চিন্তাবিদ আবুল হুসেন/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

চিন্তাবিদ আবুল হুসেন

চিন্তাবিদ আবুল হুসেন

১৯৭৩ সালের কথা। যশোর এম এম কলেজে সবে ভর্তি হয়েছি, কিন্তু ক্লাস শুরু হয়নি।  সেই সময়ে কোন ব্যস্ততা নেই । আমার বড় বোনের বাসায় খুলনায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। বিকালে দুলাভাই বললেন, চলো যশোরের এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ঐ বাড়িতে যাওয়ার পর গৃহকর্তার সাথে এই বলে পরিচয় করিয়েদিলেন, ‘উনি সাহিত্যিক আবুল হুসেইন সাহেবের ছোট ভাই’। 

তিনি তখন অবসরপ্রাপ্ত কোন সরকারি কর্মকর্তা। তার নামটা আজ আর মনে নেই। খুলনা শহরে কোন এক মহল্লায় তার নিজস্ব বাড়ি। ক্লাস সেভেনে থাকতে আবুল হুসেইনের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। আমাদের বাংলা বইয়ে ‘কৃষকের আর্তনাদ’ নামে একটা প্রবন্ধ ছিল। টেক্সট বইয়ে লেখার আগে বা পিছে যেটুকু লেখক পরিচিতি থাকে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই তাঁর সম্পর্কে সে সময় আমার জানার পরিধি ছিল। যশোরের ঝিকরগাছা থানার পানিসরা গ্রামে ১৮৯৬ সালে ৬ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। পিতা হাজী মোহাম্মদ মুসা একজন আলেম ছিলেন। ১৯১৪ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে আই এ এবং বি এ পাশ করার করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২০ সালে অর্থনীতিতে এম এ করেন। এরপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনায় অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। ১৯২৬ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক একদল প্রগতিশীল সাহিত্যিক  যে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠন করেন, তিনি তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন শুরু করেন। এই গোষ্ঠির মুখপাত্র হিসাবে তাঁরা ‘শিখা’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন তার সম্পাদক। এই পত্রিকার প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদে মুদ্রিত থাকত “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সাথে আরো যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল কাদির, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন অন্যতম।

 

আবুল হুসেইন সাহেবের ছোট ভাই একটা পুরাতন ফাইল বের করলেন। তার মধ্য থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের শিখা পত্রিকার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সংখ্যাসহ আরো বেশ কয়েকটি সংখ্যা বের করে দেখালেন। এগুলোতে কার কি লেখা আছে তা পাতা উল্টিয়ে  দেখলাম। সেই সময় সকলের নামের সাথে আমি পরিচিতও নই। ভদ্রলোক অতি যত্ন সহকারে এগুলো রেখে দিয়েছেন। সবশেষে ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সন্মেলন উপলক্ষ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রধান অতিথি করে ঢাকায় আনা হয়েছিল। সে সময় এর একটা বিশেষ সংখ্যা বের করা হয়েছিল, তা দেখালেন। সন্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের অডিটোরিয়ামে। তবে নজরুল উঠেছিলেন তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়, এখনকার ঢাকা মেডিকেল কলেজের দক্ষিণ গেটের দোতলায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের অফিসে। এখানে নজরুলের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন।  সন্মেলনটি ছিল দুই কি তিন দিনব্যাপী। প্রবীণ ভদ্রলোক জানালেন যে কয়েক দিঞন নজরুল ঢাকায় ছিলেন, সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় চা আর পান খাওয়ার সাথে চলতো কবিতা পাঠ, গানের আসর ও আড্ডা। ঐ আড্ডার মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় কথার ছলে কথা উঠলো কে তাঁর প্রিয়াকে কি উপহার দেবেন। নজরুল তাঁর গানের খাতায় কিছুক্ষণের মধ্যে লিখে ফেলালেন সেই বিখ্যাত গান, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোপায় তারার ফুল, কর্ণে তোমার দোলাবো তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল।’ নজরুল যখন গান লিখতেন তখন একটা সুরের ওপর নির্ভর করে তা শেষ করেই পরক্ষণে নিজেই তা গাইতেন। এস এম হলের অনুষ্ঠানে নজরুল ইসলাম যে গানগুলি গেয়েছিলেন তার মধ্যে কোনো কোনোটি ছিল প্রথমবার গাওয়া। ঢাকায় আসার পথে নজরুল লিখেছিলেন একটা সুরের উপর গুন গুন করে, কিন্তু গাওয়া হয়না।  মঞ্চে উঠে সবার সামনে প্রথমবার গাইলেন। সৃষ্টিশীলতা কোন পর্যায়ে গেলে একজন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব! এরপর আর একটা ফাইল থেকে তিনি বিভিন্ন লেখক ও কবির পান্ডুলিপি দেখালেন যেগুলি শিখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেই প্রথম  নজরুল ইসলামের হাতের লেখা দেখার সৌভাগ্য আমার হলো। অনেকক্ষণ অবধি তাঁর গল্প শুনলাম। আবুল হুসেইন সাহেবের বড় ছেলে যে ব্যারিষ্টার হয়ে বিলাতে থাকেন এবং বিবিসি রেডিও’র বাংলা  বিভাগের একজন কর্মী, তাও আমাদের জানালেন। সম্ভবত তাঁর নাম ছিল আবিদ হুসেইন। 

 

তবে যে বিষয়টা নিয়ে কোন আলাপ করলেন না তা আমি জেনেছি অনেক পরে। আবুল হুসেইন সাহেব মুসলিম সাহিত্য সমাজের সন্মেলনের দ্বিতীয় দিনে তাঁর লেখা ‘সুদ-রিবা ও রেওয়াজ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে তিনি পবিত্র কোরানে নির্দেশিত রিবা বা সুদ প্রথার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, এই  নিয়ম এখন অচল। এর পরিবর্তন দরকার। সুদ প্রথাকে কার্যকর করে মহাজনের অত্যাচার থেকে গরিব মানুষকে  অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে হবে। তিনি আরো বলেন যে,  কোরানে সুদকে হারাম বলা হলেও, এখন এটাকে আর হারাম বলা যাবে না। তিনি আরো বলেন যে, মুসলিম ধর্মের বহু আইন আছে যা সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু এখন তা পাল্টানোর সময় এসেছে। তাঁর এই যুক্তির সাথে অনেকেই একমত ছিলেন না। এমনকি ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বক্তব্য রেখে সভা থেকে বেরিয়ে যান। পরবর্তীতে বলিয়াদীর জমিদার খান বাহাদুর কাজেম উদ্দিনের কাছে ঢাকার শিক্ষিত সমাজ থেকে অভিযোগ যায়। ফলে বিচারসভা বসে ১৯২৮ সালের ২০ আগষ্ট। তাঁকে দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয় যে, এই বিষয়ে তিনি আর লিখবেন না। সেই সাথে অপরাধ করার জন্য উপস্হিত সকলের সামনে ঘরের মেঝেতে চল্লিশ হাত লম্বা জায়গা নাকে খত দিতে হয়। চিন্তা করুন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর অপরাধের জন্য সামাজিক বিচারে নাকে খত দিচ্ছেন। এই ঘটনায় চরমভাবে অপমানিত হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হলেন। এরপরেও তাঁর কলম থামেনি। ইসলামী বিষয় নিয়ে আরো লিখলেন ‘মুসলিম কালচার’। মুসলিম নারীর বোরখা পরার বিরুদ্ধে তিনি গঠন করলেন এন্টি পর্দা লীগ। এই সংগঠনের ব্যানারে তিনি বোরখা না পরার জন্য তাঁর মতামত প্রচার করতে থাকেন। তাঁর মতে বোরখা মুসলিম নারীদের অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজিকভাবে ক্রমেই তাঁরা পিছিয়ে যাচ্ছে। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাঁর এই অবস্হান ছিল এন্টি এষ্টাব্লিশমেন্ট। এক পর্যায়ে মতের মিল না হওয়ায় সাহিত্য সমাজের অন্যান্য সদস্যরা তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়ান এসময় তিনি ক্ষোভের সাথে লেখেন ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধ। এবার নালিশ যায় খোদ ঢাকার নবাবের কাছে। নবাববাড়িতে বিচারসভা বসে ১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। ক্ষমা প্রার্থনা  এবং আমি অপরাধী এটা স্বীকার করে কোনরকম শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পান। অপমানিত হয়ে এরপর তিনি ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে এম এ পাশ করেন এবং আইন পেশায় পুরোপুরি  নিজেকে নিয়োজিত করেন। তবে বেশিদিন আর বাঁচেননি। ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু হয় কলকাতায় ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর মাত্র ৪১ বৎসর বয়সে। তাঁর সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন, তিনি কোন সাহিত্যিক ছিলেন না বরং ছিলেন প্রথার বাইরে একজন চিন্তাশীল ব্যাক্তি। তিনি তাঁর চিন্তার জগতে যে বিষয়টাকে সঠিক মনে করেছেন তা যুক্তি দিয়ে সবার সামনে উপস্হাপন করেছেন। তবে তাঁর এই মতামত তৎকালীন সমাজে কোন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। জীবদ্দশায় তাঁর কোন লেখা বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। তবে মৃত্যুর বহু পরে বাংলা একাডেমি তাঁর রচনা সমগ্র প্রকাশ করে।

কাজী মুজাহিদুর রহমান
%d bloggers like this: