোথায় খালামনি?

মুখে মুখে তর্ক করবে না  অভদ্র মেয়েদের মতো…

আর কথা বাড়ায় নি ওয়াসফিয়া। তখনই সে খেলনাটি তুলে দিয়েছিল তার সাথে খেলা করা বিদেশি ফর্সা গালের মেয়েটির কাছে। যে মেয়েটি তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল বাবা মায়ের সাথে।

ছোটবেলায় সেই প্রথম সাদা চামড়ার কোন মানুষ দেখেছিল সে। বাবা মায়ের সাথে তাদের বাসায় এসেছিল ধবধবে  মিষ্টি চামড়ার সাদা মেয়েটি। তার সাথে ওয়াসফিয়ার খুব ভাব হয়েছিল। তার খেলনাটা নিয়ে একটু খেলতেই খালার এই বক্রশাসন!

 

সাদা চামড়ার মেয়েগুলোই বুঝি কেবল খেলতে পারে এই খেলনা দিয়ে? ওদেরই বুঝি সব অধিকার! পৃথিবীর সবকিছু শুধু তাদের…

ওয়াসফিয়া ভেবেছিল সেদিন। তারপরও জীবনে আরো কত কত না এলো! কিন্তু ওর মধ্যে চেপে থাকা জিদ এবং জিতে যাবার আকাক্সক্ষার মধ্যে সমন্বয়তার জন্য ক্রমান্বিক যুদ্ধ যুদ্ধ ব্যাপারটি লালন করতে থাকলো আজীবন। এমন কিছুই সে করতে চায় যা তার দেখা অন্য কোন মেয়েরা করেনি এর আগে।

এই না এর শক্ত আবরণের ভেতর থেকে যেন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল মেয়েটির মন। আস্তে আস্তে নিজেকে বুঝতে শিখলো। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে নিষ্ঠতায়!

পড়াশোনা শেষ করে যোগ দিলো কেয়ারে। নতুন চাকুরি। একেবারে অন্যরকম। কেয়ারের মাধ্যমে পতিতালয়ের নারী আর শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য আরো সব সুবিধা দিতে এগিয়ে এলো সে। বিদেশী সাহায্য আসে।

ম্যাডাম, আপনি আমাগো নতুন জীবনের ডাক দিলেন। আমাগো বাচ্চাগুলানরে পড়াশুনা শিহাইতে পারছি। অসুক-বিসুক হলি ডাক্তার দেহাইতে পারছি। আপনি আমাগো সাক্কাত দেবতা মাগো।

কি যে বলেন? এভাবে বলতে নেই। আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।

তারপরও কতজন আইলো কতজন গেলো কিন্তু আপনার মতন কেউ না।

আপনি আমাগো নিজির বাপ-মার মতন যত্ন করেন। খোঁজ-খবর করেন। ঔষধ পত্তি সবকিছুতেই আপনার চিন্তা আগে আগে…। আপনি সবার চে আলাদা মা।

 

ভালোই লাগে ওয়াসফিয়ার এসব মায়াবী কথাবার্তা শুনতে। চাকরির পাশাপাশি, পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি মানবিক সেবাটায় সে অন্য রকম আনন্দিত থাকে। কিন্তু সে ধারাবাহিকতা কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিদেশি সাহায্য। ওর মন ভেঙে গেল। এভাবে আর কতদিন? বাইরের সাহায্য আর কতদিন? ওদের ওপর নির্ভরতা আর নয়। বেরিয়ে আসতে হবে এর থেকে। এই ভাবনাটার রূপায়ণ দরকার। তখন নিজেই নিজের পৃথিবী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ওয়াসফিয়া এবং তার সাথে যোগ হলো সবাইকে সাহায্য করবার মানসিকতা।

প্রথম বাংলাদেশকে তুলে ধরলো সেভেন সামিট ফাউন্ডেশনে।

 

 

২০১১ সালের ২ অক্টোবর তিনি আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারো এবং ২০১১ সালেল ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত অ্যাকোনকাগুয়া জয় করেন। এর আগে তিনি ২০১১ সালের  জুলাই মাসে ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত এলাবার্সের চূড়ায় ৩০০ মিটার নীচ থেকে খারাপ আবহাওয়ার কারণে ফিরে আসেন। এলাবার্সের চূড়ার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮,৫১০ ফিট। এলাবার্সে চূড়ায় ওঠার দুটি পথ ছিল। একটি উত্তর দিক দিয়ে অপরটি দক্ষিণ দিক দিয়ে। সচরাচর সবাই দক্ষিণ দিক দিয়েই এলাবার্স চূড়া জয়ে নামেন। কিন্তু ওয়াসফিয়া নাজরীনদের গাইড তাদেরকে ও পথ দিয়ে যেতে নিষেধ করেন। বাধ্য হয়্ইে উত্তর দিকের দুর্গম পথ দিয়েই এলাবার্স জয়ে নামেন ওয়াসফিয়া। এই পথে আগে কোন রশি টানানো ছিল না। তাই তাদেরকেই রশি টানিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছিল।

অ্যাকোনকাগুয়া জয়ের আগেই ঠিক করেন এর পরের গন্তব্য ‘মাউন্ট এভারেস্ট‘। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি নেপালের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। ২৬ মার্চ কাঠমুন্ডু থেকে ওয়াসফিয়া নাজরীন এভারেস্ট অভিযান শুরু করেন। তিনি এভারেস্ট হাইওয়ে দিয়ে এভারেস্ট বেস্টক্যাম্পে পৌছেন ৬ এপ্রিলে।

প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার বিভিন্ন সাক্ষাতকারে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য, অজানা কাহিনি।

কেমন ছিল এ মৌসুমের যাত্রাটি?

২০১২‘র মৌসুমটি অনেক ভয়ানক ছিল। কারণ, এভারেস্ট তখন অনেক জীবন্ত ছিল। অনেক ধরনের দুর্ঘটনা যেমন তুষার ধস, পাথর ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। যে পরিমান মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে এভারেস্টের ইতিহাসে এ রকম খুব কম হয়েছে।

আবহাওয়া? কেমন ছিল দিনরাত্রি?

একটানা ৪২ দিন ঠান্ডা আবহাওয়া, প্রতিকূল পরিবেশ, সুউচ্চ পর্বত, খুম্বু আইসকলের ভয়াল দংশন, বন্ধুর পথ, দুর্গমতা সব পেরিয়ে ক্যাম্প -১, ক্যাম্প-২, ক্যাম্প-৩। সত্যি খুবই রোমাঞ্চকর এবং ভীতিপ্রদ ছিল একসাথে। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। অন্য রকম থ্রিল! যা আজ ভাষায় বোঝানো সম্ভব না। মৃত্যূকে হাতের মুঠোয় নিয়ে হেঁটেছি।

তা কি খুব সহজ ছিল? সহজ ছিল সবকিছু, ম্যাডাম?

খুব সহজে করে ফেলা প্রশ্নটার উত্তরে এক মুহূর্তে যের নাজরীন ফিরে যান সেই সময়ের বন্ধুর পথে কিছুটা মুহূর্তে। উত্তর দেন,

না, না। ঠিক তা নয়। ঐ সময়ের বাস্তব জীবন আর এখনকার মিডিয়ার সামনে অনুভূতি প্রকাশ আকাশ পাতাল তফাৎ।  তখন জীবন ছিল হাতের মুঠোয়। যখন তখন যে কোন কিছুর জন্য ছিল মানসিক প্রস্তুতি এবং প্রত্যয়! আর এখন? তা এখন পলকা বাতাস। শ্বাস নিচ্ছি যখন তখন বুক ভরে। ভুলে গেছি। যেন ভুলে গেছি সবকিছু। ঠিক যেমন করে ভুলে যান একজন মা তার সন্তানের জন্মের পর তার কষ্টকর প্রসবের যন্ত্রণাক্ষণ! ঠিক তেমনি।

হা করে দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা সীমাহীন অক্সিজেন মুখ ভরে বুক ভরে টেনে নেন নাজরীন। হা হা হাসির ফোয়ারায় জীবন ভরিয়ে দেন মুহূর্তে।

এক সময় তো ধাতস্থ হয়েছিলেন?

তা তো। অবশ্যই। এবং এটাকেই বরং অন্য রকম আনন্দে ভরে দিতে পেরেছিলাম শেষ মুহূর্তে।

 

একটি প্রশ্ন করতে চাই ম্যাডাম। বর্তমানে তো আপনি ফ্যাসান সচেতন তরুণীদের আইডল। আপনার ইমেজ, আপনার পার্সোনালিটি,আপনার ফ্যাসান সবকিছু এখন ভাইরাল! আপনার ব্যবহৃত কসমেটিকস কিংবা কানের দুল, জিন্স, টপ্স…এ সম্পর্কে কিছু…

 

হা হা হাসির গমকে ওয়াসফিয়া ভরিয়ে ফেলেন প্যাসেজ। এটা অবশ্য সময় বলবে। আমার ব্যবহৃত পোশাক, কসমেটিকস কিংবা কানের দুল, আংটির মডেল সেটি বহুল ব্যবহৃত কিংবা প্রচারিত এটা এ পৃথিবীতে প্রথম বিষয় নয়। এটা হচ্ছে তরুণদের ধর্ম। বৈশিষ্ট্য। তারা সবকিছুকেই ওয়েলকাম করে উইলিংলি, ভালবেসে, নির্দ্বিধায়।

কতক্ষণ অবস্থান করেন সেখানে?

এভারেস্টের চূড়ায় ছিলাম ৩০ মিনিট।

সাথে কেউ ছিল?

না। সাথে অন্য কোন সঙ্গী ছিল না। ছিলেন আমেরিকার গাইড ক্রিস ক্লিঙ্কে এবং দুজন শেরপা নিমা গুরমে দর্জি ও কুসাং শেরপা।

আপনার এই আয়োজনে আয়োজক ছিলেন কারা?

আয়োজক ছিলেন ‘হিমালয় ডটকম’। পৃষ্ঠপোষকতা করেন সিটি ব্যাংক, গাজী ফার্মস, রেনাটা লিমিটেড এবং জাগো  ফাউন্ডেশন।

একটি স্মরণীয় মুহূর্তের কথা বলবেন, ম্যাডাম?

হ্যাঁ। অবশ্যই। বেসক্যাম্প ৩ থেকে বেস ক্যাম্প ৪ এ উঠার সময় প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম আমি। এভারেস্ট জয় শেষে নামার সময়েও এক শেরপার অবদানের কারণে প্রাণ নিয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরতে পেরেছিলাম ‘সাউথ কোল এবং সাউথ সামিটের মাঝখানের ব্যালকনিতে।

 

ততদিনে ধাতস্থ হয়েছেন ওয়াসফিয়া। এই পরিবেশের সঙ্গে, অর্জন করেছেন পর্বত উপযোগী সহ্য ক্ষমতা।

 

২০০৯ সালে নেপালের লুরী পর্বত, ২০১০ সালে আইল্যান্ড পিক জয় করেন। রাশিয়ার স্থানীয় সময় সকাল সাতটা ৫১ মিনিটে তিনি এলব্রুস চূড়ায় আরোহন করে বাংলাদেশের লাল- সবুজ পতাকা ওড়ান সাহসিকতা আর সাফল্যে।

১৭ মে চুড়ান্ত আরোহনের আগের দিন পড়লেন অ্যাভালাের (বরফ ধসে) কবলে। হারিয়ে গেল প্রয়োজনীয় রসদসহ তাঁবু ও অতি প্রয়োজনীয় কৃত্রিম অক্সিজেন সিলিন্ডার। হারালেন সামিট পুশের সুযোগ। নেমে এলেন বেসক্যাম্পে। সব রসদ এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগাড় করে ২২ মে আবার বেসক্যাম্প থেকে অভিযান শুরু করেন। আবার খুম্বু আইসফল, ক্যাম্প -১, ক্যাম্প-২, ক্যাম্প -৩, ক্রাম্প -৪, ব্যালকনি ফাস্টস্টেপ, সেকেন্ড স্টেপ, তারপর হিলারী স্টেপ হয়ে ২৬ মে সকাল ৬টা ৪১ মিনিটে পৌঁছলেন এমন এক উচ্চতায় যার উপর এই ভূপৃষ্ঠের আর কিছুই নেই। আছে শুধু আকাশ। জ্বলজ্বলে রংহীন আকাশ। ধোঁয়াসা। ধোঁয়াটে। অথচ তাঁর চোখে জ্বলজ্বল করছে পৃথিবীর সব মনি-মানিক্যের বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল প্রভার দ্যুতি!

এভারেস্টে দ্বিতীয়বারের মত কোন বাংলাদেশী নারীর হাতে উড়লো লাল সবুজের পতাকা। আর সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশী হিসেবে জয় করলেন এভারেস্ট চূড়া।

‘আমার মেয়েকে নিয়ে আমি হ্যাপী।’

মায়ের কথায় হেসে ওঠেন বাবা।

‘আমার সন্তানকে নিয়ে আমিও খুশি।’

এটি আমার মেয়ে। মায়ের খুনসুটিতে বাবার যোগ।

‘ওয়াসফিয়া শুধু আমার মেয়ে নয়। সে আমার সন্তান।’

‘কখনো কখনো মেয়েকে শুধু মেয়ে বলে ইন্ডিকেট করতে আমার দারুণ লাগে।’

সান্ধ্যকালীন চায়ের আড্ডায় ওয়াসফিয়ার মা বাবার সন্তানের গৌরব কখন যেন জেন্ডার ইস্যু ক্রস করে। তারা দুজনই অনুভব করে মেয়ে আর ছেলে, ছেলে আর মেয়ে তখনই এক হয়ে যায় যখন তারা ছেলে-মেয়ের একক পরিচয় ছাড়িয়ে পরিপূর্ণ সন্তান হয়ে ওঠে। তাদের সময়গুলো আরো মধুময় হয়ে ওঠে যখন খবরের কাগজের একটি রিপোর্ট তাদের আকাক্সক্ষাকে আরো পরিপুর্ণতা দেয়।

‘ওয়াসফিয়া এখনও পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশী এবং দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী হিসেবে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে শনিবার সকাল পৌনে সাতটায় বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেষ্টের চূড়ায় আরোহন করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি যুদ্ধবিরোধী এবং মানবতার পক্ষে বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যুতে সক্রিয় আন্দোলনকর্মী ছিলেন। তিনি উন্নয়নকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন। এখন তিনি বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট কর্মসূচিতেই সময় দিচ্ছেন। তাঁর মেন্টর হিসেবে আছেন পৃথিবীর প্রথম সেভেন সামিট বিজয়ী কানাডার প্যাট্রিক মোরো।’

 

বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অ ল দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার (ওশেনিয়া) সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কারস্তনেজ পিরামিড জয়ের মধ্য দিয়ে সাতটি পর্বত জয়ের কাজটি সম্পন্ন করেন ওয়াসফিয়া। ২০১১ সালে ওয়াসফিয়া তাঁর সেভেন সামিট অভিযান শুরু করেন। ১৬ হাজার ২৪ ফুট উচ্চতার কারস্তনেজ পিরামিডের স্থানীয় নাম পুনাক জায়া। সেভেন সামিটের অংশ হিসেবে ওশেনিয়া অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে ধরা হয় এটিকে। এটি ছিল সেভেন সামিটের ৭ নম্বর চূড়া জয়।

 

সকাল থেকেই আকাশে বাতাসে অন্যরকম এক মাদকতা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বর্ষ সেরা অভিযাত্রীর খেতাব পেয়েছে ওয়াসফিয়া। ওয়াসফিয়া নাজরীন। দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী দুঃসাহসী অভিযানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে নিজের অঙ্গিকার ও তৎপরতার জন্য তাকে ২০১৪ সালের অন্যতম বর্ষসেরা হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। ওয়াসফিয়া সত্যি অবাক। ও জানতো, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কিন্তু এভাবে তার স্বপ্নগুলো পাখনা মেলবে সাত আকাশে তা সে জানতো না। তাই বৃষ্টির শেষে সাত রং রঙধনুর মতো সাত রঙে হেসে ওঠে ওয়াসফিয়া। সাথে থাকে দিগন্ত রং আকাশ, জলাভূমি আর সমান্তরালের মাখামাখি। আনন্দে ওর মুদিত চোখে হাস্যোজ্জ্বল দেখতে পায় জাজ্বল্যমান সবকিছু…।