চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি (ধারাবাহিক উপন্যাস)

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

পর্ব ১

 

‘সুন্দর গন্ধ তাই না।’ 

বাগানের দিককার জানালাটা খুলতে খুলতে বললো তিসু।

‘কি হলো, গন্ধ পাচ্ছো?’ তিসু আবার বলে। ‘জানালা  না খুলে এই গুমোট ঘরে কি করছো? আকাশ স্বচ্ছ আর সুন্দর। কোথাও কোন মেঘের কালো ছায়া নেই। খন্ড খন্ড সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে শিমুল তলোর মতো। সুন্দর বাতাস বইছে। আর তুমি ঘর গুমোট করে রেখেছ।’ তিসু কথা বলতে বলতে জানালার দিকে এগিয়ে যায়। 

 

 আজ ছুটির দিন।

সপ্তাহ জুড়ে কাজ করতে করতে ভাবে এই ছুটির দিনটির কথা। কখন আসবে তার জন্য নিবিড় অপেক্ষায় থাকে তিমির। আজকের এই ছুটির দিনটিও ওর প্রতীক্ষিত দিন। দুপুরে খাওয়ার পরে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে সেবা রোমান্টিক পড়ছিল। দুপুরে খাওয়ার পরে সময় কাটানোর জন্য বইয়ের কোন জুড়ি নেই! তিমির বই পড়তে পছন্দ করে, ভালোবাসে। বই পড়লে অনেক কিছু জানা যায়। ও যখন বই পড়ে তখন মনযোগের সঙ্গে পড়ে; প্রতিটি শব্দ, লাইন,দাঁড়ি,কমা, সেমিকোলন সব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। ভালো লাগে।  

তিমিরের মনযোগ বইয়ে। তিসুর কথা শুনতেই পায়নি প্রথমবারে, দ্বিতীয়বারে শুনেছে কিন্তু জবাব দেয়নি। 

 

তিসু জানালার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে দাঁড়ালো খাটের পাশে। বললো, ‘কি হলো, কিছু বলছো না! গন্ধ পাচ্ছো না।’ তিমির বইয়ে চোখ রেখেই বললো, ‘কই না- তো! কোন গন্ধই তো পাচ্ছি না। কোথায় গন্ধ?’

‘একটু নিবিড়ভাবে গন্ধ নাও, তাহলে পাবে।’  তিসুর কথা শুনে জোরে শ্বাস টানে তিমির।

বলে, ‘কই, কিসের গন্ধ, পাচ্ছি না তো!’

‘তা পাবে কেন?’ তিসু রেগে যায়। কন্ঠে একরাশ ঝাঁঝ ঝরিয়ে বলে, ‘তোমাকে  একটা কথা বললে কোনদিন মন দিয়ে শুনেছো বলো? কখনও শোননি!’ তিমির কোন প্রত্যুত্তর করলো না। সে বইয়ের দিতে বেশি মনযোগি হলো। তিমির খুব ভালো করে জানে একজন রাগ করলে অন্যজনকে চুপ করে থাকতে হয়। তিসুও তাই জানে। ও একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকালো তারপর কিছু না বলে জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের সৌন্দর্য দেখতে থাকলো। এখন শরতকাল। এই সময়ে মেঘের মেলা আর আকাশ খুবই সুন্দর লাগে তিসুর কাছে, তিসু আবিষ্ট হয়ে যায়।

 

তিসু মেয়েটি ফর্সা নয়, শ্যামলা। বেঁটে নয় লম্বা। লম্বা শ্যামলা মুখে গাঢ় স্বচ্ছ দুটি চোখ অসম্ভব সুন্দর! ঐ চোখের দৃষ্টি কিছুটা ধাঁরালো, কিছুটা নরম, কিছুটা অন্তর্ভেদী হওয়ার কারণে প্রথম দেখাতেই বড়ো ছেটো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিসু। ওর শুধু চোখই নয় আছে কোমর ছাপিয়ে পড়া ঘন কালো চুল। তিসু আর তিমিরের বিয়ের বয়স এখনও এক বছর পেরোয়নি।তিসু আজ যে গন্ধটা পাচ্ছে তা বিয়ের দিন থেকে পেয়ে আসছে। ওর কেন যেন মনে হয়েছে, ও যে একটা গন্ধ পাচ্ছে, সেটার কথা তিমির বিশ্বাস করবে না। শুধু তিমির কেন বিশ্বাস করবে না কেউ-ই! এই কথা ভেবেই এতোদিন বলেনি কিন্তু আজ না বলে পারলো না। আজই প্রথম বললো তিমিরকে। আর তিসুর কথা সত্য প্রমাণিত হলো, বিশ্বাস করলো না তিমির। কিন্তু কেন বিশ্বাস করলো না তাও ভেবে পেলো না তিসু!

 

তিসু জানালার কাছে উদাস দাঁড়িয়ে আছে। তিসু যখন এই গন্ধটা পায় তখন ওর ভেতরটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়! মাথার স্নায়ুগুলো অবশ মনে হয়! মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হয়! কিছুই ভালো লাগে না তখন। 

 

তিমির একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। ব্যাংকের চাকরি; দিনের বেশিরভাগ সময় অফিসের কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়। কোন কোন দিন বাসায় ফিরতে রাত আটটাও বেজে যায়। তিসু ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। অল্পস্বল্প লেখার অভ্যাস আছে। সংসারের কাজ আর লেখাপড়া শেষে সময় বের করে একটু লেখালেখি করে। সংসার গুছিয়ে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিলো ওদের। কিন্তু যতোদিন যাচ্ছে এই গন্ধটা ভীষণভাবে যেমন আকৃষ্ট করছে তেমনি কাহিল করে দিচ্ছে তিসুকে! 

 

এই বাসায় শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ নয়ন, ভাসুর তুষার, জা রায়না আর ওদের এক ছেলে বিপুল আছে। নয়নের বিয়ে হয়নি এখনও, কথাবার্তা চলছে। তিসুর সঙ্গেই পড়ে নয়ন। ওরা সকলে একই বাড়িতে থাকে পৃথকান্ন; রান্না খাওয়া পৃথক। পৃথক রান্নার ব্যবস্থা তিসুর শ্বশুর মশাইয়ের; তাঁর অভিমত রান্নাবান্না পৃথক থাকলে পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় থাকে। 

 

তিসু জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। গন্ধটা ক্রমশ ঝাঁঝালো হয়ে স্নায়ুগুলো অবশ করে দিচ্ছে তিসুর। তিসু একটা সুর শুনতে পাচ্ছে, খেয়াল করে বুঝতে পারলো ওটা বাঁশীর সুর! এখানে বাঁশী বাজায় কে? আজ দিন পাঁচেক ধরে গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এই সুর শুনতে পাচ্ছে! এই সুর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওর মন বিষণ্ন থেকে বিষণ্ন হয়ে যায়। সংসারের সব কাজ ফেলে তখন ঘুমাতে ইচ্ছা করে! ইচ্ছা করেও জেগে থাকতে পারে না! কোন কাজ তো করতেই পারে না। এ যেন শ্যামকানাইয়ের বাঁশির সুর! যখনই বাজতে শুরু করে তখনই কাজ করার ইচ্ছা থাকে না ওর! না, রাধার মতো সব ফেলে বাইরে ছুটে যায় না, কিন্তু সব ফেলে ঘুমাতে চলে যায়। আর জোর করে বসে থাকলে যেখানে যে অবস্থায় থাকে ঘুমিয়ে যায়! ও স্বপ্ন দেখে। কেউ  সেসময় ওকে ডাকলে, কথা বলে বিরক্ত হয়, রাগ হয়ে যায় ওর। 

 

জানালায় দাঁড়িয়ে তিসু আধা ঘুম আধা জাগরণে ভাবছে, এভাবে চললে খুব খারাপ হয়ে যাবে; স্বামীর সঙ্গে, এই বাসার সকলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশংকা রয়েছে। এই সংসার টিকবে কিনা তাও সন্দেহ আছে। কিন্তু এসব কিছুই চায় না তিসু। ও জানে সংসার পরিবার ভিন্ন একজন মানুষ কখনও সুখী হয় না, থাকতেও পারে না। শুধু জানা নয়, ওর বিশ্বাস। একটা মেয়ে যা চায় তিসুও তাই চায়। সুন্দর সুখী একটি পরিবার, একটি সংসার। স্বামীর আদর-সোহাগ, সন্তানের খুনসুটি শ্বশুর-শাশুড়ির  স্নেহ নাম-যশ সবই চায়। মানবজন্ম তো একটাই। এই এক জীবনে কে না চায় জন্মকে সার্থক করে তুলতে। আর সকলের মতো একটি সফল মানবজীবন চায় তিসুও। 

 

‘তিসু অ্যাই তিসু, একটু চা করো না।’ তিমির অনুরোধ করে বউকে।

ওদিকে বিষ্নে হয়ে আসছে তিসুর মন। তিমিরের প্রতি একটু বিক্ষুব্ধ! কারণ তিমির ওর কথায় গুরুত্ব দেয়নি। ওকে না শুনে ওর কথার কোন গুরুত্ব না দেওয়াটা ভালো লাগেনি তিসুর। চা চাইতেই রাগ হয় তিসুর। ঝংকার দিয়ে ওঠে তিসু, ‘পারবো না, পারবো না।’

হঠাৎ কী হলো তিসুর! অবাক হয়ে ভাবে তিমির। কখনও এমন ব্যবহার করে না তিসু। বই রেখে উঠে জানালার কাছে যায় তিমির। দুহাতে বেষ্টন করে কাঁধের ভেতরে মুখ রেখে বলে, ‘কী হলো আমার প্রাণের? রেগে আছো কেন? বেড়াতে যাবে বলেছিলে। চা করো, চা খেয়ে যাবো।’ 

‘যাবো না বেড়াতে, যাও।’

‘কেন যাবে না?’

‘এমনিতেই!’

‘তোমার কী হয়েছে বলত? এবারও কোন জবাব দেয় না তিসু। আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে জানালাতে। তিমির আর একটু সাধাসাধি করে। কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই তিসুর! দাঁড়িয়েই থাকে, যেমন দাঁড়িয়েছিল। তিমির আর কথা বলে না ওর সঙ্গে; বিছানায় এসে বই খুলে পড়তে চেষ্টা করে  কিন্তু বইয়ে মন দিতে পারে না। আজ বেড়াতে যাবে বলেই না আজকের ছুটির দিনটা না ঘুমিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিয়ে কাটালো। আজ বাসায় আছে তিমির, ওর কথা রেখে তারপরেও হাসি নেই তিসুর মুখে। ওর হাসি কেন উধাও হয়ে যাচ্ছে তাই ভাবছে তিমির। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে হাসির কোন কমতি নেই তিসুর। অল্প একটু কথাতেই হেসে গড়িয়ে পড়তে দেখেছে তিমির। আজ কী হলো? শুধু আজ নয় ইদানিং কী হয়েছে? মাঝেমধ্যেই ঝগড়া করছে ওর সঙ্গে। কখনও কখনও মনে হয় তিসু যেন ইচ্ছে করেই ঝগড়া করছে। আজ যেমন মনে হচ্ছে! অথচ জানে জিজ্ঞেস করলে জবাব পাবে না; হয়তো বলবে মাথা ব্যথা না হয় চুপ করে থাকবে। 

 

তিসুর ব্যবহারে মেজাজ বিগড়ে গেছে ওর। বইয়ের পাতায় মন দিতে পারছে না। বই একপাশে রেখে দিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে তাকিয়ে রইলো তিসুর দিকে। তিসুর ব্যবহার কষ্ট দিয়েছে ওকে! তিসু কেন এইরকম ব্যবহার করলো ওর সঙ্গে; এই ভাবনাটা। তিসু ইদানিং কী চায় তাও বুঝতে পারছে না, দিনদিন বড্ড অচেনা হয়ে যাচ্ছে ও। বিষণ্ন হয়ে গেল তিমির। বিষণ্ন মনের ভাবনা থেকে এক অদ্ভূত ধারণা হলো মনে, ও ভাবলো তিসুর পছন্দ নয় ওকে! পছন্দ করে না তিসু ওকে ভাবতেই দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো। কেন পছন্দ করছে না তিসু ওকে! তিসুর কি অন্য কাউকে পছন্দ ছিল? ও কি দেখতে অসুন্দর? নাকি উপার্জন কম? এটা ঠিক যে ওর বড়ো ভাই তুষারের চেয়ে ওর বেতন কম! কিন্তু তাতে কী? চলে তো যাচ্ছে! এতোসব প্রশ্ন মনে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আর ভাবছে এইসব প্রশ্নগুলো করবে কিনা বউকে। ও প্রশ্ন করতে যাবে তিসুকে এমন সময় মা ঘরে এসে দাঁড়ায়। মায়ের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জানালা থেকে সরে এসে মাকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। 

‘বসুন মা।’ তিসু বলে।

‘কিছু বলবে মা।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে তিমির। ‘আমাকে ডাকলেই তো পারতে মা।’ তিমির নরম সুরে বলে।

‘শুয়ে আছো ভেবে ডাকিনি, নিজেই এলাম।’ ছেলের পাশে বসতে বসতে মা। 

‘তোমরা কি কোথাও যাবে বাবা?’

 ‘না মা, তুমি কিছু বলতে চাইলে বলো।’

‘বউমা, তুমিও বসো। দুজনের সাথেই কথা বলি। তোমাদের দুজনেরই শোনা দরকার।’ মা কথাগুলো বলে ছেলে বউয়ের দিকে তাকায়। তিসু এসে খাটের পাশে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ আগের বিক্ষিপ্ততার কোন চিহ্ন নেই ওর মুখে। শান্তশ্রী যেন কিছুই হয়নি! মনযোগ দিয়ে শাশুড়ির কথা শুনতে থাকে তিসু।

 

‘নয়নকে তো আগামী সোমবার  দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। তোমাকে ছুটি নিতে হবে বাবা। তোমার বাবার প্রেসারটা বেড়েছে, সেই সাথে হাঁপানির টানটাও!’ মা কথাগুলো বলে চুপ করে। বাবার প্রেসার হাঁপানির টান আছে তা জানে তিমির। মাকে বলে, ‘এমন করে বলছো কেন মা! আগামী সোমবার তো! এখনও দেরি আছে মা। তিনদিন। তুমি এমন করে বলছো কেন মা? নয়ন কি আমার পর!’

‘তা নয় বাবা, তোমার ব্যাংকে চাকরি। সময় যদি না পাও তাই।’ ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে শাশুড়ি, ‘এখন যাই মা, নামাজের সময় হয়েছে। পরে তোমার সঙ্গে কেনাকাটা নিয়ে কথা বলবো। নয়নের পছন্দ পছন্দ ছেলেরও এখন শুধু বাবা মায়ের দেখা আর আশির্বাদ। আমি যাই বউমা।’ 

 

শাশুড়ির কথা শেষ হলে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দরোজা পর্যন্ত সঙ্গে যায় তিসু। মা চলে যাওয়ার পরে তিসুকে কাছে টেনে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় তিমির। বলে, ‘চলো না বেড়াতে যাই।’ তিসু বেড়াতে যাওয়ার জন্য সাজুগুজু করতে যায়। তিমির অবাক হয়! এখনকার তিসুর সঙ্গে একটু আগের তিসুর কোন মিলই খুঁজে পায় না তিমির। 

 

 

%d bloggers like this: