চন্দনের গন্ধ ৫/ আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

পর্ব ৫

বিপুল-রায়না চলে গেছে অনেকক্ষণ। এতক্ষণ বোনের কথা ভাবছিল; ওর কথা ভাবতে ভাবতে আবার  ঘুমিয়ে যায় তিসু। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না তিসু। ও স্বপ্ন দেখে; একটা সুন্দর ফুলের বাগান, সেই বাগানে সৌম্যদর্শন এক বৃদ্ধ তাঁর পরণে সাদা ফিনফিনে জোছনা রঙের

পাঞ্জাবী। তাঁর চোখে সুরমা। মুখে শুভ্র দাড়ি। বাগানের মাঝে একটি শান-বাঁধানো পুকুর ঘাট। সেই ঘাটে ওর পাশে বসে আছেন সেই বৃদ্ধ। ওর মাথায় হাতের আঙুলে বিলি কাটছেন।

তিসুর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বৃদ্ধ কথা বলছেন। তাঁর সব কথা শুনতে পাচ্ছে তিসু। তিনি খুব নরম স্বরে বলছেন, ‘আমার সব শক্তি তোকেই দেবো মা, আমার সব শক্তি!’

‘কী শক্তি বাবা?’ মন্ত্রমুগ্ধ তিসু ঐ বৃদ্ধকে বাবা ডেকে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘দেবো মা দেবো। যখন দেবো তখন বুঝতে পারবি। কিন্তু এই কথা কাউকে বলতে পারবি না। আমাকে কথা দে, কথা দে মা।’ বৃদ্ধ ওর হাত চেপে ধরে আবার বলে, ‘কথা দাও মা।’

‘কাউকে কিছু বলব না, কথা দিলাম। কিন্তু আপনি কে? আপনি আপনার সব শক্তি আমাকে কেন দিতে চাইছেন. আর আপনার শক্তিই বা কী?’

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘আমার কথা থাক, আমাকে চিনবি না। ধরে নে, আমি বাঁশিওয়ালা।’

‘আপনি …’ তিসুকে থামিয়ে দেন বৃদ্ধ। বলে, ‘কোন কথা নয়। কথা বলো না।’

তিসুর মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করে। তারপর তার গলা থেকে একটি শ্বেত পাথরের হার খুলে পরিয়ে দেয় ওকে। হারটি পরিয়ে দেওয়ার সময় বিড়বিড় করে কী মন্ত্র আওড়ালেন বৃদ্ধ তা শুনতে পেল না

তিসু। মন্ত্র পড়া শেষ হলে বৃদ্ধ বললেন, ‘এটি খুব যত্নে রেখ মা। এটিই শক্তি। আমার সব শক্তি । আমি তোমাকে দিলাম। তুমি আমার উত্তরসূরী। আমার সৃষ্টির উত্তরাধিকার আমি তোমার মধ্যে

রেখে গেলাম। এত বছর খুঁজে, এত স্থান ঘুরে আমি পেয়েছি তোমাকে। আমি সব দিলাম তোমাকে। ভালো থেক।’

জোছনাস্নাত বৃদ্ধের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল তিসুর। ঘুম ভেঙে গেলেও স্বপ্নটা পুনর্বার দেখতে চাইল তিসু।  কিন্ত দেখতে পেল না। পাবে না জানে কারণ ঘুুম ভেঙে গেলে আর স্বপ্ন দেখা যায় না; এটাই চিরাচরিত নিয়ম। তবুও কিছু কিছু স্বপ্ন থাকে যা দেখতে মন চায়; বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। তিসুর কাছে এই স্বপ্নটাও সেই রকম! ঘুম ভেঙে

গেছে, ভেঙে গেছে স্বপ্ন কিন্তু এখনও বুঝতে পারছে না তিসু, ও ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে! এটা স্বপ্ন না বাস্তব! এই স্বপ্ন সে কেন দেখল? কী অর্থ এই স্বপ্নের? কে ঐ জোছনাস্নাত বৃদ্ধ? তিনি কেনই বা ওকে তার শক্তি দিলেন? কেনই বা তিনি চলে যেতে চাইছেন? আর এই ‘শক্তি’টাই বা কী? তিসুর ভাবনার মাঝে এতসব প্রশ্নের ঘোরাফেরা চলছে; তা সত্ত্বেও উঠে বসতে চাইল কিন্তু পারল না! ওর শরীর যেন বিছানার সঙ্গে আটকে গেছে।

আবার ভেসে আসছে চন্দনের গন্ধ! বাঁশির সুর শুনতে পেল। উঠতে চেষ্টা করলো তিসু পারছে না;

ঘুমের অতলে নিমজ্জিত হতে চলেছে। এই ঘুম যেন গভীর সমুদ্র আর সেই সমুদ্রে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে তিসু। কিন্তু ঘুমালে তো চলবে না। জেগে থাকতে হবে ওকে। উঠে বসতে হবে ওকে! জোর করে উঠে বসে। এই পৃথিবী আর আগের মতো নেই। তার গতির ফলে সময়ের

বিবর্তনে অনেক এগিয়ে গেছে জীবন। যুগ পরিবর্তনে হয়েছে সভ্যতার উন্নতি আর বিকাশ।

এসেছে আণবিক-পারমাণবিক শক্তি। গ্যাসচুল্লিতে গ্যাসশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, সৌরশক্তি কতরকমের শক্তি আছে পৃথিবীতে তার ইয়াত্তা নেই। এর মাঝে ঐ বৃদ্ধ ওকে কিসের শক্তির কথা বলল, তা ভেবে পেল

না তিসু! এই ভাবনাটা ওর ঘুমের জন্য ঠিকঠাক মাথায় থিতু হতে পারছে না। এই দিনে কী এই অলৌকিকশক্তির কথা কেউ বিশ্বাস করবে! কেউ কী স্বপ্নের মাঝে কাউকে কোন জিনিস দেয় আর তা বাস্তবে দেখা যায়! তিসু আনমনা!

“আনমনা আনমনা, তোমার কাছে আমার বাণীর মাল্যখানি আনব না…” তিমিরের কথায় চমকে ওঠে তিসু। ও যে কখন ঘরে ঢুকেছে টের পায়নি।

‘কখন এলে’?

‘এই তো! আজ তাড়াতাড়ি চলে এলাম, তুমি এসেছ বলে।’ ব্রিফকেস রাখতে রাখতে বলে তিমির। তারপর বলে, ‘এত তন্ময় হয়ে কী ভাবছিলে বল তো, আমি ঘরে ঢুকলাম তুমি টেরই পেলে না!’ এই কথায় আবার চমকে ওঠে তিসু। ওর চমকে ওঠা দেখে তিমির বলে, এত কী ভাবছো যে,

বারবার চমকে উঠছো।’

‘কিছু ভাবছি না। ঘুমিয়েছিলাম তো। দেখ কি কান্ড তুমি এলে আর বুঝতেই পারলাম না, তাছাড়া এখনও বসে আছি। আমি চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করি।’

‘এত ব্যস্ততার কিছু নেই। তুমি কেন আমার এই ঘরে ঢোকাটা বুঝতে পারলে না, তাছাড়া কী এত ভাবছিলে বলতো।’

‘কই, কিছু না।’ বলে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায় তিসু। ঠিক তখনই ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে তিমির বলে, ‘আমি রাধা রাধা ভেবে মরি/ রাধা যে যায় আনবাড়ি/ যায়রে রাধা যায়রে…’ ওর সুরে সুরে কথা শুনে লজ্জারাঙা হয়ে যায় তিসু। বলে, ‘যাহ।’ স্বামীর বুকে মুখ রেখেই বলে, ‘তুমি

কেমন ছিলে? ভালো ছিলে তো?’

‘তুমি ছাড়া আমি কী করে ভালো থাকি বল।’

‘থাক আমাকে আর ভুলাতে হবে না। কথায় মন ভুলানোতে তোমার জুড়ি মেলা ভার।’

‘তাই।’ বলে ওর মুখ তুলে ধরে তিমির। ঠোঁটে ছোট একটু চুমু খায় তিমির। তিসু ওর লুঙ্গি-গামছা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘পোশাক-আশাক খুলে হাত-মুখ ধোও আমি চা করে আনছি।’ ওরা চা খেতে খেতে টুকটাক কথা বলছিল। কথা বলতে বলতে তিসুর মাথার গুমোট-ভোতা ভোতা ভাবটা চলে গেছে বুঝতে পারে তিসু। অফিস ফেরত তিমিরের একসঙ্গে দুইকাপ চা খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে। স্বামীর সঙ্গে খেতে খেতে একই অভ্যেস হয়ে গেছে ওর। নিজে আর এককাপ চা নিয়ে স্বামীর দিকে আর এককাপ চা এগিয়ে দিতেই চমক লাগল! তিমির বউয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ; তারপর বলল,‘কি সুন্দর মালা! বাবা দিয়েছে বুঝি।’

‘মালা! কোথায়?’ স্বামীর কথায় চমকে ওঠে তিসু।

‘এই তো। তোমার গলায়।’ তিসু ওর গলায় হাত দিয়ে মালা অস্তিত্ব অনুভব করে। স্বপ্নে তো এই মালা পরিয়ে দিয়েছে ঐ জোছনাস্নাত সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। কিন্তু এখন তো বাস্তবে, ঘুমে নেই;

তিসু চিমটি কাটে নিজেকে। না জেগেই আছে। মালাতে হাত রাখে তিসু। মালাতে হাত রাখতেই মনে পড়ে বৃদ্ধের শান্ত স্নিগ্ধ কথা, ‘আমার ‘শক্তি’ আমি তোমাকে দিলাম। এই মালার মধ্যে আছে সেই ‘শক্তি’। কখনও এই মালা গলা থেকে খুলবি না, আর এই ‘শক্তি’র কথা বলবি না কাউকে; এমন কি স্বামীকেও না।’ তিসু আনমনা।

‘কি হলো, মালা কিনেছ? কিনলেও তো আপত্তি নেই। তুিম কিনতেই পারো। মালার কথা জিজ্ঞেস করতেই চমকে উঠলে তুমি! এর ভেতর কি অন্য কোন ব্যাপার আছে, যা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে যাচ্ছো!’ তিমিরের কন্ঠে বিরক্তি।

‘না, না লুকাবো কেন? এই মালা কোথা থেকে এল তাই তো জানি না।’

‘এটা একটা কথা বললে, তোমার গলায় মালা আর তুমিই জানো না। তার চেয়ে বল, তুমি বলবে না!’ তিমির ব্যঙ্গ করেই বলে।

‘এভাবে কথা বলো না! আমি সত্যিই জানি না, এই মালা আমার গলায় এল কীভাবে।’ তিসু মিথ্যে বলতে পারে না। বলতে গেলে আটকে আটকে যায়। এখনও কথা বলার সময় সেইরকমই হচ্ছে।

এতে রেগে যায় তিমির।

‘কীভাবে বলব বলো। তোমার গলায় এত দামি একটা মালা ঝুলছে আর তুমি জানো না বললেই হলো। তোমার এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে বলো।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিসুর উত্তর আশা করে কিন্তু তিসু কথা বলে না। তখন তিমির আবার বলে, ‘তিসু, তুমি তো এমন ছিলে না। আমার কাছে কোন কথা লুকাতে না। তবে আজ কী হলো,

সামান্য একটা মালা কোথা থেকে পেলে সেকথা তুমি লুকাতে চাইছ।’

তিসু চুপ করে থাকে। তিমিরের কথায় খুব কষ্ট হয় ওর। এই মালার কথা তো বলতে পারবে না তিসু,বলা বারণ। কোন কথা না বলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তিসু। ওর চোখের ভাষা তিমির না বুঝলেও ভেতরে ভেতরে খুব দূর্বল হয়ে পড়ে তিমির। ওর মনে হয় তিসুর চোখের দৃষ্টি যেন ওর বুকের পাঁজর ভেদ করে বুকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ঠেকেছে। মনে মনে কী ভাবছে তা যেন বুঝতে পারছে ওর স্ত্রী। তিসু বেশকিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপ-প্লেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যায়। ওগুলো ধুতে ধুতে খুব কান্না পায়! কাঁদতে থাকে। এই এক অসুবিধা হয়েছে ওর; কান্না

পেলে কান্না চেক দিতে পারে না।

 

( চলবে)

%d bloggers like this: