আমার সাতকাহন-৭ / ছন্দা দাশ
ধারাবাহিক রচনা
আমার সাতকাহন-৭ / ছন্দা দাশ
এক একদিন আমাদের অংকে মন বসে না।কিন্তু বড়দিতো ছাড় দিবে না।কি করি! ভাবতে ভাবতে খুঁজে পেতে রাজ্য ঘুরে লাল টুকটকে বরই ভরা বেতের ঝুড়ি নিয়ে বড়দির রুমের সামনে এসে বলি, বড়দি খাবে? আমাদের মধ্যে বড়দিরই তখন একা একটি পড়ার ঘর ছিল। অবশ্য আমি তখনো গণনার মধ্যে পড়ি না। সেজদিই বেশি করতো এসব। সে পড়তো খুব কম। সারাদিন ঘোরাঘুরি আর সবাইকে নাস্তানাবুদ করতে ওস্তাদ। অবশ্য সবাই ওকে পছন্দ করতো। কিন্তু মায়ের বেতের দাগ তার পিঠেই বেশি। একবার পুকুরে স্নান করতে নেমে তো উঠেই না। স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। মা তাকে ভেজা শরীরে এমন মার! দেখে আমি লুকিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিলাম। আমার সেই মা আবার রাতে আমরা ঘুমিয়ে গেলে মাথা কোলে নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে কাঁদতেন।
বড়দি বরই খেতে চাইত না প্রথমে। বলতো, খেতে পারি তবে অংকে ছাড় দেব না। দাদা বলতো, বড়দি কাল বেশি করে করবো। বড়দি কিছুতেই রাজী হয় না। বলে, মা জানলে আমাকে বকা দেবে। শেষে আবার রাজীও হয়ে যায়। সবাই মিলে নুন, ঝাল মেখে বরই খেতে খেতে গল্পে হারিয়ে যাই। বড়দি সারাজীবন খুব কম খায় কিন্তু ভোজন রসিক। ভালো ভালো রান্নার পদ হলে খাবে। মিষ্টিকুমড়ো রান্না হলে খেতে চাইত না। কিন্তু মায়ের ভয়ে না খেয়ে উপায় নেই। আমাদের ডেকে বলে শোন, মিষ্টিকুমড়ো খেয়ে লাভ নেই। কারণ এক মণ মিষ্টিকুমড়ো খেলে একফোঁটা রক্ত হয়। অথচ একপিস
মাছ বা মাংস খেলে এককাপ রক্ত হবে। আমরাও খাবার টেবিলে মিষ্টিকুমড়ো দেখলে একসাথে চেঁচিয়ে বলি, খাব না আমরা।মা অবাক! সবার কি করে হঠাৎ মিষ্টিকুমড়োয় অনীহা? শেষে বুঝতে পেরে বড়দিকে কি বলেছিলেন আজ আর আমার মনে নেই। তবে বড়দিকে কম বকা দিতেন। বড়দিকে ভোলানোর আরও একটিকৌশল ছিল আমাদের। কলেজে সারা বছরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই আছে। তখন শিল্পীরও অভাব নেই কলেজে। আমাদের বড়দিকে তখন লতা মঙ্গেশকর বলে ডাকা হত। বার্ষিক পুরস্কার অনুষ্ঠানে বড়দি এত পুরষ্কার পেত! ঝুড়ি ভরা বই নিয়ে আমরা দিদির সাথে আসতাম। কিন্তু দিদির প্রতিপক্ষ কম নয়। নটু প্রসাদ দে নামে একজন মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিল। ছয় ফুটের মত লম্বা, মুখে সব সময় স্মিত হাসির রেখা। ফিনফিনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবীতে সে যখন স্টেজে আসতো হাজার করতালিতে ফেটে পড়তো কলেজ প্রাঙ্গন। এখনো কানে বাজে তারই কণ্ঠে “তারে বলে দিও,সে যেন আসে না আমার দ্বারে এই গানটি।” এ ছাড়া মান্না দের গানগুলো কি অপূর্ব গাইত সে!তবলা বাজাতেও সে সমান পারঙ্গম। আর পূজোর সময় আরতী করতো দুহাতে,মুখে,কপালে ধুনুচী নিয়ে, কি সুন্দর নৃত্যের ভংগীমায়! এর সাথেই চলতো বড়দির প্রতিযোগিতা। কেউ কারো থেকে কম নয়। আমাদের যখন অংক করবার ইচ্ছে হতো না তখন বড়দির কাছে গিয়ে আস্তে বলতাম,
সেদিন তুমি আর নটুদার গান নিয়ে ছাত্ররা বলছিল।
বড়দি সব ফেলে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইতো সে কথা।
আমাদেরও আর পায় কে? সোজা বলে ফেলি তাহলে আজ আর অংক করবো না। এটা দাদাই বেশি করত।
দাদার প্রতি বড়দির স্নেহের পাল্লা ভারী।কারণ বড়দির স্বভাব যে মেধাবী সে যদি হাজার দোষও করে থাকে সব দোষ ক্ষমা করে দেবে। কিনতু অমনোযোগী ছাত্র বড়দির ভীষণ অপছন্দনীয়।
সেবারে কলেজে রসায়ন বিভাগে একজন নতুন অধ্যাপক এলেন। যার নাম ছিল মৃণাল দেওয়ানজী। চট্টগ্রামে সেসময় শুধুমাত্র দুটো কলেজ থাকার ফলে বাইরে থেকে ভালো ভালো অধ্যাপকেরা সব আসতেন। বেশিদিন ছিলেন না। পরে উনি কানাডায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সবাই বলতো,
উনি রসায়ন রসের মত করে ছাত্রদের খাইয়ে দেন। মৃণাল কাকুর বিশেষত্ব ছিল আমাদের কাছে সামনের তিনটে সোনার দাঁতের জন্য। হাসলেই উনার তিনটে দাঁত ঝকমক করে উঠে। আমাদের বিস্ময় দাঁত কি করে সোনার হয়! বড় হলে আমরাও এমন সোনার দাঁত করে নেব। উনি ইংরেজীর অধ্যাপক মনীন্দ্রলাল ভট্টাচার্যের কোয়ার্টারে ভাগ করে থাকেন।মনীন্দ্র কাকুর বড় মেয়ে পারুল যার
নাম। সে যেদিন প্রথম আসে সেজদি দেখা করতে যায়। কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাইরে এসেই বলে, ও বাসায় একটি মেয়ে এসেছে, ওর নাম ললিতা আলু। সাথে সাথেই তা চাউর হয়ে যায়। সে নাম আর সে ঘোচাতে পারেনি। অবশ্য রহমান কাকাবাবু তাকে দেখে বলেছিলেন রীনা নামটা মন্দ দেয়নি।সেই মৃণাল দেওয়ানজী রোজ দুধ গরম করে রেখে যান ক্লাশ শেষে খাবেন বলে।কিন্তু ফিরে এসে দেখেন দুধ তলানীতে। পারুলকে প্রশ্ন করলে বলে, বিড়ালের উৎপাত।
উপায় না দেখে উনি শেষে রান্নাঘরে তালা দিয়ে যান। পারুল তখন পেঁপের ডগা কেটে নিয়ে জানালা দিয়ে গলিয়ে দুধের পাত্র থেকে দুধ খেয়ে নেয়। মৃণাল কাকু দরজা খুলে অবাক! আবারও পারুলকে জিজ্ঞাস করলে বলে, বলেছিলাম না বিড়াল আছে খুব! মৃণাল কাকু তখন বলেন, বিড়াল খেলে তো সরসহ খাবে। সেটা কি করে পাত্রের তলায় রুটির মত করে রয়ে গেছে? এ কোন বিড়াল বুঝতে পেরেছি।শেষে উনি উনার বোনকে নিয়ে আসেন।বোনের নাম কামনা।সেজদির বয়সী।সারাদিন
সেজদির সাথে সাথে থাকে। একদিন সেজদির সাথে বড়শি ফেলে তার বড়শীতে কাঁকড়া উঠতেই সে বড়শী ফেলে কামড়া কামড়া বলে দৌঁড়। চট্টগ্রামের লোকেরা কাঁকড়াকে বলে কঁড়া। সেও তাই শুদ্ধ করে কামড়া বলতেই নাম তার কামনা ঘুচে গেল।সেজদি সবারই একটা করে নাম দিত। যেমন পদার্থ বিজ্ঞানের ডেমনস্ট্রেটর সুখেন্দুবাবুর নাম দিয়েছিল কেঁডা ইচা (গলদা চিংড়ী)। (চলবে)
Facebook Comments Sync