আমার সাতকাহন -৬ / ছন্দা দাশ

আমার সাতকাহন 11

আমার সাতকাহন

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা

আমার সাতকাহন -৬ / ছন্দা দাশ

আমাদের ছোটকা পাটিগণিতে অসাধারণ। বাবাও তাই।বাবা ম্যাট্রিকে লেটার পেয়েও সাহিত্যেই ভর্তি হয়েছিলেন। সেসময়ে  ডাক্তার,ইঞ্জিনিনয়ারিং এ পড়তো কম মেধা সম্পন্ন ছাত্ররা। উচ্চমাধ্যমিকে বাবা যখন প্রথম বিভাগ পেলেন বাবার একজন বন্ধু (আওয়ামী লীগ নেতা) তৃতীয় বিভাগ পেলে বন্ধুরা বললো,  কি আর করবি তুই মেডিকেলেই ভর্তি হয়ে যা। ওদের তো তখন বলা হতো half educated. কিন্তু পরবর্তিতে তো সেই ডাক্তার একনামে পরিচিত। যশ, খ্যাতিতে রমরমা অবস্থা তার।

ছোটকা যখনই যাকে পেতেন পাটিগণিত করতে দিতেন। আমরা আবার সবাই উল্টো। বীজগণিতই আমাদের সোজা ছিল। একমাত্র বড়দি ছাড়া। বড়দি তো সব্যসাচী। দাদাকেই বেশি বলতেন ছোটকা। আর দাদা ছোটকাকে দেখলেই বীজগণিত খুলে বসতো। ছোটকা দূর থেকে  দেখেই পিছুটান নিতেন। একবার আমাদের সবচে শাান্ত বোন ছোড়দিকে পাকড়াও করে ছোটকা আমাকে ডেকে বললেন,  “ছন্দা যাও কৃষ্ণার কান টেনে দাও।” আমি তো ভ্যাবাচেকা। কি যে করি! ভাগ্যি ভালো বাবা এসে সে যাত্রায়  রক্ষা করেছিলেন আমাক। যে দিন আমরা পুকুরে বড়শি ফেলে মাছ ধরতাম সেদিনের আনন্দই ছিল আলাদা! আমাদের সবার মধ্যে সেজদিই সবচে বেশি মাছ ধরতে পারতো। ওর হাতে যে কি ছিল!  আমি শুধু পুঁটিই ধরতে পারতাম। সেজদি রুই,কাতল সব মাছ নিমেষেই ধরতো। এক একদিন ঝাঁকি ভরে যায় মাছে। আটার গুলি,ভাত,কেঁচো গেঁথে আমরা বড়শি ফেলি। এসব কিছু যোগান করে দিত আকাশ, লক্ষণ  নামে পাশের গ্রামের সমবয়সী ছেলেগুলো।

কোন কোন সকালে আমাদের মা বাইরে যেতে দিতেন না। ঘরের একটি রুমে আমাকে আর ছোটভাই বাবুর একহাতে রশি বেঁধে জানালার শিকে আটকে দিতেন। দরজাও বাইরে থেকে আটকে দিতেন। আমরা দু ভাইবোন বসে বসে রাজ্যের গল্প করি আর বাইরে যাদের দেখি

ডেকে ডেকে গল্প করি। কখনো কল্পনার রাজ্যে নিজেকে অমল,কখনো মায়ের খোকা হয়ে যেতে ভালোবাসি। বাইরে ঘাস কাটতে আসা পাড়ার ছেলের দলও আমাদের সাথে গল্প করতে বসে টোপা কুল,তেঁতুল,আমের গুটি দেয় জানালা দিয়ে। আমাদের সময়ে এই  মেলামেশায় শ্রেণি বৈষম্য দেখিনি। এখন আর তা দেখতে পাই না। একটু যখন বড় হলাম তখন আর হাত না বেঁধে খাতা পেন্সিল দিয়ে আদেশ দিতেন,  দশ পাতা বাংলা আর দশ পাতা ইংরেজীতে মুক্তোর মত করে লিখে রাখতে। আমরা সব ভাই বোন পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্কুলে ভর্তি হই। তার আগ পর্যন্ত মা বাসায় পড়াতেন। তাতে আমরা কম বয়সেই এস,এস,সি পাশ করে যাই। দাদা তো মাত্র তের বছর বয়সে পাশ করে ম্যাট্রিক। সিক্সে ভর্তি হয়ে সে কিছু বোঝে না। লিঙ্গান্তর কি জানে না। চিরকালের দুষ্ট সেজদি শিখিয়ে দিল, “ ও একেবার সোজা পড়তে হয় নাকি!” যাই আসুক দেখার দরকার নেই। লিখবি পাতা/পাতি,গাছ/গাছি,মাছ/মাছি।

বেচারা আমার এতটুকু দাদা সেজদির কথামতো তাই লিখে কম নাম্বার পেয়ে পাশ করলো। পরের বছর থেকে সে ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিল বরাবর। মাকে আমরা সবাই বাঘের মত ভয় করি। বাবা কখনও চোখ বড় করে তাকিয়েছেন তাও নেই স্মৃতিতে। শুধু একবার একটি অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলেছিলেন, “আমার বিশ্বাস ছিল তুমি একটি আদর্শ  অনুসরণ করে চলো “ বাবার

ঐ একটিমাত্র বাক্যে আমি আর কখনো অন্যায় করতে পারি না। শুধু তো বাবাই নয় এরপর বড়দিও উপদেশমূলক জ্ঞান দিয়ে দিতেন। যেমন মহাত্মা গান্ধীর ছোটবেলার গল্পটি বলে বোঝাতেন। ছোটবেলায় উনি স্কুলের সহপাঠীদের পেন্সিল চুরি করতেন। স্কুল থেকে অভিযোগ

এলো তাঁর বিরুদ্ধে। গান্ধীজির বাবা ছেলেকে কিছুই বললেন না।শিশু গান্ধীজি উঁকি দিয়ে দেখেন বাবার দ ‘চোখ বেয়ে জলের ধারা। সেদিন থেকে গান্ধীজি আর কোনদিন অন্যায়ের পথে পা বাড়াননি। বড়দি বললেন, “বাবার মনে দুঃখ দিলে ঠাকুর বাবার আয়ু কমিয়ে দেয়।” আমরা প্রতিবাদহীন হয়ে তাই গ্রহণ করে চলি।

স্মৃতি সতত সুখের। কিন্তু আমার সুখের গীত গাইতে গিয়ে  আমি অন্যের কতটুকু বিরক্তিভাজন হচ্ছি জানা নেই। আমার চোখের সামনে সেলুলয়েডের ফিতার মত স্মৃতিরা যখন ভীড় জমায় নিজেকে সংযত করা কঠিন হয়। মনে হয়, আমার সুখটুকু কারো সাথে শেয়ার করি। আমাদের সময়ে প্রত্যেক মানুষই এক একটি চরিত্র। প্রত্যেক জনকে নিয়েই কিছু না কিছু লেখা যায়। যা বর্তমান সময়ে আমি দেখি না। এখন যেন প্রত্যেক মানুষের চরিত্র একই বা কোন চরিত্রই

নেই একমাত্র উপরে উঠার সিঁড়িটির অনুসন্ধান করা ছাড়া। 

সেই যে ঘর থেকে বের হলেই মাঠের সীমানায় যে বিশাল রেইনট্রি গাছ তার নীচে যে লোকটি লাঠি হাতে দঁড়িয়ে সে পাগল। আকাশকে তার ছাত্র বানিয়ে অনবরত ইংরেজি পড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরম বিস্ময় পাগল কি করে ইংরেজি বলতে পারে? আমরা তার সামনে গেলেই হেসে বলবে Good morning, How r u? ইত্যাদি। তার জন্য আমাদের খুব দুঃখ হতো! কিন্ত আমার এটাই বিস্ময় তার সন্তানদের পড়বার সবটুকু সাহায্য কলেজের অধ্যাপকেরা করেছিলেন । পরবর্তিতে তার মেয়েরা সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা হয়েছিল। এমনকি তার মেয়েদের বিয়ের সাহায্যও বাবারা করে দিতেন। এখন আমরা সমাজের এসব উন্নতির কথা কি ভাবি?

আমাদের বাসায় মামা,কাকুরা আসলে চাঁদের হাট বসতো। কাকুরা সবাই মাছ ধরতে ওস্তাদ আর মা পাকা রাঁধুনী। যেদিন বিশাল মাছ ধরা পড়তো সেদিন বাসায় মহাযজ্ঞ। মামাবাড়ির বড় বড় দিঘীতে বিশাল রুই ঘাই মারতো যখন তখন।কাকুরা কখনো যেতেন বড়শি নিয়ে সেখানে।বিকেলে সবাই লাইন দিয়ে পাত পেড়ে বসে মুড়োঘন্ট, মাছের কালিয়া দিয়ে ভাত যেন অমৃত! তারপর গানের আসর তো ছিলই। দিদি,মামা কখনো লুডো নিয়ে সে কি উল্লাস! আমরা তখন এতছোট ধর্তব্যের মধ্যে পড়ি  না। আমার বড় মামা অজিত লালা এত মেধাবী ছিলেন স্কুলে মাত্র দু বছর পড়েছিলেন। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়ে ডাবল প্রমোশনে অষ্টম শ্রেণি আর তারপর ডাবল প্রমোশনে দশম শ্রেণিতে। ম্যাট্রিকে মেধা তালিকায় দিত্বীয় স্থানে। তারপরই মামা ঘর থেকে বেরিয়ে বোহেমিয়ান জীবন বেছে নেন। কোথায় কোথায় চলে যান। আবার হঠাৎ কোন মধ্যরাতে উপস্থিত। এখন আমার মনে হয়, বেশ করেছেন মামা। নিজের ইচ্ছেটাকে মরে যেতে দেননি। এ সবাই পারে না। 

(চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ
%d bloggers like this: