চন্দনের গন্ধ / আফরোজা অদিতি

চন্দনের গন্ধ 14,15

চন্দনের গন্ধ / আফরোজা অদিতি

পর্ব ১২

 

হঠাৎ তিমিরের ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে। ঘুম ভেঙে গেল কেন বুঝতে চেষ্টা করে। একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কোন দিক থেকে শব্দটা আসছে তা বুঝতে পারছে না তিমির! ঘরে আলো নিভিয়ে শোয়ার অভ্যেস ওদের; তিসু আলো জ্বেলে ঘুমাতে পারে না! তিমির টেবিল ল্যাম্প-এর আলোতে বই পড়ে। আলো জ্বালে না যদি ঘুম ভেঙে যায় তিসুর। চোর এলো নাকি ভাবতে ভাবতে খাট থেকে নামতে গিয়ে বুঝতে পারে খাটের ওপাশ খালি। আলো জ্বালে। তিসু কোথায় গেছে!ওয়াসরূমে? কিন্তু ওয়াসরূমের আলো নেভানো আর ঘরের দরোজা ভেজানো! তাহলে, কোথায় তিসু? তিসু কি তবে… ! আর ভাবতে পারে না তিমির। অনেকদিন তিসু ভালোই ছিল। তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে দরোজা খোলে; দরোজা খুলতেই বাঁশির সুর আর নুপুরের শব্দ শুনতে পায়। চন্দনের গন্ধে ভরে গেছে বাড়ি। তাহলে আবার কি লাইব্রেরিতে? 

 

পায়ে  পায়ে লাইব্রেরি ঘরের সামনে দাঁড়ায় তিমির। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেজানো পাল্লা আস্তে আস্তে একটু ফাঁক করে; দেখতে এবং শুনতে পায়। তিসু দেয়ালে টাঙানো ছবিটার সামনে মাথা ঠুকছে আর বলছে, ‘না, না এভাবে আমাকে চলে যেতে বলো না। আমি উর্মিকে রেখে কোথাও যাব না।’

‘যেতে তো হবেই। আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না।’ কে কথা বলছে, কোথা থেকে বলছে তা বুঝতে পারলো না তিমির। কিন্তু কন্ঠটি পুরুষের তা বুঝতে পারলো। ঘরের ভেতর যাতে সবটুকু দেখা যায় সেই রকমভাবে দরোজা ফাঁক করে দেখতে চেষ্টা করলো, সবটুকু দেখা না গেলেও যেটুকু দেখল কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু কথা শুনতে পাচ্ছে। পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেল আবার।

‘আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না। যেতে তোমাকে হবেই।’

‘আমি যাব না, যাব না। আমি যেতে চাই না। আমি ভালোবাসি এই বাড়ি, এই বাড়ির সকলকে। আমি আমার মেয়েকে ভালোবাসি, মেয়ের বাবাকে ভালোবাসি। আমি এই সংসার ভালোবাসি। এই সংসার আমার প্রিয় থেকেও প্রিয়তর।’ তিসুর এই কথা শোনার পর একটা চড়ের শব্দ শুনতে পায় তিমির! আশ্চর্য হয়। সেদিনের কথা মনে পড়ে। যেদিন কেউ একজন বা কারও অদৃশ্য হাত চড় মেরেছিল ওকে। তিসু কাঁদছে।

‘আমাকে কেন মারছো তুমি? কেন অত্যাচার করছো? সবসময় আমার ওপর এত অত্যাচার কেন করো?’ একটানা কথা বলে একটু থামে তিসু। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুমি আমার মেয়েকে আমার কাছে থাকতে দাও। আমার স্বামীকে আমার থেকে দূরে দূরে রেখেছ। আমার সংসার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাকে দয়া করো, দয়া করো।’ তিসুর কন্ঠ ভিখেরির মতো শোনালো! তিমিরের কাছে মনে হলো তিসুর কন্ঠে রাগ, কান্না একই সঙ্গে জড়াজড়ি করে উঠে আসছে বুকের প্রত্যন্ত অঞ্চল  থেকে। তিসুর ঐ কথার পর হা-হা-হা শব্দের ঘর কাঁপানো হাসি শুনতে পায়। ঐ হাসিতে শ্রবণশক্তির কার্যক্ষমতা হারিয়ে যাবে এমন মনে হলো তিমিরের। 

‘হেসো না। হাসির কোন কথা বলিনি আমি।’ তিসুর কন্ঠের রূঢ়তা টের পেল তিমির।

‘হাসবো না, হাসবোই তো! নিছক মাটির মানুষ তুই? তোর কতটুকু শক্তি আছে বল? তুই না গেলে তোর মেয়েকে নিয়ে যাব। উর্মি তো আমার!’

‘না উর্মি তোমার নয়। উর্মি আমাদের, তিমির আর আমার, আমাদের।’

‘হোঃ, হোঃ! তুই বলবি আর আমি শুনবো।’ হিংস্র  এক বিকৃত কন্ঠ শুনতে পেল; এই কন্ঠ শুনে রীতিমতো ভয় পেলো তিমির। আর কোন কথা শুনতে পায় না তিমির। তিসুর কান্না শুনতে পায় তিমির। কাঁদছে তিসু। 

 

দুই বছর আগের কথা মনে পড়ে। 

একদিন রাতে বিছানায় মেয়েকে দেখতে না পেয়ে তিসুকে জিজ্ঞেস করে, ‘তিসু উর্মি কোথায়?’

‘উর্মি ঐ ঘরে। আজ থেকে মায়ের কাছে, মায়ের ঘরে থাকবে উর্মি।’

‘মায়ের কাছে থাকবে! থাকতে পারবে তো ঐ টুকুন মেয়ে?’ বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে তিমির।

‘পারবে।’ নির্বিকার উত্তর দেয় তিসু। 

 

সেদিন অনেকক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ওকে। বুঝতে পারে না। কোনদিন পারবে কিনা তাও জানে না। তিসু তো এমন ছিল না। ওর বোধের অগম্য ছিল না তিসু। হাসিতে খুশিতে উচ্ছল প্রাণবন্ত তারুণ্যে ভরপুর এক অতি কাছের মানুষ ছিল। এখন দিন দিন কাছের মানুষটা দূরে চলে যাচ্ছে; একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন এমন হলো? কী ঘটেছে যা জানে না তিমির। তিসু এখন ইউনিভার্সিটিতে যায় না। এমন কি বাড়ির বাইরেও নয়! আগে লেখালেখি করতো এখন তাও ছেড়ে দিয়েছে। 

কী হয়েছে ওর? আর কার সঙ্গে কথা বলে তিসু? ঐ কন্ঠস্বরই বা কার? উর্মিকে নিয়ে যাবে কে? আর নিয়ে যাবেই বা কোথায়? এত কথা ভাবতে ভাবতে চিন্তার জট পাকিয়ে যায়! বারান্দায় এসে বসে। ভালো লাগে না। তিসু কখন এসেছে টের পায়নি। ওর কথায় চমকে ওঠে তিমির।

‘আচ্ছা মানুষ তো তুমি; সেই কখন থেকে ডাকছি শুনছোই না। কী চিন্তা করছো?’ একটানা কথা বলে যায় তিসু।

‘তুমি ডাকছো, শুনিনি। প্লিজ বলো, কেন ডাকছ।’

‘একটা ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন আর ইচ্ছা করছে না।’ তিসু চলে যেতে চায়। 

তিমির আগলে থাকে পথ। বলে,‘বস। তোমাকে বলতে হবে কী হয়েছে তোমার?’ তিসু কথা না বলে ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তিমির ওর হাত ধরে বসিয়ে দেয়। বলে, ‘তুমি যেতে পারবে না। আজ তোমাকে বলতেই হবে কী হয়েছে তোমার? আমি দেখেছি তুমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলে; আমাকে দেখেও দেখলে না। আমার ডাক শুনলে না। আরও একটা কথা , তুমি কাঁদো কেন? তোমার কষ্ট কিসের? তুমি কী কোন কারণে আমাদের কাছ থেকে মানে আমি বা আমার মা-বাবা—ভাই-বোনদের কাছ থেকে কোন কষ্ট পেয়েছ? আমাকে বলো; খুলে বলো সব কথা। আমি সব শুধরে নেব। প্লিজ, তিসু। এভাবে সংসারটা নষ্ট করো না!’ তিমিরের মিনতি ভরা কন্ঠস্বর আপ্লুত করে তিসুকে‌। কিন্তু তিসু বলতে পারে না কিছু। কিছু তো বলতে পারবে না তিসু! তিসু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্বামীকে বলে, ‘ব্যাপার কী তোমার বলতো? এত কথা বলছো আমাকে। কী করেছি আমি।’

‘কিছুই করোনি তুমি? তোমার কিছুই মনে নেই হয়তো। যা করেছ নিজের অজান্তে করেছ। কারণ আমার মনে হয়েছে, মনে হয়েছেই বা বলছি কেন আমি দেখেছি তুমি একটা ঘেরের মধ্যে ছিলে। এই যে তুমি বলছো তুমি আমাকে দেখনি অথচ আমি প্রায় আধ ঘন্টা যাবত এখানেই। তুমি লাইব্রেরিতে কার সঙ্গে কথা বলছিলে জানি না। ওখান থেকে এসে ঘরে এলে তারপর চলে গেলে রান্নাঘরে। আমাকে দেখেও দেখলে না! আমি ডাকলাম শুনলে না তুমি! এরপর তুমি রান্নাঘরে কথা বলছিলে, কাঁদছিলে সবই আমি দেখেছি, শুনেছি।’  তিমিরের কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় তিসু। ‘কী বলছো তুমি! আমি কাঁদছিলাম!’

‘হ্যাঁ। কাঁদছিলে তুমি। সত্যি করে  বলো তো কী হয়েছিল তোমার। এখন তো ভালো আছো।’

‘আমার কী হবে! কিছুই্ হয়নি।’ কন্ঠে একটু জোর এনেই বলে তিসু। 

‘হয়েছে তিসু, হয়েছে। তুমি স্বীকার করো বা না করো, আমি জানি তোমার কিছু হয়েছে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে তিমির নিজের মতো করে আস্তে আস্তে কথা বলে। ‘একটা ডাক্তার দেখাতে হবে তোমায়। মানসিক ডাক্তার।’ নিজের মতো করে আস্তে আস্তে বললেও শুনে ফেলে তিসু। বলে, ‘ডাক্তার দেখাবে, তাও আবার মানসিক ডাক্তার? কেন, আমি কি পাগল?’   

‘তুমি পাগল তা কি একবারও বলেছি আমি! তোমার একটা চেক-আপ দরকার তাই বলেছি।’

‘কোন চেক-আপের দরকার নেই। আমার কোন অসুখ নেই। তুমি অযথা ব্যস্ত হয়ো না। আমার কোনই অসুখ করেনি।’ কথাগুলো বলে ঘর থেকে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ায় তিসু। 

‘তুমি শুধু শুধু রাগ করছো আমার ওপরে। আমি, তোমার জন্য ব্যস্ত হবো না তো কার জন্য হবো বলো। তুমি আর উর্মি ছাড়া কে আছে বলো তো আমার!’ তিমির হাত ধরে ওর। জোর করে কাছে টানে।

‘আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি তিসু।’ আমি আমার কথা নয়, ভাবছি তোমার আর উর্মির কথা। তোমাদের জন্যই তো এই আমি।’

তিমির চুপ করে। এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে। তিসু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই তিমির যেন এক অচেনা মানুষ। এতো আবেগপ্রবণ এই মানুষটাকে দেখেনি কখনও তিসু। তিমির বুকে চেপে ধরে রেখেছে তিসুকে। নিজেকে ছাড়াতে পারছে না তিসু। 

‘চল, চল আর বাইরে যেতে হবে না।’ বলে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় তিমির। শুইয়ে দিয়েও হাত ধরে রেখেছে তিমির। আজ ওর হলো কী? ভাবছে তিসু। এমন তো কখনও করে না। তিসু হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে। না পেরে অনুরোধ করে। 

‘হাতটা ছেড়ে দাও।’

‘হাত তো ছাড়ার জন্য ধরিনি। আজ সব শুনবো বলে ধরেছি।’

তিসু কথা বলে না। চুপ করে থাকে। কারণ ও জানে সব কথা বলা যাবে না। বলা ঠিক হবে না। কিন্তু তিমির একরোখা জিদ্দি শিশুর মতো বলেই চলেছে। ‘আমি শুনবো, সব শুনবো।’ তিমিরের এই পাগলাটে ভাব দেখে মন কেমন করে তিসুর। কিছুক্ষণ ভাবে তিসু। তারপর মনে করে যা হয় হবে, সব কথা বলে দিবে তিমিরকে। কিন্তু বলার আগে একবার অনুমতি নিতে হবে মালা দিয়েছিলেন যিনি তাঁর কাছ থেকে। কিন্তু তিনি বলেছেন, অনেকদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না! আসবেন না তিনি; কবে তিনি আসবেন তাও বলেননি। যাক যা হবার হবে, তিমিরের এমন করুণ পাগলাটে রূপ ভালো লাগছে না ওর!

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি