চন্দনের গন্ধ ৬ / আফরোজা অদিতি
পর্ব ৬
বউয়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে তিমির। ওর মনে খটকাগুলো ঘোঁট পাকাচ্ছে; তিসু কেন মালার কথা বলল না? কেনই বা মালার কথায় অমন চমকে উঠল? অত দামী মালা কেনার সাধ্যি
তিসুর নেই কারণ অত টাকা তিসুর কাছে নেই, যে হাতখরচ দেয় ভার্সিটিতে যাওয়া-আসার পরে অতো টাকা জমার কথা নয়! ওর বাবা যদি মালাটা দিতো তাহলে তো স্বীকার করতো; এভাবে এড়িয়ে যেত না! কে দিলো ঐ মালা? ওর বাবা না অন্য কেউ? তিসুর কি বিয়ের আগে কোন
প্রেম ছিল? সেই প্রেমিক দিয়েছে? তবে কী তিসু অন্য কারো সঙ্গে… না, না! এটা খুব বিশ্রি ব্যাপার! তিসু অমন মেয়ে নয়; এতদিনে তা বুঝতে পেরেছে। আসলে কি বুঝতে পেরেছে! না মনে হয়!
খটখট করে ভীষণ শব্দে ওর মনের ভেতর নড়েচড়ে গেল কথাগুলো; ও ভাবলো আসলে বড়োলোকের ছেলেমেয়েদের তো বন্ধুবান্ধবের অভাব হয় না। আর তিসুর বাবা-মা তো ওদের খবরই রাখতো না কোনসময়! কিন্তু এখন কী করবে তিমির, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। জানালার
বাইরে তাকিয়ে থাকে। ওখানে গাছের সবুজ পাতায় ছলকে যাওয়া বিকেলের আলো খেলা করছে কিন্তু ওর সেদিকে চোখ নেই। অথচ ঐ আলোর খেলা দেখতে খুব ভালো লাগে ওর, আজ লাগছে না!
তিমিরে মন বিষষ্ন হয়।
‘এই নাও চা’ আজ আরও এককাপ চা নিয়ে ঘরে আসে তিসু। নিজের জন্যও আনে। তিমিরের মুখোমুখি বসে। তিমির ওর মুখের দিকে এখন তাকিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। আদা চা। তিসু এই আদা দেওয়া চা ভালো বানায়। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবে এত নিষ্পাপ
মুখের মানুষের মনে কী কখনও কোন পাপ লুকানো থাকতে পারে, পারে না! তিমির ওর মনের ভাব লুকাতে চায়; কখনও সংসারে অশান্তি চায় না। অশান্তি চায় না বলেই মালার প্রসঙ্গে ফিরে যায় না।
‘তোমার বাবা-মা-বোন কেমন আছে?’
‘হ্যাঁ, ভালো।’ মাথা নাড়ে এপাশ-ওপাশ।
‘না, বলছিলাম তুমি যে হুট করে চলে এলে তাই। আমাকে কোন খবর দিলে না। ওখানে কী কিছু
বলেছে ওরা?’
‘না, না। ওদের তো কোন সময় নেই। কী আর বলবে! আমার ভালো লাগল না, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করলো, তোমার কথা মনে পড়ল তাই চলে এলাম।’
‘ঢঙ্গি’ মনে মনে বলল তিসুকে আর মুখে বলল,‘যাইনি বলে কি রাগ করেছ?’
‘মাত্র তো কয়দিন! আমি তো রাগ করিনি; কেন আমি কী কিছু বলেছি, না করেছি।’
‘না, চলে এলে তাই বললাম।’ এরপর আর কোন কথা হয় না দুজনের। তিমির টেনিস খেলতে যায় ক্লাবে। ঘরে একা বসে থাকে তিসু। কিছু ভালো লাগছে না ওর। কেন এমন হচ্ছে? এই সংসার কি এলোমেলো হয়ে যাবে? এই সংসার এলোমেলো হয়ে গেলে ওর তো দাঁড়াবার জায়গা নেই।
এই বাড়ি এই ঘর এই বাড়ির মানুষগুলো সান্নিধ্য ছাড়া তো কিছুই ভালো লাগে না ওর। ও শান্তি পায় না কিছুতেই!
রাত দশটায় ডিনার সারে ওরা। সব গুছিয়ে ঘরে আসতে প্রায় এগারোটা। শোয়ার আগে হাতমুখ ধুয়ে চুল বেঁধে শোয়া অভ্যাস তিসুর। আয়নার সামনে বসে চুল বাঁধতে বাঁধতে নজর পড়ে মালাটার দিকে। মালাটির দুধ সাদা পাথর থেকে একটা অন্যরকম দ্যুতি বের হচ্ছে। যা আয়নার
গ্লাসে পড়ে পিছলে ওর চোখে লাগছে; ওদিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে তিসু। দূরে কোথায় বাজছে বাঁশি। বাঁশির সুর এসে মর্মে বিঁধছে। ওর মনে হচ্ছে, যে বাতাস ঐ সুর বয়ে এনেছে সেই সুরে ভরা বাতাস যেন ডাকছে ওকে; এস, এস তুমি, তোমাকে নিয়ে যাবার
অপেক্ষায় অনেকদিন! যেন ডাকছে দূরের, বহুদূরের বাতাস।
বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে তিমির। বিকেলের খটকা দূর হচ্ছে না কিছুতেই। কীভাবে দূর করবে, কীভাবে জানবে এই মালারহস্য তাই চিন্তা করছে তিমির। ওর এই এক স্বভাব একটা কথা মনে ঢুকলে হয় কিছুতেই বের হতে চায় না।
তিসুকে বলে, ‘ কোথায় পেয়েছ মালাটা বল না প্লিজ।’
স্বামীর কথাতে সম্মোহন ভাবটা কেটে যায় কিন্তু ওর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কথা বলছে না দেখে আদুরে কন্ঠে ডাকে।
‘কাছে এস, এস না।’
চুল বাঁধা শেষ হয়েছে। চিরুনি গুছিয়ে এসে খাটের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে। একটু আদর করে জড়িয়ে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলে, ‘বল না, কোথায় পেয়েছ মালা? আমাকে বলতে তোমার দ্বিধা কেন? এরকম তো ছিলে না!’
‘প্লিজ এই মালার কথা জিজ্ঞেস করো না। বলতে পারবো না। যিনি দিয়েছেন তাঁর বারণ আছে।’ তিসু গম্ভীর হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘শুধু এইটুকু জেনে রাখ তোমাকে ঠকাইনি আমি। কাউকে ঠকানোর মতো কোন কাজ কখনও করিনি, করবও
না।’
‘আমাকে ঠকাওনি মানলাম। কিন্তু মালার ব্যাপারে এত জিদ করছো কেন? বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।’
‘জিদ তো আমি করছি না তিমির, করছো তুমি।’ কঠিন হলো তিসুর কন্ঠ। এমন তিসুকে এই কয়মাসে দেখেনি তিমির। তবুও বলে,
‘ দেখ তিসু, এমন করো না। আমি তো একটা মানুষ যদি আদারওয়াইজ মানে এই মালাটার অন্যরকম মানে করি।’
‘ইচ্ছে তোমার। অন্যরকম মানে করলেও আমার কিছু করার নেই। আমি বলতে পারবো না।’
ওয়াসরূমে চলে যায় তিসু। খুব খারাপ লাগছে। তিমিরের কাছে কোন কথা লুকায়নি আজ পর্যন্ত। লুকানো-ছাপানো ওর পছন্দ নয়! কিন্তু এই মালার কথা বলতে পারছে না, পারবে না! এই মালার কথা তিমিরকে বলুক আর যে কাউকে বলুক ক্ষতি হবে তিমিরের, ক্ষতি হবে এই সংসারের।
কিছুতেই তিমির বা এই সংসারের কোন ক্ষতি মেনে নিতে পারবে না তিসু। কিন্তু কিছুতেই তো মানতে চাইছে না তিমির। তিমির মানুক বা না মানুক ওকে তো মানতেই হবে। তিসুর কান্না পায়। কিছুক্ষণ কাঁদে। তারপর হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখে বই পড়ছে তিমির। তিসু
খাটের কিনারে এসে দাঁড়ায়। তিমির দেখেও দেখে না ওকে। তিসু বুঝতে পারে এই মালার কথা বলা না বলা নিয়ে দুজনের মাঝে একটা সুক্ষ্ম দেয়াল উঠে গেল; তিসুর বুকের পাঁজর ভেদ করে একটা ব্যথার স্রোত নেমে গেল ধীরগতিতে। তিসু জানে এই ব্যথার উপশম হবে না কখনও!
শনিবার। ছাত্র-শিক্ষকের কোন্দল শেষাবধি রাজনীতি পর্যন্ত গড়ানোর ফলে ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ওর ইউনিভার্সিটি যেতে ভালোও লাগে না। এই মালা পাওয়ার পর থেকে বাড়িতে অদ্ভুত কান্ডকারখানা শুরু হয়েছে; ভীত হয়ে পড়েছে সকলে। ইদানীং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা একদমই হয় না। তিসু সংসারের নিত্যকর্ম শেষ করে বেশিরভাগ সময় লাইব্রেরীতেই থাকে। লাইব্রেরী হলো এই বাড়িরই একটি ঘর; লাইব্রেরী বা ঘরটা ওর নিজের, একান্তই নিজস্ব। এই
লাইব্রেরীর দক্ষিণকোণে বিশাল আকারের পূর্ণায়বে বাঁধানো একটি নারীচিত্র আছে। এই চিত্রটি এই বাড়ির পূর্ব মালিক যিনি ছিলেন তার।
এই বাড়িটি শ্বশুর মুজাহিদ সরকার মাস চারেক আগে এক হিন্দু কাপড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছেন। হিন্দু ভদ্রলোকের স্ত্রী সাত বছর আগে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যা করে। একমাত্র ছেলে আর ছেলেবউ আমেরিকা থেকে মাকে দেখার জন্য দেশে ফেরার পথে প্লেন ক্রাশে মারা যায়।
স্ত্রী আর ছেলেকে হারিয়ে শোকে উন্মাদ হয়ে যান ভদ্রলোক। তারপর জলের দরে বাড়ি বিক্রি করে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। কেউ বলে সন্যাসী হয়েছে কেউ বলে ‘আল-কায়েদা’ দলে যোগ দিয়েছে আবার কেউ বা বলে মারা গেছে। এক অর্থে কেউ জানে না কী হয়েছে। তবে এই
বাড়িটি মুজাহিদ সাহেবের স্ত্রী অর্থাৎ তিসুর শাশুড়ি কিনতে রাজী হননি। তবে খুব সস্তায় এত বড়ো বাড়ি পাওয়া যাবে তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজী হয়েছিলেন। এই বাড়িতে পাঁচটি বড়ো বড়ো ঘর ছাড়াও রান্নাঘর, স্টোররূম আর একটি ছোট ঘর আছে। পাঁচতলা ফাউন্ডেশন; মাত্র
আড়াইলক্ষ টাকা !
বাড়িটি কেনার পর এখানে এলে ছোট ঘরটা দেখে খুব পছন্দ হয়ে যায় তিসুর। ওর খুব ইচ্ছা লাইব্রেরী করে; শ্বশুর রাজী হয়ে যায়। এই ঘরের ঐ ছবিটি খুলতে দেয়নি তিসু। কার ছবি তা না জেনেই রেখে দিয়েছে। এই ঘরে পা দিলেই প্রথমেই চোখে পড়ে ছবিটা। ঐ ছবিটা দেখতে দেখতে ওর মনে হয় ছবির মানুষটা যেন ফ্রেম থেকে বেরিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে চায়। ঐ ছবির নারীটি যখন বাইরে এসে দাঁড়ায় তখন বাঁশির সুর শুনতে পায় আর সেই সুরের সঙ্গে ওর ভেতরের পরিবর্তন টের পায়। ওর খুব নাচতে ইচ্ছা করে, গাইতে ইচ্ছা করে।গানে গানে উন্মন-মাতাল হতে ইচ্ছা করে, তাল-লয়-মুদ্রায় নাচতে ইচ্ছা করে অথচ কখনও নাচ শেখেনি, গান শেখেনি তিসু। ওর গা থেকে বের হয় চন্দনের গন্ধ। ও নিজে টের পায় না। তিমির বলেছে।
‘ তোমার গা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ বের হচ্ছে তিসু। সেন্ট মেখেছ? কোথাও গিয়েছিলে?’
‘না তো! কোথাও যাইনি, সেন্টও মাখিনি।’
‘তা হলে গন্ধ আসছে কোথা থেকে। আমি তো মাঝেমধ্যেই তোমার গা থেকে গন্ধ পাই কিন্তু কথার পাত্তা দাও না তাই বলি না।’
তিমিরের কথা শুনে চোখে জল ভরে ওঠে তিসুর। জলভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি বিশ্বাস করো না আমাকে।’
তিমির সংকুচিত হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে, ভাত দাও।’ খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে শুতে যায় ওরা।
( চলবে )
Facebook Comments Sync