জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৭/ বেগম জাহান আরা

ড. বেগম জাহান আরা

 

একদিন বিকট শব্দ করে পানির পাম্পের কি যেনো ফেটে গেলো। সেদিন বৃহস্পতিবার। কর্মচারিদের বাড়ি যাওয়ার তাড়া। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ডাকলাম। একাউনটেন্ট বললো, আপা টেন্ডার ছাড়া এই কাজের টাকা ছাড় করা যাবে না।

আমি বললাম, কি কারণ?

– আপনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারেন নিজের সিদ্ধান্তে। তার বেশি হলে টেন্ডার দিয়ে কাজ করতে হবে।

– তাহলে এতোগুলো লোকের পানি খাওয়া, বাথরুম যাওয়া, গোসল করার পানি, এসব পাওয়া যাবে কোথা থেকে?

– শনিবারের আগে কোনো কাজ হবে না আপা।

আমার মথায় বাজ পড়লো। বলে কি লোকটা? দু ঘন্টার মধ্যে এলাকা নরক হয়ে যাবে একাডেমি এলাকা পানি ছাড়া। বললাম, কতো টাকা লাগবে পাম্পটা মেরামত করতে?

– আট নয় হাজার টাকা লাগবে। আরও একবার এই কাজ আমরা করেছি। মেশিনটা পুরনো হয়ে গেছে ম্যাডাম।

– কি করা যায় এখন সেটা বলেন আনসার।

– একটা উপায় আছে আপা।

– কি সেটা? বলছেন না কেনো এতোক্ষণ?

– সেটা বেআইনি কাজ হবে আপা। মিটিমিটি হাসে আনসার।

কী ঠান্ডা মাথায় মানুষটা আইন আর বেআইনের কথা ভাবছে? বললাম, ফেলে দেন আপনার আইন আর বেআইন। আমি বেআইনের কাজটাই করবো। তবু আমাদের এখানে পানি চাই।

 

একাউনটেন্ট বেআইনি কাজের বিবরণ দিলো। আমার সামনে কর্মকর্তারা বসে আছে। ওরা বুঝতে পারছে না আমি কি করতে চাই? সামনের দুজনকে বললাম, নবাবপুরে যাও। লোক লস্কর যন্ত্র পাতি, মেরামতির জিনিস সব নিয়ে এসো। একাউনটেন্টকে বললাম, ওদেরকে টাকা দিয়ে দিন।

কেউ বাড়ি যেতে পারলো না। আমি তো থাকলামই। মেরামতির কাজ শেষ হলো তিন ঘন্টা পর। পানি এলো রাত আটটা নাগাদ। স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

 

পরে সাড়ে সাত হাজার টাকার কাজ ভেঙে দুদিনের হিশেবে ব্যাকডেট দিয়ে কার্যাদেশ বানানো হলো। অনিয়ম এবং বেনিয়ম যাই বলা হোক, নিয়মমতো কমিটি গঠন করে ব্যাক ডেটে সকলের সই সাবুদ নিয়ে তৈরিও করতে হলো টেন্ডারের কাগজ পত্র। জীবন বাঁচলো প্রতিযোগিতা উপলক্ষে আসা মানুষগুলোর। ঢাকাতে জুন মাসের গরম বলে কথা!

 

একাউন্টেন্ট বললো, আপনার হিম্মত আছে আপা। অফিসারেরা জোরে জোরে হাসলো। বললো, খাঁটি কথা বলেছেন  আনসার ভাই। আমি হেসে বলি, তা আছে। ভালো কাজের জন্য আমি ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করি। আরও বললাম, তোমাদের সমর্থন না পেলে কি আর করতে পারতাম? তোমরাই আমার সাহস। তবে এখন আনসার সাহেবকে ফাঁসাতে পারি এরকম একটা পাকা বেআইনি কাজ করার জন্য। কি বলো তোমরা?

 

মুহূর্তে আনসারের মুখ শুকিয়ে গেলো। বললো, আপা  আপা—

কথা আটকে যায় মুখে। সব্বাই হেসে উঠোলো জোরে।

 

ক্রমে ক্রমে একাডেমির চেয়ারম্যানের সাথে সম্পর্ক এতোই খারাপ হলো যে ওর সাথে কথাই বলা যায় না। তবু বলতে হবে। জাতীয় পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী আসবেন প্রধান অতিথি হয়ে। বহু গণ্য মান্য লোকজন আসবেন। কার্ড ছাপানো, দাওয়াত দেয়া, হল ভাড়া নেয়া, নাচ গানের কি কি আইটেম যাবে, সাজসজ্জার ডিজাইন, ইত্যাদি অনেক কাজ। আমি চাই সে সম্পৃক্ত থাকুক সব কাজে। এটা তার আর আমার কোনো ব্যাপার নয়, একাডেমির সম্মানের ব্যাপার।

 

একাডেমিতে ছেলে মেয়েরা নাচতো লাল সুতি কাপড়ের ড্রেস পরে। একবার চিনা শিশুরা একাডেমিতে অনুষ্ঠান করলো সার্টিনের ড্রেস পরে। ঝলমল করে উঠলো আলোর প্রতিফলনে। কী যে ভালো লাগলো! আমাদের বাচ্চারাও সেদিন নাচলো। একাডেমির বাচ্চাদের সুতির কাপড় স্টেজে দেখতে ন্যাকড়ার মতো লাগলো। আরো ত্যানা ত্যানা মনে হলো তা আলোর প্রতিফলনে।। তারপরে আমি একক সিদ্ধান্তে বদলে দিলাম ড্রেসের কাপড়। বলে দিলাম, নাচের বাচ্চাদের সার্টিনের ড্রেস পরতে হবে। মা বাবারা খুশিই হলো। বদলে গেলো দৃশ্যপট। সেই বাচ্চাদেরকেই স্টেজে মনে হলো পরী। যেনো আকাশ থেকে নেমে এসেছে নাচতে। বাচ্চারা খুশি। অন্যেরাও খুশি হলো।

 

ওসমানি মিলনায়তনে খুব জাঁকজমকের সাথে হলো আমাদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। নিপাট নিখাঁদ অনুষ্ঠান। সবাই তুষ্ট। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে উঠলেন। মিটিং-এর সিদ্ধান্ত মতোই যার যার কাজ, তা করতে লাগলাম। আমার দায়িত্ব ছিলো, লাল সার্টিনে ঢাকা একটা ট্রেতে মেডেলগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো। বিজয়ীর নাম ঘোষণার সাথে সাথে একটা করে লাল ফিতায় বাঁধা মেডেল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া। ছবি উঠলো অসংখ্য। প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে দাঁড়িয়েছিলো মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী আর চেয়ারম্যান। সে আবার মাথায় বেশ খাটো। অনেকটা আমার আড়ালে পড়ে গেলো সে। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো যতো ছবি, তাতে প্রধানমন্ত্রীর আর আমার ছবি বেশি উজ্জ্বল দেখালো। বিটিভি-র সন্ধের সংবাদের পর ঐ অনুষ্ঠানের ছবি দেখানো হলো। তারপর ঐ ছবি একটানা দেখানো হলো পর পর বারো দিন রাত আটটার খবরের শেষে। ঐ ছবিই কাল হলো।

 

সব দোষ হলো আমার। আমি কেনো পুরস্কারের থালাটা তার হাতে দিলাম না? আমার জবাব ছিলো দুটো। এক, চেয়ারম্যানের মর্যাদায় সেটা শোভা পায় না। দুই, মিটিং-এর সিদ্ধান্ত তাই ছিলো। জুবাইদা বললো যে, এই সিদ্ধান্তের কথা তার মনে নেই।

 

– রেকর্ড ফাইল দেখলেই মনে পড়বে। আর তাছাড়া আপনি তো তখন খুশি ছিলেন যে, মহিলা ও  শিশু বিষয়ক মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে মঞ্চে দাঁড়াবেন। মনে মনে বলি, ভেবেছিলেন যে, তখন ছবি উঠবে দেদার। সেগুলো পেপারে আসবে, মর্যাদা বাড়বে।

– আপনি সব সময় আমাকে উল্টো পাল্টা বোঝান।

– তা কেনো হবে? সিদ্ধান্তগুলো রীতিমতো খাতায় লেখা আছে।  আবার বলি আমি কথাটা।

– রাখেন আপনার লেখালেখি।

– তাই তো রেখেছি ফাইলে।

– আপনার এরেঞ্জমেন্ট একটুও পছন্দ হয় নি আমার।

– কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। মনে মনে বলি, তুমি তো আমার মাথার ছায়ায় ঢাকা পড়বেই। এটা ওপরওয়ালার মার। আমার উচ্চতার জন্য কারোই কিছু করার নেই। বলেছিলাম, মন্ত্রীকে বলে বিটিভি থেকে ঐ ছবি দেখানোটা বন্ধ করলেই তো পারতেন। জানি, সেটাও পারতো না। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ছবি বাদ পড়ে যায়। আসলে পরশ্রীকাতরদের অবস্থা এমনই হয়।

 

মনে মনে রেগে গেলেন মহিলা ও  শিশু বিষয়ক  মন্ত্রীও। আমাকে কেনো এতো প্রমিন্যান্টভাবে দেখানো হলো? কিন্তু সে কথা আমাকে বলেন নি। আমার অনুমান চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা হয়েছে। নাহলে দুজনের একই ডিগ্রির রাগ হবে কেনো? তিনি আমাকে সরাসরি কিছু বলেন নি। কিন্তু রেগে যে আছেন সেটা আমি বুঝতে পারতাম। আমার প্রিয়ভাজনেরা খুব খুশি হয়েছিলো। আমাদের এক শুভাকাঙিক্ষ বন্ধু ফোন করে হেসে বললেন, ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলংকার’ গানের লাইনটা মনে পড়েছিলো মঞ্চে আপনাকে দেখে।

 

বললাম, আমি বড়ো জ্বালায় আছি ভাই। আপনি আর রসিকতা করবেন না।

 

আমি তো জানতাম না যে আসল রসিকতা তখনো বাকি? কয়েকদিন পর কেউ একজন বিরাট এক ছবি নিয়ে এলেন শিশু একাডেমিতে। প্রধানমন্ত্রী পুরস্কারের মেডেল নিচ্ছেন আমার হাত থেকে। পাশে দাঁড়ানো বিজয়ীদের গলায় পরিয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের দুজনের মুখেই হাসি। ছবিটা সত্যি ভালো হয়েছিলো। আগের ঝামেলাই সামলাতে পারিনি। এখন আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

 

চেয়ারম্যান তখন একাডেমিতে তার ঘরে বসা। ওর ফাইলে সই টই করার ব্যাপার থাকে না। একাডেমিতে এসে যে সবার সাথে দেখা করে হাই হ্যালো করবে, তাও নয়। নিজের ঘরে বসে ওর চামচা কজনকে ডাকে। তাদের সাথে ওর কি কথা হতো, তা আমি জানতাম না। জানার চেষ্টাও করি নি। আমি শুধু ওর বাড়ি যাওয়ার সময় গাড়ির ব্যবস্থা ঠিক রাখতাম।

 

ছবি যিনি এনেছেন তিনি আমার ঘরে ঢুকে পড়েছেন। আমি আমার পি এস-কে দিয়ে অন্যদের ডাকালাম। ভদ্রলোককে বললাম, চলেন চেয়ারম্যানের ঘরে। ছবিটা ওঁর হাতে দিন। আসেন, আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে। উনি যেখানে ভালো মনে করবেন সেখানে রাখবেন ছবিটা। ভদ্রলোক বললেন, তাঁর ইচ্ছে লাইব্রেরিতে ছবিটা রাখা হোক।

 

চেয়ারম্যানের ঘরে গেলাম আমরা। আলাপ পরিচয় হলো। তারপরে বললো, ছবিটা আপনি রেখে যান আমরা লাইব্রেরিতেই রেখে দেবো। চলে গেলেন ভদ্রলোক। তাঁকে আপ্যায়নও করা হলো না। অফিসের সবাই খুব পছন্দ করলো ছবিটা। ঢাকায় যে ছবি এতো বড়ো করা যায়, সেটাই জানতাম না আমরা। যতোটা মনে আছে লাইব্রেরির একটা কোনায় রাখা হয়েছিলো বেশ বড়ো ছবিটা।

 

দোতলায় বসতো ফারজানা আর ডলি। ওরা ছিলো ভদ্র আর অনুগত। কাজের কথা বলতে হতো না। একাডেমির অনুষ্ঠানাদিতে নিজেদের দায়িত্বের বাইরেও অনেক কাজ করে দিতো আমাদের। এদের কারো কথাই কোনোদিন ভুলবোনা। আমার পিএস এর কথা আগেও বলেছি। বলেছি ড্রাইভার ইমরানের কথাও। ও ছিলো আমার বিশ্বস্ত সারথি। ওর ওপর ভরসা করতাম আমি। আর ভরসা করতাম বলেই তো শুধু ওকে নিয়েই বেরিয়ে পড়তাম ট্যুর প্রোগ্রামে। হরতাল তখনও হতো। সেদিন কাক ডাকা ভোরে ধানমন্ডি গিয়ে আমাকে নিয়ে আসতো অফিসে।

 

তারপর তো আমার চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ। জান দিয়ে চেয়ারম্যান চেষ্টা করলো যেনো আমার চাকরির মেয়াদ আর না বাড়ে। কথা তো গোপন থাকে না, শোনাই যায়। আমি নিজেও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। ওর ধারণা ছিলো, আমি মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তদবির করবো। অফিসের লোকজন বললো, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেনো আমি দেখা করি। আমি কিছুই করি নি। মনটা উঠে গেছিলো। তদবিরের জ্বালায় অস্থির হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে। সব অফিসেই কুট কচালি থাকে। ছিলো একাডেমিতেও। তবে দুটো কাজের জন্য আমার এখনো অনুতাপ হয়। একজন অফিসারকে বদলি করা, আর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ি একাডেমির মাঠে রাখতে না দেয়ার জন্য বিশেষ বন্ধুজনকে চিঠি দেয়া। কাজ দুটো আমি ভীষণ চাপের মুখে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। দুজনেই আমাকে ভুল বুঝেছিলো। সেটা আর ভাঙানো যায় নি। তাই দুঃখটাও যায় নি মন থেকে। মনের ভেতর ক্ষমার প্রার্থনাটা থেকেই গেছে। ওঁরা জানলেন না।

 

একাডেমির ওরা আমাকে মনে রেখেছে। ফোন করে, খোঁজ নিয়েছে। আমার মেয়েটা যখন হঠাৎ চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলো, তখন ওরা একাডেমিতে দোয়া দরুদ পাঠ এবং মিলাদও পড়িয়েছিলো। এসব কথা কি ভোলা যায়! চেয়ারম্যান খুব দরদমাখা সুন্দর একটা সমবেদনার চিঠি লেখেছিলো একাডেমির সিল ব্যবহার করে। ব্যক্তিগত চিঠিও লিখতে পারতো সে। তাই ভাবি, জীবনের মোহনামুখ যতোই বিস্তৃত হোক, স্মৃতিগুলো নিয়েই সে চলতে থাকে। সবই থাকে সময়ের গভীরে আর জীবনের বিস্তারের ভাঁজে ভাঁজে খোদাই করা। খুব নিরবে ওগুলোকে বয়ে নিয়ে চলে জীবন। যেমন নদি বয়ে চলে রাজ্যের বর্জ আর পলি বুকে ধারণ করেই।

( চলবে)

 

 

%d bloggers like this: