চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি

চন্দনের গন্ধ 14,15

চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি

 

পর্ব ৮

বিপুল ক্রমশ ভালো হয়ে উঠছে। দূর্বল শরীর, বিছানা ছেড়ে একা একা উঠতে পারে না। রায়না ছেলের কাছে বসে থাকে সবসময়; ওকে একা রেখে কোথায়ও যায় না। রায়না ছেলেকে গল্প বলছে আর

আপেল কেটে খাওয়াচ্ছে। বিপুলের বায়না রোজ একটা করে গল্প বলতে হবে। গল্পের ভেতরও পছন্দ আছে, হতে হবে ভূতের গল্প, রাজার গল্প, যুদ্ধের গল্প। মাঝেমধ্যে ঈশপের নীতিকথামূলক গল্পগুলোও শোনায়

রায়না। ওদের গল্পের মধ্যেই ঘরে আসে তিসু।

‘এই যে বিপুমণি, কেমন আছো?’

‘ওমা, চাচি। এস, এস। আপেল খাও, আমি খাচ্ছি।’

‘এস, তিসু এস। কোথায় গিয়েছিলে, ভার্সিটি?’ ওকে দেখে রায়না ডাকে।

‘না, দিদি। ভার্সিটি নয়। নয়নের সঙ্গে নিউমার্কেট গিয়েছিলাম। নয়ন কতকগুলো শাড়ি কিনল আর টুকিটাকি কিছু।’

‘কি শাড়ি কিনেছে! আজকাল খুব শাড়ি কিনছে!’

‘ওমা, দিদি, বিয়ে বলে কথা! কিনবে না। একটা কাতান সিল্ক কিনেছে; খুব সুন্দর।’ তিসু কথা বলতে বলতে আদর করে বিপুলকে।

‘বিপুল এখন কেমন আছে দিদি? এখনও কি ভয় পাচ্ছে!’

‘না, আর ভয় পাচ্ছে না! কয়দিন তো ভালো আছে। শুধু একটু দূর্বল। তাবিজ আর পানিপড়াতে কাজ ভালোই হচ্ছে মনে হয়।’

 

রায়নার কথা শুনে তিসুর মুখের কোণে একটু হাসির আভাস জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়।

বিপুলের বিছানায় ওর পায়ের কাছে বসে তিসু।

‘এই নাও, বিপু সোনা, দেখতো পছন্দ হয় কিনা?’ একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয় বিপুলের দিকে।

‘কী আনলে আবার।’

‘একটা এক্কা গাড়ি। ঘুরতে ঘুরতে পছন্দ হলো কিনে আনলাম। আমার মনে হয় বিপুলেরও পছন্দ হবে।’

চাবি দিয়ে গাড়িটা বিপুলের বিছানায় রাখে তিসু। গাড়ি চলতে শুরু করে। গাড়ির দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছিল বিপুল আর কিছুক্ষণ পরপর ঘোড়ার ডাক ডাকছিল। গাড়ি দেখতে খুব মগ্ন হয়ে ছিল, হঠাৎ চিৎকার দিয়ে তিসুর কোলের মধ্যে ঢুকে যায় বিপুল।

‘কী হলো কী হলো?’ মা-চাচির উদ্বিগ্ন কন্ঠ।

‘ঐ যে দরোজায়!’ দরোজার দিকে আঙুল দিয়ে দেখায় কিন্তু কোল থেকে মুখ তোলে না বিপুল।

‘ও মাগো!’ আবার চিৎকার দেয় বিপুল।

‘তুমি তো মুখই তোলনি বিপুল, আবার কি দেখলে, মুখ তোল সোনা বিপু।’ তিসু দুহাত দিয়ে মুখ তুলে ধরতে চায়। কিন্তু মুখ তোলে না বিপুল।

‘না-না।’ তিসুর কোলে মুখ গুঁজে চিৎকার দেয়। কিছুতেই মুখ তোলে না বিপুল। ঐ দিন রাতে রায়না আর তুষারের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে সবার। সকলেই তুষারের ঘরে।

‘কী হয়েছে?’ বাবার প্রশ্নের জবাবে তুষার বলে, ‘বাবা, বিপুল ওর মায়ের কোলে ঘুমিয়েছিল । এখন পাওয়া যাচ্ছে না! বাড়ির কোথাও নেই।’

‘ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, এটা হয় নাকি!’ বাবা বললেন। তারপর সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। ঘরে, খাটে তলে, আলমারির পেছনে, ওয়াসরূম, রান্নাঘর, গোলাঘর, অন্য সব ঘর এমনকি বাগানে খোঁজা হলো কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। এরপর খুঁজতে খুঁজতে স্টোররূমের তাকের ওপর ঘুমন্ত পাওয়া গেল বিপুলকে। একটা মই নিয়ে ওকে নামিয়ে আনে তিমির। সকলে মিলে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। ওখানে কেমন করে গেল, কে নিয়ে গেল, কী করছিল ওখানে। নানা রকম প্রশ্ন করছিল সকলে। কিন্তু কিছুই বলতে পারছিল না বিপুল। রায়না ভয় পেয়েছে কিন্তু বিপুলের চোখে-মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন নেই! রায়না এই বাড়িতেই আর থাকবে না বলে, কোনদিকে না তাকিয়ে,কাউকে কিছু না বলে তিমিরের কোল থেকে বিপুলকে একরকম জোর করেই নিয়ে চলে গেল ঘরে।

পরদিন দুপুরে সুন্দর একজন তরুণকে ড্রয়িংরূমে বসে থাকতে দেখল নয়ন। নয়ন কথা বলতে যেতেই দেখল নেই, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পরপর কয়েকদিন এমন হতে দেখল; এই কথা কাউকে বলতে

পারল না কারণ বাড়ির থমথমে অবস্থা। কেউ প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। তাছাড়া ড্রয়িংরূমে কেউ ছিল আর কাছে যেতেই উধাও হলো এমন কথা সকলে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিবে। এর মধ্যেই বিপুল দুপুরে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঠিকা-ঝি না দেখলে

রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়তো। রায়না আরো ভীত হয়ে পড়েছে। এই বাড়িতে আর একদন্ডও থাকতে চায় না। স্বামীকে বলে, ‘বাড়ি দেখ।’ গলায় ঝাঁঝ রায়নার।

‘বাড়ি দেখব। আমার বেতন কত জানো তো! তাহলে, বাড়িভাড়া দিব কি আর খাব কি।’

‘ওসব কিছু আমি জানি না। বাড়ি দেখবে, এখান থেকে চলে যাব, ব্যাস। এখানে থাকলে আমার ছেলেটা মারা যাবে সেইসাথে আমিও।’

‘কিন্তু, চলবো কীভাবে?’

‘দেখ এই রকম কিন্তু কিন্তু করো নাতো। আমি এখানে থাকব না, থাকব না, থাকব না। তুমি আলাদা বাড়ি না নাও, আমি বাবার বাড়ি গিয়ে থাকব।’ এভাবে কথা বলতে বলতে একসময় তুষারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি চরমে পৌঁছাল। তারপর একটা-দুইটা-তিনটা দিন করতে করতে ওদের কথাই বন্ধ হয়ে গেল!

দিন দশেক পর রায়না,তুষার বিপুল চলে গেল। প্রথমে গিয়ে উঠল বাবার বাড়ি তারপর ভাড়া বাড়ি।

সকলের মন খারাপ। তিসুরও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ওরা যেদিন ভাড়া বাসায় উঠে যায় সেদিন তিসু আর নয়ন গিয়েছিল ওদের ঐ বাসাটাতে! বাসাটা খুব সুন্দর, একতলা। দক্ষিণমুখী।

একতলার ছাদ আছে। রায়নার বাবা এই বাসাটার ভাড়া দিবে বলেছে। তা না হলে, তুষারের যা বেতন তাতে বাসা ভাড়া দিলে খাওয়া-পরা চলবে না। তুষার আসতে চায়নি কিন্তু রায়নার জন্য বাধ্য হয়েছে আসতে। এখন রায়না ভালো আছে। ছাদে বাগান করবে সেই প্ল্যান করছে। তিসুরও খুব ইচ্ছে বাগান করে। শ্বশুর মশাইকে বলেছে বাগানের এককোণে একটু জায়গা দিতে যাতে বাগান করতে পারে। তিনি রাজী হয়েছেন। মাটি-টব-চারা এনেছে কিছু গাছও লাগিয়েছে। তিসু একদিন

স্বপ্ন দেখে একটি সুন্দর ফুলের বাগান, সেখানে হরেক রকম ফুল। সেই বাগানে একটি সিংহাসন; সেই সিংহাসনে রাণীর মতো বসে আছে তিসু।

রায়না বিপুল চলে যাওয়ার পর বেশিরভাগ সময় একাই থাকে তিসু। আজও ঘরে একাই। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। নয়ন কাছে আসতেই চোখ না খুলেই বলে, ‘এস ননদিনী এস। কিছু বলবে?’

নয়ন অবাক হয়।

‘আমি এসেছি তুমি জানলে কী করে!’

‘জানি, এখন বল কী বলতে এসেছিস।’ বলে শোয়া থেকে উঠে বসে তিসু।

‘না, তেমন কিছু না।’

‘কিন্তু তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু…’ হাসে তিসু।

‘ভাবী…’ বলে মুখ নিচু করে তিসু।

‘বল, এত ইতস্তত করার কিছু নেই। বলে ফেল। মনের কথা মনের মধ্যে গোপনে রাখতে নেই ভাই!’ ওর একটা হাত ধরে তিসু।

‘মনের গোপন কথা সখি, রাখিও না গোপনে।’ বলেই আবার হাসে তিসু।

‘ঠাট্টা নয় ভাবী। বাবাকে বলে বিয়েটা বন্ধ করা যায় না?’ ননদের কথা শুনে এবার অবাক হওয়ার পালা তিসুর। কিন্তু অবাক হয় না। কারণ নয়নের মনের সব কথা গতকালই বুঝতে পেরেছে। নয়ন কষ্ট পাবে বলেই বলেনি। তিসু নয়নের মুখ তুলে ধরে। 

‘কেন রে কারো প্রেমে পড়েছিস।’

‘কী যে বল, ভাবী।’ লজ্জা পায় নয়ন। একটু চুপ থেকে বলে, ‘আমি লেখাপড়া করতে চাই ভাবী।’

তিসু অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,

‘দিদিভাই, তুমি তো জানো, বাবা এই কথা মানবেন না। এমনিতেই বাবা রিটায়ার্ড করেছেন, তা ওপর বয়স হয়েছে এখন; তিনি মনে করেন কখন আছেন কখন নেই! এই অবস্থায় মেয়েটার একটা গতি করে যেতে চান। এই রকম সব বাবাই তাঁদের মেয়েদের জন্য চান। জানিস তো বাবা জীবিত থাকলে যত ভালো বিয়ে হয়, বাবা না থাকলে তত ভালো বিয়ে হয় না।’ ভাবীর কথা চুপ করে শুনে গেল নয়ন। কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পায়ের নখ খুটল, কিছুক্ষণ শাড়ির আঁচল দাঁতে কাটল। ওর এই অবস্থা দেখে তিসুর খুব কষ্ট হলো। ওর হাতের আঙুল নিয়ে বেশ খানিক্ষণ

নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবল কথাটা বলবে কি বলবে না। তারপর বলেই ফেলল।

‘নয়ন তুই আমাকে মিথ্যে বললি কেন?’

‘আ…আ…আ…মি মিথ্যে বলেছি;!’

তিসুর হাসি পেলেও না হেসে বলল, ‘তাই তো! তা সেই পছন্দের মানুষটির নাম কি?’

নয়ন মুখ তোলে না। ভাবীর কাছে ধরা পড়ার লজ্জায় আরক্ত সে। ওর অবস্থা দেখে এব হেসে ফেলে তিসু।

‘অত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? শফিক নামের মানুষটি যে শিপিং কর্পোরেশনে চাকরি করে

জানো না বুঝি!’

‘তুমি সব জানো। কীভাবে জানো। আমি তো বলিনি তোমাকে!’ চমকে উঠে বলে নয়ন!

‘তাহলে সব সত্যি বল।’ মাথা নেড়ে সায় দেয় নয়ন। ওর দিকে তাকিয়ে বলে তিসু।

‘এই বিয়ে তো হবে না ভাই। বিরহনদীর দুইপাড়ে থাকতে হবে দুজনকে। জীবনে…।’ কথা শেষ করতে দেয় না নয়ন।

‘ভাবী…!’ কান্নায় কন্ঠ রুদ্ধ আর চোখ ভরে যায় অশ্রুতে। ওর কান্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে তিসুর মন আর চোখ দুই-ই ভিজে যায়। ওকে খুশি করার জন্য ওর সঙ্গে রসিকতা করে।

‘ননদিনী আমার ননদিনী / পরে রাঙা চেলি / যাবে কী আমায় ভুলি।’ রসিকতায় খুব লজ্জা পায় নয়ন। বলে, ‘তুমি একটা যা-তা ভাবী। যাও তোমার সঙ্গে আমার আড়ি।’

‘তাই বুঝি! বেশ তো, থাক তাহলে!’

‘এই না ভাবী ওকথা এমনিই বললাম। তুমি আমার ভাবী নও, এখন থেকে তুমি আমার বন্ধু।’ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ওরা। তিসুর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে নয়ন।

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি