ফু বাবা / অমিতাভ মীর

ফু বাবা / অমিতাভ মীর

ফু বাবা 

(১).

দুপুর বেলায় বাড়িতে ফিরে দেখি খুলনা থেকে আমাদের দূর সম্পর্কের দুজন আত্মীয় এসেছেন। ওদের আপ্যায়ন চলছে। ওরা সম্পর্কে আমার ভাগ্নে হয়। দুজনেই বয়সে আমার বড়। বড় জন আকরাম, ছোট জন কামরুল। খাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ পারিবারিক গল্পের আসর বসলো। চৈত্র মাসের পড়ন্ত বিকেলে মাথাভাঙ্গা ব্রিজের দিকে ঘুরতে বেরোলাম। ব্রিজের ওপর বইছে মৃদুমন্দ বাতাস। হাওয়া খেতে বিকেল থেকে রাত অবধি ব্রিজের ওপর হাওয়া খেতে অনেক লোকজন জড়ো হয়।  চৈত্র মাসের এই সময়টাতে বাতাসের জোর একটু বেশি। এলোমেলো চৈতালী বাতাস মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়।

ব্রিজ তৈরীর ইতিহাস, মাথাভাঙ্গা নদীর উৎসমুখ ইত্যাকার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শেষ হলে আকরাম মামা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- মামু, বেশ নামডাক আছে এমন কোন গুণীন আছে নাকি এই এলাকায়?

– গুণীন দিয়ে কি হবে, মামা?

– ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগাতে পারে এমন একজন তান্ত্রিক বা গুণীনের সন্ধান চাই। শুনেছি, তোমাদের এখানে এমন তান্ত্রিক আছেন। সেই জন্যেই এখানে আসা, মামু।

– বললাম, এমন লোক দু’একজন আছে বলে শুনেছি। যারা তন্ত্রমন্ত্র সাধনা করে, কুফরি কাজেও পটু। মন্ত্রতন্ত্র যোগে বাণ মারে, যাদু টোনার অপপ্রয়োগ করে। টাকার বিনিময়ে অন্যের ক্ষতিসাধন করে। ঠিক আছে মামু, আমি খোঁজ নেবো। রাত হয়ে যাচ্ছে, চলুন বাড়ি যাই।

বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে গল্পগুজবের এক ফাঁকে আকরাম মামা বললেন, আগামীকাল বিকেলের ট্রেনে আমরা খুলনা ফিরে যাবো। বাড়ির সবাই আরও দু’চারদিন থাকার কথা বললেও আকরাম মামা জরুরি কাজের অজুহাতে থাকতে চাইলেন না। কাল বিকেলের ট্রেনে ফিরে যাওয়ার কথা পাকাপোক্ত হয়ে থাকলো। সবাই শয্যায় গা এলিয়ে দিলেন। 

(২)

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়লাম তান্ত্রিকের খোঁজে। পথেই দেখা পেয়ে যাবো ভাবিনি। নাম তার একটা আছে বটে, তবে সেই নাম এখানে নিচ্ছি না। ফু বাবা বললেই সবাই তাকে চেনে। বিভিন্ন বাউল ফকিরের আখড়ায়, পীরের দরবারে নিত্য তার যাতায়াত। ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ এসব বুজরুকি তার নেশা, পরবর্তীকালে তা দস্তুর মতো পেশায় পরিণত হয়েছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারের লোকজন ও মেয়েদের মাঝে তার বিশাল জনপ্রিয়তা। কাজ কি হয় না হয়, তারাই জানে। সম্পর্ক ভাঙা কিংবা জোড়া লাগানো, স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হওয়া, প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা বশ এসব কাজে লোকজন তার কাছে ভীড় জমায়। 

 

– ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করলাম, চললে কোথায়? 

– সাথে সাথে জবাব দিলো, বাজারের দিকে যাচ্ছি একটু চা-টা খেতে। 

– চলো বাঁদুড়তলায় গোলাম ভাইয়ের হোটেলে যাই, ওখানে বসে লটপটি আর পরোটা খাবো। তারপর চা আর সিগারেট। সানন্দে রাজী হয়ে আমার সাথে হাঁটতে লাগলো।  

গোলাম ভাইকে বললাম, দু’জনের জন্য নাস্তা দিন। পরোটা আর লটপটি। গোলাম ভাইয়ের দোকানের লটপটির বেশ সুনাম আছে এতদাঞ্চলে। মুরগির কলজে, গিলে, মাথা ও গলা একসাথে রান্না করার নাম লটপটি। বেশ সুস্বাদু। রুটি কিংবা পরোটার সাথে খেতে চমৎকার। পাশেই ট্রাক পরিবহন বন্দোবস্ত অফিস। ট্রাক ড্রাইভার, হেলপার ও বন্দোবস্তকারী দালালদের সরব উপস্থিতিতে মশহুর থাকে এই এলাকা। এরাই মূলত এই হোটেলের প্রধান খদ্দের। আমাদের মত সময়ে অসময়ে রুচি বদলের রসনা বিলাসী খদ্দের কদাচিৎ আসে এখানে। খেতে খেতে কথা পাড়লাম। আচ্ছা এই যে ভেঙে যাওয়া প্রেমজ সম্পর্ক জোড়া লাগাতে পারে এমন গুণীনের সন্ধান জানা আছে তোমার? 

– গুণীনের সন্ধান দিয়ে কি হবে?

– ওর পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে বললাম, আমার এক ভাগ্নে খুলনায় থাকে। তাঁর সাথে প্রতিবেশী এক উকিলের একমাত্র মেয়ের  দীর্ঘ দিনের প্রণয় চলছে। অতি সম্প্রতি তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ঘটেছে। মেয়ে তো একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভাগ্নে জীবনের প্রতি উদাসীন হয়ে গেছে। 

– কোন ব্যাপার না। সব ঠিক করে দেবো।

– পারবে তুমি?

– এতকাল তাহলে কি শিখলাম আমি? আমাকে নিয়ে চলো। সব ঠিক করে দেবো।

যাক, আশার আলো দেখতে পেলাম। আকরাম মামাকে খবরটা এখনই দেওয়া দরকার। পরোটা প্রতি পিস দুটাকা, লটপটি ৫ টাকা প্লেট আর চা প্রতি কাপ দুটাকা। মোট ছাব্বিশ টাকা বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। বাদুড়তলায় মোশাররফ ভাইয়ের দোকান থেকে দুটাকা দিয়ে দুটো গোল্ডলিফ সিগারেট নিয়ে তাকে একটা দিয়ে আমি একটা ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়ির পথে পা বাড়ানোর আগে ওকে দুপুরে আমার বাড়িতে আসতে বললাম। 

৩).

বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে আকরাম মামা হৈ হৈ করে উঠলেন। আরে মামু, সকালে নাস্তা না করেই কোথায় গিয়েছিলে। তোমাকে খুঁজতে আমরা বড়বাজার হয়ে ব্রিজ পর্যন্ত ঘুরে এসেছি। কোথাও তোমার দেখা পেলাম না।

– বাড়ির পাশেই বাদুড়তলায় ছিলাম, মামা। এ কথা বলেই, উঠোন থেকে তেঁতুল গাছ দেখিয়ে বললাম, বলেন তো মামা ওই গাছে ঝুলছে ওগুলো কি?

– খুব ভালো করে পরখ করে বললেন, বাদুড় বলে মনে হচ্ছে। 

– একদম ঠিক বলেছেন মামা। এ জন্যেই ওই জায়গাটার নাম বাদুড়তলা। আমাদের বাড়ির সামনে এই যে বাগান বাড়িটা দেখছেন ওটা এঁদেরই সম্পত্তি। ওখানে বড়সড় একটা তেল ও চালের মিল আছে। ওই বাদুড়তলার রাস্তার ওপারেই একটা হোটেলে সেই গুণীনকে নিয়ে নাস্তা খেয়ে আলোচনা পর্ব শেষ করে তবেই বাড়ি ফিরলাম।

– বলো কি, এতো ঝটপট আয়োজন করে ফেললে। তুমি পারবে এই বিশ্বাস ছিলো বলেই তোমাদের বাড়িতে আসা। তুমি ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গায় কিছুদিনের জন্য এসেছো সেই সংবাদ জেনেই তবে এসেছি। দেখছো তো, কামরুল কেমন মন মরা হয়ে বসে আছে! বড় ভাই হিসেবে ওর দিকে তাকাতেই পারি না। ওর মনমরা মুখ দেখে বুক ফেটে যায়।

– মামা, গুণীন দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসবে। তার সাথে খোলাখুলি সব কথা বলে নেবেন। 

 

আমাদের কথা বোধহয় কামরুল মামার কানে ঢুকেছে। এতক্ষণ বারান্দায় একটা চেয়ারে মাথা নীচু করে বসেছিলেন। উনি নড়েচড়ে উঠে কান খাঁড়া করলেন। সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মামু উনি আসবেন তো?

– হ্যাঁ মামা, নিশ্চিন্ত থাকেন উনি অবশ্যই আসবেন।

৪).

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট চু্কে গেছে অনেকক্ষণ আগে। গোয়ালন্দ থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী ট্রেন চুয়াডাঙ্গায় ৫:৫০ পৌঁছে ৫:৫৩ মিনিটে ছেড়ে যাবে। এখন চারটে বাজে। দুপুরে আসার কথা অথচ এখনও ফু বাবা এলো না। আকরাম মামা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর উঠোনে পায়চারী করছেন। আকরাম মামা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন, কিছুক্ষণ পর লাগেজ হাতে কামরুল মামাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। রিক্সা চালক জোয়ার্দারের বাড়িতে আসার কথা সাড়ে পাঁচটায় আমাদের স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার বাড়ি থেকে স্টেশন দশ মিনিটের পথ। বেশ বুঝতে পারছি, আকরাম মামা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। রিক্সাওয়ালা জোয়ার্দার এসে হাজির। ওদিকে হুড়মুড় করে ফু বাবাও এসে হাজির। বাড়ির ভেতর ঢুকেই বললো, এক জ্বিনে ধরা রুগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না। আকরাম মামা ও ফু বাবাকে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে কাঁঠালতলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম মামা, আপনারা কথা বলতে থাকেন আমি বাড়ির ভেতর থেকে আসছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ৫:০৫ বাজে। হাতে ঢের সময় আছে। ট্রেন শিডিউল টাইমে চলাচল করে না। এক আধঘন্টা লেট নৈমিত্তিক। রিক্সাওয়ালাকে আরেকটা রিক্সা আনার জন্য বলে কাঁঠাল তলায় গেলাম। আকরাম মামা ও ফু বাবা খুব নীচু স্বরে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন।

– মামা, আরেকটা রিক্সা আনতে পাঠিয়েছি। রিক্সা এলে আপনারা দুজন একই রিক্সায় বসে আপনাদের কথা চালাবেন। ট্রেন লেট থাকলে স্টেশনে বসে বাকি কথা শেষ করতে পারবেন। 

– সে-ই ভালো হবে মামু। চলো, স্টেশনে যাওয়া যাক।

বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আকরাম মামা ও কামরুল মামা গেটের বাইরে এলেন। আমি আর কামরুল মামা একটা রিক্সায় উঠলাম। ওদিকে আকরাম মামা ফু বাবাকে নিয়ে জোয়ার্দার এর রিক্সায় চাপলেন। স্টেশনে এসে খোঁজ নিয়ে জানলাম ট্রেন এক ঘন্টা লেট। প্লাটফর্মের ওপর একটা চায়ের দোকানে বসে আলাপ-আলোচনা জমে উঠলো। কামরুল মামাও আলোচনায় অংশ নিলেন। ফু বাবা বিভিন্ন রোগী ও রোগীনীর কেস হিস্ট্রির সাথে তার চিকিৎসাধারার ফিরিস্তি বয়ান করে তার পারঙ্গমতা জাস্টিফাই করছে। ফু বাবার সপ্রতিভ ও গোছালো কথাবার্তায় কামরুল মামা, আকরাম মামা দুজনেই একদম সম্মোহিত হয়ে গেলেন। ট্রেন আাসার ঘন্টা বাজলো।

সম্মোহনে আচ্ছন্ন কামরুল মামা মানিব্যাগ বের করে পাঁচশো টাকার একটা নোট ফু বাবার হাতে দিয়ে বললেন, মামুকে নিয়ে খুলনায় কালকে আসেন। কোন সমস্যা হবে না। আপনার সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। থাকা ও খাওয়ার কোন ত্রুটি থাকবে না।

– কালকে তো যেতে পারবো না। জরুরী একটা রোগীকে দেখতে যেতে হবে আগামীকাল। পরশুদিনও আরেক রোগীর বাড়ি থেকে তলব এসেছে। সেখানে যেতেই হবে। আজকে তো বুধবার, আমরা বরং শনিবারে যাই। খুলনা পৌঁছে রাতেই কাজ শুরু করে দেবো। এসব কাজে শনি ও মঙ্গলবার উত্তম দিন।

– মামু, আপনি এই পাঁচশো টাকা রাখেন আপনার কাছে। ফকির বাবাকে সাথে নিয়ে শনিবার সকালের ট্রেনে খুলনা চলে আসবেন।

– ঠিক আছে মামা। আমরা ঠিক পৌঁছে যাবো খুলনায়।

 

ট্রেন ছেড়ে দিলে ফু বাবাকে নিয়ে আমিও বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। ভাবতে লাগলাম কতটা সম্মোহিত হলে একজন মানুষ হুটহাট পাঁচশো টাকা বের করে দেয়। সেই সময়ে পাঁচশো টাকায় এক বিঘে ধানী জমি কেনা যেত, যার বর্তমান বাজার মূল্য পাঁচ লক্ষ টাকা। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ফু বাবাকে বললাম শনিবার সকালের ট্রেন ধরতে হবে। শুক্রবারে বাড়িতে দেখা কোরো। অগ্রীম টিকেট কাটতে হবে। ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে ফু বাবা ওর বাড়ি চলে গেল।

 

৫).

 

শুক্রবার সকাল এগারোটার দিকে স্টেশনে গিয়ে কুড়ি টাকা দিয়ে শনিবারে যাত্রার জন্য খুলনার দুটো অগ্রিম টিকেট কেটে নিলাম। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে ফু বাবার দেখা পাওয়া গেল। বাদুড়তলার একটা চায়ের স্টলে বসে চা সিগারেটের পর্ব শেষ করে তাকে  টিকিট দুটো দেখালাম। যাত্রার সময় সকাল ৯:১০ মিনিটে।

 

ওকে বললাম, কাল সকাল আটটায় তোমার কারামতির সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো। একসাথে নাস্তা সেরে স্টেশনে চলে যাবো।

– তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমার বাড়িতে নাস্তার আয়োজন করতে বেলা দশটা পার হয়ে যায়।

– আমার বাড়িতে ওসব সমস্যা নেই। তুমি ঠিক আটটায় গুছিয়ে চলে এসো। আমার বাড়িতে মা সাতটার মধ্যে নাস্তার আয়োজন শেষ করে ফেলেন। বিকেলে যদি তোমার সাথে দেখা না-ই হয়, অবশ্যই আগামীকাল সকাল ৮টার মধ্যেই আমার বাড়িতে চলে আসবে।

– একদম পাক্কা কথা। কোন বিপদ-আপদ না হলে কথার নড়চড় হবে না।

– চলো আরেক দফা চা-সিগারেট হয়ে যাক।

 

ভোর ছটায় ঘুম ভেঙেছে। মুখ ব্রাশ করে গামছা নিয়ে চলে গেলাম মাথাভাঙ্গা নদীতে। আধঘন্টা সাঁতরে বাড়ি ফিরলাম যখন ঘড়ির কাঁটায় সাতটা বাজে। দ্রুত কাপড় পাল্টে নিলাম। ব্যাগ রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলাম। অতিরিক্ত দুটো প্যান্ট-সার্ট, লুঙ্গি, গামছা, টুথপেস্ট ও ব্রাশ ব্যাগে ভরে নিলাম। সাতটা চল্লিশে ‘ফু বাবা’ বাড়িতে হাজির। নাস্তা টেবিলে সাজানো ছিলো। দু’জনে নাস্তা সেরে নিলাম। মা জানতেন খুলনা যাবো। কিন্তু, কেন বা কি কাজে যাবো তা জানতেন না। মাকে বললাম, মা আসি।

– সাবধানে যাস, বাবা। আর তাড়াতাড়ি ফিরিস।

– চিন্তার কারণ নেই, মা। পরশু নাগাদ ফিরে আসবো, ইন শা আল্লাহ্!

 

আমি আর ‘ফু বাবা’ মেইন রোডে এসে রিক্সা নিয়ে নিলাম। হাতে বেশ সময় আছে। স্টেশনে চায়ের স্টলে বসে দু’দফা চা পান আর নিকোটিনের ধোঁয়া উদগীরণ করার শেষ মুহুর্তে ট্রেন আসার ঘন্টা ঢং ঢং ঢং করে বেজে উঠলো। কিছুক্ষণ পর ডাউন ট্রেন হিসহিসিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালো, ফু বাবা আর আমি নির্ধারিত বগিতে উঠে পড়লাম। আসন নম্বর খুঁজে নিয়ে নির্দিষ্ট আসনে দু’জনে পাশাপাশি বসে পড়লা দিয়েম। একবার লম্বা ভোঁওওওওও

আওয়াজ তুলে ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট তালে ট্রেন চলতে শুরু করলো।

 

৬).

 

জীবন্ত দৃশ্যকে পেছনে ফেলে ট্রেনের গতি বেড়ে গেছে। সামনে জয়রামপুর স্টেশন। মেল ট্রেনের এই স্টেশনে স্টপেজ নেই। দর্শনা রেলক্রসিং। ডানে দর্শনা-গেদে হয়ে শিয়ালদহ। সোজা পথে দর্শনা হল্ট স্টেশন। বেশ কিছু যাত্রী উঠলেন। কারও গন্তব্য কোটচাঁদপুর, কারও কালীগঞ্জ, বারোবাজার অথবা যশোর। বাকি যাত্রীরা যাবে খুলনা।

 

উথলি, আন্দুলবাড়িয়া ও কোটচাঁদপুর স্টেশন থেকে বেশ কিছু যাত্রী উঠলেন। ট্রেনের কামরায় পা ফেলার স্থান নেই। কামরার ভেতরে যে যার মত বিড়ি ও সিগারেট ফুঁকছে। কোনও দিকেই কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। সিগারেটের ধোঁয়া যাঁদের অসহ্য তাঁরা নাক-মুখ ঢেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করছেন। এখনকার সময়ে কামরার ভেতরে ধূমপান অসম্ভব। ট্রেনের ওয়াশরুম অথবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ধূমপান অনেকেই করেন। তবে কামরার ভেতরে কেউ ধূমপান করে না জরিমানা অথবা যাত্রিসাধারণের প্রতিবাদের কারণে। যাহোক, সেকাল ও একালের মধ্যে অনেক কিছুরই পরিবর্তন এসেছে।হঠাৎ আমাদের ফু বাবাজিও ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশে ধোঁয়া ছেড়ে আমার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলো। 

আমার মন সায় দিলো না। বললাম, পরে নেবো। 

 

ট্রেন এসে দাঁড়ালো ঐতিহাসিক যশোর রেলস্টেশনে। হুড়মুড়িয়ে যত যাত্রী নামলো তারও অধিক খুলনাগামী যাত্রী উঠলো। এরই মধ্যে পূবালী ঝড়ের সাথে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আবহাওয়া বেশ চমৎকার। বৃষ্টি হওয়াতে ধূলোর প্রকোপ কমে গেছে। বাতাসও বেশ নির্মল। ট্রেন ছুটছে দুরন্ত দুর্বার গতিতে খুলনার পথে। বেলা একটায় পৌঁছে গেল ট্রেন খুলনা রেল স্টেশনে। নেমে এলাম ট্রেন থেকে। প্লাটফর্ম ধরে বেরিয়ে এলাম স্টেশনের বাইরে। কোন কোন যাত্রী কুলির মাথায় মোট চাপিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাশের ঐতিহাসিক খুলনা নৌবন্দরের দিকে। স্টিমারে চেপে বরিশাল, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ অথবা ঢাকায় যাবে। 

 

একটা রিক্সা ঠিক করলাম শিপইয়ার্ড রোডের দারোগা বাড়িতে যাওয়ার জন্য। রিক্সাওয়ালা ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, ওঠেন। উঠে পড়লাম দুজনে। রূপসা ফেরিঘাট সামনে রেখে রিক্সা ডান দিকে ঘুরে গেল। রুপসা ফেরিঘাট পার হলেই বাগেরহাট যাওয়ার জন্য মন্থর গতির মনোরেলের চলাচল ছিলো। এখন অবশ্য সেই রেল নেই। রূপসার ওপর নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সেতু। 

 

ডানে বাঁক নিয়ে রিক্সা ওয়ালা রাস্তার ডান পাশ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, এহান থেইক্যা দারোগা বাড়ির সীমানা শুরু অইলো। শ্যাষ হইছে শিপইয়ার্ড কম্পানির গেইটে গিয়া। বাঁদিকে দৃষ্টি ফেরালাম। রূপসা নদীর তীর বরাবর অসংখ্য ঝুপড়ির মত গোলপাতার ছাউনি দেওয়া বাড়ি-ঘর দেখতে পেলাম। রিক্সার গতি শ্লথ হলো। 

– এই যে বামে হইলো উকিল বাড়ি আর ডাইনে দারোগা বাড়ি। ডাইনে থামামু না বামে?

– রিক্সা ডানে থামাও।

 

রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উকিল বাড়ির দিকে তাকলাম। বেশ পরিপাটি ও দৃষ্টিনন্দন আরসিসি ছাদের একতলা বাড়ি। অনুমান করলাম, এই বাড়ির মেয়ের সাথেই কামরুল মামার প্রণয় পর্ব চলছে।

 

ইতিমধ্যেই, রিক্সার আওয়াজ পেয়ে কামরুল মামা ও আকরাম মামা দু’জনেই বাড়ির বাইরে চলে এসেছেন। বেশ বুঝতে পারলাম আমাদেরই আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। দুজনেই এক সাথে হৈ হৈ করে উঠলেন। 

– মামু, পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো? আসেন, আসেন, ভিতরে আসেন।

কামরুল মামা হাত ধরে এক প্রকার টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।

– মামু, আপনাদের ব্যাগ ওর হাতে দেন, ও আপনাদেরকে রুমে নিয়ে যাবে। হাতমুখ ধুয়ে ওকে সাথে করে খাবার টেবিলে চলে আসবেন। আপনাদের খাবার একদম রেডি। গড়গড় করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন আকরাম মামা।

 

রুমে ঢুকে কাপড় পাল্টে নিলাম। হাত-মুখ ধুয়ে ওই বাড়ির কাজের ছেলেটার সাথে ডাইনিং রুমে এলাম। এরই ফাঁকে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললো, জামাল। আরও বললো, ছোট বেলা থেকেই ও এই বাড়িতে থাকে। ওর মা-ও এই বাড়িতে কাজ করে।

 

ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার বিশাল আয়োজন। আস্ত রূপচাঁদা ফ্রাই, গলদা চিংড়ির দোপেয়াজা, খাসির মাংসের রেজালা, গোল বেগুন ভাজি, সোনা মুগের ডাল চচ্চড়ি, মুরগির রোস্ট, সর্ষে ইলিশ। এত খাবার দেখে আমি তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। আমি চিরকালের স্বল্পাহারী মানুষ। ফু বাবার দিকে তাকালাম। ওর চোখ চিকচিক করছে রসনানন্দে। শুরু হলো খাওয়া দাওয়া। আমি কোনরকম সবগুলো থেকে একটু একটু নিয়ে খেয়ে নিলাম। কিন্তু ফু বাবা নুলো ভরে খেয়েই যাচ্ছে। দুদুটো রূপচাঁদা মাছ ভাজি, দু পিস মুরগির রোস্ট, গোটা দশেক খাসির মাংসের বড় বড় টুকরো, সর্ষে ইলিশের পেটির অংশ ও আস্ত মাথা গলাধঃকরণ করে তবেই থামলো। খাওয়া শেষে এলো দই ও মিষ্টি। আমি অল্প দই খেয়ে উঠে পড়লাম। মিষ্টি পড়েই থাকলো। ফু বাবা দু’দুবার দই নিলো, গোটা চারেক বড় রাজভোগ পেটে চালান করলো। হ্যাংলা পাতলা মানুষ অথচ পেটে এত খাবার ঢোকে, না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হতেই পারে।

 

আকরাম মামা ও কামরুল মামা ফু বাবা ও আমাকে নিয়ে কামরুল মামার বেডরুমে এলেন। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। ফু বাবা বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে নেড়ে শুনছে। 

সব শোনার পরে ফু বাবা বললো, আমি রাতে কাজ শুরু করবো। কাজটা রাতেই করতে হবে। দিনের বেলা করলে সিদ্ধ হবে না। যখন যে কাজ করার সময় তখনই তা করতে হবে। অনেক রাত পর্যন্ত আমার সাথে জাগতে হবে আপনাদের সবাইকে। এই বেলা ঘুমিয়ে নিই সবাই। 

ফু বাবা আর আমি চলে এলাম আমাদের ঘরে। ভাত ঘুম দেওয়ার আগে ফু বাবাকে শুধু বললাম, কাজটা সত্যি তুমি পারবে তো?

– তুমি শুধু দেখে যাও আমি কি করি, একজন সিদ্ধ কাপালিকের মতো ভাব নিয়ে কথাটা বললো, ফু বাবা। 

আমিও কথা না বাড়িয়ে বালিশে মাথা রাখলাম।

 

৭).

 

টানা দু’ঘন্টা ঘুমোনোর পর যখন ঘুম ভাঙলো চারদিকে আসরের আযান ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলেছে। ফু বাবার কোন সাড়াশব্দ নেই। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দুপুরে অমন নুলো ভরে উদোর পুজো করলে মরার মতো ঘুমোতে তো হবেই! শয্যা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ির বাইরে জামালকে পেয়ে গেলাম। ওকে বললাম, চলো পুরো এলাকাটা যতটা পারা যায় একটু ঘুরে দেখি।

– চলেন, বলেই ও হাঁটা ধরলো বাড়ির পেছন দিক দিয়ে। 

 

খুলনা শিপইয়ার্ড এর গেট পর্যন্ত এই বাড়ির সীমানা। অনুমান করলাম চব্বিশ বিঘে মতো হবে জমির আয়তন। বিশাল একটা দীঘির চারপাশ ঘিরে আধপাকা বাড়ি-ঘর ছড়ানো ছিটানো। এখানে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ভাড়া থাকে। কক্ষ ভেদে পাঁচ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া। অনুমান করলাম তাতেও মাসিক আয় হাজার পনেরো তো হবেই। তাল, নারকেল, সুপারির কথা বাদই দিলাম। এক্কেবারে একটা জমিদারি এস্টেট। চারপাশ জুড়ে তাল-নারকেল-সুপারি গাছের সারি। অনুমান করি হাজার দশেক নারকেল গাছ আছে। শ’তিনেক তাল গাছ আর সুপারি গাছ আছে বেশুমার। গাছ জুড়ে দৃষ্টিনন্দন সবুজ ও হলুদ প্রজাতির ডাব আর কাচা-পাকা সুপারি ঝুলছে। আর গোলপাতার ছাউনি দেয়া ঘর গুনে শেষ করা যাবে না। সূর্য পাটে যেতে বসেছে। জামালকে সাথে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মসজিদে মাগরিবের আযান ধ্বনি শোনা গেল। ঘরে ঢুকেই দেখি জোর গল্প-গুজব চলছে। আসরের মধ্যমনি স্বয়ং ‘ফু বাবা’। ডাইনিং টেবিলে অর্ধভুক্ত খাবার ও খালি কাপ পড়ে আছে।  

 

আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই আকরাম মামা বললেন, মামু ঘোরাঘুরি কেমন হলো। পরিবেশ কেমন লাগলো।

– মামা, আপনি জানলেন কি করে আমি আপনার বাড়ির চৌহদ্দি মাড়িয়ে এসেছি।

– আরে মামু, এখানের বাড়িঘরের যত বাসিন্দা আছে সব আমার পাইক-পেয়াদা, এ কথা বলেই মামা হো হো হো করে হাসতে লাগলেন। 

– আমিও সলজ্জ হেসে বললাম, বাহ্ দারুণ ব্যাপার। এক্কেবারে খাসা জমিদারি। 

– হুম তা বলতে পারো। জমিদারিই বটে। আয় তো আর নেহাৎ কম নয়। এই জামাল, দাঁড়িয়ে কি শুনিস? ভিতরে যা, মামুর জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আয়। 

– মামা আমার চা কিন্তু কড়া হতে হবে।

– এ্যাই জামাল, শুনলি তো মামুর চা কড়া হবে।

– রান্নাঘরে চা নাস্তা রেডি করতে বলে মামুকে ডাকতে এসে দেখি গুণীন মহাশয় একা বসে। আমার মামুর খবর নাই। বাইরে খোঁজ নিয়ে জানলাম মামু জামালকে নিয়ে বাড়ির দীঘির পাড়ে গিয়েছে। তারপর খবর পেলাম, মামু দীঘির সিঁড়িতে বসে আছে। আর জামালের কাছ থেকে আমার মামুর পরিচয় নিচ্ছে ভাড়াটিয়া লোকজন। আমার মামু, আমাদের পরিবারের কে হয়, কোথায় থাকে, কখন এসেছে ইত্যকার যত তথ্য। সহজ সরল মানুষ অপরিচিত লোক দেখলে একটু বেশিই অনুসন্ধিৎসু হয়, এই আর কি!

 

চা-নাশতার সাথে সবার জন্য আরেক কাপ করে চা এলো। আমার কারণে এই অতিরিক্ত পেয়ালা চা সবার জন্য বোনাস। কিন্তু আমার ভাগে ওই এক পেয়ালা ই।

 

চায়ের পর্ব শেষ হওয়ার পর আকরাম মামা বললেন, মামু গুণীন মহাশয় রাত নয়টায় কাজ শুরু করবেন। আমরা সাথে থাকবো যাতে উনার কোন সমস্যা না হয়।এই সব সহজ সরল লোকদের মধ্যে যাতে কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতে না পারে, সেদিকেই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। এখন চলেন, আপনাদেরকে নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।

 

জামালকে আকরাম মামা দুটো রিকশা আনতে বললেন। রিকশা এলো। আকরাম মামা আর ‘ফু বাবা’ এক রিকশায় আর কামরুল মামার সাথে আমি আরেক রিকশায় শহর দেখতে দেখতে যাচ্ছি। বিভাগীয় শহর হিসেবে এখনকার মতো আহামরি কোন রূপ তখন ছিলো না বটে খুলনার, তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা শহর ছিলো তখন। রিকশা চালকের পায়ের পেশির শক্তিতে রিকশা ছুটে চলেছে নিউ মার্কেট অভিমুখে। 

 

৮).

 

নিউ মার্কেটের বাইরের একটা ফুচকার দোকান থেকে ফুচকা খেলাম সবাই। কিন্তু স্বাদে ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের নাজির চটপটির ফুচকার ধারে কাছেও নয় এখানকার ফুচকা। সাড়ে আটটায় ফিরে এলাম সবাই। দীঘির পাড়ে একটা নির্জন ঘরে ফু বাবার তন্ত্র মন্ত্রের কাজ কারবার চালানোর জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। দীঘির পাড়ে পৌঁছনোর পর দু’জন লোককে ডাব পাড়ার জন্য নিযুক্ত করলেন আকরাম মামা। এক কাঁদি ডাব হাজির হয়ে গেল মুহুর্তের মধ্যে। একজন কেটে দিচ্ছে আর আমরা ডাবের মুখে মুখ লাগিয়ে জল পান করছি। তিনটে ডাব গলাধঃকরণ করে ক্ষান্ত দিলাম। আকরাম মামা ও কামরুল মামা দুটো করে আর ফু বাবা একাই সাতটা ডাবের জল গলার ভেতর চালান করে দিলেন। একটু পর সবাই এদিক ওদিক পেশাব করা শুরু করলাম। দু’দুবার পেশাব হওয়ার পর স্বস্তি ফিরে এলো। 

 

কিছুক্ষণ পর ফু বাবা খুব নীচু স্বরে আকরাম মামাকে বললেন, ডাবের জল মেশানো মদ লাগবে আর নাপাক অবস্থায় সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে কাজটা করতে হবে। শরীরে সুতো পর্যন্ত থাকতে পারবে না।

– এই জামাল, মধুকে ডেকে আন এখানে। আদেশ করলেন আকরাম মামা।

 

মুহুর্তের মধ্যে মধুকে সাথে করে হাজির হলো জামাল। মধুর হাতে টাকা দিয়ে দ্রুত এক বোতল ধেনো আনতে বললেন। স্বল্প সময়ের ভেতর ধেনো চলে এলো। ফু বাবার হাতে তুলে দেওয়া হলো ধেনোর বোতল। 

 

– একটা জগ আর গ্লাস চাই। একটা ডাব কেটে দেন আমার হাতে, যে ব্যক্তিটি ডাব কেটে দিচ্ছিলো তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো ফু বাবা।

জগে বোতলের ধেনো মদ ঢেলে ডাবের জল মিশিয়ে গ্লাসে ঢেলে খাওয়া শুর করলো ফু বাবা। মধুও যোগ দিলো ফু বাবার সাথে। নেশা যখন জমে উঠেছে, তখন ফের মুখ খুললো ফু বাবা।

– আমাকে নাপাক হতে হবে। নাপাক হওয়ার ব্যবস্থা করেন তাড়াতাড়ি। 

– নাপাক হতে হলে কি করতে হবে? জিজ্ঞেস করলেন আকরাম মামা। 

– মেয়ে মানুষ লাগবে। সোজা সাপটা জবাব ফু বাবার।

 

আকরাম মামার আদেশ পেয়ে মধু ছুটলো দীঘির দক্ষিণ প্রান্তের এক ঝুপড়িতে। সেখান থেকে পেশাদার একজন গণিকাকে নিয়ে আসা হলো। ফু বাবা ওই নারীকে নিয়ে ঢুকে গেল অন্ধকার ঘরে। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রথমে ওই নারী বেরিয়ে এলো। তার পিছে পিছে ফু বাবাও বেরিয়ে এলো। এদিকে কেউ যাতে না আসতে পারে সেজন্য আগে থেকেই পাহারা বসানো ছিলো।

 

– রুম থেকে আমার ব্যাগটা আনার ব্যবস্থা করেন। ওর ভিতরে কাজের সরঞ্জামাদি আছে। পিদিম জ্বালানোর জন্য সর্ষের তেল লাগবে। মেয়ের নামের সাথে মেয়ের বাবা ও মায়ের নাম আর ছেলের নাম, ছেলের বাবা ও মায়ের নাম একটা কাগজে লিখে দেবেন, আকরাম মামার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো ফু বাবা।

 

আকরাম মামার আদেশ পেয়ে জামাল বাড়ির ভেতর থেকে ফু বাবার ঝোলা আর এক শিশি সর্ষের তেল এনে ফু বাবার হাতে দিলো। আকরাম মামা ছেলে ও মেয়ের নাম, বাবা-মায়ের নাম লেখা কাগজ ফু বাবার হাতে দিলেন। ফু বাবা সব কিছু বুঝে নিয়ে ভেতরে ঢুকে বেড়ার দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরে ঢুকেই ফু বাবা পিদিম জ্বাললো। তারপর এক এক করে পরনের কাপড় খুলে দিগম্বর হয়ে গেল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে পিদিমের আলোয় আমরা সবাই তার কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম। ঝোলা থেকে সে ভোজপাতার মত দেখতে কিছু একটা বের করলো। শিশির ভেতর রাখা এক ধরণের কালি দিয়ে আকরাম মামার দেওয়া কাগজ দেখে নামগুলো ওই পাতার ওপরে লিখতে লাগলো। সাতটা পাতা ভরে নামগুলো লিখলো। তারপর সেগুলো এক এক করে মুড়িয়ে সলতের মত করে পিদিমে রেখে জ্বালানো শুরু করলো। অস্ফুট স্বরে মন্ত্র পাঠ করতে লাগলো। চাপা স্বরের কারণে কি মন্ত্রপাঠ করছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে, মাঝে মাঝে ‘ওঁ হ্রিং হ্রিং স্বাহা’ এমন জাতীয় মন্ত্র কানে আসতে লাগলো। মন্ত্র পাঠের মধ্যেই মাঝে মাঝে শিশি থেকে পিদিমে তেল ঢালতে লাগলো। এক সময় সব সলতেগুলো পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল। ঝোলা থেকে সলতে বের করে আবারও পিদিম জ্বালালো। বেড়ার দরজা ফাঁক করে আকরাম মামাকে ডাকলো। তখনও ফু বাবা সম্পূর্ণ ন্যাংটো।

– আপনাদের বাড়ির উঠোনের মাটি লাগবে। ব্যবস্থা করেন।

আবার জামাল ছুটলো উঠোনের মাটি আনতে। ঠোঙা ভরে মাটি নিয়ে এলো সে।

 

ঘন্টাখানেক পরে কাপড়-চোপড় পরে বেরিয়ে এলো ফু বাবা। ঝোলা থেকে লুঙ্গি ও গামছা বের করে নিয়ে ঝোলাটা জামালের হাতে দিলো। আর ঠোঙা ভরা মন্ত্রপূত মাটি আকরাম মামার হাতে দিয়ে বললো, এটা ঘরে নিয়ে রাখেন। আমি দীঘিতে গোসল করে আসছি। সবাই আমরা দীঘির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ও ঝপাৎ ঝপাৎ ডুব দিয়ে উঠে এলো। তখন রাত দেড়টা বেজে গেছে। আমরা সবাই বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। 

 

– এই মন্ত্রপূত মাটি মেয়ের বাড়ির ভেতরে ছিটিয়ে দিতে হবে। 

– কিন্তু ওই বাড়িতে একটা বদরাগী কুকুর আছে। রাতে ওকে শেকলমুক্ত করা হয়। ভেতরে ঢোকা কি করে সম্ভব? আকরাম মামা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

– আমাকে আগে বলবেন তো, ওই বাড়িতে কুকুর আছে। ওই কুকুরটাকে বশ করতে হলে আমাকে আবারও নাপাক হতে হবে এবং ন্যাংটা হয়ে কাজটা করতে হবে। তাও প্রায় আরও তিন ঘন্টার ধাক্কা। ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যাবে। লোকজনের চলাচল শুরু হয়ে গেলে ধরা পড়ে যেতে হবে। আজকে কাজটা হচ্ছে না তবে। কালকেই হোক।

– ঠিক আছে। কালকেই হোক। সায় দিলেন আকরাম মামা। 

 

খাবার ডাইনিং টেবিলে ঢাকা দেওয়া ছিলো। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম সবাই। রাত আড়াইটে বাজে। খাবার মুখে তুলে আমি আদ্যপান্ত ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। ফু বাবার বুজরুকির মধ্যে একটা বড়সড় চালাকির প্রচ্ছন্ন সূত্র ঝিলিক মেরে উঠলো। ফু বাবা বিভিন্ন বুজরুকির ঘটনার বিবরণ দিয়ে আকরাম মামা ও কামরুল মামাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। গল্পের তোড়ে ওদের প্লেটের খাবার শেষ হয়েও হচ্ছে না। আমি ঝটপট খাবার শেষ করে রুমে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। পরপর দু’গ্লাস পানি পান করলাম। বালিশে মাথা রাখতে না রাখতেই ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।

 

৯).

 

গত রাতে দেরী করে ঘুমানোর কারণে সবারই ঘুম ভাঙলো বেশ বেলাতে। নাস্তার পর্ব শেষ করে রুমে এসে সিগারেট ধরালাম। ফু বাবা সিগারেটে সুখ টান দিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললো, চলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। রিকশা হাজি মহসিন রোডের মাথায় আসতেই একটা ওষুধের দোকান দেখিয়ে রিকশাওয়ালা কে থামতে বললো।

রিকশা থেকে নেমে দুজনেই ঢুকলাম ফার্মেসির ভেতর। 

– দশটা সোনারিল ট্যাবলেট দিন।

দোকানী মুখ তুলে চাইলো। তারপর দশটা গোলাপি রঙের ট্যাবলেট একটা ছোট খামে ভরে তার হাতে তুলে দিলো। 

দাম মিটিয়ে দিয়ে আমরা রিকশায় চেপে বসলাম।

যেখান থেকে আমরা রিকশায় উঠেছি সেখানে ফিরে চলো, রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দিলো ফু বাবা।

আমি অষুধ কেনার কথা কাউকে যেন না বলি, সে ব্যাপারে আমাকে রিকশায় বসেই সতর্ক করে দিলো।

আকরাম মামাদের বাড়ির সামনে এসে ভাড়া চুকিয়ে রিকশা ছেড়ে দেওয়া হলো।

 

রুমে এসে ভাবছি, সোনারিল ট্যাবলেট দিয়ে কি হবে! একটা সোনারিল ট্যাবলেট ১০০ মিলি গ্রামের। পাগলের পাগলামি থামাতে সেবন করানো হয়, শুনেছি। ফু বাবা এই ট্যাবলেট দিয়ে কি করবে? মনের ভাব মনে রেখেই চুপ মেরে থাকলাম। বোকার ভান ধরে চুপচাপ দেখে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

খালি সিগারেটের প্যাকেট ভাঁজ করে তার ভেতর দুটো সোনারিল ট্যাবলেট রেখে পেপার ওয়েট দিয়ে ঠুকে ঠুকে পাউডার বানিয়ে ফেললো, ফু বাবা। তারপর কাগজে মুড়ে ঝোলার ভেতর রেখে দিলো। তারপর ঝোলার ভেতর থেকে মোড়ানো পাতা বের করলো। গত রাতে পিদিমের ক্ষীণ আলোয় ভালো বুঝতে না পারলেও। কাছ থেকে দেখলাম ভোজপাতা। ছোট একটা কাঁচি দিয়ে সাতটা টুকরো করলো। আকরাম মামার লিখে দেওয়া নামের কাগজটা বের করলো, দোয়াত ও কলম বের করলো। সাতটা টুকরোতেই সবগুলো নাম লিখে ভাঁজ করে শিশিতে পুরে ঝোলায় ভরে রাখলো।

আমি কোন ঔৎসুক্য দেখালাম না। সে-ও কিছু বললো না। আমাকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজেও একটা সিগারেট ধরালো।

এরই মধ্যে আকরাম মামা, মামু মামু বলে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোন সমস্যা হচ্ছে না তো মামু?

– না মামা, কোন সমস্যা নেই। সব ঠিকঠাক আছে। 

– গুণীন মহাশয়, আপনার কিছু লাগবে কি?

– এক পোয়া মত গরু অথবা খাসির মাংস পরিমাণমত নুন আর হলুদ মেখে সিদ্ধ করে রাখবেন। কোন ঝাল দেবেন না। সন্ধ্যার সময় লাগবে।

– ঠিক আছে, সময় মতো পেয়ে যাবেন। আর কিছু? 

– কাউকে দোকানে পাঠিয়ে সিগারেট আনিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়।

জামালকে ডেকে দু প্যাকেট জন প্লেয়ার্স গোল্ডলিফ আনিয়ে নিলেন আকরাম মামা। কুড়ি শলাকার প্যাকেট। এক প্যাকেট ফু বাবাকে দিলেন, আরেক প্যাকেট দিলেন আমাকে।

 

আজ দুপুরের মেন্যুতে ছিলো কাচ্চি বিরানি, মুরগির রোস্ট, সালাদ, বোরহানি ও দই। যথারীতি নুলো ভরে গলাধঃকরণ করলো ফু বাবা। চেটেপুটে দই খেলো। আমি দু’গ্লাস বোরহানি খুব রসিয়ে রসিয়ে গলাধঃকরণ করলাম। আবারও সেই ভাতঘুম। উঠলাম বিকেল পাঁচটায়। ফু বাবা দেখি আজ আমার আগেই উঠেছে। বিছানায় বসেই আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকছে। 

 

জামাল এসে বললো, ডাইনিং রুমে আসেন, চা-নাস্তা দেওয়া হয়েছে। ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে হাজির হলাম ডাইনিং টেবিলের সামনে। আকরাম মামা চেয়ার টেনে বসতে বললেন। আলু পুরি, চপ আর ছোলা ঘুঘনি বেশ জমিয়ে খেলাম সবাই। জামাল, কেটলি থেকে চা ঢেলে সবাইকে পরিবেশন করলো। চায়ের পর্ব শেষ করে সবাই মিলে বাইরে এলাম। আকরাম মামা জানতে ফু বাবার কাছে জানতে চাইলেন, কাজ শুরু করবেন কখন আর রান্ন করা মাংস লাগবে কখন?

– সন্ধ্যার পরই কাজ শুরু করবো। রান্না মাংস ওই সময়েই কলা অথবা কচু  পাতায় মুড়ে আনলেই হবে। আর মদ ও মেয়ে মানুষের ব্যবস্থাটাও আগেভাগে করে রাখবেন। আজকে সময় বেশী লাগবে। আগেভাগে যোগাড় থাকলে সময় বাঁচবে।

– ঠিক আছে, এখন তো সাড়ে ছ’টা বাজে। সব কিছু সাড়ে সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে যাবে। 

– আমি আসছি, বলেই ফু বাবা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল, মুহুর্তের মধ্যে ঝোলাটা হাতে করে ফিরে এলো। বললো, চলেন দীঘির পাড়ে যাই।

সবাই দীঘির পাড়ে গিয়ে সিঁড়িতে বসলাম। 

– ঝোলা থেকে শিশিটা বের করে ভাঁজ করা সাতটা ভোজপাতা আকরাম মামার হাতে দিয়ে বললো, দেখেন তো নামগুলো সব ঠিক আছে কি না। 

– আকরাম মামা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নামগুলো পড়লেন। তখন গোধূলি। সূর্য পাটে যায়নি। পড়ার পর ভোজপাতাগুলো ফু বাবার হাতে ফেরত দিতে দিতে বললেন, সবগুলোই ঠিক আছে। 

– নিপুণ হাতে ভোজপাতা মুড়িয়ে সলতের আকার দিলো। ঘরের ভেতর কালকে রাতে রেখে যাওয়া সর্ষের তেলের শিশিটা আছে তো? আকরাম মামার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো ও।

– মুহুর্তে মামা রুমের ভেতর ঢুকে গেলেন আর অর্ধেক তেল সমেত শিশিটা নিয়ে তার হাতে দিলেন।

– ওহ্ অনেকটা তেল আছে। এতেই হয়ে যাবে বলে শিশিটা ঝোলায় রেখে দিলো।

 

সূর্য পাটে গিয়েছে অনেকক্ষণ। আকাশে মেঘ জমেছে। চারদিকে আলো আঁধারের খেলা। মধু, বোতল নিয়ে হাজির হলো। ওর পিছে পিছে গতরাতের সেই মেয়েটা নিঃশব্দে গতকালকের সেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। মধু ওদেরই একজনকে ডাব পেড়ে আনতে বললো। আমরা সবাই ডাবের জল পান করছি। জামাল জগ আর দু’টো গ্লাস নিয়ে এলো। ফু বাবা আর মধু ডাবের জল মিশিয়ে মদ পান করতে লাগলো। মদের পর্ব শেষ হলে, ফু বাবা ওই অন্ধকার ঘরের ভেতর টলতে টলতে সেঁধিয়ে গেল। আমরা সবাই দীঘির সিঁড়িতেই বসে থাকলাম।

 

ওই মেয়েলোকটা যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে এদিক ওদিক না তাকিয়ে দক্ষিণ কোণের বস্তির দিকে চলে গেল। ফস্ করে দেয়াশলাই জ্বালানোর শব্দে সবাই অন্ধকার ঘরটার দিকে চোখ ফেরালাম। পিদিম জ্বলে উঠেছে। আমরা এগিয়ে এসে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। সম্পূর্ণ উলঙ্গ ফু বাবা পিদিম সামনে রেখে বসা। শিশি থেকে এক এক করে ভোজপাতার সলতে পিদিমের তেলের চারধারে সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। সলতের মত ভোজপাতা জ্বলতে শুরু করলো। ঘরটাও আগের চেয়ে বেশী আলোকিত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কলাপাতার ভেতর মোড়ানো রান্না করা মাংস আলগা করে ঝোলা থেকে পুরিয়া করে রাখা সোনারিল ট্যাবলেটের গুঁড়ো এদিক ওদিক তাকিয়ে পিদিমের দিকে পিঠ রেখে ঘুরে বসলো। তারপর দু’হাতে মাংস চটকাতে লাগলো আর মাথা দোলাতে লাগলো। মাঝে মাঝে ছু ছু করে মাংসের ওপর ফু দিতে লাগলো। পুরিয়ার ভেতর রাখা ট্যাবলেট গুঁড়োর বিষয়টা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তাই, কেউ-ই কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। সবাই ভেবে নিলো রান্না মাংসকে মন্ত্রপূত করা হচ্ছে। পিদিমের সব সলতে পুড়ে ভস্ম হয়ে নিভে গেল। ফু বাবা কলাপাতায় রাখা মাংস হাতে করে বেরিয়ে এসে জামালের হাতে দিলো। তখনও সে দিগম্বর। মুহুর্তে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। এবারে লুঙ্গি পরে হাতে ঝোলা নিয়ে দীঘির পাড়ে এলো। লুঙ্গি ও ফতুয়া বের করে ঝোলাটা জামালের হাতে দিলো। ঝপাৎ ঝপাৎ দীঘির জলে কিছুক্ষণ ঝাপিয়ে উঠে এলো সে। কাপড় ছেড়ে জামালের কাছ থেকে ঝোলাটা নিলো। বললো,

– কটা বাজে এখন? 

– রাত সাড়ে ন’টা, ঘড়ি দেখে বললেন আকরাম মামা।

– ওই কুকুরটাকে কি ছাড়া হয়েছে?

– আমি দেখে আসছি, বলেই ছুটতে চাইলো জামাল। 

– দাঁড়াও, যদি কুকুর ছাড়া থাকে তবে, এই কলাপাতার ভেতরের মাংস গেটের ভেতরের দিকে ফেলে দেবে। খুব সাবধানে কাজটা করবা। আর খেয়াল রাখবা যেন কেউ না দেখে।

জামাল চলে গেল। মধুও পিছু নিলো জামালকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য।

 

১০).

 

মধু ও জামাল কাজ সেরে ফিরে এসে জানালো, কলাপাতা সমেত মাংস ফেলার সাথে সাথেই ঘেউ ঘেউ করে উঠেছিলো কুকুরটা। তারপর সব চুপচাপ। সন্দেহ হওয়াতে গেটের নীচ দিয়ে উঁকি দিয়ে ওরা দেখতে পেল কুকুরটা বসে আয়েশ করে মাংস খাচ্ছে। এ কথা শুনে, সবার চোখে মুখে প্রশস্তি ঝিলিক মেরে উঠলো। 

– রাত বারোটার দিকে আমরা সবাই মিলে ওই বাড়ির ভেতর ঢুকবো। তারপর গত রাতের মন্ত্রপূত ওই মাটি ওদের বাড়ির চলাচলের পথে ছিটিয়ে দেব, তাতেই জমে যাবে খেলা। বেশ ভাব নিয়ে কথাগুলো বললো ফু বাবা।

– ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আকরাম মামা বললেন, রাত সাড়ে দশটা বাজে, চলুন আমরা রাতের খানাপিনা সেরে ফেলি। জামাল, বাসায় গিয়ে বল টেবিলে খাবার দিতে।

জামাল দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। 

মিনিট দশেক পর আকরাম মামা আমাদের সবাইকে নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে যাত্রা করলেন।

 

খাওয়া শেষে, জামাল ঝুটো প্লেট টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। 

আমরা সবাই সড়কের ওপর চলে এলাম। দিনের ব্যস্ত শিপইয়ার্ড রোড এখন শ্রান্তির কোলে। লোকজনের কোন সাড়াশব্দ নেই,  গাড়িঘোড়া নেই রাস্তায়। মাঝে মাঝে স্টিমারের ভেঁপু’র তীক্ষ্ণ শব্দ রাতের নৈঃশব্দ ভেদ করে কানে ভেসে আসছে। দূরে কোথাও একটা কুকুরের করুণ আর্তনাদ শোনা গেল। কুকুরের এমন ডাক অশুভ মনে করা হয়। আমরা রাস্তার এপারে দাঁড়ানো। আমাদের সামনেই ওই বাড়ির গেট।

– জামাল গেটের নীচ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখ তো, কুকুরটা কি করছে?

– ফু বাবা বলার সাথে সাথেই জামাল গেটের কাছে গেল। হাঁটু মুড়ে বসে মাথা বেঁকিয়ে ভেতরটা দেখলো খুঁটিয়ে। কুকুরটাকে দেখতে পেলো। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। 

– সমস্যা নাই। কুকুর ঘুমে আছে।

 

আরও কিছুক্ষণ রাস্তার ওপর অপেক্ষা করে ফু বাবা আমাদের সাথে নিয়ে ও বাড়ির গেটের সামনে থমকে দাঁড়ালো। কান খাঁড়া করে কিছু শোনার ভান ধরলো। মাটি ভরা ঠোঙাটা মধুকে দিয়ে বললো এটা নিয়ে আপনি আমার পিছে পিছে আসেন। তারপর আমাদের ইশারা করে গেটের ওপর উঠে গেল। মধুও গেট টপকে ওপারে চলে গেল। আমরা ক’জন মানে আকরাম মামা, কামরুল মামা আর আমি হাঁচড়পাঁচড় করে গেট টপকে গেলাম। ভাগ্যিস পায়ে ক্রেপসোল লাগানো জুতো ছিলো নইলে, যা একটা জাম্প দিয়েছিলাম না, সেই শব্দেই বাড়ির সব লোক জেগে যেত। ভেতরে ঢুকে দেখলাম মধু আর ফু বাবা কুকুরটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কুকুর চেতনে নেই নিশ্চিত হয়েই কুকুরের পাশে পড়ে থাকা কলাপাতা কুড়িয়ে গেটের বাইরে ছুঁড়ে দিলো।

তারপর ওই বাড়ির চলাচলের রাস্তায় ধুলোমাটি ছিটাতে লাগলো। কাজটা প্রায় শেষের দিকে এরই মধ্যে ওই বাড়ির ভেতর খুট করে লাইট জ্বলে উঠলো। আমরা সতর্ক হয়ে সরে গেলাম। একটু পর জল ছাড়ার শব্দ পেলাম। কেউ ওয়াশ রুমে গেছে হবে। কিছু পর ওই বাতি নিভে গেল।

আরও মিনিট দশেক অপেক্ষার পর ফু বাবা বাকি মাটিগুলো ছড়িয়ে দিলো। আমরা পাচিল টপকিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলাম। 

গেটের বাইরে ছুঁড়ে দেওয়া কলাপাতা কুড়িয়ে নিলো ফু বাবা। বললো, চলেন দীঘির পাড়ে যাই। এই কলাপাতাটা পানিতে ফেলে দিতে হবে নইলে, অমঙ্গল হবে।

অমঙ্গল হবে জেনে কি আর কেউ অমঙ্গলের পথে হাঁটে? কলাপাতা ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো দীঘির জলে। 

 

ঘুমোতে হবে। সকাল ৭:৪০ মিনিটের ট্রেন, মিস করলে বিরক্তিকর বাস যাত্রা ছাড়া উপায় থাকবে না।

ভোর ছ’টার দিকে ঘুম ভাঙলো ওয়াশ রুমে যাওয়ার তাগিদ নিয়ে। চোখে মুখে জল দিলাম। রুমে এসে জল পান করলাম। চোখ জুড়ে ঘুম তবুও ঘুমোলাম না আর। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে লাগলাম। সাড়ে ছ’টা বাজে। ফু বাবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম। ধড়মড় করে উঠে বসলো। বললাম সাড়ে ছ’টা বাজে। দ্রুত খাট থেকে নেমে ওয়াশ রুমে চলে গেল। তাগিদ ওরই বেশি। আকরাম মামা আজকের দিনটা থেকে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু, ওর কি জরুরি কাজ আছে তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। অগত্যা তার গরজেই সে প্রস্তুত হচ্ছে। বাটার টোস্ট, ডিম অমলেট আর চা। নাকেমুখে গুঁজে ঝোলা কাঁধে নিলো ফু বাবা, আমিও ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালাম। রিকশা এলো। আকরাম মামা ফু বাবাকে পাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে হাতে নোট ধরিয়ে দিলেন। কত টাকা দিলেন আন্দাজ করা গেল না। রিকশায় উঠলাম, আকরাম মামা পাঁচশো আমার হাতে দিলেন রাহা খরচ বাবদ। আমি নিতে চাইলাম না। জোর করেই মামা আমার পকেটে টাকাগুলো গুঁজে দিলেন। স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনে ওঠার ঠিক দশ মিনিট পরেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। চুয়াডাঙ্গা পৌঁছতে তিন ঘন্টা লাগবে। ঘুমিয়ে এই সময়টুকু পুষিয়ে নেয়া যাক। গল্পটা এখানে শেষ হলেই বোধ হয় ভালো হতো। কিন্তু গল্পের নিজেরও একটা একান্ত গল্প থাকে। 

 

আমি চুয়াডাঙ্গায় আরও প্রায় মাস দুয়েক থেকে ঢাকায় ফিরে গেলাম। পাড়ার চির চেনা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছি। পাশের টেবিল থেকে এক খদ্দের আবেগতাড়িতভাবে বলে উঠলো মহানায়ক উত্তম কুমার মারা গেছেন। কৌতুহলী দশ পনেরো জোড়া চোখ সেদিকে ঘুরে গেল। একজন জিজ্ঞেস করলেন, কখন? আপনি জানলেন কিভাবে?

– এই তো কিছুক্ষণ আগে। আকাশ বাণীর খবরে শুনলাম।

রেস্টুরেন্টের ভেতর একটা চাপা গুঞ্জন। কে কবে উত্তমের কোন ছবি একাধিকবার দেখেছে তারই ধারাবিবরণী দেয়া শুরু করেছে। 

খবরটা শুনে মন বিষাদে ভরে গেল। উত্তম-সুচিত্রার ডাইহার্ড ফ্যানকুলের আমিও যে একজন!

টেবিলে চা এলো। চায়ের কাপ কেবল মুখে তুলেছি, দেখি আকরাম মামা ঢুকছেন রেস্টুরেন্টে। 

সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, মামা বসেন, কবে এসেছেন ঢাকায়?

মামা, আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন এই মাত্র ট্রেন থেকে নামলাম। রিকশা ধরে সোজা এখানে। 

– চা বলি, মামা?

– না আমি ভারী কিছু খাবো। 

– ওয়েটারকে ডাকলাম, বললাম খাওয়ার কি আছে? 

– ভাত, গরু, খাসি, মুরগি, কৈ, বাইন, চিংড়ি ভর্তা, করল্লা ভাজি, সব্জি, ডাইল- এক নাগাড়ে বলে গেল সে।

– ভাত নিয়ে এসো, সাথে বাইন মাছ, চিংড়ি ভর্তা, করল্লা ভাজি আর ডাল, মামা অর্ডার প্লেস করলেন।

মামা বেসিনে হাতমুখ ধুতে চলে গেলেন। ওয়েটার ট্রেতে করে খাবার এনে টেবিলে রেখে গেল।

আমাকেও খেতে সাধলেন মামা। বললাম, আমি এত জলদি দুপুরের খাবার খাইনা।আপনি অভুক্ত অবস্থায় জার্নি করে এসেছেন। আপনি খেয়ে নিন। মামা খাওয়া শুরু করলেন।

– আমাদের বাসায় যাবেন তো মামা?

– বলতে পারছি না। জরুরী একটা কাজে এসেছি। রাতেই বাসে চেপে ফিরবো।

– ও আচ্ছা। কামরুল মামা কেমন আছেন? গুণীনের তদবিরে কোন কাজ হয়েছিলো, মামা?

– আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মামা বললেন, তোমরা খুলনা থেকে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর উকিল সাহেব পরিবারসহ ঢাকার আত্মীয় বাড়িতে যান। সেখানে এক ছেলের সাথে গোপনে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আবার খুলনা ফিরে আসেন। কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারিনি আমরা। এক সপ্তাহ আগে আমরা বিষয়টা জানতে পেরেছি। এখন আর কিছুই করার নেই। 

– মামার কথা শুনে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। অস্ফুট স্বরে শুধু একটা কথাই মুখে এলো, ‘দুঃখজনক’। 

চোখ তুলে মামার দিকে তাকাতে পারছি না। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে ইচ্ছে করছে এখনই চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে ফু বাবাকে একটা চরম শিক্ষা দিয়ে আসি। মামার সামনে থেকে পালানোর পথ খুঁজছি। 

বাল্যবন্ধু কবি জসিম উদ্দিন রোডের কায়সার ও নাসির হন্তদন্ত হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে সোজা আমার টেবিলের সামনে এসে বললো, দোস্ত জলদি আয়। আমাগো এক দোস্তের লগে এহানে এক সেলুনে গ্যাঞ্জাম হইছে। তুই ছাড়া এইডা কেউ মিটমাট করবার পারবো না।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে মামাকে বললাম, আপনি খেতে থাকুন। কাজ শেষে বাসায় যেয়েন। আমি এদের বিষয়টা মিটিয়ে দিয়ে আসছি, বলেই দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলাম। পালিয়ে বাঁচলাম বলাটাই বোধহয় বেশী যুক্তিযুক্ত।

অমিতাভ মীর
অমিতাভ মীর
%d bloggers like this: