চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি

চন্দনের গন্ধ 14,15

চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি

 

পর্ব ৯

কিছু সময় থেকে চোখ মুছে ঘরে যায় নয়ন। নয়নের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর গতরাতের কথা মনে পড়ে। গতরাতে ঘুম হচ্ছিল না। ওর মাঝেমধ্যেই এমন ঘুম হয় না। যখন ঘুম

হচ্ছিল না তখন নয়নের জীবনটা প্রদক্ষিণ করেছে তিসু। দেখতে পেয়েছে নয়নের জীবনমাঠে বিষণ্ন শফিকের সম্মুখে অশ্রুপ্লুত নয়ন। অশ্রুময়ী নয়নকে দেখার পর থেকেই তিসুর মন খারাপ। নয়ন খুব ভালো মেয়ে। লক্ষ্মীমন্ত যাকে বলে। এত ভালো মেয়ে অথচ বাবার পছন্দের এই বিয়ের জন্য সারাটা জীবন ও কষ্ট পাবে। কিন্তু ওর করার কিছু নেই। নয়নকে বলেছে, বাবাকে বলবে কিন্তু জানে তিসু, ওর শ্বশুর মশাই কিছুতেই মানবেন না। ওর বা ওদের কারো কথাই শুনবেন না তিনি। তবে মাকে বলে দেখতে পারে। মা যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু করতে পারে।

তিসুর মন খুব খারাপ। লাইব্রেরীতে যেতে ইচ্ছা করছে। মন খারাপ হলেই লাইব্রেরীতে যেতে ইচ্ছা করে ওর। ঐ ঘরে ঢুকলেই অদ্ভুত রকমের এক সুরের আবহ তৈরি হয়! হিমহিম তন্দ্রা আসে। অদ্ভুত রকমের স্বপ্ন দেখে। তবে সব স্বপ্নই সুন্দর, বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। তিসু পায়ে পায়ে লাইব্রেরীতে ঢোকে। পনেরো দিন পর এই ঘরে এল তিসু। এই ঘরে না আসলেও রোজ সেলিমের মা ঝাড়পোছ করে, গোছগাছ করে। তিসু ইজিচেয়ারে বসে। ওর চোখ ভরে ঘুম নেমে আসে।

অফিস ফেরত তিমির তিসুকে না পেয়ে ওর মায়ের ঘরে আছে কিনা দেখতে যাচ্ছিল, সামনে নয়নকে দেখতে পেয়ে ওর কাছেই তিসুর কথা জিজ্ঞেস করে।

 

‘তোর ভাবী কোথায় আঁখিমণি?’ নয়ন হাত তুলে লাইব্রেরী দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘ঐ দিকে যেতে দেখেছিলাম।’

লাইব্রেরী ঘরের ভেজানো পাল্লা একটু ফাঁক করে তিমির অবাক! কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে তিমির। তিসু নাচছে; অপূর্ব সে নাচ। তিসু যে নাচতে পারে তা কখনও শোনেনি; নাচতেও দেখেনি কখনও! তিমির নৃত্যরত তিসুকে দেখল। এ তিসু যেন এই পৃথিবীর কেউ নয়। ও যেন

অন্যযুগের অন্যকালের মেয়ে। তিসু নয় ও যেন অন্য কোন নারী। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়েছিল তিমির নিজেও জানে না। হবে পাঁচ-সাত-পনেরো-দশ মিনিট। তিমিরের অবাক চোখের সামনে

আরো অবাক ঘটনা ঘটে। নাচতে নাচতে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে থাকে তিসু। কাঁদতে কাঁদতে কাউকে বলছে, ‘তুমি যাও, আর না, আর না! তুমি যাও।’ তিমির কাউকে দেখতে পেল না ঘরে; ঘরের ভেতর কেউ কোথাও নেই! অথচ তিসু কথা বলছে এমনভাবে যেন সামনে কেউ আছে!

কান্নার গমকে ফুলেফুলে উঠছে তিসুর শরীর। কেমন যেন অর্ধচেতন ভাব ওর চোখেমুখে খেলা করছে। তিমির কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব কাটিয়ে একছুটে দুহাত বাড়িয়ে তিসুকে বুকে নিতেই চেতনা হারিয়ে ওর হাতের পরে এলিয়ে পড়ে তিসু। তিসুকে ইজিচেয়ারটাতে শুইয়ে

বাইরে এসে চিৎকার করে ডাকে সকলকে।

‘মা, নয়ন তোমরা কোথায় শীগগির এস। তিসুর কী যেন হয়েছে।’ তারপর ঘরের ভেতর গিয়ে পানির ছিটা দেয় চোখে মুখে। হাত-পা ঘষে দেয়। তিসুর চেতনা ফিরে আসে। নয়ন টেলিফোন করেছে ওদের পারিবারিক ডাক্তারকে। ডাক্তার তিমিরের বাবার বন্ধু। নাম কবীর হোসেন। পসার ভালো।

তিনি এসে দেখলেন তিসুকে। তারপর হেসে বললেন, ‘ভাবী, সুখবর, মিষ্টি খাওয়ান।’

তিমিরের উদ্বেগাপ্লুত চোখে অবাক দৃষ্টি! ডাক্তার তিমিরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এখনও দাঁড়িয়ে আছো। দেখছ কী! মিষ্টি খাব, মিষ্টি। আমি, তোমার বাবা, তোমার মা, আমরা দাদু, দিদা হবো। আর তোমরা হবে বাবা-মা।’ বলে হা-হা- হাসিতে বাড়ি মাতিয়ে দিলেন। যেন খুব

বড়ো একটা রসিকতা করেছেন!

ডাক্তার চাচাকে নিয়ে ড্রইংরূমে আসে তিমির। একটু আগের ঘটনাগুলো বলবে কি বলবে না ভেবে ইতস্তত: করে। ওর এই ভাব দেখে ডাক্তার বলে, ‘তুমি কী কিছু বলবে তিমির বাবা?’

‘জী।’ তারপর যা দেখেছে সব খুলে বলে সেইসঙ্গে তিসু যে কোনদিন নাচ শেখেনি, নাচতে জানে না তাও বলে। তিমিরের সব কথা শুনে ডাক্তার চিন্তিত হয়। একটু চিন্তা করে একটা কার্ড বের করে দিয়ে বলে, ‘এই কার্ডটা রাখ। আর এখানে যে ডাক্তারের ঠিকানা লেখা আছে ঐ

ঠিকানায় চলে যেয়ো। খুব ভালো সাইক্রিয়াস্টিক। আমার কথা বলো। ডাক্তার না দেখালে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।’ ডাক্তারের কথা শুনে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে তিমিরের চোখে-মুখে। ডাক্তার ওর

দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কোন চিন্তা নেই বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে। কোন অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিয়ো আর একজন ভালো গাইনি-ডাক্তারের সঙ্গে চেক-আপে রাখবে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত। আমি আসি।’

রাতে খাবার টেবিলে দিনে দেখা সব ঘটনা বলে তিমির। সব শুনে অবাক হয় তিসু। চোখ বড়ো করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তিমির, স্ত্রীকে আদর করে। চুলের গন্ধ নেয়; হাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ‘তুমি নাচ জানো তা তো কখনও বলনি। এত সুন্দর নাচ কোথা থেকে শিখলে বল তো!’

‘আমি নেচেছি!’ তিসু নিজেই অবাক।

‘হ্যাঁ। নেচেছ। খুব সুন্দর নেচেছ। আর শুধু কি নাচ। নাচতে নাচতে কাকে যেন বললে, আর না, আর না।’

‘কাকে বলেছি? ধ্যাৎ, আমার তো কিছুই মনে নেই! ওখানে কে ছিল দেখেছ তুমি।’

‘কাকে কী বলেছ তা তো তুমিই বলতে পারবে। আমি কি বলতে পারব! আমি তো তো শুধু তোমাকে দেখেছি, আর কাউকে দেখিনি। কে ছিল তা তোমার জানার কথা, আমার নয়!’ এই কথা শোনার পর তিসুর সব কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু সত্য কথাগুলো তিমিরকে বলতে পারে না,

পারবে না কখনও। সব সত্যি বললে অনেক অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এমন কাজ তো কখনও করতে পারবে না সেটা খুব ভালো করে জানে তিসু।

‘আমি কথা বললাম, নাচলাম! তুমি দেখলে!’ কথাগুলো বলে চুপ করে যায় তিসু। তিমির ওর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে। তিসু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝছি না, বুঝতে পারি না। এর আগেও একদিন নয়ন আমাকে বলেছিল, কিন্তু আমার মনে পড়ে না।’

‘তুমি এর আগেও এরকম হয়েছে, তুমি নেচেছ?’

‘হ্যাঁ, একবার।’

তিসু সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ওর মনে পড়ে গেল এসব কথা বলা নিষেধ। কথায় কথায় সত্যি কথাটা বেরিয়ে আসতে পারে। তিসু কথা চেপে রাখতে পারে না কখনও। তিমিরের আরও কিছু প্রশ্ন করার ছিল, কিন্তু তিসুর অনীহা দেখে চুপ করে গেল তিমির। তিসু

ঘুমিয়েছে কি ঘুমায়নি বুঝতে পারল না তিমির কিন্তু ওর সারারাত ঘুম এল না। মাঝেমধ্যে কেন যে এমন ব্যবহার করে তিসু তা ভেবে পায় না তিমির। তিসুকে ভাবতে ভাবতে শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্রামতো এসেছে।  ঠিক তখনই তিসুর চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় তিমিরের। তিসু

কাঁদছে। কেন কাঁদছে তিসু কিছুই বুঝতে পারে না তিমির। জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর পায় না তিমির। অথচ ওর কান্না বিষণ্ন আর অবসাদগ্রস্থ করে দেয় তিমিরকে।

বেশ কয়েকদির পর আজকের সকালটা একটু অন্যরকম লাগে তিমিরের কাছে। আজ সকালে সেই প্রথমদিকে যেমন ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলতো তেমনি তিসু আজ ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে ওকে। অথচ কয়েকদিন ওর সস্মুখেই আসছিল না তিসু। আর রোজ রাতের সেই

কান্নাকাটি আর চিৎকার। আজ চোখ মেলতেই তিসুকে দেখতে পেল। ভোরে স্নান সেরেছে।

মাথার ঘন কালো চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দিয়েছে। সাদা পাড়ের বেগুনি রঙের শাড়ি পড়েছে। আর কপালে বেগুনি টিপ। স্নিগ্ধ- রূপবতী রাজকন্যার মতো লাগছে ওকে। ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরতে

ইচ্ছা করে তিমিরের। তিসুকে দেখে খুব ভালো লাগছে, খুব…খুউব! ওর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে তিসু। এই হাসির মাঝে সেই পুরানো তিসুকে খুঁজে পেল তিমির।

‘কোথাও বেরুচ্ছ নাকি?’

‘না, জনাব, আমি বেরুচ্ছি না, তুমিও না।’ বলে ওর মাথার কাছে বসে পড়ে।

‘আমি যে বেরুব না, আজ কি আমার ছুটির দিন?’ তিসুর কথাকে ঠাট্টা ভেবে বলে তিমির।

কিন্তু তিসু এবারে ঠাট্টার ছলে কথা বলে না। ও বলে, ‘আজ তোমার অফিস আছে কিন্তু অফিস যাচ্ছ না।’

‘কেন যাব না বলো?’ আজ যে অফিসে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।’ তিসু ওর কথায় ধারেকাছে না গিয়ে চুলের ভেতর হাত দিয়ে বলে, ‘তোমার চুলগুলো খুব সফট, কচি ঘাসের মতো নরম।’

‘তাই-ই বুঝি!’

‘হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আবার তোমার চুল থেকে চন্দনের গন্ধ বের হয়।’

‘কি বলছ, আমি তো পাই না।’

‘তুমি না পেলে কি হবে, আমি পাই।’ তিমিরের চুলের গন্ধ নেয় তিসু। তারপর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে খিলখিল করে ছেলেমানুষের মতো হাসতে থাকে তিসু। ওর এই হাসিমুখ অনেকদিন দেখেনি তিমির। ও হাসে না, এখন শুধুই কাঁদে। মনের মধ্যে আক্ষেপ ছিল, হাসি ভুলে

গেছে তিসু। ওকে হাসতে দেখে খুব ভালো লাগছে তিমিরের। বলে, ‘আরে কী হলো। এমন হাসলে কিন্তু ভোর-সকাল মানবো না…।’ চুপ করে বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তিমির। কিছুক্ষণ ওকে হাসতে দিয়ে বলে, ‘হাসছ কেন বলো তো।’

‘এমনি। ওঠ ওঠ ওঠ তো।’

তিমির ওঠে না বরং তিসুর কোলের ওপর একটা হাত রেখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিসু ওর দিকে তাকিয়ে কপট রাগে চোখ পাকিয়ে তাকায়।

‘ওঠ চা খাব। আমাকে কি চা না খাইয়ে রাখবে!’

‘খাবে। কিন্তু সখি, আমার যে এখন উঠতে ইচ্ছা করছে না।’

‘এই না বললে, তোমার অফিস আছে। সেখানে খুব দরকারি কাজ আছে।’

‘থাক দরকারি কাজ, আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আমার যে কেবলই …।’ ওকে কথা শেষ করতে দেয়

না তিসু। স্বামীর মুখে হাত চাপা দেয় যেন কেউ ওর স্বামীর কথা শুনতে পাচ্ছে। মুখে বলে, ‘থাক আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। ওঠ তো।’ তিমির আজকের তিসুকে চিনতে পারছে না। খুব অবাক হয়েছে কিন্তু বুঝতে দিতে চাইছে না তিসুকে। ওকে বুঝতে দিতে না চাইলেও ওর মনে

বসন্তের প্রশান্ত বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। মনের উঠানে ঝকঝকে আনন্দ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অনেকদিন পর কাজলকালো মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য হেসেছে ওদের আকাশে। তিমির ওয়াসরূমে গিয়ে সাত-তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে যেন দেরি হলে পালিয়ে যাবে

আজকের এই ভালোলাগা আর ভালোবাসা। আজ সবকিছু ভালো লাগছে, এই বাড়ি, এই দিন, এই সকাল এই জীবন সব–সব ভালো লাগছে ওর। তিমির গুনগুন করে, “তোমারও কথা ভাবিতে ভাবিতে

বিভোরও হইয়াছি, সুন্দরী আমারে কইছ কি…।”

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি