আমার মেয়েবেলা – শারমিনা পারভিন

আমার মেয়েবেলা

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ফিরিয়ে দাও আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব। কাকে বলবো? কে দেবে? শৈশব কি ফিরে পাওয়া যায়? পেয়েছে কখনো কেউ?

তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম

সে এখন ঘোমটা পরা দূরের কোন গায়

যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরে পাওয়া যায়?

ছোট বেলায় গানটা আমার খুব প্রিয় ছিল।

প্রিয় ছিল,

মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে

স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ে বেদনার নানা রংয়ে ছবি আঁকে

মনে পড়ে যায়

মনে পড়ে যায়

সত্যি সত্যিই বড় বেশি মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই মধুর দিনগুলোর কথা!

আজ সকালে ছোট আপু কথাসাহিত্যিক আফরোজা পারভীনের একটা লেখা পড়লাম। আমাদের শৈশব, আমাদের বাড়ি সাঈফ ভীলা সম্পর্কে। 

কত স্মৃতি, কত গান,কত আনন্দ। কত না আনন্দ বেদনার শহর। আজও চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হয় সেদিনের কথা। আমাদের স্বপ্নের বাড়ি, মা আব্বা, ভাই বোনের ছুটাছুটি, আত্মীয় স্বজন, আব্বার রাজনৈতিক অনুসারী,  আব্বার চেম্বার, আমাদের খোলা ছাদ, যেখানে জোছনারাতে জোছনা উপচে পড়তো। বড় ভাবি গিটার বাজিয়ে গাইতেন, ‘আজ জোৎস্নারাতে সবাই গ্যাছে বনে’।

সারি সারি টব দিয়ে সাজানো বাগান। বাড়ির সামনে বাগানবিলাস, টগর, কামিনী, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম। পাগল করা গন্ধ!  আজও প্রতিনিয়ত আমাকে তাড়িত করে। ফিরে পেতে চায় সেই প্রাণময় হারানো শৈশব।

বলাবাহুল্য করোনায় অবরুদ্ধ থেকে আমার নষ্টালজিয়া ভর করেছে। বড় বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি আমি। তা থেকেই এ লেখার অবতারণা।

যে স্মৃতি আমাকে নিয়ে গেছে আমার স্বপ্নের শহর নড়াইলে। আমরা বলতাম নড়াল। যেখানে আমার শিশুকাল,কৈশোর, যৌবনের দুরন্ত সময় কেটেছে।

 সাঁতার !

ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ভাল সাঁতার কাটতাম।পাড়ার ছেলে- মেয়েদের সাথে কলার ভেলায় চড়ে সাঁতার শিখতাম। আব্বার সাথে নদীতে গোসল করতে যেতাম। আব্বা আমাকে একটু দূরে ছেড়ে দিয়ে বলতেন, ‘হ্যাপু সামনে আসো।’ আমি যতই সামনে আসার চেষ্টা করতাম, আব্বা ততই দূরে চলে যেতেন। এভাবেই একসময় সাঁতারে পারদর্শী হয়ে গিয়েছিলাম।

একটু বড় যখন ফোর ফাইভে পড়ি, তখন চিত্রানদী পাড়ি দিয়েছি কয়েকবার। শীতকালে নদী শুকিয়ে যেত তখন। পাড়ার নন্টু মামা, ইসমাইল কাকা, কালাম (আমাদের বাড়ি কাজ করতো) চান্দু ভাই, হারুনভাই, নীনা টুনু লাভলী যারা আমার ছোট বেলার সাথী, বন্ধু , তাদের নিয়ে নদীর ওপারে চলে যেতাম। ওপারে গিয়ে চিৎকার দিতাম,ফুল না ফল? প্রতিধ্বনি হয়ে আসতো উল্টোটা ফল। ঠিক তেমনি ভাবে আকাশ না বাতাস। ইকো হতো বাতাস। ওপারে ঘন জঙ্গল ছিল। আনঝুম পেড়ে খেতাম। (জামের মতন ছোট ছোট ফল) বড়ই মজার। ওপারে একটি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল।নাম চায়না। জানিনা চায়না কোথায়? বেঁচে আছে কি?

 ভয় ডর কিছুই ছিল না। না ছিল ডুবে যাবার ভয়,না ছিল কুমিরের ভয়, না শিশুকের ভয়।

ছোট নদী চিত্রা। মায়াবতী নদী। শান্ত সমাহিত। কখনও উত্তাল হতে দেখিনি।

আমার স্বপ্নের নদী, আমার ভালবাসার নদী, আমার ময়ুরাক্ষী নদী।

আমার একটা নদী ছিল জানলো নাতো কেউ।

বাড়িতে যখন আসতাম, মা বলতেন, ‘আসার দরকার কি?’ আমাদের বাড়িতে পুকুর ছিল। পুকুরের উপরে আম গাছের ডাল ঝুলে ছিল। সেখানেও একই দশা। আম গাছ থেকে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়তাম পাল্লা দিয়ে।  কে কত বার পারে! পুকুরের পাশে পেয়ারা গাছে মাঝে মাঝে সাপ জড়িয়ে থাকতো।সাপেরা রোদ পোহাতো।

আমাদের পুকুরে প্রচুর গলদা চিড়িং হতো। শীতে গলদা চিড়িংও রোদ পোহাতো। ধোড়াসাপগুলো টুপ করে মাছ  খেয়ে ফেলতো। একবার মাছ ধরতে গিয়ে হাতে সাপের বিষ লেগেছিল। তিনমাস ভুগেছিলাম।পরে আঙুল অপারেশন করে বিষ ফেলা হয়।

পুকুরে প্রচুর ছোট চিড়িং হতো। গামছা দিয়ে ধরতাম। মা  অনেক করে পেঁয়াজ দিয়ে মচমচ করে ভেজে দিতেন।বর্ষায় মাছ ধরতাম বড়শি দিয়ে। পুঁটি মাছ, খয়রা মাছ। আমাদের পুকুরে লাল রংয়ের খয়রা মাছ হতো। এখন যে একিউরিয়ামে মাছ দেখা যায় তারচেয়ে অনেক বেশি সুন্দর মাছ।

পুকুর থেকে যখন উঠে আসতাম তখন দুই গালে কাঁদার শেতলা পড়ে যেত । শুদ্ধ ভাষায় বলা যায় আস্তর । মার সেই একই কথা। পুকুরেই থেকে যাও।

ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরে কাটাতাম। চোখ লাল টকটকে।

কী ভীষণ দুরন্ত ছিল আমার শৈশব!

আর আজ আমি! একটা তেলাপোকাকে ভয় পাই। এক ফুট উচুতে উঠতে পারি না। ফুটপাতের সামান্য উঁচু পার হতে পারি না। অন্যের সাহায্য লাগে।

বড় অদ্ভুত মানুষের জীবন! বয়স,অসুস্থতা!

অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি হলে ছাদে গোসল করা, নীচতলায় পাইপের নিচে দাড়িয়ে থাকা, শীলা বৃষ্টিতে শীল কুড়ানো, ঝড়ের মধ্যে আম কুড়ানো।

কই তখনতো একবারও জ্বর আসতো না।

আর এখন ঘরে থেকে হাঁচি কাশি,ঠান্ডা লেগে থাকে। এখানে ব্যথা ওখানে ব্যথা।

এটা পরিবেশের কারণ? নাকি মেঘে মেঘে অনেক বেলা হল? শরীর জানান দিচ্ছে আর কত?

মিলিবন্ধু !

 যার কথা না বললে না, সে আমার বাল্যবন্ধু মিলি।

যাকে আমি মিলিবন্ধু বলতাম, সে আমাকে হ্যাপীবন্ধু বলতো। দাদারাও মিলিকে মিলিবন্ধু বলতেো। ওদের বাড়িতেও আমাকে সবাই হ্যাপীবন্ধু বলতো।

ও আমার দেড় বছর বয়সের বন্ধু। তখন আমরা কিছুই বুঝতাম না। ওরা আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতো। কাকা,কাকিমা আমাকে খুব আদর করতেন। কাকা সরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।

আমাদের বারান্দায়  চটা দিয়ে ঘিরে খোয়াড় বানিয়ে তার মধ্যে আমাকে আর মিলিকে রাখা হতো, যাতে করে আমরা পড়ে না যাই।

একবার নাকি আমি ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে নেই। আদৌ সত্যি কিনা জানি না! তবে ও সারাজীবন ঐ কমপ্লেন করে গেল।

আমি আতাগাছে উঠতাম।ও নিচে থেকে বলতো, ‘বাদুড় ভাই বাদুড় ভাই, একটা আতা দেন না।’ আমি আতা ফেলতাম। ও টুপ করে ধরে ফেলতো।

আমাদের বরই গাছে উঠতাম, মগডালে। আমার সাথে বলাকা মাঝে মাঝে উঠতো (বলাকা মাশরাফির মা)। ও আমাদের ভাগ্নী, আবার ছোট বেলার বন্ধু।  খুব চঞ্চল ছিল। সারাদিন শুধু নিজেদের বাড়ি,আর মামার বাড়ি করতো।

কিরে বলাকা, কই যাস?

উত্তর মামাবাড়ি। সেই বলাকা কত শান্ত সিগ্ধ।

রত্নগর্ভা মা।

বলাকার সাথে আমার ছোট্টবেলার অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে।

মিলিদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির মাঝে ছিল একটা বড় মাঠ। ও সকালের দিকে আসতো। দুপুর পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। কি কথা বলতাম,  আজ মনে করলে অবাক লাগে।

তারপর শুরু হতো এগিয়ে দেবার পালা। একবার এগিয়ে দিয়ে ও আমার সাথে আবার আসতো। আমি ও ঠিক তাই।

আপ পহেলে,আপ পহেলে অবস্থা।

আমাদের এক মামি,  একলিম মামার বউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিষয়টি খুব এনজয় করতেন। রোজ একই ঘটনা। এরকম কমপক্ষে পাঁচবার হবার পর যার যার বাড়ি ফিরে যাওয়া। মামী বলতেন, তোদের মাঠের মধ্যে একটা ঘর করে দি। তোরা ওখানে থেকে যা।

ও আর একটা মজার কথা বলা  হয়নি। সুপুরির পাতার উপরে বসতাম। ও টেনে টেনে নিয়ে যেত। ওর কষ্ট হতো। কিন্তু আমার কথা না শুনে ও পারতো না। তাই মাঝে মাঝে উল্টো পাল্টা টেনে ফেলে দিতো।

নাকি মাথা ফাটানোর শোধ নিতো?

আল্লাহ মালুম!

মিলি কারো সাথে মিশলে আমি সহ্য করতে পারতাম না। ও মাঝেই আমার সাথে বেঈমানী করতো। নতুন নতুন বন্ধু জুটাতো। আমি শুধু মিলি মিলি করে পাগল হতাম। ওকে ছাড়া আমার একদিনও চলতো না। তখন আমার দিনগুলো সীমাহীন কষ্টে যেত!

ছোটবেলার বন্ধুত্ব বোধহয় এমনি হয়। আমার জীবনটাই তখন ছিল মিলিময়।

মিলি ভাল আছে। খুলনায় থাকে।মেয়ে ডাক্তার হয়েছে।

ঢাকায় আসে। দেখা করে না, ফোন ও দেয় না। সেই একই রকম আছে। এতটকু বদলায়নি।

রাগ করলি বন্ধু আমার?

আমার প্রাণের বন্ধু, আমার জীবনের প্রথম বন্ধু।

তুইতো আমাকে বন্ধুত্ব চেনালি মিলি বন্ধু!

 

ফুল কুড়ানো! 

সেই ছোটবেলায় অতি ভোরে উঠে কোর্ট ভবনে শিউলিফুল কুড়াতে যেতাম। থরে থরে শুভ্র বসনা শিউলি ফুল পড়ে থাকতো। সাদা ফুলের ডাটিটা ছিল কমলা। সৃষ্টির কী অপূর্ব লীলা! শরতের শিউলি ফুল। সকালের ফুরফুরে হাওয়া।আমি নীনা, টুনু,লাভলী, শিরীন ফুল কুড়িয়ে এনে মালা গাঁথতাম।

শিউলি ফুল নিয়ে ,কবি কত কিছু লিখে গেছেন।

কবি নজরুল লিখেছেন শিউলিমালা

কি সতেজ শুভ্র বসনা,সিগ্ধ ফুল।

সেখানেই শেষ নয়। যেতাম ‘প্রান্তিক’ নামে একটি বাড়ির পিছনে। শামলু ভাইদের বাসা।পাশে  শাহআলম ভাইদের বাসায় বকুল গাছ ছিল। যত ভোরে যাওয়া যেত, তত ফুল বেশি পেতাম। চাচী আম্মা হেসে বলতেন, এত সখ তোর ফুল কুড়াবার?

কোথায় চাচী আম্মা!

সব মমতাময়ী মায়েরা চলে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

পাড়ার ছেলেরা খ্যাপাতো। ‘কিরে মালা গাথঁলি? কাকে পরাবি?’

তারপর সূর করে একযোগে

‘আমরা দুজনে বকুল বাগানে

তুলবো ফুল গাঁথবো মালা, পরবো দুজনে

হি হি হা হা’

সব সময় এমনতর কিছু বদ থাকে। তখন এ কথার মানে বুঝতাম না। এখন হাসি পায়।

হায়রে আমার মেয়েবেলা।

 

বাদাম টুকানো!

অলিয়ার ভাইয়ের দোকানের কাছে একটা বাদামগাছ ছিল। আবার মুন্সেফ ভবনের সামনে তিনটি গাছ ছিল। তখন নড়ালের সব গাছ লতাপাতা নখদর্পণে আমার। বাদাম দূরে পানিতে ভাসতো। অতি কষ্টে বাদামগুলো পাটখড়ি দিয়ে টেনে আনতাম। পাটখড়ি বাড়ি থেকে নিয়ে যেতাম।

কী মেয়েমানুষি।

বাদাম এনে দুই ইটের মাঝে দিয়ে ভাঙতাম।

এত কষ্টের পর খুব অল্প বাদাম হতো। সেটা আবার চিনির মধ্যে দিয়ে জ্বাল দিতাম।

আহা্  কী স্বাদ! আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি ভাবতেপারে?

 

অলিয়ার ভাই!

বাড়ি থেকে চৌরাস্তার দিকে যেতে অলিয়ার ভাইয়ের দোকান বাদাম গাছের নিচে। সারাদিন অলিয়ার ভাই এটা দেন,ওটা দেন। তখন কি ছাতা মাথা এত কিছু পাওয়া যেত! লাঠি লজেন্স, ভুতের ডিম, চানাচুর, বিস্কুট,শক্ত পাউরুটি।

অলিয়ার ভাইয়ের দোকানে যত সাজার  জিনিস পাওয়া যেত সব আমার চাইই চাই ।

আব্বার বলা ছিল, অলিয়ার হ্যাপু যা চায় দিয়ে দিও। আমারে আর পায় কে।

আমার একটা কাঁচের বাক্স  ছিল। সবাই বলতো এটা অলিয়ারের দোকান। তার মধ্যে আমার সাজু গুজুর জিনিসপত্র থাকতো। ছোটবেলা থেকেই সাজতে ভালবাসতাম।

শুধু গায়ের রংটা সব সময়ই বিপক্ষে ছিল।

অলিয়ার ভাই কি বেঁচে আছেন? কতকাল পরে অলিয়ার ভাইয়ের কথা মনে পড়লো।সবার জন্য এত মায়া লাগে কেন?

 

চানাচুরওয়ালা সুধীরদা! 

একটা টিনের বাক্সে চানাচুর বিক্রি করতেন।  সবাই দাদার চানাচুরের ভক্ত ছিল। দশ পয়সায় খুব কম চানাচুর দিতেন। বলতাম,সুধীরদা এত কম কেন? বলতেন,বুন্ডি খরচ ম্যালা। দেহনা কি চিকুন চিকুন করে বানাই। জীবনে কত ধরনের চানাচুর খেয়েছি। কিন্তু সুধীরদার চানাচুর  আজও মুখে লেগে আছে!

সুধীরদা সুর বলতেন,

আগে খান,পরে দাম

খারাপ হলে চায়নি দাম

বাড়িতে গামলায় করে গরম রসগোল্লা নিয়ে আসতো। কার্তিকদার দোকানের সন্দেশ,আমৃতি কাঁচা গোল্লা। আহা!

সারামাস খেতাম। আব্বা মাসের শেষে টাকা দিতেন।

কোথায় সুধীরদা? হায়রে আমার মেয়েবেলা!

কলাপাতায় করে মাখন, গরম গরম ফেনা ভাতে ঘি দিয়ে মা ভাত মেখে দিতেন।

আহা! কোথায় লাগে বার্গার স্যান্ডসুইচ,।।

 ভাইবোন, আত্মজন!

এক ডজন কাজের লোক বাড়িতে। ,মহর ভাই, আরব আলি ভাই,হেমায়েত ভাই, কুলসুম বু,আকলির মা, মজিরনের মা, মজিরন,রিজিয়।,মার আশ্রিতজন, আব্বার রাজনৈতিক মানুষজন,ভরা বাড়ি।যৌথ পরিবার, রাজনৈতিক পরিবার, এক অনাবিল পরিবেশ।

সকালে খেজুরের রস,মুড়ি দিয়ে রস খাওয়া, সন্ধ্যায় তালের রস। বাড়ির সামনে কালভার্টে বসে টগর গাছে ঝুলতে ঝুলতে রস খাওয়া, সেই কি ভুলা যায়!

পাড়াবেড়ানো !

নীনা, টুনু,লাভলী মিলে এলোপাথাড়ি হাঁটা। গোচর পযন্ত গিয়ে আলাদাতপুর হয়ে, বরাশুলা হয়ে,মহিষখোলা হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফেরা। মাঝে মাঝে মটরসুটি ক্ষেত থেকে মটরশুঁটি তোলা। দু একবার ক্ষেতের মালিকের তাড়া খেয়েছি, ধাওয়া খেয়েছি, পা কেটেছি।  ভোগান্তি কম হয় নাই। আর আজ এক গজ হাঁটতে কত আলিস্যি।

বাড়ির পাশে স্নিগ্ধ নদী ।  খরস্রোতা নদী। আমাদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে গেলে প্রথম কাজটা ছিল নৌকায় বেড়ানো। একপাশে ছোট শহর, অন্য পাশে গাছগাছালি। কখনও কাশফুল, নাম না জানা পাখি।কি অনিন্দ্য সুন্দর নদী। ছেলে মেয়েরা বউ ঝিদের গোসল করা। আজ সেই স্বপ্নের চিত্রা শুধুই অতীত। কচুুড়িপানায় ভরা। আমরা সব শেষ করে দিয়েছি। পরিবেশের উপর এত অত্যাচার! নদীর তো ধারণ করবার ক্ষমতা থাকতে হবে!

বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলা!

ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে পাড়ার ছেলেদের সাথে বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলতাম । সারা গায়ে কাদামাটির ছড়াছড়ি।তারপর আবার সেই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া। মারবেল খেলা, ঝিয়াপতি খেলা। (অনেকে ঝিয়াপতি চিনবে না)। মারবেলের মত ছোট ছোট ফল। ঘষতে ঘষতে মারবেলের আকার ধারণ করে।খেলাটাও একদম এক।  লাটিম ঘোরানো, গুলতি মারা। আমাদের একটি লাটিম গাছ ছিল। বিকালে চিবুড়ি খেলা,কুতকুত খেলা, দড়ি লাফানো। তবে আমি ছেলেদের খেলা বেশি খেলতাম। আমাদের শৈশবে ছেলে মেয়ে পার্থক্য ছিল না। সবাই একই পরিবারের।

কোথায় তাহামিদ? ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বন্ধু তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে?

নান্নু,শরীফ,রব্বানী?

হায়রে আমার গুলতি,লাটিম, মারবেল!

ফিরিয়ে দাও আমার অরণ্য স্বর্নালী মেয়েবেলা!

আজ তোদের বড় দেখতে ইচ্ছে করে। কোথায় লাভলি,কোথায় নীনা,কোথায় টুনু,রমা,রোজি,ডালিয়া, কবিতা?

আর একবার প্রাণের মাঝে আায়রে সখা আয়।

আদিবাসী! 

আমাদের বাসার পাশে আদিবাসীরা বাস করতো। যাদেরকে বুনো বলা হত স্থানীয় ভাষায়।

ওরা আমাদের বাসায় টুকিটাকি কাজ করতো। ওদের সাথে খেলতাম। পূর্নিমা, সান্ত্বনা, মিলন মাতালদা, তপোনদা, স্বপনদা, হরিদাসি দিদি, প্রেমো দি।

প্রেমো দি কি বেঁচে আছে!

ওদের বাসায় কেউ যেত না। মাঝে মাঝে চিত্রামাসি আমাকে গুড়ের চা খাওয়ার জন্য ডাকতো।

আমি লুকিয়ে লুকিয়ে যেতাম। ওরা তেজপাতা,আদা আর গুড় দিয়ে চা বানাতো।  আহা্ সুধীরদার চানাচুরের মত সেই চায়ের স্বাদ কোথাও পাইনি।

বউরা সিদূর পরে মাথা ভতি তেল দিয়ে ঘুরে বেড়াতো।

পূর্নিমা আমার বয়সের ছিল। ওর যখন বিয়ে হলো কত যে খুশি। বলতো জানিস দিদি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।চোখ মুখ দিয়ে আনন্দ উপচে পড়তো।

ওরা নিম্নবর্গের হওয়াতে আমাদের অন্য চোখে দেখতো।

আমি তখন বিয়ে বুঝতাম না। তখন ভাবতাম, বিয়ে ভাল না। পরের বাড়ি চলে যেতে হয়।

পূনিমা এখন রোগগ্রস্ত। একগাদা ছেলে নাতি নাতনী। প্রায় বার্ধক্যে উপনীত। আমিও কি তাই?

চা !

চা খাওয়ার নেশা আমার সারা জীবনের। সবাই জানে। আমাদের পরিবারের সবারই চায়ের নেশা। চুলার উপরে কেটলি বসানো থাকতো।  একবার মা গোসল করতে গেছেন। এই সুযোগে আমি চা বানাতে গেছি। চুলার মুখের চেয়ে হাড়িটা ছোট ছিল। হাড়িটা চুলার মধ্যে পড়ে গেল। আমি হাড়ি তুলতে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ব্যস দগদগে আগুনে আমার হাত গলা সব পুড়ে গেল। হাতের চামড়া পুড়ে ঝুলে ছিল।আড়াই মাস বিছানায় ছিলাম। তখন নাকি চিৎকার করে কেঁদেছি। আর ছোট আপু,ছোটআপু করেছি। ছোট আপু যশোরে থাকতো। ও কি বোঝে ওকে কতটা ভালবাসি? সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাস্তার মানুষ গুনতাম। একবার দেড়শ মানুষ গুনেছিলাম। তখন মানুষও কম ছিল। কজন মানুষ নড়ালে। সবাই সবার চেনা। সবাই সবার আত্মাীয়। হিন্দু, মুসলমান এক, অভিন্ন।

ছোটবেলা থেকে আগুন আমাকে বড় বেশি টানে। বহুবার পুড়েছি। 

মা তাই আমাকে নিয়ে ভয় পেতেন।

ছোটআপুর বন্ধু বিপ্লব ভাই, বড় মজার মানুষ। ল্যাব এইডের ডাক্তার। খুব ক্ষাপাতো।

এই হ্যাপী তোর দুই পায়ে দুই রকম স্যান্ডল কেন?

দেখতাম,  ঠিকইতো আছে।

একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। বিপ্লব ভাই বললো,

দেখ হ্যাতু (আঞ্চলিক ভাষায় কুকুর)

আমি কুকুর খুব ভয় পেতাম।  দৌড়ে গিয়ে পড়লাম ড্রেনের ভিতর।

পা ভাঙলো।। প্রায় দেড়মাস বিছানায়। গালাগালি দিয়েছিলাম, অভিশাপ দিয়েছিলাম, বিপ্লবের যেন পা ভাঙ্গে।

ঠিকই একমাস পরে ফুটবল খেলতে গিয়ে বিপ্লব ভাইয়ের পা ভেঙে গেল। বিপ্লব ভাই ছোটআপুকে চিঠি লিখেছিল, পপীরে হ্যাপু আমাকে কি অভিশাপ দিলরে!

বিপ্লব ভাই আমার বড্ড প্রিয় মানুষ, প্রাণের মানুষ।

বিপ্লব ভাইয়ের বউ রুবা আপাও ছোটআপুর বন্ধু।

ওনার সব কিছু ভাললাগতো। ওনার চলা,কথা বলা, গেটআপ,সাজাসজ্জা।

অদ্ভুত ব্যাপার উনি যেভাবে ঘুমাতেন ওভাবেই উঠতেন।

কতবার ওনার মত হতে চেষ্টা করেছি।

বৃথা এ চেষ্টা!

আইসক্রিম! 

আমরা খুব স্বচ্ছল পরিবারে মানুষ হয়েছি। আব্বারপ্রচুর ইনকাম ছিল। কোন জিনিস চেয়ে পাইনি,এমন কখনো হয়নি।

স্কুল থেকে কোর্ট মাত্র কয়েক গজ দূরে। টিফিনের সময় আব্বার কাছে পয়সা আনতে যেতাম। আব্বা আমাকে পর্দার কাছে দেখে বলতেন, রাজ্জাক, হ্যাপুকে চার আনা দিয়ে দাও। (রাজ্জাক ভাই আব্বার মহুরী ছিলেন)। আব্বার আরো কয়েকজন মহুরী ছিলেন। তারা ও আমাদের আপনজন।

পয়সা নিয়ে আফসার সাহেবের আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে গিয়ে আইসক্রিম কিনে কেথাম । জিহ্বা লাল সবুজ করে বাড়ি ফিরতাম। তখন ওগুলোর রং,লাল সবুজ হতো।

বাড়িতে কটকটিলা এলে ভালো ভালো হাঁড়ি কুড়ি দিয়ে কটকটি খেতাম।

আড়ং!

বৈশাখী মেলা হতো নিশিনাথতলায়।কি না কিনতাম। বেলুন বাঁশি, কদমা,মাটির পুতুল, মাটির, বাঘ, সিংহ, মাথা কাঁপানো বুড়ো,ঘোড়া, আম,কাঠাল, লিচু কলা,দুনিয়া কেনা চাই। খাবার জিনিস কদমা,গজা,পাপড় সব সব।

যাত্রা পালা,সিনেমা দেখতাম।,সার্কাস, পুতুল নাচ হতো। একবার পুতুল নাচ দেখতে গিয়ে, বর পুতুলকে কেউ একজন  জিজ্ঞাসা করল,বউ কই? সে মাথা কাঁপিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল। চারিদিকে হাসির রোল পড়ল।

সেই ছোট বয়সে বড় লজ্জা পেয়েছিলাম।

যাত্রাপালা দেখতাম। মরে ও মরেনি যারা, দুই পয়সার আলতা, রসের বাইদানী, বেদের মেয়ে,

নবাব সিরাজুদ্দৌলা, ফকির মজনু শাহ।  কত না যাত্রা।

একটা সংলাপ মনে পড়ছে,

পালিয়ে যাচ্ছ কোথায় সুন্দরী? এই কে আছিস?

শমিষ্ঠা,তুমি পাপিষ্ঠা।

না, না,ওগো আর বোল না।আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।

বাংলা কি আমায় ভালবাসেনি গোলাম হোসেন?

পথহারা পাখি কেঁদে ফেরে একা

সিনেমা! 

নড়ালের সিনেমা হলেরর নাম ছিল চিত্রাবাণী । সিনেমা হলে প্রথম দিন যে ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল তার নাম ছিল, নীল আকাশের নীচে। 

নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা

এই সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা।

এর আগে অবশ্য আমি সিনেমা দেখেছি। বড়দা তখন খুলনায় ম্যাজিট্রেট ছিলেন।

নড়ালে যে ছবিটা মুক্তি পেতো আমি প্রথম দিনই দেখতাম। একটা ছবি যে কতবার দেখেছি। কোন কোন ছবি শুধু একটা গান দেখার জন্য মাসিকে পান খাওয়ার পয়সা দিতাম। মাসি সিনেমা হলের টিকিট চেকার ছিলেন। (মাসি কার্তিকদা, অপর্নাদির মা)

আর  একটু ছোট অবস্থায় সিনেমা হলের চাটাইয়ের ফুটো দিয়ে ছবি দেখতাম। কি ফটকা যে ছিলাম! 

ও দরিয়ার পানি তোর মতলব জানি

এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না

তোমাকে চাই আমি আরো কাছে

শুধু যে এগুলো দেখতাম, তা কিন্তু না। অবুঝ মন, দীপ নেভে নাই, নাচের পুতুল, আবির্ভাব,জীবন থেকে নেয়া  এ ছবিগুলো দেখেছি কত ছোট বয়সে।

আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন

সাতটি রংয়ের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই

এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে

সেদিনের মতো এ গানগুলোর আবেদন তেমনই আছে।

সে সিনেমা দেখার অভ্যাসটা আমার এখনও রয়ে গেছে। ঢাকায় নতুন  সিনেমা মুক্তি পেলে আমি সুযোগ পেলে এখনও দেখি ছোটআপু,বন্ধু বান্ধব,কলিগদের সাথে।ছোটআপুর মেয়ে বৃষ্টি আমাদের প্রতি মাসে একটা করে ছবি স্পসর করে। ভাল খারাপ সবই দেখি।

খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে? বিনোদনের জায়গা কোথায়?

করোনা ভাইরাসের ভয়ে ঘরে বসে অনেক ছবি দেখছি। আবার শবর, ফড়িং, শুভ মহরত, একযে আছে রাজকন্যা আরোহন,মহা নায়িকা, পিপড়াবিদ্যা.  ন ডরাই,রবিবার, কন্ঠ। আমার এক অতিপ্রিয় বন্ধু আমাকে ছবিগুলোর নাম পাঠায়।

অসাধারণং এত সুন্দর কাহিনি বিন্যাস। সে আমার মতন সিনেমাপ্রেমী। আপনারা দেখতে চাইলে আমার কাছ থেকে নাম নিতে পারেন।

কলেজ !

একটু বড় হবার পর ভ্যানে করে কলেজে যাওয়া, রিক্সায় যাওয়া,কোনটা আগে যেতে পারে? পাল্লা দেওয়া।

পাড়ার সেই ছেলেটা যে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। অকারণে সামনে দিয়ে গিয়ে শিস দিয়ে গাইতো,

দাদা পায়ে পড়ি রে মেলা থেকে বউ এনে দে

ওগো নিরুপমা করিও ক্ষমা

কোথায় সে? বেঁচে আছেতো?

ভারতীয় নাটকের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। বৃহস্পতিবার, শনিবারে নাটক,সোমবার শনিবারে অনুরোধের আসর।রেডি ওতে দূবার, হাবিবুর রহমান জালালের সৈনিক ভাইদের জন্যে, শফি কামালের উপস্থাপনায়,মহানগর,বশির সাহেবের সংসার।

অনুরোধের আসরে নাম পাঠাতাম।সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম। কখন জানি বলবে,নড়াইল থেকে হ্যাপী লাভলী, টুনু।

 পুরানো দিনের গান! 

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে হয়ে গেছি তারা। মনে হতো সত্যি সত্যিই বোধহয় তারা হয়ে গেছি।

আমার বলার কিছু ছিল না

চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে

মনে হত সত্যি কেউ চলে গেছে

অথচ বাস্তবে তার অস্তিত্বই ছিল না

কতকাল দেখিনি তোমায়

আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়

কত কালজয়ী গান। শম্ভু মিত্র,তৃপ্তি মিত্র শাওলী মিত্রের নাটক,দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের আবৃত্তির গলা,খবর পড়া আজও যেন কানে শুনতে পাই।

ভাই বোনদের সাথে মারামারি করে বই পড়া। ছোট থাকার কারণ সবার পরে বইটি পড়ার সুযোগ আমার হতো। বাড়িতে বই পড়ার পাঠ্যাভাস ছিল। মা খুবই বই পড়তেন। লুকিয়ে লুকিয়ে দস্যু বনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানা পড়ার আনন্দই ছিল আলাদা।

ধরা পড়ে গেলে ছোটদার কানমলা, কঠিন শাসন। ইঁচড়েপাকা উপাধি পাওয়া। হায়রে! শৈশব! দাদাদের জন্য ছাদে দাড়াতে পারিনি। প্রেমতো দূরের কথা।

বড় হবার পর একদিন মেজদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদা এত শাসন কেন করতে? দাদা হেসে উওর দিয়েছিল, সেজন্যইতো মানুষ হয়েছিস। নাহলে তো কোন দোকানদারের সাথে ভেগে যেতি।

সত্যি সত্যিই তাই কত কত বন্ধু বান্ধব ভুল করে কোথায় হারিয়ে গেছে।

ও বই পড়ার কথা বলছিলাম। কত অল্প বয়সে সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু, বিমল মিত্রের বই পড়েছি। কড়ি দিয়ে কিনলাম পড়ে রাতের পর রাত জেগেছি। নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেবের জন্য আজও কষ্ট হয়। আর একটু বড় হলে, কালবেলা, কালপুরুষ, মাধুকরী, মানবজমীন, কাগজের বউ, রবীন্দ্রনাথ নাথের ছোটগল্প, শরৎ নজরুল সব পড়েছি।

আমার মেয়ে কি একটি বইয়ের নাম জানে? হায়রে! ভবিতব্য।

 বিকাল হলে নিয়ম করে পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম আমি আর লাভলী।

কোথায় লাভলী বন্ধু তুই?

ছোটবেলায় চালের ধাপড়া খেতে খুব ভালবাসতাম। যাকে শহুরে ভাষায় চাপাতি বলে। মনে হতো বড় হয়ে হাড়ি ভরে শুধু চালের গুড়া রেখে দেবো। আর শুধু চা খাবো। চায়ের নেশা আজও ছাড়তে পারিনি।আমার মা আপার ধারণা আমি নাকি কালো হয়েছি চায়ের কারণে।ব্যাখ্যাটা কি বিজ্ঞানসম্মত?

ও আর একটা ঘটনাও নাকি আছে। আপা আমাকে অলিভঅয়েল দিয়ে রোদে শুইয়ে রাখতেন। এটা ও আমার কালো হবার কারণ বটে। কি হাস্যকর। স্নেহ অন্ধ।

তাছাড়া মার কাছে গল্প শুনেছি,  আমাদের বারান্দায় টিনে করে কেরোসিন তেল রাখা হতো। আমি খুব ছোট তখন।  গুটি গুটি পায়ে মগ ডুবিয়ে মনের মতন করে কেরোসিন খেয়েছিলাম, গোসলও করেছিলাম। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পেট ফুলে ঢোল হয়েছিল। বাঁচবো কেউ ভাবেনি। আজও বেঁচে আছি। জীবনে বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। শোক রোগ সব সহ্য করতে হয়েছে। আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, দেখ হ্যাপী মানুষ কতটুকু সহ্য করতে পারে? যতটুকু পারে সে, ততটুকুই আল্লাহ তাকে দেন।

একে কি সহ্য করা বলে।  সীমাহীন কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা!

মাঝে মাঝে অবাক বিস্ময়ে ভাবি, কেমন করে বেঁচে আছি। এত রোগ শোক তাপ!

মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী।সে জানে নাসে কতটুকু পারে!

এই আমি কি সেই আমি?

গাছে চড়া,নদী পার, ঝাঁপিয়ে পড়া।

হায়রে! আমার দুরন্ত মেয়েবেলা।

ঈদের জামা! 

ঈদে ভাইয়া, আমাদের বড় দুলাভাই,  আমাদের দুবোনকে একই রকম জামা দিতেন। ছোট আপু কামিজ, আমি ফ্রক। বড়দা তখন সি এস পি হয়েছেন। পাকিস্তানে ট্রেনিং নিচ্ছেন।। পাকিস্তান থেকে দাদা আমাদের জন্য সাটিন, ব্রোকেড,মখমলের জামার কাপড় নিয়ে এসেছিলেন।  তখন এসব জামার কাপড় সহজলভ্য ছিল না।

আমরা খোকাদার দোকানে জামা বানাতাম  অতীব গোপনে। পাছে কেউ আমাদের জামার কাপড় দেখে ফেলে। যদি পারুল শিরীন জানে।বানিয়ে ফেলে যদি। কি ভীষণ সতর্কতা।

কি হাস্যকর! অথচ কি মজার দিনগুলো।

কি ছেলেমানুষী!

আচ্ছা খোকাদা কি বেঁচে আছেন? খোকাদার জন্য মায়া লাগছে।

কেন সবার জন্য মন পুড়ছে?

চুলকাটা !

নদীর ওপার থেকে চুল কাটতে আসতো এক কাকা। নামটা মনে পড়ছে না। মনে পড়া উচিত ছিল। স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কি?

জলচৌকিতে বসে সারিবদ্ধভাবে সবার চুল কাটতো। ছোটআপু,দাদারা,আব্বা। আমার চুল ছোট করে কাটতো।আমি ডাট দিতে চাইতাম সেই ছোট বয়সে।শোনা হতো না। জোর করে কাটানো হত। যত ছোট করে কাটবো তত নাকি চুল বড় হবে। আর টগবগ করে ঘোড়ায় চড়ে রাজার কুমার আসবে।

তাহলে চুল এতদিন কত লম্বা হবার কথা।

টগবগ টগবগ করে তো কোন রাজার কুমার আসেনি।

মনে পড়ছে কোরবান কাকার কথা। রোজার সময় সেহেরীতে মানুষজনকে ডাকতেন।

কি সুমধুর কন্ঠ

জাগো, খোদার দোস্ত পেয়ারা, জাগো

ঘুমের গোরে আছো যারা

আড়াইটা বেজে গেছে,  জাগো

কি আনন্দময় রোজা। ফুঁ দিয়ে গরম ভাত খাওয়া।

সকালে উঠেই  বলতাম, মা,খিদে। আব্বা বলতেন, চেষ্টা করো হ্যাপু।

মা বলতেন, থাক ওরকম করবেন না। ওর আজকে চারটা রোজা হবে। শেষ রাত, সকাল,  দুপুর, রাত। রোজা রেখে পানিতে ডুব দিয়ে থাকা, ঘন ঘন কুলি করা, কখনও পানি খেয়ে ফেলা। কি কঠিন রোজা রাখা।

কি দুঃসহ!

হায়রে শৈশব!

ম্যাজিট্রেট বড়দা নড়ালে আসলে আমাদের দুবোনকে নিয়ে পাখি মারতে যেতেন। আমরা দুবোন অধীরভাবে অপেক্ষা করতাম কখন পাখি পড়বে।

বড়দার তখন পিরোজপুরে পোষ্টিং। আমি আর মা বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি তখন খুব ছোট। বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছিলাম।  বড়দা সকালে বিছানা ভেজা দেখেে বল্ল, কিভাবে ভিজলো। মা বললেন, পানি পড়েছে। মা, বড়দা মুচকি হেসেছিলেন।

আমি ছোটবেলায় খুব ভয় পেতাম। রাতে পুকুর পাড়ের গাছের দিকে তাকাতে পারতাম না। কি যেন অদৃশ্য ভয়। একবারতো একজন  মাকে বলল, আপনার মেয়ের জ্বিনের আছর আছে।

সত্যি সত্যিই কি তাই?

সে ভয়টা আমার এখনও আছে। একা থাকতে পারি না, একা শুতে পারি না, অন্ধকারে থাকতে পারি না। কেউ বাসায় না থাকলে সারা বাড়ির লাইট জ্বালিয়ে রাখি।

একটা মজার ব্যাপার, আমার মেয়ের যখন চার বছর বয়স।  তখন একদিন বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। আমার অতটুকু মেয়ে বলে কিনা, মা ভয় পেও না।আমি আততিতি।

ছোটবেলা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে মানুষ হয়েছি। লেখালেখি,কবিতা আবৃত্তি, রম্যরচনা, রচনা প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতায়  পুরস্কারগুলো আমাদের বাড়িতে বেশি আসতো। এত এত বই পেতাম।

বড়দা শহীদ হবার পর বাড়িতে একটা লাইব্রেরি করা হয়েছিলো। মিজান স্মৃতি পাঠাগার।

একটা বড় স্মৃতি রোমন্থন করতে ভুলে গেছি। কত কত স্মৃতি। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি। লিখতে গেলে হয়ত মহাকাব্য হয়ে যাবে।

তবুও অনেক লিখেছি।

যে বিষয়ে লিখবো সেটা ছোটআপু লিখেছে তার লেখায়।

চড়ুই !

বাড়ির কড়ি বরগায় ঘর বাধতো অজস্র চড়ুই। সারাদিন কিচির মিচির, খড় কুটো ফেলা। আর ঘন্টায় ঘন্টায় তা পরিস্কার করা। তবে সত্যি যদি একদিন তাদের কলরব কম হতো মা বলতেন, পাখিরা গেল কই? মাঝে মাঝে চড়ুই- এর বাচ্চা পড়ে যেত। মা পরম যত্নে তুলে দিতেন। কতবার চড়ুই পড়ে মরে গিয়েছে, কখনো পড়ে কখনো ফ্যানে বাড়ি খেয়ে। আমরা মন খারাপ করতাম। মনে হত কত আপন একজনকে হারালাম। তারপর যথাযোগ্য মর্যাদায় তাকে কবর দেয়া হতো। ওরা তো আমাদেরই পরিবারের অংশ ছিল।

আমাদের পুকুর পাড় ছিল অভয়ারণ্যে। শিমূল গাছে অজস্র পাখি বসে থাকতো বড় নিরাপদে। বুলবুলি, টিয়া,দোয়েল, শালিক কত না পাখি। কতকাল মাছরাঙা , কাঠঠোকরা দেখিনি।

হায়রে! আমার মেয়েবেলা

আর আজ মানুষে মানুষে হিংসা,অহংকার।

কিসের এত বাহাদুরি? এত দাম্ভিকতা? সামান্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবানুর কাছে জিম্মি।

হায়রে! সৃষ্টির সেরা জীব

জীবনের একি পরাজয়! মানুষ যে কত অসহায়।

মনে পড়ে, স্মৃতি জাগানিয়া পাখিরা মনে করিয়ে দেয়। আমার শৈশব, আমার মা,আব্বা, বড়দা,আপা আমাদের নড়াল,আমার চিত্রা নদী,শহীদ মিজান সড়ক,আমার স্কুল কলেজ, বন্ধু বান্ধব, আত্মাীয় স্বজন, প্রতিবেশি, রুবিআপা রেবাখালাম্মা, মিরাখালাম্মা, পারুল শিরীন।

কোর্টের বারান্দায় সেই পাগল লোকটার কথা। যে শুধু বলতো,

হাতে নেই পয়সা করি,মনে হয় বিয়ে করি

হাতে নেই পয়সা কড়ি,  মনে হয় তামুক খাই

এ দুটো ব্যাপার খুব ভাল বুঝতো।

মনে পড়ে বাসায় একজন বুড়ো ফকির আসতো। ভাত চাইতো না, বলতো পয়সা দাও, সোডা কিনে খাবো। পেটে ব্যাথা।

সোডায় কি পেটে ব্যথা কমে? জানা নেই।

আপা, আমার বাল্যবন্ধুরা,আমার শিক্ষক যাদের নিয়ে কেটেছে আমার দুরন্ত শৈশব তাদের কথা মনে পড়ে।

এ জীবনে কত মানুষের সাথে উঠা বসা। কত মানুষের সাথে সখ্য। কত আপনজনকে হারালাম। মা, আব্বা, আপা, ভাইয়া, মন্টু ভাই, মনি মৌসুমী আমার সন্তানেরা আমার শাশুড়িমা! সবাই চলে গেছে যে যার মতন করে। বাইরের পৃথিবীতে কত মানুষের সাথে পরিচয়। কত ভালবাসাবাসি।

তারাও অনেকে চলে গেছে সূদূরে!

তাদের জন্য বড় ব্যথা পাই।

এ পৃথিবী বড় মায়ার বন্ধন।

বড় কাঁদায়। একটা বয়সে বোধহয় এমনি হয়!

সবার জন্য এত মায়া।মন সবাইকে দেখতে চায়।

যেদিন গ্যাছে তাকে কি আর ফিরে পাওয়া যায়?

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে

তাঁরার পানে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে

পুরোনো সেই দিনের কথা কেউ কি ভোলে?

নাকি ভুলা যায়? ভুলেছে কখনো কেউ?

স্মৃতির নদীতে চড়া পড়ে

জোয়ার এলে আবার প্লাবিত হয়।

করোনা আতঙ্কে দেশ ছেয়ে গেছে। বিশ্ব আজ হুমকির মুখে।

এ সময়ে আমার এই স্মৃতিকাতরতা!

আসলে এ সময়ে মনটা বড় বেশি আবেগী। কতকাল ছোটআপুকে দেখিনি, ভাইদের দেখিনি,ভাগ্নেগুলো, ভাগ্নী,ভাস্তে ভাস্তি,আত্মীয় স্বজন,চিরচেনা কলিগ। জানি না কবে দেখা হবে! মনে হয় অনন্তকাল  বসে আছি।

আজ শুধু ধোঁয়াসা!

তবুও জীবন যাচ্ছে চলে জীবনের নিয়মে।

আমি হাল ছাড়িনি।

হাল ছেড়ো না বন্ধু

ছেড়েছো তো অনেক পুরানো অভ্যাস।

বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে

দেখা হবে তোমায় আমার তরে

ছেড়েছো অনেক কিছু

পুরানো হাসিটা ছেড়ো না বন্ধু

হাল ছেড়োনা।

সবাই ভাল থাকবেন। অমানিশার এই দুঃসময়ে।